Site Overlay

ধার

অভিযান ভট্টাচার্য্য

সৌপ্তিক পড়াশুনায় মন্দ ছিল না | ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে একটা ছোটোখাটো কোম্পানীতে চাকরী পেয়ে সাতপাঁচ না ভেবে জয়েন করে যায় | তারপর থেকে ১০ বছর হয়ে গেল | সৌপ্তিক ওর কাজটা ভালোবাসে | মালিক সান্যাল বাবুর সাথে পিতা-পুত্র সুলভ সম্পর্ক | অর্থ কম হলেও সম্মান আছে, শান্তি আছে | এই কোম্পানী ছাড়ার অনেক হাতছানি এলেও ও সাড়া দিতে পারে নি | ওর সতীর্থরা এরই মধ্যে চার পাঁচটা কোম্পানী পাল্টে বেশ মোটা মাইনের কাজ করছে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্হায় | পড়াশুনোয় তারা যে সৌপ্তিকের থেকে সবাই ভালো ছিল তেমন নয় | তবু সৌপ্তিকের কাছে আজ তাদের সম্পদের তুলনায় কিছুই নেই | তাদের বড় বড় সাজানো ফ্ল্যাট, দামী বিদেশী ব্র্যান্ডের গাড়ী | সবই অবশ্য মোটা টাকা EMI এর বিনিময়ে | অতো EMI দেওয়া সৌপ্তিকের পক্ষে সম্ভব নয় | তাই ব্যাঙ্ক থেকে ধার করে অতো বড় ফ্ল্যাট বা গাড়ী কেনা ওর হয়ে ওঠে নি | ওর জীবন যাপনের মান বিশেষ পাল্টায় নি তাই | বছর তিনেক হল সৌপ্তিক বিয়ে করেছে | এই তো সেদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে ওর বন্ধুদের সাথে দেখা | সৌম্যও এসেছিল | ছাত্রজীবনে ওর খুব ন্যাওটা ছিল সৌম্য |  কত পরীক্ষায় যে সৌপ্তিক ওর নিজের খাতা থেকে সৌম্যকে অবাধে টুকতে দিয়ে পাশ করিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই | সেই সৌম্য কিনা সৌপ্তিকের বৌয়ের সামনেই বলল, ” সৌপ্তিকটা জীবনে কোন রিস্কই নিল না | আরে বস, একটু তো অ্যাম্বিশন রাখ লাইফে ?” 

সৌপ্তিকের স্ত্রী ছবি নেহাতই ঘরোয়া গৃহবধূ | অন্য বন্ধুদের স্ত্রীরা অনেকেই চাকরী করে, কেউ বা করে না | কিন্তু তাদের ঠাট বাটের সামনে ছবি গুটিয়েই থাকে একটু | সৌম্য-র কথাটা খুব গায়ে লাগল ছবির | একটু একটু করে জীবন যুদ্ধে স্বামীর ব্যর্থতা সম্বন্ধে তার মনে বিশ্বাস বদ্ধমূল হল | বাড়তে থাকল অশান্তি | শেষে সৌপ্তিক নিয়েই ফেলল চরম সিদ্ধান্ত | সৌম্য যে বহুজাতিক কোম্পানীতে কাজ করে সেখানেই ইন্টারভিউ দিল | চাকরীর অফারও পেয়ে গেল | মাইনে তিনগুন ! ছবি খুশীতে ডগমগ হয়ে বলল, ” আমি জানতাম, তুমি পারবে !” 

দুরু দুরু বুকে সান্যাল বাবুকে ইস্তফাপত্র দিল সৌপ্তিক | সান্যাল বাবু পিঠ চাপড়ে শুভেচ্ছা জানালেন | সৌপ্তিকের অবশ্য মনে হল সান্যাল বাবুর চোখের কোনে এক ফোঁটা দুঃখ জমা হয়ে রয়েছে |

ছবির বাবার এক বন্ধুর ছেলে প্রোমোটিং করে | তাদের নতুন প্রোজেক্টে একটা বড় দক্ষিন খোলা ফ্ল্যাট বুক করার জন্য কথা বার্তা ফাইনাল করে ফেলল ছবি আর সৌপ্তিক |  কয়েক মাসের মাইনে পেলেই সেই পে-স্লিপ গুলো দেখিয়ে ব্যাঙ্ক লোন হয়ে যাবে | আপাতত একটা টোকেন মানি দিয়ে ফ্ল্যাটটা ধরে রাখল তারা |

নতুন চাকরী শুরু হল সৌপ্তিকের | এখন  বাড়ি ফেরে অনেক দেরী করে | ছবি মেনে নিয়েছে | অতগুলো টাকা কি এমনি এমনি দেবে অতো বড় কোম্পানী ? তিন বছরে এই প্রথমবার জামাই ষষ্ঠীতে শ্বশুর বাড়ি যেতে পারল না সৌপ্তিক | তাতে ছবি একটু যেন গর্বই বোধ করল | অন্ততঃ বাপের বাড়িতে প্রমান করা গেছে যে রাঙা পিসির কর্পোরেট জামাইয়ের মতন তার স্বামীকেও ডাকলেই পাওয়া যায় না !

