ঋত্বিকা
গ্রামের পূবদিকে ফলসা নদীর পাড়ে বুড়োশিবমন্দির। পোড়ো কালিঝুলিমাখা জীর্ণ মন্দির আর তার ভিতরে একশ বছরের ও পুরোনো শিবলিঙ্গ।বুড়োশিব !
নিত্য তার আকন্দ,বেলপাতা টুকটাক জোটে বটে তবে ঘটা হয় শিবরাত্রিতে ।
মন্দিরের পিছনে ফলসা নদী আর তার ধারে এক মস্ত বেলগাছ।সেই গাছে থাকে এক বামুন ভূত। লিকলিকে রোগা তপু মুকুজ্জে ম্যালেরিয়ায় মরে ভূত হয়ে বেলগাছে আশ্রয় নিয়েছে।সে এখন দাপুটে ব্রহ্মদত্যি !
দাপুটে কারণ বেঁচে থাকতে থাকতে তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো।সে এতোটাই রোগা ছিল যে তার নাকি ছায়া পড়ে না এইসব আর কি !
তো ভূত হয়ে সে এখন তার অপমানের শোধ নিচ্ছে। সন্ধ্যের পর শিব মন্দিরের আশেপাশে কেউ ঘুর ঘুর করলেই তপু তার লিকলিকে হা পা নেড়ে দারুন ভয় দেখায় ! বিশেষ করে যারা তাকে বিরক্ত করতো,তাদের তো তপু এ তল্লাটে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। পকাই,হারু এরা তো ভেবেই পায় না সন্ধ্যের পর মন্দির চত্বরের আশপাশ দিয়ে কীভাবে যাতায়াত করবে !
হারু তো একদিন ব্রহ্মদত্যির কবলে পড়ে দাঁতকপাটি লেগে হার্টের ব্যামো বাধিয়েছে !!
তপু এইসব কান্ডকারখানা করে দিব্য মজা পায়।তবে কি সমস্যা হলো রোজ একঘেয়ে খাবার ! হয় গুজিয়া নয় বেল,বড়োজোর এক ঘটি দুধ ! দূর দূর এসব খেলে তার ভৌতিক জীবন ও টিঁকিয়ে রাখা মুশকিল!এবার এর একটা বিহিত করতেই হবে।
এবারের শিবরাত্রির দিন এগিয়ে আসতেই তপু পরিকল্পনা করে নেয়। এবার ঘটাও বেশী।রতন মাষ্টারের নাতি হওয়ায় তার পরিবার বুড়োশিবকে ধন্য ধন্য করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
সারাদিন মন্দির ধুয়ে,ফুলমালা দিয়ে সাজানো হলো।পুরুতঠাকুর তো ভোর থেকেই নেচে নেচে তদারকি করছে।এই কাজে তার আবার দুটো স্যাঙাতও জুটেছে। তপু বেলগাছে পা ঝুলিয়ে বসে সব ই দেখতে থাকে।
বিকেল থেকেই গ্রামের মেয়েরা সার দিয়ে আসতে থাকে।হাতে থালা,রঙিন শালুর কাপড়ে ঢাকা। তপু বুঝতে পারে সেই পুরোনো খাবার জিনিস,ফলমূল আর কি !
সন্ধ্যে থেকে জল ঢালা পর্ব চলে।তপু তক্কে তক্কে থাকে,তার বেলগাছের দিকটায় কেউ এলেই তাকে ধরবে।যদিও ভূতের ভয়ে এইদিকটা সবাই এড়িয়েই যায় !
হঠাৎ ব্রহ্মদত্যির চোখে পড়ে একটা বছর সাতেকের ছেলে হাতে কি একটা নিয়ে খেতে খেতে আসছে।ব্রহ্মদত্যি তপু দেখে এই সুযোগ।
পল্টু একটা চিপসের প্যাকেট খেতে খেতে বেলগাছের তলায় চলে আসে।তার মা আজ ব্যস্ত বুড়োশিবের মাথায় জল ঢালতে।নিবিষ্ট চিত্তে সে একটা একটা করে চিপস্ খাচ্ছিল,এমন সময়…”অ্যাঁই খোঁকা, তোঁর ভঁয় নেঁই ? এঁদিকে এঁসেছিস যেঁ বঁড়ো?”
পল্টু ডানপিটে ছেলে।সে একটুও না ঘাবড়ে বলে,”ও তুমিই সেই ভূত ? যার ভয়ে কেউ এদিকে আসে না ? “
তপুই এবার ঘাবড়ে যায়,একটু দমে সে বলে,”ভূঁত আঁবার কিঁ কঁথা, ব্রঁহ্মদত্যি বঁল”
পল্টু জবাব দিলো,”ওই হলো,তা তোমার আর কাজ নেই ? মানুষ কে ভয় দেখিয়ে বেড়াও ? কি চাই কি তোমার?”
ব্রহ্মদত্যি খানিক ব্যোমকে গিয়ে বলে,”এঁকটা শঁর্তে ভঁয় দেঁখানো ছেঁড়ে দেঁবো”
পল্টু জিজ্ঞেস করে,”কি সেটা শুনি?”
“আঁমাকে নিঁত্যি নঁতুন খাঁবার দিঁয়ে যেঁতে হঁবে,ফঁল খেঁয়ে খেঁয়ে হঁদ্দ হঁয়ে গেঁছি !”
পল্টু এবার হেসে ওঠে,”ও এই ব্যাপার ? বেশ,আমি সবাইকে বলে দেবো এবার থেকে পুজোর থালায় সন্দেশের পাশে চিপস,চকোলেট রাখতে,তাহলে তুমি আর ভয় দেখাবে না তো ?”
ব্রহ্মদত্যি তপু আবার তার লিক লিকে শরীরটা হাওয়ায় ভাসিয়ে উত্তর দেয়,”তুঁমি কঁথা রাঁখলে আঁমিও কঁথা রাঁখবো,ভূঁত হঁলেও দুঁনম্বরী কঁরি না”
পল্টু তার আধ খাওয়া চিপসের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,”এখন এইটা খাও,কাল থেকে আরো পাবে,আমি এখন চললুম,মনে রেখো আর ভয় দেখানো চলবে না’
ব্রহ্মদত্যি চিপসের প্যাকেটটা সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে বেলগাছের মাথায় চড়ে বসে।চিপসের স্বাদ নিতে নিতে সে দেখতে পায় পল্টু লাফিয়ে লাফিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে।
মন্দিরে তখন জোরে জোরে ঘন্টা বাজছে।মেয়েরা তাদের মনোকামনার চরিতার্থের জন্য বুড়োশিবকে ডাকতে থাকে আর ওদিকে ব্রহ্মদত্যি বসে থাকে পল্টুর আশায়….
Facebook Comments