দেবযানী ভট্টাচার্য
বেশ টুং টাং শব্দ। মিঠে।
পিয়ানোরই হবে। কী বাজছে অতশত সে বোঝেনা। বাজনা টাজনা নিয়ে তার জ্ঞান বউয়ের সঙ্গে তাল ঠোকার মত যুৎসই কোনদিনই ছিল না। তবে কানে ঝরঝর আর কড়কড় এটুকু বোধ আছে।
সে যাক গে, অন্যত্র এ রিনরিনে বেশ লাগে কিন্তু এখানে বোধহয় এটা কিছু বেমানানই হল। উপায়ও তো নেই, গলাটা খরখর করছে। সিগারেট শেষ খেয়েছিল ঘণ্টা তিনেক আগে, সেই ডাক্তার চলে যাওয়ার পরে। আর এই এখন একটা ধরানোর চেষ্টা করতেই, টুং টাং!… বিব্রতবোধ হচ্ছে। আসলে শ্মশানে এলে শোক জড়িয়েই থাকাটা বাঞ্ছনীয় তা সে শোকের মাফলারই হোক বা পুলওভার। তার উপর এক্ষেত্রে তো স্ত্রী বিয়োগ।
বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘটনা ঘটা ইস্তক।
ভাল, খুবই ভাল। এত একরকম উষ্ণতার প্রকাশই হল, কিন্তু তার গা গুলোলে কী আর করা!
সে গুটিকয়েক পা সরে গিয়ে ধরাল। গলাটা টান করে ধোঁয়া ছাড়তেই চিমনি দিয়েও একই রকম সামান্য ময়লা তুলো রঙের ধোঁয়া নজরে এল। ইচ্ছে গেল গাড়ি ঠেলবার রকমে এই রোগাসোগা ধোঁয়ার রেখাদের জোরে জোরে ফুঁ দিতে দিতে পৌঁছে দেওয়া যাক ওই মোটাসোটা ধোঁয়ার থোড়ের গায়ে। পঞ্চভূতে মিশতে থাকা ধোঁয়াময়ী হয়ে ওঠা বউকে শেষবার কবে জড়িয়েছে ভুলে মেরে দেওয়া বরের ফুসফুস সেঁচে ওঠা ধোঁয়ারা একটু জড়াক।
মনে রেখে শেষবার।
ধোঁয়াময়ী, বেশ শব্দ বেরোল তো ভাবনার কুয়ো ফুঁড়ে। ধোঁকাময়ী হলে কী আরেকটু …থাক, আর ওসব অনর্থক টানাটানি করে লাভ নেই। অর্থময় টানের গুণ সে বুঝেছে।
ওই তো দাঁড়িয়েই আছেন ভদ্রলোক। চুপচাপ। শেষযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন সে সমেত গোটা পৃথিবীর পরোয়া না করেই।
ভারী সুন্দর একথোকা নীলচে গোলাপী ফুল এনেছিলেন। নাম ধাম সে জানে না কিন্তু তার চোখে রাজ্যের ফ্যাকফ্যাকে রংহীন ফুলেদের স্তূপের উপর ওই ফুলগুলো টাইটানিকের নায়িকার ঘোর সাদা বুকের ভাঁজে শুয়ে থাকা সেই রংদার লকেটের মত লাগছিল।
আপত্তি করতে ইচ্ছে যায়নি।
বুকের ভেতরের দখলনামা ফর্দাফাই জেনে ফেললে বুকের বাইরের ইজারাদারী নিয়ে করুণ অথচ তীক্ষ্ণ এক লড়াইয়ে নামতেই হয়, আহত অহংই নামায়, ছাপোষা ঘাম রক্ত রসের জীব হওয়াতে তার ক্ষেত্রেও বিপরীত কিছু হয়ে ওঠে নি। অসহ চিড়বিড়ানি জেগেছে। অনেক কামড়াকামড়ি ঘষটাঘষটি চিরে ফেলা ছিঁড়ে ফেলার টানাহ্যাঁচড়া তো হয়েছে।
কিন্তু আজ তো আলাদা দিন।
একেবারেই আলাদা। সে বুকটাই তো আজ সমস্ত তোলন নামনের আকর্ষক ক্ষমতা সরিয়ে রেখে নিতান্তই জড় পদার্থ।
কার জিত কার হার?
কাঞ্চী কর্ণাট দুইই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্তব্ধ স্বর শুনছে। কে কটা শুনছে তার কর কি গুনছে?
