ধ্রুবজ্যোতি বাগচী
‘মানুষ অসভ্যতার সূতিকাগার হইতে বাহির হইয়া যতই সভ্যতার সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়াছে, ততই এই অচেতন মনের ভাণ্ডার বৃহৎ হইতে বৃহত্তর হইয়াছে, কারণ ততই তাহাকে তাহার সহজ প্রবৃত্তি-রূপ রিপুগুলিকে অবদমন করিয়া অচেতন মনোবিভাগের কারাগারে বন্দী করিয়া রাখিতে হইয়াছে। মানুষের যে ইচ্ছা পরিপূর্ণ হয় নাই, যে সকল কামন–বাসনা-লিপ্সা ‘উত্থায় হৃদি লীয়ন্তে’, সেগুলি এই বিভাগে আসিয়া শুধু ব্যক্তিগত জীবন কালেই নহে- বংশপরম্পরায় জমা হইতেছে ও আটক পড়িতেছে। পরিবারগত, সমাজগত, রাষ্ট্রগত ও কৃষ্টিগত শাসন-সংস্কার-বিধি-নিষেধের স্তুপের নীচে চাপা পড়া আমাদের বংশপরম্পরাগত সেই আদিম মন মরে নাই। সেই অবদমিত ইচ্ছাগুলির মুক্তিচেষ্টারও বিরাম নাই…’ (‘ফ্রয়েডের ভালবাসা’, নৃপেন্দ্রকুমার বসুর গ্রন্থের ‘মনের সৃষ্টিরহস্য’ অংশ থেকে উদ্ধৃত)। ‘সরস্বতী পুজোয় জোড়ে ঘুরলেই শাস্তি! হুমকি বজরং দলের’- গত বছর এমন একটি হুমকি সংবাদ মাধ্যমে প্রাকাশিত হয়েছিল, যা পাঠে আমাদের পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিতে লজ্জিত হতে হয়েছিল। যদিও এই সংবাদকে পাত্তা না দিয়ে প্রেম তার চিরায়ত রূপে সর্বদা হাজির। বিশেষত, সারস্বত দিনে এবং ভ্যালেন্টাইন দিবসে।
এবার আরও একটু পেছনে দৃষ্টি ফেরানো যাক।…কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করব।
ঘটনা (১)
মহিলাটি তার প্রাথমিক স্কুলে একসঙ্গে পড়া দুই বন্ধুর সঙ্গে নিজস্বী তুলে বন্ধু-দিবসে ফেসবুকে পোস্টিয়েছিল। পোস্টটি চোখে পড়ে তার স্বামীর। ব্যস্, শুরু হয় অবিরাম জেরা এবং মেয়েটির বাপের বাড়িতে সর্বসমক্ষে অপমান এবং প্রহার। অবশেষে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তার মৃত্যু। বাপের বাড়ির লোকজনের দাবি, এটি খুন।…বিয়ের পরও কেন তার ছেলে বন্ধু থাকবে? এই ছিল তার স্বামীর অভিযোগ এবং মেয়েটির অপরাধ।
আমাদের আদিম মন তাহলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, কৃষ্টি, শাসন-সংস্কার, বিধি নিষেধের স্তুপের নীচে বংশপরম্পরাগতভাবে চাপা পড়ে থাকে। আদিম মন মরে না। ফ্রয়েডিয় তত্ত্ব অনস্বীকার্য বা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্তরে নিহিত ধরে নিলেও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই আধুনিক কালেও কি আমরা, পুরুষরা, সম্পর্কজনিত আস্থা অটুট রাখার বিষয়ে সন্দেহরহিত? পক্ষান্তরে, এক শ্রেণীর আধুনিক মহিলারাও কি অত্যাধুনিক হওয়ার স্বেচ্ছাচারিতায় খানিকটা উন্মার্গগামী?
