স্বাধীন সরকার
মাঠ পাড়ার বস্তিতে বড় থমথমে পরিবেশ | হাবাদের বাড়ির পাশে সরু একটা গলিতে সাদা কাপড় ঝোলানো এক চিলতে প্যান্ডেল | বস্তিরই কিছু পুরুষ ও মহিলা মিলে পংক্তি ভোজনের সামান্য আয়োজন করছে | মন্ডপে ঢোকার মুখে একটি তুলসীমঞ্চের ওপর বসে একটা কাক মন্ডপের দিকে মুখ করে সকাল থেকে কর্কশ চিৎকার করে যাচ্ছে | মাঝে মধ্যে চিৎকার থেকে বিরতি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু যেন সব নিরীক্ষণ করছে | তারপর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গিয়ে বসছে গলির মুখের আমগাছটায় | শশব্যস্ত হয়ে আবার ফিরে আসছে তুলসী মঞ্চে | আবার শুরু করছে চিৎকার | ভাবখানা এমন, যেন তার ওপরেই সব কিছু তদারকি ন্যস্ত আছে; কিন্তু কোনো কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না |
মন্ডপের ভেতরে এক প্রান্তে একটি চৌকিতে মলিন একটা শাড়ি পড়ে ঘুমিয়ে আছে হাবার মা | দু চোখের পাশে শুকিয়ে গেছে জলের ধারা I আর এককোনে শতরঞ্জী পাতা | পিতৃশ্রাদ্ধে বসেছে হাবা | পাশে আলুথালু চুলে বসে আছে হাবার পাঁচ বছরের বড় দিদি | সবে গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হয়েছে | মাঝে মাঝে শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে নিচ্ছে | হাবা তার বড় আদরের ভাই | কিন্তু একটু এবনর্ম্যাল | সেই জন্যই তার নাম হয়ে গেছে হাবা | কথা বার্তা তার একটু অস্পষ্ট | অনেক সময়েই সামনের মানুষকে বোঝাতে পারে না, সে কি চায় | অথচ আশপাশের সব কিছুই সে অনুধাবন করতে পারে | একমাত্র হাবার দিদিই এই পৃথিবীতে হাবাকে সব থেকে ভাল বোঝে | হাবার কথা বুঝতে বা হাবাকে বোঝাতে তার কোনো অসুবিধা হয় না | ভাইটাকে সে বড় ভালোবাসে | ভাই এর জগত জুড়েও শুধুই তার দিদি | আজও হাবার দিদির প্রাথমিক দায়িত্ব হোলো, পুরুত মশাইয়ের সাথে হাবার যোগাযোগ রক্ষা করা | পুরুত মশাইয়ের অনেক কথাই বুঝতে পারছিল না হাবা | অবশ্য হাবার এসব অনুষ্ঠান-উপাচারে বিশেষ আগ্রহও ছিল না | সে একভাবে দেখছিল কাকটাকে | কাকটা যেন তার দিকে তাকিয়েই কা কা করে ডেকে কিছু বলছে | আর উড়ে গিয়ে বসছে আমগাছটার ডালে| আমগাছটার দিকে চোখ গেল হাবার |
গাছের নিচে ওর বাবার চা বিক্রির গুমটিটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে | গুমটির সামনে ওর বাবারই পাতা বেঞ্চে এখনও বসে আছে কালুয়ার দুটো চ্যালা | মনে হচ্ছে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের দিকে নজর রাখছে | ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোরের মধ্যে চলে গেল হাবা | কিছু যেন ওকে জোর করে ভেতর থেকে ঝাঁকাচ্ছে | এর আগেও হয়েছে ওর এরকম | কিন্তু এবার জন্য সব অন্যরকম | অন্যবারে চোখ অন্ধকার হয়ে যায় | কিন্তু এবার যেন চোখের সামনে আলো, শুধু আলো ! ধাঁধিয়ে যাচ্ছে চোখ | হাত দিয়ে চোখ ঢাকবার চেষ্টা করল | আলোর মধ্যেই ফুটে উঠল এক দলা অন্ধকার | ওইতো চায়ের দোকান খোলা | অনেক রাত হয়েছে | বাবার শরীরটা ভালো নেই | দিদি দোকানে বাবাকে সাহায্য করতে গেছে সব গুছিয়ে দোকান বন্ধ করার জন্য | এমন সময় কালুয়া দুটো ছেলে নিয়ে দোকানে এসে চা চাইল | দৃশ্যতঃই তারা অপ্রকৃতস্থ |