…
দুটি আগুন এ তল্লাটে টুয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন গনগনে জ্বলে। শ্মশানের গেটের মুখে এই চায়ের গুমটির উনানের আগুন আর শ্মশানের পেটের ভেতর ওই লাশ পোড়ানোর চুল্লীর আগুন। অবশ্য দুটিই জ্বলে আরেক আগুনদের নেভাতে। খিদের আগুন আর শোকের আগুন।
দোকান ছিল আদতে কারেন্ট দোকানীর বাবার, ছেলে স্লাইট হা করা ক্যাটাগরিরই ছিল, তা বাবা দোকানী নিয়মমাফিক মারা গেলে আজ এই সতেরো বছর ধরে একই রকম নিয়মমাফিক চা সিগারেট বাংলার প্যাকেট বেচতে বেচতেও চরিত্রের টানে ছেলে দোকানীর অভ্যেস দাঁড়িয়ে গিয়েছে শ্মশান যাত্রীদের জরিপ করা।
এ যেন এক নাছোড় নেশা। লাশগুলো জিন্দা টাইমে কে কী করত, কোথায় থাকত, কেমন চলত বলত সব জেনে নেওয়া যায় মগে ঘ্যাটর ঘ্যাটর আওয়াজ তুলে দুধ গুলতে গুলতেই। শেষযাত্রায় আসা তাঁদের কাছের মানুষ দূরের মানুষদের পারস্পরিক ভালখারাপবাসার খানিক আন্দাজও মিলে যায়। বেশ একটা লাগে।
আজ যেমন সকাল থেকে একটা খুনখুনে বুড়ি, একটা ট্রেনে কাটা পড়ুয়া, একটা মাঝবয়সী মাস্টার, একটা গলায় দড়ি বছর পঁচিশের বউ আর এই খানিক আগেই একটা হেব্বি সুন্দরী ম্যাডাম টাইপ মহিলা এই সব সমেত পাঁচটা লাশ এসেছে। অন্য দিনের হিসেবে বেশ কমই বলতে হবে, ব্যাবসা ডাউন, তাই মেজাজের জিভে কূলেখাড়ার স্বাদ। এরই মধ্যে শ্মশানঘাট এর উঠোনে শোয়ানো লাস্ট লাশের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরাতে পারছে না দোকানী।
“কী সুন্দর মাঈরী!”
সিনেমার মেয়েগুলি ছাড়া এত মাখন মাখন গড়নে জ্যান্ত মানুষ হয়! আব্বুলিশ, এও তো এখন লাশ। আহা রে! শালা বরটার ব্যাডলাকটাই খারাপ। এই বউ চলে গেলে আর মিলবে এরম … আহ্, এসব ভাবতে নেই। পাপ হয়। কিন্তু ভাবনা আসছে যে, আর একটা জিনিসও চোখে আসছে। বউটার চোখের নীচে গভীর কাল আর্ধেক চাঁদের গর্ত।
একটা কলি ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে উঠছে পাঁজরের গর্তে ওই গর্তে চোখ পড়লেই।
“রাতের চাদরে মুখ ঢেকে খোঁজ কীসের সান্ত্বনা!”
…
“অদ্ভুতভাবে ঘাড়ে এসে পড়লেন তো! বৃষ্টিকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে?”
প্রথমবারের শোনা শব্দেরা তাঁর লোমকূপে শ্বাপদের মত গুঁড়ি মেরে মেরে ঢুকছে থেকে থেকেই। সেদিনের করোগেট শেডের উপর আছড়ে পড়া জলের ঝামর ঝামর কলরোল আর ঋজু যুবতীর ঝাপটা বোল কর্টেক্স এর কোথায় রাখা তা খেয়ালদার হিপোক্যাম্পাস একরত্তিও ভোলেনি। মনে পড়া সুতোতে টান, হাজির সেপিয়া টোনে বায়োস্কোপ…।
সমস্ত ঘাটের অনুষঙ্গে শ্মশান থাকে না, শ্মশান এর অনুষঙ্গে একটি ঘাট থাকেই। আচরণীয় কিছু প্রয়োজনীয়তা তো আছেই, মানবিক প্রাসঙ্গিকতা, সেও বড় কম নয়। যত নাব্য খাত তত ঢালে তাত। জুড়াতে আকুতি। এই যেমন ঘাটের ওধারে স্বামী ভদ্রলোক ওই দাঁড়িয়ে আছেন, বাট জ্বলছে দুই আঙুলে গড়া ঠোঁটে, সূর্যগলা ধিকিধিকি জল পেরিয়ে দৃষ্টি, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিচ্ছু দেখছেন না। ঘাটের এধারে দাঁড়িয়ে তাঁরও তাকানোর মধ্যে মোমোর পুরের মত অনেক অনেকগুলো নরম দেখা যা শুধু চোখ বুঝলেই নজরে আসে। এরকমটা দেখিয়ে দেওয়া, দেখতে পাওয়া, জলের কোল ছাড়া ঘটা অসম্ভব।
শরীর টের পাচ্ছে গরম তরল জোরদার ফিনকি দিয়ে বাহী-র দেওয়ালে ধাক্কা মারছে। ক্রমাগত জোরে, আরও জোরে। তবু মাথা ঘুরতে দেওয়া যাবে না। হাত দুটি বুকের উপর আড়াআড়ি ভাঁজে চেপে রাখা টাল সামলাতেই। সে প্রেমিক। উত্তাল হিংসুক মরালিটির উদ্দাম ঢেউ দাবিয়ে রোমাঞ্চিত সার্ফারের প্রেমযাপন শিখিয়েছিল মেয়েটা। গোনাগুনতি শব্দে।
“শোন, ওই ন্যাকাবোকা আমরা বন্ধু গোছের ডিপ্লোম্যাটিক ডিক্ল্যারেশন আমার দারুণ অপছন্দের। প্রেমিক সে প্রেমিকই। পুলিশের ভয়? পুলিশ বুঝি প্রেমিক নয়?”
