হাসান শরিফ
“ধুত্তোর!”
আপনার মাতৃভাষা যদি বাংলা হয় তবে এই আগের শব্দটি ইংরেজিতে লিখে কোনোদিনই সন্তুষ্ট হতে পারবেন কি? ঠিক যা বোঝাতে চাইছেন তাই কি পারবেন বোঝাতে? ধরেই নিলুম ইংরেজিতে আপনি এক ঘর (এই বাক্যটাও চেষ্টা করে দেখুন না!), তবু পার্থক্য একটু থেকেই যাবে আমার বিশ্বাস। অংকের ভাষায় বললে – নিরানব্বই দশমিক নয় নয় শতাংশে পৌঁছে যাবেন, কিন্তু ঠিক একশোতে নয়।
উপরে তর্জমা করা নিয়ে যে কথাগুলি বললাম সেগুলি নেহাতই ছেলেমানুষি। সব ভাষাতেই এমন কিছু ভাব প্রকাশ করার পথ আছে যেগুলি কখনোই একেবারে যথার্থ ভাবে অন্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বাংলার ক্ষেত্রে যেমন “ধুত্তোর” এর ইংরেজি হয়না, তেমনি ইংরিজি অনেক শব্দেরও যুৎসই বাংলা হবে না।
তার কারণটা কিন্তু এটাই যে একই পরিস্থিতিতে একজন বাঙালি যেখানে “ধুত্তোর” বলে ওঠে সেখানে একজন ব্রিটিশ অন্য কিছু বলবে। যে মনের অবস্থা থেকে তারা ওই শব্দবন্ধ উচ্চারণ করে সেই মনের অবস্থাটিও কি একেবারে একই? আমার ধারণা তা নয়। আসলে বক্তার মনের অবস্থাটিও তৈরী হয় তার ভাষার বোধ থেকে।
মাতৃভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এরকমই। আমরা আবেগ কে ভাষায় প্রকাশ করি বলে ভাবি, আসলে কিন্তু আমাদের আবেগই রঞ্জিত হয় আমাদের ভাষার রঙে। ভাষার দ্যোতনাতেই আমাদের “মন খারাপ হয়, উদাস বিকেলে মন কেমন একটা করে।” ভাষার হাত ধরেই “নতুন প্রেমে পড়া হৃদয়টি তার কথায় তিরতির করে কাঁপে।”
অনুভূতিকে যখন আমরা রোমন্থন করি বা প্রকাশ করি তখন আশ্রয় নিই মাতৃভাষারই কাছে। অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা এমনিতেই কঠিন। তবু মাতৃভাষাই পারে তার সবথেকে কাছে যেতে। মাতৃভাষার বর্ণ, শব্দ, বাক্য দিয়ে রচনা করি আমাদের হৃদয়ের গহনে ডুবে থাকা আবেগকে। ধীরে ধীরে সেই অনুভূতি আর ভাষা মিলেমিশে যায়, অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায়। মাতৃভাষা তাই খুব কাছের। “মা”-এর সাথে এই “ভাষা” শব্দটি জোড়া নেহাত কথার কথা নয়।
বেঙ্গালুরুতে যখন ছিলাম একবার একটি কর্মশালাতে যোগ দিয়েছিলাম। সেই কর্মশালাটি ছিল ইংরেজিতে সৃজনশীল লেখা কিভাবে লিখতে হয় সেই বিষয় নিয়ে। শিক্ষক বললেন,”তোমায় ভাবতে শিখতে হবে ইংলিশ-এ। স্বপ্ন দেখতে হবে ইংলিশ-এ। তবেই ভালো লিখতে পারবে।” বলা বাহুল্য যে, অধম চিরকাল বাংলাতেই স্বপ্ন দেখে এসেছে যে সে ইংলিশ-এ লিখছে। হয়তো স্বীকার করে কালিদাস হচ্ছি (করুন এর ইংলিশ, দেখি) তবু বলি আজও স্বপ্ন দেখে চলেছি ইংলিশ-এ গল্প-উপন্যাস লিখে নাম করার। কথাটি খুব পরস্পরবিরোধী শোনাচ্ছে জানি, অন্তত আজকের প্রেক্ষাপটে, একুশে ফেব্রুয়ারীতে। তবু লেখার সময় মিথ্যে লিখতে চাই না।