অবশেষে একদিন ব্যাঙ্ক থেকে লোন  পেয়ে গেল সৌপ্তিক | EMI দিতে হবে মাসে মাসে | সেটা দিয়েও কিছু থাকবে সংসার চালানোর জন্য | আর, ভালোভাবে কাজ করলে নিশ্চয়ই প্রমোশনও পাবে তাড়াতাড়ি ! তখনতো মাইনে আরও বেড়ে যাবে |

এই ভাবেই চলল বছর খানেক | নতুন ফ্ল্যাটের চাবি হাতে আসবে দুদিনের মধ্যেই | কিন্তু ছবি লক্ষ্য করে, সৌপ্তিক যেন কি নিয়ে অস্বস্তিতে আছে | অফিস থেকে এসে গম্ভীর হয়ে থাকে | প্রাণ খুলে হাসে না | ছবি কারণ জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায় নি | তারপর একদিন মাঝরাতে বাড়ি এসে ছবির কাঁধে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল সৌপ্তিক, ” পারলাম না ছবি | পারলাম না ! ওরা  ভারতের ব্যবসা একেবারে গুটিয়ে নিল | সৌম্য জানত এটা হবে | আমায় না জানিয়েই ও কোম্পানী ছেড়ে আগেই পালিয়েছে |” 

ছবির বুকের ভেতর যেন একটা শব্দ হল | জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা একটা দমকা বাতাসের ঝাপটা খেয়ে ধপ করে মৃদু আর্তনাদে যেমন নিভে যায়, অনেকটা সেরকম | সৌপ্তিককে আসলে সে বড় ভালবাসে | সৌপ্তিক বড় ভাল ছেলে | ও যাতে জীবন থেকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য অর্জন করে নিতে পারে, ছবি সেটুকুই চায় |  সৌপ্তিকের কান্না দেখে ভেতরটা দুমড়ে যাচ্ছিল ছবির |  কিন্তু এখন ভেঙে পড়লে চলবে না | নিজেকে স্থির রেখে খুব নরম ভাবে সৌপ্তিকের মাথায় বিলি কেটে বলল, ” এই চাকরীটা যখন এত সহজে পেয়েছ , তোমার কি চাকরীর অভাব হবে ? তুমি ঠিক পারবে | এর থেকেও ভালো জায়গায় পাবে | বাচ্চাদের মতন কাঁদছ কেন ?”

” বড্ড কঠিন ! ” আস্তে আস্তে বলল সৌপ্তিক | ” শেষ দিকটায় কোম্পানীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটু বেশীই ভোকাল হয়ে গেছিলাম আমরা কয়েকজন | শুরু থেকেই কিছু গন্ডগোল নজর হচ্ছিল | টার্মিনেশন লেটারটাতে কোম্পানী এত বাজে রিমার্কস লিখে দিয়েছে, ওই এক্সপিরিয়েন্স কোথাও দেখাতে পারব না ছবি ! উফ্! কেন যে … এত বাড়িয়ে ফেললাম সব ! ” ছবির আলিঙ্গন ছাড়িয়ে মাথার চুল চেপে ধরে বসে পড়ল সৌপ্তিক |

পরদিন সকালে গতরাতের বিনিদ্র চোখের নিভে আসা জ্যোতি নিয়ে সৌপ্তিক গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়াল সান্যাল বাবুর চেম্বারের সামনে | অপরাধীর মত |বছর খানেকেরও বেশী সময় পর ! সান্যাল বাবুর মধ্যে বয়সের ছাপ আরেকটু প্রকট হয়েছে | আগের মতোই পিঠে হাত রেখে ভেতরে এনে বসালেন সান্যাল বাবু | সৌপ্তিক কিছু বলতে যাচ্ছিল | তাকে থামিয়ে সান্যাল বাবু বললেন, ” যে কাজটা করতে সেখানেই শুরু কর | যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম তাকে অন্য দিকে পাঠিয়ে দেব | আর হ্যাঁ, মাইনে কিন্তু বাড়াতে পারব না | বড়জোর আগের থেকে ৫০০ বাড়ানো যায় কি না দেখছি | চাইলে আজই শুরু করতে পার|”

সান্যাল বাবুর হাত দুটো খপ ধরে নিয়ে সৌপ্তিক মাথায় ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল | ব্যাঙ্কের ধারটা যে করে হোক সে শোধ করবে | কিন্তু, সান্যাল বাবুর এই ঋণ সে কোনোদিন যে শোধ করতে পারবে না! কেনো দিন না !

Facebook Comments