বেহাল হলেই বাচাল মেয়েটির খিলখিল শুনতে পাবে সে। নিশ্চিত।
“মৃত্যু মানতে পার না, জীবন বাঁচার লোভ কর!
‘I will drink life to the lees.’ মুসল্লম ইমান একে বলে বুঝি? “
এতক্ষণ ছিল ট্রেতে, কিছু আগে লিভারে টান, সূর্য সৌরভী মেয়েটা এখন শুয়ে আছে চুল্লির গহ্বরে। পুড়ছে খুব পুড়ছে। যেভাবে তারা দুজনায় পুড়েই চলেছে বিগত কয়েকটি বছর। ফারাকও আছে। সে পোড়ায় খাদ ঝরে এ পোড়ায় খাক করে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি দুপুর। সব পুড়ছে, সব্বাই, কে জানে কত শতাব্দী ধরে।
“april is the cruellest month”.
…
“কাঠের চালা : একটি
কলসি : একটি
সরা : একটি
এছাড়া আতপচাল-তিল-কলা-ঘি-পাটকাঠি সবে মিলে হল গিয়ে একশ টাকা”, বিড়বিড় করতে করতে সরঞ্জামের ফি এর রসিদ হাতে নিয়ে পূবালী দোলায় কলাপাতের মত ঘাটের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ডাঁয়ে না বাঁয়ে বাঁয়ে না ডাঁয়ে করছে যে টিকিধারী, সে হল দাহকার্যের আগে এবং পরে ধর্মীয় আচার পালনে সহায়কের সহায়ক অর্থাৎ কি না ঘাটের পুরুতের হেল্পার। টেনেহিঁচড়েও পনেরো পেরোয় নি।
আদতে দুটিতেই অগ্রদানী, পৌরহিত্যের অধিকার নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু শ্মশানে মশানে আর সেকথা ওঠাচ্ছে কে!
আজকাল নার্সিংহোমের লব্জ পেশেন্ট পার্টির কায়দায় এরা বলে বডিপার্টি।
এবারে হেল্পার বুঝে নিতে চাইছে এবং নিতে গিয়ে ঘেঁটে যাচ্ছে দুইদিকে দাঁড়ানো দুইজন ভদ্রলোকের মধ্যে কোনজন স্বামী, বডিপার্টির হেড। রসিদটা দিতে তো হবে।
মালের টালে মুখাগ্নির সময় না থাকাটাই গেরো হল তার।
এমনিতে চোখের উপরে, ঠোঁটের কোণায় শোকের বসা থেকে আন্দাজ লাগিয়ে ফেলা যায় কে লাশের কতটা কাছের। যত বেশি আপনার জন তত বেশি হাত পা ছড়িয়ে গেড়ে গুছিয়ে বসে শোক। বাকিদের ক্ষেত্রে উবু হয়ে কিম্বা দাঁড়িয়েই থাকে। সামাজিকতার পিত্তিরক্ষা হলেই ফটাস করে ঠ্যাং এগিয়ে হাঁটা দেবে। ছেলের স্কুল, মেয়ের গানের ক্লাস, গিন্নির অর্থোপেডিক, কত্তার ইয়ার এন্ডিং।
কারোর শোক জলের পারা, কারোর আবার জ্বলে খাড়া।
তার নিজের অবিশ্যি গজলের ধারা। ব্যক্তিগত শোকাবহ সিচ্যুয়েশনে গান পায়। সেই প্রপঞ্চময় টা খুব পায়।
কী কেস? গাঁজার ডোজ কিছু বেশি হয়েছে না কি, এসব কী আলফাল ভাবছে সে! এমনিতেই দমের গুঁতোয় টাইমে হাজিরা হয়নি আজ, তার উপর এইভাবে ধিনিকেষ্ট হয়ে থাকলে “প্রুদ্দা” কেলিয়ে খাল খিঁচে নেবে। এগোনো যাক।
