Site Overlay

এবং নবদ্বীপের দই

দেবযানী ভট্টাচার্য

– কী যেন বলছিলাম…হ্যাঁ, তো তারপর সেই আষাঢ় রাত মাথায় নিয়ে সে হাঁটছে তো হাঁটছেই চলছে তো চলছেই… সম্মুখে অন্তহীন হাঁটু ডোবা হাবড় থুড়ি গাঁয়ের পথ। অবশ্য হাঁটছে না বলে হাবড়াচ্ছে বললেই ঠিক হয়। নেহাত নচিকেতা জন্মায়নি তখনও নইলে রিলেটেড গানখানি গলায় নিয়েই চলত সে। গলাখানা তো বলতে নেই বাবা নিশিনাথের দয়ায় বেশ সরেস। পাঁচ গাঁয়ের লোক বায়না দিয়ে নিয়ে যেত ঘটোৎকচ বধ পালার হিরোর পার্ট করাতে, সে দস্তুরমত শিল্পী বলেই না!

– আরে এ তো মহা জ্বালা বাধল! নাম সাকিন না জানলে গল্প এগোয় না শুনতে মন বসে? কে এই সে রে বাপ? অনন্ত পথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেটা কোথায় শুনি?

– ওহ্ হো, বলিনি না এদান্তে কে এই সে? আসলে হয়েছে কী, না হোক হাজার বার, (আরে চোখ পাকাচ্ছ কেন?), আচ্ছা ঠিক আছে, শ খানেক বার, (ফের ভুরু তোলে!), বেশ এই কিন্তু ফাইনাল আর কমাবো না, তা অন্তত খান পঞ্চাশ বার তো নিশ্চয় শুনিয়েছি তার গল্প পোড়ামাতলা থেকে বাবা পঞ্চাননের থান অবধি সব কটি আড্ডায়, ফেমাস পারসোনালিটি যাকে বলে তাই হয়ে গিয়েছে সে ও দিগরে, সেকারণে কলকাতার লোকেদের কাছে গল্প বলতে এসে নামটা বলতে যে হবে মনে করে সেটা মাথা থেকে উড়ে গেছিল যা হোক। বলছি বলছি। আরে এ আমাদের দেশ গাঁয়ের পুব পাড়ার গোবরাদা গো, গোবর্ধন ভট্টাচার্য। চলেছে গলায় দড়ি দিতে।

– কী দিতে??

– দড়ি। গলায় দড়ি। জানো না? মনের দুঃখে লোকে দেয় গো। চালের আড়া থেকে পাতকুয়োর কপিকল হয়ে বড় গাছের ডাল উঁচু যা কিছু দেখে গরুর দড়ি বা ধুতির খুট বা কাঁধের গামছা যা হোক একটা ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লেই কেল্লা ফতে। নে করবি কত অশান্তি কর, আমি তো কেটে পড়লাম দায় ঝেড়ে। মর তোরা এইবার। সেই গলায় দড়ি দিতে পথ চলেছে গোবরাদা। দুঃখ তার একঝুড়ি।

– হুম, জানি। তা সে লোকের অনেক দুঃখ, না? অনেক। তা অত দুঃখ নিয়ে এত পথ চলার দরকার টা তো বুঝলাম না। দেখে বেছে কাছে পিঠে একটা গাছে ঝুলে গেলেই তো পারত। খাটনি আসান হত। জলদি দুঃখ অবসানও বলতে পারি।

– না, হত না। মরবে বলে কি আশ মেটাবে না? খুনে ডাকাতও ফাঁসী গেলে তার শেষ ইচ্ছে শুধোয় সরকারে, মেটায়ও সাধ হাতনাগালে হলে, আর আমাদের গোবরাদা কি এমন পাপ করেছে শুনি যে একটা মাত্তর শেষ ইচ্ছে পূরণ হবে না! তার উপর নিজেই তো নিজের পায়ে হাঁটছে, চাট্টি চালভাজা চিবুতে চিবুতে কাউকে বলেছে কি ‘আমায় এট্টু কাঁধে করে দিয়ে আয় বাপ ওই তেরাস্তা অবধি, বাতে আধ পঙ্গু জীব”, বলেনি তো। তাহলে সমস্যা কোথায়? তোমাদের বাপু সবেতেই আঁক টানা স্বভাব। যাক না যেদিকে দু চোখ চায় মরতে।

