Site Overlay

হর্ণবিল উৎসব 

সুজয়া ধর

দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর আগের কথা। আমাদের বারাসাতের বাড়িতে আমার নাগা বন্ধু আতুর আসা কলকাতা ঘুরতে। সময়টা ছিল ঠিক পয়লা বৈশাখের আগে।আতুর কাছ থেকেই আমি প্রথম নাগাল্যান্ডের গল্প শুনি। ওখানকার বিভিন্ন উপজাতিদের ইতিহাস, জীবনকাহিনী জানতে পারি। গল্প প্রসঙ্গে ও আমায় হর্ণবিল ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার কথা বলে।সেই থেকেই ওখানে যাওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছে মনের কোণে রয়েই গেছে। ইচ্ছেটা সত্যি হলো গত বছর ২০২৩ এর ৩০ শে নভেম্বর। সোজা দিল্লি থেকে ডিমাপুর বিমানে। যখন আমি বিমানে উঠি, দেখলাম আমরা দু-তিন জন বাদে সবাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ; বুঝলাম যে পর্যটকদের কোন দেশ, ধর্ম জাতি এইসব দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। বিমানের পাইলট আর বিমানকর্মী বাদ দিয়ে আমাদের সবার গন্তব্যই এক, আমরা সামনের দশ দিন এক রূপকথার দেশে আনন্দে মাতোয়ারা হতে যাচ্ছি।ঠিক যেমন ছেলেবেলায় সিনেমাতে দেখেছি গুপী বাঘা  হাতে তালি মেরে রঙীন পোশাকে সজ্জিত হয়ে শুন্ডিতে পৌঁছে গেছিল সঙ্গীতের উৎসবে, ঠিক সেরকম। হর্ণবিল উৎসব, কোনো পাখির সমারোহ নয়, আদ্যোপান্ত নাগা উপজাতির গল্পগাঁথা। সেই গল্প বলতেই আমি হাজির।

নাগাল্যান্ড উপজাতিদের দেশ। ৬০% কৃষিজীবি তাই এদের নানা উৎসব চাষাবাদ ঘিরেই হয়। Ngada festival, Hega festival , Mim kut festival, Bushu festival, Tsukhenye festivall এবং আরো বেশ কিছু উৎসব পালিত হয় নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী। ৬৮ টি উপজাতি এবং দুগুনেরও বেশি ভাষা সমৃদ্ধ এই নাগা সমাজ । এদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হয় না ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায়। ঠিক এই কারণেই আন্তঃ উপজাতি সম্পর্ক স্থাপন ও নাগা সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে নাগাল্যান্ড সরকার এর সহযোগিতায় ২০০০ সালে শুরু হয় হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল। এইখানে বলে রাখি এই উৎসবের নাম হর্নবিল পাখির নামে । হর্ণবিল হল বাংলাতে ধনেশ পাখি।নাগাদের জীবন সংস্কৃতি এই পাখির সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে । যদিও নাগাল্যান্ডে এখন হর্নবিল পাখির দেখা পাওয়া যায় না।একে বলা হয় "Festival of Festivals"। ৬৮টি উপজাতির মধ্যে ১৭ টি উপজাতি ( চাং, আও, চাখেসাং, লোথা, কনিয়াক, রেংমা, কুকি, জেলাং, খামনুগাং, সুমি, সাংতাম, কোম, কাচারি, গারো, ইয়ামচুংরু, পচুরি, আংগামি ) অংশগ্রহণ করে এই উৎসবে।

নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা থেকে ১২ কিমি দূরে কিসামা গ্ৰামে নাগা হেরিটেজ ভিলেজে প্রতি বছর ১ থেকে ১০ তারিখ অবধি চলে এই উৎসব।বিশাল এলাকা জুড়ে এই ভিলেজ। মূল এরিনার চারিদিকে গ্যালারি করে বসার ব্যবস্থা। এখানে অনুষ্ঠিত হয় মূল অনুষ্ঠান। এর বাইরে চারদিক জুড়ে বিচিত্র সব স্টল, কোথাও বা সবজি (যার মধ্যে সগৌরবে বিরাজ করছেন নাগা ভূত জোলাকিয়া লঙ্কা, স্থানীয় ভাষায় অনেকেই রাজা মিরচিও বলে- যার ঝাল পৃথিবী বিখ্যাত) কোথাও বা ফুল ফল, পাশেই রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক প্যাভিলিয়ন । ১০ দিন ধরে চলে নানা প্রতিযোগিতা। কুস্তি, তিরন্দাজি, ভারোত্তলন, স্টোন পুলিং, নাগা লঙ্কা খাওয়া প্রভৃতি।