দুজনেই থম মেরে সিধে খাড়া। চৈত্রের সেগুন গাছের মত শক্ত শুকনো চেহারা। জ্বলন্ত হিটারের কয়েল রঙা দৃষ্টি। কী মনে হতে ধাঁ করে এগোয় ডান ধারের লোকটির কাছে।
গলা খাঁকারি, সাড়া নেই।
-দাদা… সাড়া নেই।
-ও দাদা… সাড়া নেই।
বেশ খানিকটা গলা তুলে ,
-ওও দাদা, এই যে জিনিসের রসিদ। ধরুন।
ঝাঁকুনি খেয়ে ফিরল লোকটা। দৃষ্টি তখনও ভাষা পায়নি। আচ্ছন্ন। না বুঝেই খুবসম্ভব হাত বাড়াল, সেও দিতে যাবে, হড়বড়িয়ে এগিয়ে এল ওধারের লোকটা।
-আমায় দিন।
-ওহ আমি ভাবলাম …
-বুঝেছি। দিন।
মাঝরা টা কী? বউটার কি দুটো বর? ধ্যুর! বর আর বর মত। মতই?
“বহত আরজু থি গলি কী তেরি
সোয়াসে লহু মে নাহা কর চলে…”
নাহ্, ঘাড়ে কানের পেছনে জল দিতে হবে।
বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আজ।
…
নির্দ্ধারিত পঁয়তাল্লিশ মিনিটের অর্ধেকেরও বেশি পেরিয়ে এসেছে দাহ সময়ের। মেয়েটির শরীরের পঁচাত্তর শতাংশ মত কালচে সাদা ছাই হয়ে এল। মেয়েটির জীবনের দুই পুরুষের সন্তাপের প্রাবল্য মাপনীর কোন খাতে বইছে এখন? অভিঘাতের অভিমুখই বা কোন দিকে?
আলো এসময় অনেকটাই ডিফিউজড।
বেশ নরম।
সিনেমায় সদ্য স্নান সেরে কফি কাপ হাতে ঘুমন্ত স্বামীর পাশে এসে বসা স্নিগ্ধ নারীর ঠোঁটের মত নরম।
ফুল, অগুরু, ছাই, সস্তা কোরা কাপড়ের অজস্র টাটকা বাসি গন্ধবহ বাতাস জড়িয়ে ঝিম মেরে পড়ে আছে বিকেল ডাকা শ্মশান।
একটি বছর আট কি দশের ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে নতুন এক বডিপার্টি এসেছে মেয়েটির পরে। নিদাঘ দুপুরের ঘূর্ণি বাতাস থেকে থেকেই ঘুলিয়ে ঠেলছে হাহাকার। পাক খেয়ে খেয়ে আছড়ে পড়ছে শূন্যতা।
মেয়েটির শ্মশান বন্ধুদের ভেতরে দুচারজন এরইমধ্যে এগিয়ে গিয়েছেন গন্তব্যের দিকে। ব্যক্তিগত তাড়া ছিল প্রত্যেকেরই। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখান সেখান। ছাই ভাসিয়ে রওনা হওয়ার অপেক্ষায়।
কেবল কাল অবধি এক কীলক আঁকড়ে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ, “প্রুদ্দা”র হেল্পারের ভুল পদক্ষেপে যাঁদের আকস্মিকভাবেই মুখোমুখি এসে পড়া খানিকক্ষণ আগে, পাশাপাশি বসে আছে ঘাটের পৈঠায়।
অন্য কোথাও দেখা হলে কাঁকড়ার দাঁড়ার মত আঙুল এগোত পরস্পরের কলারের দিকে। তীক্ষ্ণ সভ্য জিভে অভব্যতায় ফালাফালা করে চলত পরস্পরের সম্ভ্রমহানি।
কিন্তু আজ ক্লান্ত। বিষণ্ন। শূন্যময় দুজনায়। তরবারী হারিয়ে গেছে।
দুই কিশোর এক চাঁদিয়ালের টানে জানবাজি রেখে তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে হঠাৎই নজর করে তৃতীয় খেলুড়ে সুতো কেটে চলে গেল এইমাত্র। সাকিনের পাত্তা নেই, লড়াই দেওয়া তো দূর অস্ত। অতএব, ভাঙা বাখারি ছেঁড়া কাগজ কোলে মুহ্যমান বসে আছে তারা। ন্যুব্জ ঘোলাটে চাওয়া।