– বাপ রে! আচ্ছা, ঘাট হইইয়েসে আমাগের, ফিরোয় নিস্যি। উজিরপুরের পুবপাড়া থেকে উজবেকদের পাছ দোরে চলে যাক, আমাদের সমস্যা নেই। শান্তি? বল এইবার ইচ্ছে তার কী? কারণখানাই বা কী উজিরপুর থেকে উজিয়ে মরার।

– হুম! খুব যে নকলওয়ালী হয়েছ দেখছি সব, গেরামের ভাষা বলছ বেশ। যাক, উঁচু জাতের গলায় দড়ে হবে এই তার শেষ সাধ। সঙ্গে লেজুড় মিতে গাঁয়ে মরা।

– গলায় দড়ে? মিতে গাঁয়ে? মানে কী গো এসবের?

– কলকাতার লোক হল না যেন বিভূঁইয়ের অতিথ হল বাবা, কিচ্ছু জানে না! বলি শোন, উজিরপুরের পাশের গাঁ হল গোবরা। আমাদের সেও হল গোবরা। নামে নামে মিলল কি না? এরম মিললে হয় মিতা সমপক্ক। সেই নিয়মে গাঁ খানা হল দাদার মিতা। এবারে হল কী সেই গাঁয়েরই শেষে তেরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক আধ বিঘের আঁশশ্যাওড়া। থাক, মুখে মাছি ঢুকিয়ে কাজ নেই, এক কাঠাই সাব্যস্ত হল না হয়, কিন্তু ছিল। সে গাছের বড় নাম। যে ঝুলবে সেই গলায় দড়ে হবে মানে কথা ভূত হবে কিন্তু হবে ওরই মধ্যে সেরা জাতের। কেন? নীলকর সায়েবেরা জনা পাঁচেক খাতককে এক লপ্তে ঝুলিয়ে ছিল বুঝি কোম্পানির রাজত্বে, তেঁনারা সব ওখানেই রয়ে গেছেন সেই থেকে। কোন সে আদ্যিকালের লোক তাঁরা, তাঁদের মুরুব্বী মানে বাকিরা। সেই সম্মানেই এই বন্দোবস্ত আর কী। হয় না, শহরের বড় কলেজে পাশ দিলে গেরেমভারী ব্যাপার আর সেই একই পাশ মফস্বলে দিলে দায়সারা আচ্ছা ঠিকাছে বুঝেছি, এও তেমন।

– বুঝলাম। তা এই ব্যবস্থা যে ভূতেদের জগতে আছে এ খবর তোমাদের দেয় কে? চিঠি চাপাটি চলে বুঝি? আর খামোখা মরতেই বা সাধ হল কেন ভদ্রলোকের?

– মরলে যখন সোয়াস্তি মেলে তখন মরবার সাধ হয় বৈকি। বললাম না, একঝুড়ি দুঃখ ছিল তাঁর। বলব বিস্তারে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। তা যা বলছিলাম, দুঃখ কষ্ট ছিল তো বটেই, উপরি জব্বর গোঁ ছিল এক ধামা। গেজেলের জেদ বাবা। মরব, মরেও জ্বালাব। তাই ভূত হওয়ার নিশ্ছিদ্র প্রকল্প হাতে নিয়ে পথে নেমেছিল গোবরাদা।

আর হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে, জানান দেয় কে, তাই তো? বলি ফি শনিবারের বারবেলা ভরে পড়ে যারা তারা কি হাপু গায় নিশিনাথ বাবার থানে বসে? কত কী ভূত ভবিষ্যৎ বলে দেয় তা জানো! তারাই সব বলে। সে যাক গে যাক, নিশ্ছিদ্র প্রকল্পটি শোন আগে। কাঁধে নীলু গাইয়ের দড়িগাছ, বগলে ছাতা, এক হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে হুঁকো আর আরেক হাতে এক ঘটি জল, চিঁড়ে, পাটালি, সবরী কলার পুঁটুলি নিয়ে পথ চলছে গোবরা দাদা। (আবার ভুরু কপালে তোলে দেখ!) এখানে আবার কী সমস্যা?