ইংলিশ-এ লেখার সঙ্গে হৃদয়ের টান ততটা নেই, যতটা আছে বিষয়ের টান। দুঃখের হলেও এটাই সত্যি যে “বাংলা লিখে পয়সা নেই।” আমার কবি-লেখক বন্ধুরাই বলেন। প্রায়ই উপদেশ দেন, “লিখতে যদি পারিস ইংরিজিতে লেখ!” সেই গুঁতোয় চেষ্টা করি। যতটা হয়। যদি কখনো বাংলার কাছাকাছি যেতে পারি! আশি শতাংশ হলেও ভয়ঙ্কর খুশি হবো! এবং আক্ষেপটা এখানেই। এই চিন্তার সুতোটি নিয়েই খারাপ লাগে মাঝে মাঝেই। তীব্র দ্বন্দ্বে ভুগি। বাঙালি হয়ে কেন আমি খুঁজবো আশ্রয় অন্য ভাষায়? কেন “বাংলা” আর “বিষয়” শব্দদুটি পরস্পরবিরোধী হবে? কেন এর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে? লোভী মানুষ আমি, দুটিই কি পাওয়া সম্ভব নয়? আমি নিশ্চই দোষী এরকম ভাবার জন্য, বাংলাকে ছেড়ে পয়সার জন্য বা নামের জন্য ইংলিশকে বেছে নিতে চেয়ে আমি নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার স্নেহকে একটু হলেও অমর্যাদা করেছি।
কষ্ট-ও কম পাইনা তার জন্য। মনে আছে, কর্মশালাটি করার সময় প্রবল উৎসাহে ইংরেজিতে লেখা শুরু করি। কোনো কোনো লেখা ভালো হয়, কোনোটি খারাপ। কোনটি অতি অখাদ্য। কর্মশালাটি শেষ হবার পরেও আমার ইংলিশ-এর সাথে প্রেম নিবেদন চলতে থাকে। নিজেকে নিচে নামিয়ে হোক, বা ভাঁড়ামো করেই হোক আমি ইংলিশকে কোনো রূপসী তন্বীর মতো কাছে পেতে চাই। এভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস, বছর ঘুরে যায়। বাড়িতে হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা আমাকে দেখে অবাক হয়ে যান, জিজ্ঞেস করেন তুই তো এমন ছিলিনা, মাঝে মাঝেই আসতিস তুই, পায়ের কাছে বসে গল্প শুনতিস আমাদের! তোর হলো কি? ওঁদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলি, এক অজানা প্রেমে পড়েছি, তোমরা ক্ষমা করো এখন। এভাবে বছর দুয়েক চলে। একদিন কোনো কারণে খুব মন খারাপ। অফিসেরই কিছু হবে। আনমনে একটা পিডিএফ পড়তে শুরু করি – হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটি উপন্যাস।কয়েকটি বাক্য পড়ার পর নিজের অজান্তেই বিনা ভূমিকায় বুক মুচড়ে কান্না উঠে আসে। নিখাদ অভিমানের কান্না। বাংলা ভাষা কি সুন্দর! আমার মনের সব আনাচেকানাচে এরই বাস। আমি চিনি এই মেয়েটিকে, এর সঙ্গে আমায় ভাঁড়ামো করতে হয়না। এর সাথেই তো কেটেছে আমার ছেলেবেলা, কৈশোর, যৌবন! অদ্ভুত ভাবে নির্দ্বিধায় বাংলা ভাষার উপর রাগ করে বলি, কেন তোমাকে ছেড়ে আমায় যেতে হয়েছিল?
কিন্তু এমন অবস্থা শুধু আমার একার কি?