মেলা প্রাঙ্গণে প্রতিরূপ স্বরূপ গড়ে ওঠে বিভিন্ন উপজাতিদের " মোরং "। এই মোরং উপজাতি সমাজের গ্রামের প্রবেশপথে বা পাহাড়ের ঢালে তৈরি হয়। ১২ বছর হলেই সমস্ত ছেলেদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওখানে থাকার জন্য পূর্ণ যুবক না হওয়া অবধি। গ্রামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় এখান থেকেই। গাছের গুঁড়ি দিয়ে প্রবেশপথ সাজানো হয়। বিগত দিনে নরমুণ্ড শিকার করে এইখানেই টাঙিয়ে রাখা হতো, এখন অবশ্য তার দেখা মেলে না।নিজস্ব পোশাকে সজ্জিত হয়ে উপস্থিত থাকে ছেলে মেয়েরা এই মোরোং এ।

এবার আসি মূল উৎসবে । ১ তারিখ দুপুরে উদ্বোধন হয়, ১০ তারিখ পর্যন্ত সকালে ও দুপরে দুটি পর্যায়ে চলে অনুষ্ঠান। নাগা ঐতিহ্যমণ্ডিত পোশাকে বিভিন্ন উপজাতিদের নিজস্ব নাচ, গান, ছোট নাটক এর প্রদর্শন চলে। রং বেরং এর ঝলমলে পোশাকে সাবেকি অস্ত্র ও বাজনা নিয়ে এক একটা উপস্থাপনা চলতে থাকে আর দর্শক মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে। সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে সমবেত হয় এই সময়। বিভিন্ন হোটেল, হোম ষ্টে আর ক্যাম্প এ থেকে তারা ঘুরে বেড়ান সারাদিন এবং নানা স্থানীয় সাবেকি খাবার বা নানা দেশের খাবার খান। সঙ্গে জমে ওঠে চারিদিকে নেশা ধরানো রাইস বিয়ার এর ঘ্রাণ । এই ভিলেজের বাইরে ষ্টেডিয়ামে সন্ধ্যা বেলায় বসে রক ব্যান্ডের আসর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত রক মিউজিশিয়ানরা আসে তাঁদের দল নিয়ে। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমি দিল্লী থেকে সহযাত্রী হিসেবে সুদূর কলম্বিয়া ও সাউথ কোরিয়ার দুটি নামকরা রক ব্যান্ড এর দল কে পেয়ে ছিলাম । তাদের আন্তরিকতা মুগ্ধ করেছে আমায়। এক কথায় কিসামা গ্ৰামে তখন চাঁদের হাট বসে। আমারও সৌভাগ্য হয়েছে তাদেরকে সামনে থেকে দেখার, তাদের কথা, গান, বাজনা শোনার। তবে ২০২৩ এর হর্ণবিল এর প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বিখ্যাত ব্যাটমিন্টন খেলোয়াড় প্রকাশ পাডুকোন, ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া আর ছিলেন সঙ্গীত জগতের পন্ডিত বিশ্বমোহন ভাট ও তার মোহনবীণার সুর, যে সুরের মূর্ছনায় আবালবৃদ্ধবনিতা মেতে উঠেছেন।

স্থানীয় পর্যটন এই সময় বেশ জমে উঠে।কোহিমা শহরের ওয়ার সিমেট্রি, ওয়ার মেমোরিয়ালে ও মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইতিহাস নিয়ে। এগুলোর পাশাপাশি কোহিমা শহরের থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন গ্রাম ক্ষণমা। এই গ্রামকে ঘিরে আছে ৭০ বর্গ কিলোমিটার ঘন জঙ্গল যা অনেক বিরল প্রজাতির পশু ও গাছগাছালির নিশ্চিন্ত আস্তানা কারন গ্রামবাসীরা শিকার ও গাছ না কাটার শপথ নিয়েছেন অনেক আগেই। তাই ক্ষনমা ভারতের প্রথম ঘোষিত গ্রিন ভিলেজ। এই গ্ৰামের অনেক ইতিহাস আছে, সেই গল্প কোন এক সময় বলা যাবে।এছাড়া কিগুয়েমা, ভিসুয়েমা, কেকরিমা প্রভৃতি গ্রাম গুলো ঘুরে স্থানীয় মানুষ এর সাথে কথা বলা যায় এমনকি দু একজন বৃদ্ধ নরমুণ্ড শিকারির দেখাও মিলে যেতে পারে, যদিও আমার মেলে নি।এছাড়া এই সময় অনেকে পার্বত্য নাগাল্যান্ডের জুকু ভ্যালি ট্রেক ও করতে যায়, এই ট্রেক এর রাস্তা কিসামা থেকে শুরু হয়। এই উৎসব স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে,ছোট বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীরা বলতে গেলে সারা বছরের মুনাফা ঘরে তোলে।

উত্তর পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ডের এই প্রত্যন্ত গ্ৰামে দশ দিন ব্যাপী হর্ণবিল উৎসব মানুষকে এক অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে ফেলে আর তাই প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই দিনগুলিতে ওদের এই রঙীন নেশাতেই বুঁদ হয়ে থাকে।এই রেশ নিয়েই যে যার দেশে ফিরেও যায়। তবে এই নেশায় যারা একবার পড়েন আমার মতো তারা অবশ্যই বারবার যাওয়ার কথা ভাবে, মনে হবে গাঁটছড়াটা ওখানেই বেঁধে এলাম।

Facebook Comments