― গোবরা দাদা কি মরার আগেই ভূত হলেন? জ্যান্ত মানুষ তিন হাতি হয় কখনো?

– ওহ্, ছোট্ট মিসটেক হয়ে গেছে আর কী। হাতে ধরাতে না চাও মাথায় তুলে দিলেই হয়। বখেরা শেষ। গল্পে অত ধরলে হয় না জানো না? খালি ব্রেক চাপতে হচ্ছে।

তা ব্রেক যখন চাপলামই একটু ব্যাক গিয়ারে দিয়ে নিই। গল্পের ধরতাইয়ে সুবিধেই হবে। হ্যাঁ, তা গোবরা দাদা তো হাত পা ছাড়িয়ে রাগের ঠেলায় রওনা দিয়েছে, বৌদি বসেছে পা ছড়িয়ে কাঁদতে। আমরা, পাড়ার ছেলে ছোকরারা সে চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম তাঁদের উঠোনে। বৌদি আমাদের দেখেই হাউমাউ করে পড়লে। ওরে তোরা মানুষটাকে কেন ধমকাতে গেলি রে! ছোট ভায়েদের কাছে সম্মান খুইয়ে আর বাঁচবে না বলেই তো সে মরতে গেল রে! ওরে আমার এত বড় সব্বনাশ তোরা কেন করলি রে! আমার খাওয়া পরা সব ঘুচে গেল রে! ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা তো পুরো ভোম্বল। বলে কী বৌদি! আমাদের জন্য মরতে গেল গোবরা দাদা! তারপর মনে পড়ল দিন পাঁচেক আগের ঝগড়া ঝামেলা।

– বাওয়াল? কে কাকে দিয়েছিল?

– ভাওয়াল? ভাওয়াল এর মধ্যে এল কী করে? সে তো উজিরপুরের থেকে বহুদূরে। এতক্ষণ অঙ্ক গোলাচ্ছিলে এখন ভূগোল গোলাচ্ছ। এরম করলে মুখে কুলুপ আটব বলে দিলাম।

– উফঃ! না না, ঠিক আছে। আসলে বাওয়াল মানে ঝামেলা। কলকাতার লব্জে। তুমি এগোও।

– বেশ বেশ। ভাষার কী বাহার! যাক, হয়েছে কী গোবরা দাদার নিজস্ব ভাষ্যে প্রতি তিনদিন অন্তর বউ পেটাতে হয়। জামাকাপড় নিয়মিত না কাচলে যেমন ধোপদুরস্ত হয় না, বউ কিছুদিন পর পর না কাচলেও তেমনই চলনদুরস্ত হয় না। সত্যি মিথ্যে জানিনা বাপু এ বিদ্যে সে শিখে এসেছে শুনি সেই পশ্চিমের সাঁওতালদের গাঁ থেকে। সেখানে না কী বরে না পেটালে বৌয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে বসে বর আদরবাসা করে না বলে। বোঝো কাণ্ড! বেশ কয়েক সপ্তাহ চলল বৌ ঠ্যাঙানি। সে ভয়ানক বিচ্ছিরি ব্যাপার। বৌদি চেঁচাচ্ছে, ক্ষুদেগুলো চেল্লাচ্ছে, এমনকি গোবরাদার মাও চিক্কুর পাড়ছে। খালি মেরে ফেলে রে কেটে ফেললে রে।

 প্রথম প্রথম স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া বলে নাক গলাইনি আমরা কিন্তু এমন বেয়াড়া নিয়ম তো চলতে দেওয়া যায় না, তাই না? বৌদিটা কী কান্নাই না কাঁদে! আমাদের কাছে অভিযোগও করে মধ্যে মধ্যেই। প্রতিকার যদি কিছু করতে পারি।