আমরা আমাদের ছেলে মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই পাঠাই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-এ। বাংলা কম শিখলেও চলবে, ইংলিশটা পোক্ত হওয়া চাই। বাড়িতেও উৎসাহ দিই ইংলিশ এ কথা বলতে , ছেলে তুতলে তুতলে বাংলা বললে রাতে আনন্দে ঘুম হয়না। সারা বছর এভাবে ইংলিশ শিখে ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন ছেলেকে জল পড়ে পাতা নড়ে শেখাতে বসি। ছেলে না পারলে ছেলেকে এক ঘা দি। বাংলার মতো তুচ্ছ ভাষা শিখতে পারছিস না? বছরে একদিনের বেশি লাগে? ছেলে বাংলাকে ভয় করতে শেখে। আমরা বাংলা মিডিয়াম এর ঘুষঘুষে ছাত্র হয়েও ছেলেকে শেখাই ইংরিজি বেশি জরুরি বলে। আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী। শুধু আজকের দিনটি একটু আদিখ্যেতা করাই যায়। কিন্তু কোথাও গোলমাল নেই বললে মানি কি করে?
ইংলিশ এর প্রতি বিদ্বেষ আমার নেই এতটুকু , বাংলার প্রতি ভালোবাসারও অগাধ। বাংলাকে অগাধ ভালোবেসেও কেন একজন বাঙালি লেখক ভাববেন যে তাকে নাম করতে হলে, পয়সা করতে হলে ইংরেজিতে লিখতে হবে? কেন সে ভাবতে পারবে না যে বাংলাতে ভালো লিখতে পারলে তার বই অন্য কেউ অনুবাদ করবে ইংরেজিতে?
আসলে গলদটা ওই যে বললাম স্কুল থেকে শুরু হয়েছে। ইংলিশ এর উপর অত্যাধিক নির্ভরতা আমাদের। আর আছে নিজের ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্য।
এক বন্ধুর কাছে গল্প শুনছিলাম। কোনো একটি শপিং-মল-এ এক ভদ্রমহিলা তার আট বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন। ভিড়ে সে ছেলেটি হারিয়ে যায়। ভদ্রমহিলা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন একটি ঘোষণা করে ছেলেটিকে জানাতে যে তিনি অমুক অফিসের সামনে আছেন, ছেলেটি যেন সেখানে চলে আসে। সেই ঘোষক ভদ্রলোক ঘোষণাটি করেন ইংলিশ-এ। ভদ্রমহিলা অনুরোধ করেন যে তার ছেলে ইংলিশ ভালো বোঝেনা, তাই যেন ঘোষক বাংলাতে ঘোষণাটি করেন। ঘোষক মহা বিরক্ত হন এবং ঘোষণা করতে অস্বীকার করেন। তাদের নাকি বাংলাতে কথা বলা বারণ আছে।ভদ্রমহিলার অনেক কাকুতি মিনতিতেও কাজ হয়না। তখন বন্ধুকে গিয়ে হম্বি তম্বি করতে হয়, লোক জড়ো করে ঝামেলা করতে হয় শুধু ঘোষণাটি বাংলাতে করানোর জন্য!
তো, আমাদের অবস্থা এমনি। আমরা ভাষা দিবসও পালন করছি, আবার এরকম ঘটনাও ঘটছে শহরে। এ লজ্জা কোথায় রাখি!