একটা দুটো তিনটে এলোমেলো কথার চলাচলের পর তাঁদের নিজেদের অলক্ষেই প্রকৃতির শয়তানিতে কখন যেন কথোপকথনের উপজীব্য হয়ে উঠেছে সেই কীলকই। একের বধূ, অপরের বঁধু।
প্রেমিক ভদ্রলোক সিগারেট ঠোঁটে অবিন্যস্ত রকমে লাইটার হাতড়াতেই বিপত্নীক ভদ্রলোক এগিয়ে দিলেন নিজের জ্বলন্ত সিগারেট। ভিন্নসপ্তকে সখ্যতার ফল্গু আরেকটু বইল।
মাঝ দুপুরে কচুচুষির মাঠ পেরোনো কাঠগলা পথিকের আকুতিতে একরাশ ধোঁয়া ভেতরে শুষে ফের গলগল করে বাতাসে মেশাতে মেশাতে ধীরে অতি ধীরে বলতে থাকেন নতমুখ ভদ্রলোক।
– ভালোবাসা হলে সে চত্ত্বরে অজস্র অজস্র ধূপ জ্বলে ওঠে। সে নিজেও ধূপের ধোঁয়ার চরিত্রের। প্রকৃতিতে গাঢ় সুগন্ধদায়ী। আকৃতিতে তীব্র আচ্ছন্নকারী। আগ্রাসী এক বোধে গড়া কিংখাবে মুড়ে যায় দয়িত দয়িতার ভুবন। ঠিক ভুল উচিত অনুচিতের মিশেলে নিজস্ব আলেখ্য তৈরী হয়। অস্বীকৃত, একরোখা। হ্যাঁ, বিরোধ করব না, স্বার্থপর।
– হুম। আপনি বেশ কথা বলেন। লেখেনও, শুনেছিলাম। ওঁর কাছে। আমার এসব কোনও কালেই তেমন আসে না জানেন। আমি অতটা সুন্দর বলা বা বোঝার দলে নেই।
বেভুল ওড়বার বয়সের শুরুতেই সোনাচাঁদির শিকলি জড়ানো বাঁচা। বাপের ফার্মে ক্রমাগত ক্লায়েন্ট ডিল করতে করতে ফাইনার ফিল ব্যাপারটা জন্মানোরই সুযোগ পায় নি।
তাই সোজা ভাবনায় আমার কী মনে হয় জানেন, আপনাদের রকমের ভালবাসা সিগারেটের নেশার মতন। আমরা খুব জানি যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর, কিন্তু আকণ্ঠ ধারণ না করেও থাকা যায় না এমন ক্ষমতাধর টান তার। ঘা বেড়েই চলে। দগদগে। আর প্যাসীভ স্মোকিং এর নিরুচ্চার ক্ষয়ক্ষতি, হা হা, সেতো তার জন্মমুহূর্তের সঙ্গী।
অদ্ভুতভাবে রোড রোলার গড়ানে ঠেলে ঠেলে উচ্চারণ করেন ভদ্রলোক,
– পরকীয়া। তাই না?
আচ্ছা, আমরা তিনজনেই বন্ধু হতে পারতাম না কি একেবারেই? খুবই অসম্ভব ছিল সেটা? (চমকে তাকান বিপত্নীক)
বড্ড বেয়াড়া প্রশ্ন হয়ে গেল তাই না?
(দুজনেরই ঠোঁটে আলতো ঢেউ জাগে। চোখে যন্ত্রণা।)
– দাদা, দু কাপ চা এনে দিই? খাবেন?
পিঠের ওপাশে এসে দাড়িয়েছে ছেলে দোকানী। পাশে সেই আগল ভাঙার কারিগর। বছর পনেরোর হেল্পার।
…
– “জগনে ছিনা মুঝসে, মুঝে যো ভি লগা প্যায়ারা।
সব জিতা কিয়ে মুঝসে, ম্যায় হরদমহি হারা।
তুম হারকে দিল অপনা, মেরা জিত অমর কর দো।”
আধো আলোয় ঝুরঝুর করে শিউলি পড়তে দেখেছ কখনও?