কালুয়া বছর দশেক আগে বিহার থেকে এসে স্ক্র্যাপ লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা শুরু করে | সেখান থেকে হয়ে যায় সমাজ বিরোধী | স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে এখন এলাকার ‘বিসিস্ট সমাজসেবি’ | বাস্তবে আরও কিছু দেশোয়ালী ভাই জুটিয়ে কালুয়া এখন এলাকার ত্রাস |
হাবার বাবা বিনয়ের সাথে জানাল, দোকান বন্ধ; চা হবে না | প্রত্যাখ্যান ভালোভাবে মেনে নিল না কালুয়ার দলবল | দু’এক কথায় গরম হয়ে উঠল কালুয়ার মেজাজ | এতক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিল বেঞ্চে | টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে সজোরে লাথি মারল হাবার বাবার পেটে | পড়ে কুঁকড়ে গেল সে | এতক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল হাবার দিদি | বাবাকে পড়ে যেতে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারল না | ছাই গাদার শিকটা হাতে নিয়ে মুহূর্তে একলাফে বেঞ্চে উঠে মারল কালুয়ার মাথায় | মাথা ধরে উপুড় হয়ে পড়ল কালুয়া | ঘটনার আকস্মিক বিহ্বলতা কাটিয়ে কালুয়ার এক সঙ্গী ঝাঁপিয়ে পড়ল হাবার দিদির ওপর | কোমর ধরে হ্যাঁচকা টানে বেঞ্চি থেকে টেনে নামিয়ে এক টানে ছিঁড়ে দিল সালওয়ারের খানিকটা | পিছমোড়া করে লোলুপ হায়নার মত লালসায় কামড়াতে শুরু করল | মেয়েটা ছটফট করছে – খাঁচা থেকে কষাই মুরগীকে টেনে বের করে আনার সময় পাখীটা যেমন প্রাণপনে ডানা ঝাপটে নিষ্ফল বাঁচার চেষ্টা করে, অনেকটা সেই রকম | কালুয়ার অন্য সঙ্গী এতক্ষন কালুয়াকে তোলার চেষ্টা করছিল | তার নজর গেল মেয়েটার দিকে | “ আরে ! ই কা কিয়ে ! ই ছামিয়া তো পুরা বাঙ্গালী বোম্ব লাগত হ্যা ”, বলতে বলতে কালুয়াকে ফেলে সেও মেয়েটার অবশিষ্ট সম্ভ্রমটুকুর বেড়া ভেঙে দিতে শুরু করল | চিৎকার করে উঠল হাবার দিদি – যূপকাষ্ঠে দ্বিখন্তিত হবার পূর্বমুহূর্তে ছাগ শিশু যেমন শেষ আৰ্তনাদ করে | এতক্ষণের চেঁচামেচি শুনে আশপাশের ঘরগুলো থেকে এক এক করে লোক জড় হচ্ছে , কিন্তু প্রতিবাদ নেই কোথাও ! এমন সময় হিংস্র বাঘের মত চিৎকার করে অন্ধকার ভেদ করে ছুটে এসে কালুয়ার একটা সঙ্গীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হাবা | এক কামড়ে পেটের খানিকটা চামড়া খুবলে ছিঁড়ে নিল | আর্তনাদ করে, দিদিকে ছেড়ে শয়তানটা একহাতে পেটের ক্ষত চিপে চুলের মুঠি ধরল হাবার | হাবা শয়তানটার গলার নলি খামচে ধরল | ইতিমধ্যে লোকজন উত্তেজিত হয়ে উঠছে | হাবার মতো একটা ‘পাগলের’ একার লড়াই দেখে এলাকার মানুষের মনেও সাহস সঞ্চয় হয়েছে | এক সঙ্গীর ওই অবস্থা দেখে বিপদ বুঝে আরেকজন হাবার দিদি কে ছেড়ে পালাতে শুরু করল | সঙ্গীকে পালাতে দেখে অন্যজনও পালাল | ইতিমধ্যে জ্ঞান হয়েছে কালুয়ার | বুঝতে পারল অবস্থা বেগতিক | “ওয়ে কামিনো, রুখ | ছোড়কে ভাগ রাহা হ্যা সালোঁ!” বলতে বলতে সেও টলায়মান পায়ে তার চ্যালা দের পিছু নিল |
কিন্তু, হাবার বাবা আর উঠল না !
হাবার চোখের সামনে সব অন্ধকার আস্ত আস্তে মিলিয়ে গেল | উধাও চায়ের দোকান, ভিড়, সব! পুরোটাই উজ্জ্বল আলো | সেই আলোর মধ্যে থেকে হেঁটে আসছে হাবার শীর্ণকায় বাবা | হাত নেড়ে ডাকছে তাকে | হাবাকে যে সাড়া দিতেই হবে ! ছুটে গিয়ে ধরতে হবে | যদি বাবা চলে যায় !
“ বাব্বা !”