কেউ যেন ভেবে না বসেন আমি সবেতেই বাংলা বাধ্যতামূলক করার কথা বলছি। এক্সট্রিমিজম এখন একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তুমি হয় এ দলের নয় ও দলের, এমন একটি ব্যাপার আর কি! যাই হোক, বলতে চাইছিলাম যে অতটা হুলুস্থূল করাটাও ঠিক নয় হয়তো যে বাংলাতে প্রতিটি দোকানের signboard বাংলাতে লিখতেই হবে। ঈশ্বর জানেন বেঙ্গালুরুতে কন্নাডার চক্করে পড়ে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল কয়েক ক্ষেত্রে! আসলে কোনো জিনিস চাপানো হচ্ছে এমন মনে হলেই তীব্র বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। এই বিতৃষ্ণায় কাউকেই কষ্ট দেওয়া ঠিক না। মোরাল পোলিসিং এর মতো ল্যাংগুয়েজ পোলিসিং ও খুব একটা ভালো বলে আমার মনে হয় না। তবে উপায় কি জিজ্ঞেস করলে বলবো আমি জানিনা। আমাদের তর্ক বিতর্ক করা দরকার এটা নিয়ে, কিন্তু মারপিট নয়।
গল্প যখন করছি, একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এক মার্কিন ভদ্রমহিলা আমার পত্রবন্ধু। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে বেঙ্গালুরুকেই নিজের বাড়ি বানিয়েছেন। তার সাথে পত্র মিতালি করার কারণ আমার ইংলিশ লেখা তিনি পরিমার্জনা করেন। আমিও করি তার লেখার। ক্রিস্টি অত্যন্ত ভদ্র এবং মিতভাষী। তার সাথে একবার গেছিলাম শান্তিনিকেতনে কেঁদুলির মেলায়।মেলা থেকে যখন ফিরছি তখন প্রায় রাত দুটো। তীব্র ঠান্ডা। কাঁপতে কাঁপতে হাটছি দুজন। সেই মুহূর্তে কথা চালানোর জন্য একটি ইংরেজি কথাও কইতে ইচ্ছে করছিলোনা। আমি মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলাম, “শালা! কি ঠান্ডা!” ক্রিস্টি বললো, ইংরেজিতে অবশ্যই, “তুমি কি বললে?” আমি বললুম, “নাথিং! ভেরি কোল্ড!” ক্রিস্টি হাসলো মিষ্টি করে, বললো, “Sorry, my Bengali is very limited!” আমি জিভ কেটে বললুম ইংলিশ-এ, “জানি তো, আমারই ভুল হয়েছে।” কিন্তু মনে একটা খটকা লাগলো, ও বাংলা না জেনে কোনো হীনমন্যতাতে ভোগে না। অথচ আমি একটা বাক্য ইংলিশ-এ না বলে বাংলায় বলেছি বলে কেন জিভ কাটলাম! এতো কেন হীনমন্যতা!
আর বেশিক্ষন নেবো না।সব শেষে একটি কথা মৃদু গলায় বলতে চাই যে একুশে ফেব্রুয়ারী কিন্তু “আন্তর্জাতিক” মাতৃভাষা দিবস। শুধু বাংলা ভাষা দিবস নয়। ২১শের উদযাপন বাঙালি যেমন করে বাংলা ভাষায় আপ্লুত হয়ে, একজন সাঁওতালেরও একই অধিকার আছে সাঁওতালি নিয়ে গর্ব বোধ করার, ভালোবাসার। ২১শে ফেব্রুয়ারী সবার-ই। ২১শে ফেব্রুয়ারী নিয়ে জাত্যাভিমান করাটা ঠিক নয় বলেই মনে হয়। আমার ভাষা ভালো অন্যদের ভাষার থেকে এই রকম ভুল ব্যাখ্যা করাটা একেবারেই বর্জনীয়।
আসলে এই কথাগুলি বলবার দরকার যে পড়েছে সেটাই খুব দুঃখের ব্যাপার। সবকিছুকেই জাত্যাভিমানের গন্ডিতে বেঁধে ফেলাই যেন কেতাদুরুস্ত হয়েছে এখন। জাতি, ধর্ম, প্রদেশ, দেশ ছেড়ে বৃহত্তর মানবতার আকাশে নিজের আরোহনের চেষ্টা করা এক প্রাণঘাতী স্পর্ধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক ভয়ঙ্কর সময়ে বাস করছি আমরা। ভালোবাসার থেকে ঘৃনাতে এখন অভ্যস্ত হচ্ছি বেশি, ধ্বংসের স্পৃহায় জিভ দিয়ে লালা ঝরছে আমাদের। এখন মানুষ হয়ে ওঠাটাই সব থেকে বেশি দরকার। অন্য সব মাতামাতিতেও যেন মানুষ থাকা ভুলে না যাই আমরা এই প্রার্থনা করি।
খুব সুন্দর |
সত্যি আমরা যেন সঠিক মানুষ হতে পারি। অসাধারণ চিন্তা-ভাবনা ও লেখা।