ঠিক ঊষা যাকে বলে, সেসসময়ে, গাছের কোমর দুই তালুর বেড়ে রেখে অল্প দুলিয়ে দেওয়া, ব্যস। ফুলেল স্নান সারা হয়ে যায়। চোখের।
এই লাইনগুলি বাজলেই আমার বুকে অমন করে শিউলি ঝরে, জান।
কী অপার্থিব ভেঙে চুরে যাওয়া!
সমস্ত অক্ষমতা উজাড় করে বয়ানের পরেও কী অনবদ্য ভঙ্গিমায় দাবী রাখা! যাবতীয় অহং উড়িয়ে প্রেম কেবল রাশি রাশি প্রেম দিয়ে গড়া অঞ্জলি পেতে যাচ্ঞা করতে পারা!
উল্টো দিকের মানুষটিকে কতখানি ভালবাসলে এমন করে চাওয়া যায়? কত ও খানি? …
এমা! অমন হা করে কী দেখছ? আমি বুঝি প্রথমবার বকছি এমন প্রলাপ? গত কয়েকমাস ধরে তো শুনেই চলেছ, শুনেই চলেছ। এখনও অবাক হও তুমি!
– একটা সিনেমা দেখেছিলাম জান, নাম মনে নেই। একটি দৃশ্য ছিল।
শাদা জমিনে কাল পাড়ের শাড়ি, হাতে বীণা, বিরাট এক নটরাজের মুর্তির সামনে বসে অভিনেত্রী গাইছেন। অভিযোগ, অনুযোগ, দ্বিধা, সংশয় আর হাজারো প্রশ্নের ভীড় তাঁর বোলে সুরে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে তদ্গত চিত্ত।
তুমি যখন কথা বল, আমার চোখে কেবলই সেই তন্ময়ভাবের ছবি জাগে।
কল্পনাও করতে পারবে না এই মুহূর্তগুলোতে তুমি আমায় কী দিয়ে ভরিয়ে দাও, কীভাবে ভরিয়ে দাও, কতখানি ভরিয়ে দাও।
শোন তাহলে।
কানায় কানায় টইটম্বুর মাঝ শরতের নদীটি যেন তুমি। থেকে থেকেই দু একখানি ঢেউ উপচোয় আড়েপাড়ে। ভরভরন্ত হয়ে উঠতে থাকে চষাজমি। সেই প্লাবনের পলিমাখা বুকে এই এতখানি কষ্টের জন্ম হয়।
আসম্পর্ক গ্রহীতা আমি কী কখনও তোমায় এমন করে কিছু দেব? দিতে পারব?
– দিন। এই কলসীতে একটা কয়েন ফেলে দিন।যাত্রাপথের পারানির কড়ি। আপনার বন্ধুর।
শাদায় কাল বুটিদার আধ বালতি ছাই রাখা পাড়ের ঢালের উপরে। স্বামী ভদ্রলোক নিস্পৃহ নিষ্ঠায় একের পর এক আচার পালন করে চলেছেন। এইটুকু অবধি খেয়াল ছিল প্রেমিক ভদ্রলোকের। তারপর সব ঝাপসাতর হয়ে আছে।
পারানির কড়ি শব্দবন্ধ সম্বিৎ ফেরাল। চশমার কাচের অস্পষ্টতা সরিয়ে চোখ রাখলেন মুখোমুখি মানুষটির চোখে।
নিঃসীম শূন্যতা। উভয়ের ঠোঁটে উচ্চারিত হল কেবল শব্দগুলো। আরেকবার।
ভরা জল পাত্রে ধাতব শব্দ হল।
আমার নদীকেও তবে পেরোতে হবে নদী।
অদেখা চোখের জলের আকুল জোয়ারে বুকের ভেতর ঘর দুমড়ে মুচড়ে।
“আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেল খুলে।
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন অচেনার ধারে।”
…
আমার এক বন্ধুর বদান্যতায় তার প্রবাসী দাদার প্রোষিতভর্তৃকা স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি পড়েছিলাম, তখন ক্লাস নাইন, জান।
এইসব শব্দ আমার মুখে শুনে ভ্রূ বা হেঁচকি কোনটাই তুলো না, বিশেষণ যা কিছু তা আমার সেই বন্ধুরই বলা। আমি মেমরি থেকে কপি পেস্ট মারলাম আর কী।
তো চিঠির বক্তব্য যেমনটি হয় তেমনই ছিল, আবেগ আর বাস্তবতার মিশেলে, খাস কিছু নয়, তবে মনে আছে প্রেরকের প্রাপককে সম্বোধন ও স্বাক্ষর। বৌ এবং বর।
সেসময়েই স্থির করেছিলাম আমার বউকেও বউ বলে ডাকব।