তাই একদিন বাঁধাঘাট রতন সংঘের রত্নেরা গোবরা দাদার বাড়িতে চড়াও হয়ে তাঁকে তুলে এনে চণ্ডীতলায় ধরে বসিয়ে বেশ করে বোঝালাম। নরম গরম উভয় পথেই চেষ্টা চলল যাতে মোদ্দা কথাগুলো মরমে ঢোকাতে কিছু বাড়তি সুবিধে হয়। শুরুতে হাত পা ছুঁড়ছিল বটে, কিছুক্ষণ তড়পে যখন বুঝল এ শক্ত ঠাঁই, সুবিধা হবে না চিল্লিয়ে, গুম হয়ে শুনল খানিক। তারপর মাথাটা পেন্ডুলামের মত দোলাতে দোলাতে রওনা দিল বাড়ির পথে। বিড়বিড়িয়ে কী সব বলতে বলতে এগোচ্ছিল সে তো আর কান অবধি এসে পৌঁছয়নি আমাদের, পরে জেনেছিলাম হাঁটুর বয়সী ছোকরারা কড়কে দেওয়াতে আঁতে লেগেছিলো দাদার। বৌয়ের উপরে অভিমানও হয়েছিল ঘরের আলাপ ঘাটের বিলাপে সামিল করার জন্য। এবং সেই দুখেই মৃত্যুর সঙ্গে মিলাপের তাঁর এই সিদ্ধান্ত।

– ওহ, তার মানে এই হল পেছনের প্রলাপ থুক্কু গল্প।

– হ্যাঁ। এইবারে সামনের পথ হাঁটা যাক। গোবরাদা এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা, পা চালিয়ে এগোও। খুঁজে বের করতে হবে তো মানুষটাকে। না কী! এবং জ্যান্ত।

– আচ্ছা জ্বালায় পড়লাম দেখি। মরতে যাচ্ছি বলে তো আর আছাড় খেয়ে কোমর ভাঙতে পারব না রে বাবা। সশরীরে সগ্গে যাব, হ্যাঁ। কিন্তু পথ যেন ফুরোচ্ছে না। এত কাল এ পথে যাতায়াত, এত লম্বা তো দিনে রাতে কখনও ঠাহর পাইনি। এই হাবড় ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে হাড়গোড় ঝনঝন করছে যেন। আর না, ওই যে গাঁয়ের হাট দেখা যাচ্ছে। কোনও একটা ছাউনির তলায় বসে একটু জিরিয়ে নিই।…এই তো, এই চালার ভিটেটা বেশ উঁচু দেখছি। জল ছোঁয়নি এখনও। এখানেই বসা যাক।

– তামাক ইচ্ছা করবেন না কি?

– অ্যাঁই কে, কে?

– আজ্ঞে আমি কত্তা। আপনার পেছনে বসে আছি।

– তুমি কোথা থেকে উদয় হলে বাপ? যখন এসে বসলাম তখন তো দেখতে পাইনি। চাদরখানা এমন জড়িয়েছ, মুখ নজরে আসছে না। কী আঁশটে গন্ধ বাপু তোমার চাদরে!

– মাফ করবেন কত্তা। গরিবের চাদর, গন্ধ বাতাস থেকেই যায়। আমি ছিলাম। আছিই তো। এমন বাদলার রাত কি না, তাই ঠাহর করতে পারেননি। তা কত্তা কি তামাক খাবেন একটু? পেরসাদ পেতাম তাহলে। আমি সেজে দিচ্ছি। জলচল জাত।

– বটে। তা বেশ তো, সেজে ফেল দেখি একটা। মরার আগে এক ছিলিম খেয়েই মরি।

– মরবেন কেন কত্তা? মরুক আপনার শ্বশুর থুড়ি শত্তুর।

– মরব না মানে? মরব না মানেটা কী হে? মরতেই তো বেরিয়েছি। এ প্রাণ আমি আর রাখব না। সংসার অসার বুঝলে হে, কেউ কারো নয়। নইলে আমি গোবর্ধন ভৎচাজ, এক রাতে আটটা কালী পুজো করি মুগুর পাশে রেখে, রক্তখাগী মা অবধি এই বেটাকে ভয় খায়, সেই আমাকে কি না পাড়ার ছেলে ছোকরাদের দিয়ে ধমক খাওয়ালো সুষমা!