গোঙানির মত চিৎকার করে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাবা | শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য রাখা চাল, কলা, কোষাকুষি ছত্রখান হয়ে গেল | কাকটা ছিটকে পড়া চাল কলা খেতে মন্ডপের ভেতরে ঢুকে এসে তীব্র চিৎকার শুরু করল | দিদির চেষ্টায় একটু পরে জ্ঞান ফিরল হাবার | সন্ত্রস্ত পুরুত মশাই নমো নমো করে কাজ শেষ করলেন |
সেদিন রাত্রে দিদির পাশে নিষ্পলক শুয়ে ছিল হাবা | বুঝতে পারছিল দিদি পাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে | হাবা আস্তে আস্তে দিদিকে ডাকল |
“ দিদ্দি !”
চোখ মুছে হাবার দিকে ফিরল দিদি |
“ঘুমোসনি ভাই !”
“ শ্শদ্ধ কল…লে বব্বা সওগ্গে যাআবে ?”
“ এসব কি কথা বার্তা রাতদুপুরে ?”
“ য্ যাআ ব্বে না |”
“ কে যাবে না | কি বলছিস ?”
“বব্বা | সত্তগ্গে য্ যাআ ব্বে না !”
“ রাত দুপুরে এসব কি অলুক্ষণে কথা ! চুপ! শো বলছি |”
“শ্শদ্ধ তো ঠিক করে হওয়ে নি | বব্বা যাআ ব্বে না | এক্খানেই আআ চে | ” বলে অদ্ভুত টেনে টেনে হাসতে লাগল হাবা |
“ ভাই | চুপ কর | চুপ কর |” কাঁদতে কাঁদতে হাবার মুখ চাপা দিল দিদি | তবু হেসেই চলল হাবা |
কালুয়ার ছেলেরা হাবাকে টার্গেট করেছে | ওরা সেই বেঞ্চেই বসে থাকে | ওদের ভয়ে হাবার মা ইচ্ছে থাকলেও দোকানটা খুলতে পারে নি | হাবা বা হাবার দিদি ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেহাতি টোন টিটকিরি শোনে | হাবার দূর সম্পর্কের এক মামা হাবার মাকে রাজি করিয়ে নিয়েছে | নয়ডাতে বাঙালী গৃহস্থ বাড়িতে বাড়ির সর্বক্ষণের কাজ | ভাল মাইনে | কিন্তু হাবা রাজী নয় | সে নাকি বাবাকে ছেড়ে যাবে না | তার অনেক কাজ | হাবার মা হাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে | স্বামী গেছে কালুয়ার হাতে | এবার না ছেলেটাকেও বেঘোরে হারাতে হয় !
সেদিন বাড়ীতে দানাপানি নেই | হাবাকে নিয়ে দিদি কয়েকটা বাড়ি থেকে চেয়ে চিন্তে কিছু চাল ডাল জোগাড়ের চেষ্টায় বেরিয়েছে | নিস্তব্ধ দুপুর | ফেরার পথে দেখে বেঞ্চে সাক্ষাৎ যমের মতন কালুয়া বসে আছে | ওর সঙ্গীদের সাথে মদ খাচ্ছে | হাবা আর ওর দিদিকে দেখে উঠল বেঞ্চির থেকে | গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকল |
হাবার হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল ওর দিদি | হঠাৎ শন শন করে হাওয়ার গতি বাড়তে লাগল আর গগন ভেদ করে একটা কাক চিৎকার করে উঠল | এই চিৎকার হাবার খুব চেনা | অন্য কাকেদের চিৎকারের থেকে এটা আলাদা | শ্রাদ্ধের দিন সে এটাই শুনেছে | দিদির হাত টেনে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল হাবা |
“ দাঁড়াস না ভাই ! চল | চল |” কাতর চিৎকার করে উঠল দিদি | কাকটা ওদের মাথার ওপরে চক্কর দিচ্ছে | হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এলো একটা হাওয়ার ঘুর্নী ! শত শত গাছের পাতা আর প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে লাট্টুর মত হাওয়ার কুন্ডলী বিদ্যুতের বেগে ছুটে গেল ওদের সামনে দিয়ে | টর্নেডো ! ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে পরস্পরকে জাপ্টে ধরল ভাই আর বোন | হঠাৎ কড় কড় কড়াৎ করে একটা গগনবিদারী শব্দ হল | ঝড় থেমে গেলে অবাক বিস্ময়ে তারা দেখল, আমগাছটার মাথার একটা বড় অংশ মাটিতে পড়ে | যেন কেউ মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে কাণ্ড থেকে | তার তলায় জীবন্ত সমাধি হয়েছে কালুয়া আর তার চ্যালাদের | হাবাদের দোকানটা অদ্ভুত ভাবে অক্ষত রয়ে গেছে |
সেদিনের পর থেকে ওই কাকটাকে আর দেখে নি হাবা | তার চিৎকারও শোনে নি |
Facebook Comments