পারিনি।
বেওসাদার পরিবারের ছাঁচে পড়ে দিনকেদিন হয়ে ওঠা কাঠখোট্টা গোছের হিসেবী আমি, নিকেশ করে দিয়েছি কৈশোরের গোপন নরম ইচ্ছে, পাছে দস্তুরমত কঠিন স্বামীত্বে টোল পড়ে।
তুমি এলে।
বিশেষণ আমার তল্পিতে যাচ্ছেতাই রকমের কম, কেবল মনে হল আলো এল। অনেক অনেক আলো। কমনীয় অথচ বড় তেজী আলো। দ্বাদশী কলার আলো পেলেই যার যথেষ্ট রকমেই চলেবল্ হত সে পেল কোজাগরী পূর্ণিমার চন্দ্রমা।
ষোলকলা ভাসিয়ে দিল আমার এতদিনের নিখুঁত জমাখরচে আঁটোসাঁটো বেঁচেবর্তে থাকা। হেই সামাল সামাল রব উঠল মনমতির অন্দর ও বার দুই মহলে। দুরন্ত জেদ চেপে গেল।
আমার বউ, কেবল আমার। সে মুঠোবন্দী হয়ে থাকবে, আমারই। পরম্পরা।
পারিনি।
আলোকে খোলা তালুতে ধরে রাখা যদিওবা কোনক্রমে যায়, মুঠোবন্দী করা কী আর সম্ভবপর! আঙুলের ফাঁক ফোকর চুঁইয়ে ছটা ঠিক পড়ে গলে।
হেরে গিয়েছিলাম।
নাহ, অত্যন্ত স্বাভাবিক অহংয়েই সেটা স্বীকার করিনি কোনোদিনই। আরও আরও লড়াইয়ের জমি তৈরি করেছি কেবল। ছিন্নভিন্ন করেছি তোমায়। চাকলা চাকলা উঠে গেছে নিজেরও।
আজ মেনে নিলাম।
এবং পরাহত আমি আজও মুঠোবন্দী করতে গিয়ে আবারও একইভাবে হেরে গেলাম। ঝুরঝুর করে পড়ে গেলে তুমি।
শাদা ছাই তুমি।
কিন্তু এটা তোমায় কে বলে দেবে বল তো যে আজ লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের টুঁটি টিপে ধরতে নয়, অনেক অনেক নিখাদ আবেগে আজন্মের একমাত্র ভালবাসাটাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম।
আমি তোমায় ভালবেসেছিলাম জান। আজও বাসি। খুবরকমেই বাসি।
তুমি কি তা বুঝলে, বউ?
কড়া করে একটা ঠং শব্দ হল। লোহার রডের আঘাতে মাটির কলসী চুরমার।
অনাদরের জল মিশতে চলল আদরের জলে। বা উল্টোটা।
এগিয়ে গেল শবদাহের দল।
পিছনে ফেরা বারণ।
…
গল্প তো একপ্রকার শেষ। ভেজা গায়ে শ্মশান যাত্রীরা ঘাড়েঘোরে ঘুরঘুর করে বেড়ানো প্রুতদা’র হেল্পারের স্বেচ্ছানিযুক্ত ব্যবস্থাপনায় ছেলে দোকানীর উনুনের উষ্ণতার পাশে বসে কচুরী লাল লাল আলুর দম আর লবঙ্গলতিকা খেয়েছে।
সঙ্গে ভাঁড়ের মেঠোগন্ধী চা।
লম্বা লম্বা সন্তাপ সংঘর্ষের ছায়াদের পেরিয়ে অল্প কিছু কায়ার সঙ্গে অত্যল্প কিছু মায়া বুকপকেটে আধুলি মাফিক আধশোয়া অবস্থায় চলে যাচ্ছে। এই উভয় পক্ষের আয়া অর্থাৎ কিনা প্রকৃতির ক্ষেত্রে বলা চলে, চলেও যাচ্ছে আবার রয়েও যাচ্ছে।
ব্যোমব্যাপী স্বকীয়া শক্তি পরকীয়ার সুনির্ধারিত এবং স্বনির্বাচিত পরিণতি দেখছে মুচকি হেসে। ইত্যবসরে আমার অর্থাৎ কিনা কথকের অর্থাৎ কিনা মেয়েটির একেবারেই নিজস্ব দুটি কথা বলবার অবকাশ মিলল। স্বগতোক্তি।
বলেই নিই।
কবরে নাকি পাশ ফেরা যায়।
বাঁশ চাটাইয়ের অল্পবিস্তর খোঁচাখুঁচি সইয়ে নিতে পারলে আড়মোড়াও ভাঙ্গা যায় খুবসম্ভব। সুঠাম জোব্বাবাবু বা শ্রেষ্ঠ মদ্যরসিক এঁদের দুইয়ের কিছু কবিতাসমগ্র কোনও গতিকে মাথার পাশে গুছিয়ে রাখা গেলে জাজমেন্ট ডে অবধি তোফা কাটিয়েও দেওয়া যায়।
সাথে সামান্য Reserve de la Comtesse জুটে গেলে তো…উফ্!