– বড় দাগা দিয়েছে বৌঠান। বুঝতে পারছি। তা আপনি কি কিছু?

– হ্যাঁ, করেছি তো। যা করে সেটা বুক বাজিয়ে বলতে এ শর্মা ডরায় না। পিটিয়েছি। বৌটাকে। দু পাত্তর পচাই চড়লে মানুষের অত তালজ্ঞান থাকে না যে বেহালা বাজাচ্ছি না বউ ঠেঙাচ্ছি। সবই এক হয়ে যায়। সেরম বুঝলে আমাকেও না হয় দিত দু ঘা ঝাঁটার বাড়ি, শোধবোধ সারা। তা নয় চলল নালিশ ঠুকতে। এ একটা উচিত কাজ হল বউ মানুষের?

– তা কত্তা আপনিই বা ঐসব খেতে যান কেন? এরম পান তামাকে থাকলেই হয়।

– এটা বলেছ ভাল, তবে কী জান, কর্মসূত্রে পশ্চিমে বহুদিন বাস করে এই নেশায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এখন না হলে চলে না। কিন্তু আজ আমার বড় দুঃখ হয়েছে। ওই দুদিনের ছেলে গুলো আমায় কর্তব্যকর্ম শেখাতে এসেছে! ছ্যাঁ ছ্যাঁ! মানুষের যদি সম্মানই না থাকল তবে থাকলটা কী! যাক গে, উঠি। রাত বাড়ছে। এখন এখন কাজটা সেরে ফেলতে না পারলে লোক চক্ষে পড়ে যেতে পারি। আসি হে। শেষ তামাকটা তোমার হাতে ভালোই খেলাম হে ভজহরি। ভালো থেকো।

– আপনি সত্যিই মরতে চললেন! কী আর বলি। ইচ্ছে যখন হয়েছে…

আজ্ঞে আমার নাম ঐটি নয় কত্তা। গণপতি নাম আমার। সে যাক, চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিই। শেষ যাত্রায় সঙ্গী হওয়া পুণ্যের।

– যাবে, তা চল। দড়িদড়া বাঁধাবাধি করতে হবে। কাজে সাহায্য করতে পারবে। এই হুঁকোটা আমি মরে গেলে তুমি নিয়ে নিয়ো। বড় প্রাচীন হুঁকো হে। আমার ঠাকুরদার বাপের। চল চল। পা চালিয়ে চল।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো এগোই। আপনি বরং বগলে ছাতি আর বাম হাতে লণ্ঠনটা ধরুন, দড়ি আর ঝোলাটা আমায় দিন। ডান হাতে এবারে ধরুন দিকি আমায়। পড়লে ধরব তো বটেই, কেমন হুঁশ করে পৌঁছে যাবেন, টেরই পাবেন না।

– ধরবে, আচ্ছা বেশ ধরো। বড় অদ্ভুত মানুষ হে তুমি। মরতে এগিয়ে তো দিচ্ছই, আবার তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর গতিও করছ। লোকে তো উল্টোটাই করে বলে জানতাম।… এই এই এত জোরে ছুটছ কেন হে, চলছ না উড়ছ বুঝতে পারছি না তো…

– অত বুঝে কাজ কী কত্তা, মরাই যখন স্থির তখন সকাল সকাল সেরে ফেলা ভাল তো। যত দেরী হবে ওই যে বললেন, সমস্যা নানারকম।

হুঁইইই… এই এসে পড়লাম। এই আপনার তেরাস্তার আঁশশ্যাওড়া। নিন, একটু জিরিয়ে লেগে পড়ুন।

– আরে দাঁড়া রে বাবা। মরবার থানে এমন টেনে আনলে যেন স্বয়ং যমদূত! দম তো পথেই বেরিয়ে যেত। প্রাণ নিয়ে পৌঁছেছি এই কপাল। রোসো বাপ। একটু গলায় জল ঢালি। ঘটিটা গেল কৈ…ওই ঝোলাটা দাও তো হে।

– এই তো, এই নিন।

– আচ্ছা কত্তা, আপনার ও ঝোলায় কী আছে?

– কে? তুমি তো নও, কে বলল এ কথা?

