Site Overlay

সম্পাদকীয় – জুলাই, ২০২৪

আমি যখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি সে সময় মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে গোলদার চাচা আসতেন। শক্তপোক্ত চেহারা। মাথার পিছনদিকে ঘন চুল, কিন্তু মধ্যিখানে চকচকে টাক। টাকের দু’ধারে অগোছালো কাঁচাপাকা চুল। বাবার সাথে কিভাবে ওনার আলাপ হয়েছিল মনে নেই। কিন্তু আমার প্রায় বন্ধুহীন বাবার একজন প্রিয় বন্ধু ছিলেন চাচা।

গোলদার চাচা এলে সন্ধ্যেটা বেশ জমে যেত। কথা বলতে ভালবাসতেন খুব। অনেক গল্প করতেন। বেশ নাটক করে, অঙ্গভঙ্গি করে শোনাতেন তার গ্রামের গল্প। দু'ধরনের গল্প তার মধ্যে প্রধান ছিল - একঃ সাপের গল্প, দুইঃ জ্বিনের গল্প। 

আমার বোন আর আমি পড়া ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি তার গল্প শুনতাম। মা বলতেন “জোরে জোরে পড়, যেন শুনতে পাই।” আমরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়া মুখস্থ করতাম - "গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ‘ইন্ডিয়া’ নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। গ্রিক ঐতিহাসিক….”। গোলদার চাচার গল্প শুরু হলে আমাদের পড়াটা বদলে যেতো - “গ্রিক ঐতিহাসিক … এ এ … হেরো…এ … এ … হেরো..."। মা অন্য ঘরে গল্প করতে করতেও ঠিক টের পেতেন। গোলদার চাচার সামনে বকাবকি করতেন না যদিও। বরং ওই ঘরে এসে চা খেয়ে যেতে বলতেন। আমরা চা খেতে এসে গোলদার চাচাকে ঘিরে বসে পড়তাম। 

গল্পগুলো এখন আর মনে পড়েনা। কিন্তু গল্প শোনার সেই অনুভূতি এখনো অমলিন। একটা গা ছমছমে ভাব। চাচার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের কান থেকে সটান মনে সেঁধিয়ে যাওয়া। হ্যারিকেনের নরম হলুদ আলোতে শ্রবণোন্মুখ ক'টি মুখ।

গল্পগুলো হারিয়ে গেছে। সদা হাস্যমান গোলদার চাচা তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে চুপচাপ হয়ে গেছেন। এখন কারো বাড়িতেই খুব একটা যান না। আমরাও ধীরে ধীরে সেই সন্ধ্যেগুলো ভুলে যাচ্ছি। এসব ভাবলে এখনো মন খারাপ হয়। কিন্তু আমার  আরও বেশি খারাপ লাগে এগারো ক্লাসে পড়া আমার ছেলের জন্য। অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও একটা মায়ার রাজ্যে তো বিচরণ ছিল আমার! সেই রহস্যের রাজ্য আজ না থাকলেও তার স্মৃতি তো আছে আমার কাছে।  আমার সন্তান আমার সেই রাজ্যের অস্তিত্ব কখনো টেরও পেলনা। ছেলের না পাওয়া রূপকথার রাজ্যের কথা ভেবে আমার মন খারাপ হয়। 

গোলদার চাচার মত বন্ধু তো আমার নেই। আমার বন্ধুরা, আমি, আমার প্রজন্মের পরিচিত সব মানুষ এখন সবাই খুব কাজের লোক, ব্যস্ত মানুষ। আমরা কেউ কারো বাড়ি যাই না। গল্প করা তো দূরের কথা। আমরা নেটফ্লিক্স আর ফেসবুকে সম্মোহিত আত্মবিপণনে মগ্ন মানুষ। সন্ধ্যবেলার আকাশে রহস্য নেই আর, কোথাও নেই ভুতুড়ে অন্ধকার। অন্ধকার দেখলেই আমরা অসহজ হয়ে পড়ি। ফোন টিপে মুহূর্তের মধ্যে সব আলো ঝলমলে করে দিই।

ক্যানভাসের এই সংখ্যাটি সেই পুরনো রহস্যের দেশে কড়া নাড়ার একটা চেষ্টা মাত্র। ভূতুড়ে-অদ্ভুতুড়ে নিয়ে আরও বেশি লেখা পাবার আশা ছিল। হয়ত যে কারণটি বললাম কতকটা তারই জন্য বেশি লেখা আসেনি। জানবার উপায় আমার অন্তত খুব বেশি নেই। তবু যে ক’টি লেখা পেয়েছি, আশা করি সেগুলো পড়লে বিদ্যুচ্চমকের মত কোন রহস্যময় স্মৃতি হয়ত এক লহমার জন্য মনে উঁকি মেরে যাবে। এটুকু হলেই যথেষ্ট। 

রহস্য বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক ধূসরতা। সব সাদা-কালো হয়ে গেলে পৃথিবী কি নিতান্তই ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে না?

অন্য সব সংখ্যার মতই এবারও ধন্যবাদ জানাই অভিযান আর মৃন্ময়কে! ওদের উৎসাহ এবং কর্মোদ্যোগই এই পত্রিকার জিয়নকাঠি! এই সংখ্যায় বেশ কয়েকটি AI generated ছবিও আমরা ব্যবহার করেছি। এটাও একটা নতুন জিনিষ বটে! এবং ভাবতে গেলে বেশ অদ্ভুতও!

- হাসান

Facebook Comments