এক্ষেত্রে অবশ্য বিধি সম্পূর্ণভাবেই আলাদা।
“সাধের এই দেহটাও একমুঠো শাদা ছাই হবে, সবই তো পিছে পড়ে রবে” ইত্যাদি প্রভৃতি বিশ্বহতাশ শব্দভান্ডার ঠেসে গুঁতিয়ে পুরে দেওয়া এ গানটা যতবার কানে আসে কিম্ভূত হাসি পায়।
আজ উপলব্ধি হল প্রসেসিং সত্যিই বেশ চাপের। শুরুতে কটা অখাদ্য রজনীগন্ধা থুতনিতে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল তারপর তো গোটা শরীরে গ্যাদগ্যাদে বাটার অয়েলের অস্বস্তিকর উপস্থিতি। যাচ্ছেতাই।
একটা গোটা দিন পেরিয়ে এল প্রচার বিচার আচারের ধাপগুলি পেরিয়ে, স্বেচ্ছাচারী মন পোরা পঁয়ষট্টি কেজি হাড় মাংস চর্বি জল ভরা শরীরটা ফুরিয়ে ফেলতে।
এখন অবশ্য বেশ ফুরফুরে অনুভব।
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ছাইয়ে ছাইয়ে সারা।
সবই দিব্য এখন, কেবল থেকে থেকেই গরম ছাইয়ে ছপাৎ ছপাৎ জল ছিটকিয়ে দিলে ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে লাগে এটা জানাবোঝার উপযোগী বোধবুদ্ধি নেই কারোরই। আরে ছাইয়েরও ফোস্কা পড়ে।
কষ্ট ওঠে।
কেউ জানতে চায় না। ইচ্ছে যায় না।
ধ্যুর ছাই, ছাই তো হল ছাই-ই, এই ছাইটুকুর মালকিনের কাছেই কি কেউ কোনও দিন একবারও জানতে চেয়েছে, “বোল নাজনীন তেরি রজা ক্যায়া হ্যায়”?
ওই যে সূর্যটা রোজকারের মত ঘিঞ্জি হাওড়ার দিকেই ঢলছে ওকেই কি কেউ শুধোয় ওর কোন বিকেলে ফিটফাট ভিক্টোরিয়ার ডান কোলে ঢলতে সাধ হয় কি না?
নাহ।
পোস্ট মর্ডান হোমো স্যাপিয়েন্সের সফটওয়্যারে ইনবিল্ট নয় এসব আর আজ। বাইরের দেওয়ালে গদগদ সমব্যথী ম্যুরাল আর সুপারবিল্ট এরিয়া জুড়ে কেবলই কী চেয়ে কী পেয়েছি আর কী চেয়ে কিছুই পাইনি তার ডেটাবেস এর পাহাড়।
ইচ্ছেপূরণ ঠাকরুণ তাই খানিক ঘুরপথেই কাঙ্ক্ষিতের জোগানদার। স্বেচ্ছাচার।
দারুণ দাহক দুপুরে আমার শহরে প্রথম বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা নাকের ডগা ছুঁলে তিরতির কেঁপে ওঠে ঠোঁট। ওঠেই। কিন্তু সে কাঁপন চৌরাস্তার মোড়ে একরকম আর চিলেকোঠার আঙিনায় আরেকরকম। তাই বলে একের তাড়নে অন্য অনুভব মিথ্যে হয়ে যায় কি?
মশলার কৌটোর গড়ন হৃদয়ের। ডালা তুলে দেখ একদিন। খোপে খোপে বাসা। বার ঘর এক উঠোনে।
“তোমার” বঁধু নদী তরঙ্গে সওয়ার কালসমুদ্র সঙ্গমে চলল।
“তোমার” বধূ আলো আঁচলের খুটে নিরুচ্চারিত ভালবাসা বাঁধল।
নারী বড় আগ্রাসী। নারী বড় বিবাগী।
নারী বড় মোহময়। নারী বড় মায়াময়।
নারী আদতে বড্ড ভালবাসাবাসি।
তোমরা কবে নাগাদ বুঝবে?
গল্প অল্প ঝুলেছে।
তোমরা খুব মিষ্টি মত থেকো।
Facebook Comments