– ওই যে কত্তা, আপনার বাম পাশে, ওই দেখুন। লোকটা।

– হ্যাঁ! তাই তো। তুমি কে? কে তুমি? কী করছ এখানে?

– আজ্ঞে কত্তা আমি তো এ দিগরেই থাকি, ভূতনাথ নাম আমার। বাদরে আটকে পড়েছিলাম তাই গাছের নিচে বসেছিলাম আর কী। পাকা সবরীর গন্ধ পেলাম তো। তাই সকসকিয়ে উঠল নোলাখানা।

– হা হা হা! যেমন ভূতুড়ে গলা তেমনই নাম রেখেছে বাপ মেয়ে। তা কলায় নোলা ভিজে গেল না কী! বেশ বেশ। হ্যাঁ ওতে খানকতক কলা আছে বটে। কিছু চিঁড়ে আর পাটালিও আছে। চলবে না কি এ ফলার?

– কী যে বলেন কত্তা, আমরা চাষা ভূষো মানুষ। ভাত জোটে তো নুন ফুরায়। এমন ফলার তো অমৃত আমাদের। যদি প্রসাদ পাই…পর জন্মেও জিভে লেগে থাকবে।

– ঠিক আছে। এমনি সময় হলে কী করতাম জানি না। মরেই তো যাব। মনটা কেমন পাছ দুয়োরের পুকুর জুড়োনো বাতাসের মত উদার উদার হয়ে গেছে। না হয় তোমাদের দুটি খাইয়েই গেলাম। ওই গাছের নীচে উঁচু জায়গাটায় বসি কেমন, পাতা তো নেই, আমি মেখে দলা করে দিই, মুখে ফেলে দাও। তারপর খেয়ে দেয়ে মুখ হাত ধুয়ে ঝুলে পড়ব। হুঁকো গণপতি নেবে, ভূতো, ঘটিখানা তুমিই নিয়ো বাপ। ছাতাটা বড় প্রিয় আমার। যখন ঝুলব, মাথায় মেলে দিয়ো। কাকে ঠোকরাবে না চাঁদি। কতক্ষণে আমি নেই এই হুঁশ হবে, আমায় খুঁজবে, খুঁজে পাবে গাঁয়ের লোক তা তো জানিনা। নিশ্চিন্তে ঝুলব। নাও, এই নাও ক্যাগের দল বগার দলা।

– আজ্ঞে তাই দেন কত্তা। ভেতরে যে কী হচ্ছে আমাদের! উথল পাথাল একেবারে। কী যে তৃপ্তি হবে! ফলার খাব। ফলার! কলা পাটালি শালিধানের চিঁড়ে…

– এই নাও। হাত বাড়াও দেখি এক এক করে।

এ বাবা! কী চিমসে হাত হে। গণপতি, তোমার হাতও দেখি একই অবস্থা। হাড়ে কেবল শুকনো চামড়া সেঁটে রয়েছে যেন! মানুষ না গোভূত রে বাবা।

– হে হে হে। দিন কত্তা। দিন।…

উফ। ওই গেল গেল…ফের ফের পড়ে যাচ্ছে রে গনা। কিছুতেই গিলতে পারি না। ও গনা আমরা ফলার খেতে পাচ্ছি না রে খেতে পাচ্ছি না। মুক্তি নেই। আমাদের মুক্তি নেই! হা হা হা!

– আহ! সত্যিই পড়ে যাচ্ছে তো, চাদর অমন অষ্টমঙ্গলার মুড়ি দিয়ে কি খাওয়া যায়? খোল চাদর। আমি তোমাদের ভাসুর ঠাকুর না কি! এই আমিই দিই খুলে। শান্তিতে খাও…

– এ কী! কে তোমরা! তোমরা কারা!!! জিভগুলো এক হাত করে বেরিয়ে এসেছে! চোখগুলো খাটাসের মত জ্বলছে! গোটা শরীরে আধপোড়া কয়লার মত কালো চামড়া পেঁচানো হাড় কতগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছ! বল কী তোমরা???? মানুষ না প্রেত????

– আমরা প্রেত। না না। ভয় পাবেন না। স্থির হয়ে বসুন। আপনার কোনও ক্ষতি করব না আমরা। একটু পরেই আপনি আমাদেরই দলে এসে পড়বেন যে। একই হাহাকার আপনারও অনন্ত কাল অবধি সঙ্গী হয়ে তাড়িয়ে বেড়াবে আপনাকে। সে যন্ত্রণার কাছে আমাদের ভয় দেখানো তুচ্ছ কত্তা। তুচ্ছ। দেখতে পাচ্ছেন আমরা কাঁদছি! বড় আক্ষেপ ঠাকুর মশায়, বড় আক্ষেপ।

– আক্ষেপ? হাহাকার? ভূতভয় তুচ্ছ তার কাছে?

– হ্যাঁ। হাহাকার। এই যেমন দেখছেন আমাদের ফলার খাওয়ার এত সাধ অথচ গলা দিয়ে ভেতরে নামছে না কারণ জিভটা নেমে এসেছে সামনে বুক ছুঁই হয়ে। দুই হাতে ঠেলে গুঁতিয়েও একটি দানাও ঢোকাতে পারছি না। ডুকরে মরছি। ঠিক তেমন অবস্থা তো আপনারও হবে। গলায় দড়ে হবেন তো। যত এমন আকাঙ্ক্ষা কিস্যু পূরণ হবে না। সগ্গে যাবেন? ফ্যুস! গতিইই তো হবে না। এমন বাতাসখেকো হয়ে থেকে যাবেন। মাথা কুটে মরবেন। না না, মরবেন আর কী করে, মরা তো ইতোমধ্যে সারা। কেবল জ্বলা লেখা হবে নসিবে।

তাহলে কত্তা, দড়ি ঝোলাই?

– না! আমি মরব না। কিছুতেই মরব না। মৃত্যু এত ভয়ানক! এত কুৎসিত! এত নিঃস্ব! ঈশ্বর! আমি বাঁচব। আমার বউয়ের জন্য বাঁচব। বড় খুকির জন্য বাঁচব। খোকার জন্য বাঁচব। কত সাধ আমার। খোকার পৈতে দেব। বড় খুকির বিয়ে দেব। বৌটার গলায় পৈঁছা গড়াব। নতুন হাল বলদ কিনব। ভিন গায়ে যজমানি ধরব। ঘর তুলব। আমি মরব না। আমায় তোমরা ছেড়ে দাও। আমি মরতে চাই না। ওগো বড় বউ… খোকা রে…

– ওই ওই শুনছিস, গোবরদার গলা না? ওই যে, চিৎকার ভেসে এল। চল চল ঐদিকটায় যাই।

– আমরা তেরাস্তার কাছে রে। এগোলেই আঁশশ্যাওড়া। এই রাতে ঐদিকে…

– হ্যাঁ, যেতে তো হবেই। খুঁজতে বেরিয়ে গলা পেয়েও ফিরে যাওয়া তো চলে না। চল চল সবাই ঐদিকে চল। ও দলে থাকলে ভূতে ধরে না। আর হাতে লণ্ঠন রয়েছে তো। ভূতে আগুনে ভয় পায়। এগিয়ে আয়। আরে ওই তো, ওই যে কেতরে পড়ে আছে গোবরাদাদা! শিগগিরই পা চালিয়ে আয়।

– ও কত্তা, কত্তা, উঠুন। ওই দেখুন আপনার গাঁয়ের লোকেরা খুঁজতে বেরিয়েছে আপনাকে। এদিকেই আসছে। বাড়ি ফিরে যান কত্তা। জীবন বড় সুন্দর। নিজে হাতে তারে শেষ করতে নেই। ভগবান ক্ষমা করেন না। শাস্তি দেন। দেখছেন তো, সে শাস্তি কতখানি ভয়ানক…তবে হ্যাঁ, ভূতে আগুনে ভয় পায় এরম অসৈরণ কথা না বলতে বলবেন তো। কত তামাকখোর ভূত আছে জানে লোকে! আশ্চর্য যা হোক!

ওহ, নবদ্বীপের দই শুনেছি বড় ভাল। আসছে শনিবার দুপুরে এক হাঁড়ি খাওয়াবেন?

ফলার???

Facebook Comments