সন্দেহের বীজ উপ্ত হয় পর্ব থেকে পর্বান্তরে সাক্ষ্য প্রমাণের দলিলে। বৈবাহিক সম্পর্ক এই যুগে পরস্পরের প্রতি আনুগত্য বা বশ্যতা স্বীকারের শর্ত আরোপ করে না। অপরের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ- প্রবাদপ্রতিম এই বাক্য কি সম্পর্ক স্থায়ী রাখার বিষয়ে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে? তাহলে, স্কুলবয়সের বন্ধুদের সঙ্গে বহুদিন বাদে সাক্ষাৎ হওয়ার আনন্দে ‘বন্ধু দিবস’ উদ্যাপনের স্মৃতিকে অটুট রাখতে মেয়েটি, থুরি, বউটি সবান্ধব সেলফি তুলে ফ্রেসবুকে পোস্ট করতেন না। আট বছরের সন্তান যাদের আছে, ‘বিয়ের পর কেন ছেলে বন্ধু থাকবে?’ স্বামীর এই জোরালো দাবি কি তাহলে তার প্রাগৈতিহাসিক কুসংস্কারজাত বিষোদ্গার? আরও ছেলেমানুষি প্রশ্ন উচ্চারিত হয় স্বামীর কথায়, একটা ছেলের মেয়ে বন্ধু থাকতে পারে, কিন্তু একটা মেয়ের ছেলে বন্ধু থাকে কি করে? নাহ্, এই বালকসুলভ উচ্চারণ একজন সুস্থ স্বামী করতে পারেন না। অতএব, ভদ্রলোকের মস্তিস্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ঘটনা (২)
অপরদিকে অন্য একটি ঘটনায় জানা যাচ্ছে বাবার বারণ সত্ত্বেও প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙেননি বছর কুড়ির এক যুবক। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে মেয়েটিকে বিয়ে করার কথা জানায় সে। বাবার প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। এমতাবস্থায়, রাতে বাড়ির ছাদে ফোনালাপরত ছেলেকে দেখে ক্রোধোন্মত্ত বাবা ঈদের কুরবানিতে ব্যবহৃত ছুরি দিয়ে ছেলের পেটে কোপ মারেন। কুড়ি বছরের ছেলেটিকে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। ভবলীলা সাঙ্গ হয় প্রেমের জোয়ারে ভাসমান প্রেমিকের।…এক্ষেত্রে কি প্রমাণিত হয়? বাবার হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া ছেলের প্রতিক্রিয়া জানার আর কোনও পন্থা নেই। তাহলে এক্ষেত্রেও কি গ্রহণযোগ্য সত্য,…আমাদের আদিম মন মরে নাই?
‘প্রায় ক্ষেত্রে পুত্র যেমন অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে পিতার প্রতি একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব পোষণ করে, পিতাও অল্পবিস্তর তদ্রূপ ভাব পোষণ করেন।…আমরা ভুড়ি ভুড়ি শিক্ষিত পিতার কথা জানি যাঁহারা প্রথমজাত বা তৎপরবর্তীকালজাত শিশুতনয়ের প্রতি যুগপৎ স্নেহ ও বিদ্বেষভাব পোষণ করিয়াছেন।’ (একই গ্রন্থ- ‘পিতৃশাসন ও পুত্রবিদ্বেষের খেলা’ অংশ থেকে উৎকলিত)
গম্ভীর বিষয় বা তত্ত্ব সহযোগে বিষয়ের গভীরে প্রবিষ্ট হয়ে আলোচনায় নাই বা গেলাম। তবে মনে হয়, ‘সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি-’ বৃথাই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। সকলের জন্য নয় এই মানবিকতার বার্তা। সহজকে জটিল করে তোলাই আমাদের ধর্ম। একজন মহিলার পুরুষ বন্ধু থাকার অপরাধে তাকে যদি খুন করা হয়, তবে মিথ্যে আমাদের মান-হুঁশ সম্পন্ন জীবের বড়াই, মনুষ্যপদবাচ্য-অভিধার-অহংকার। অন্যদিকে, একজন যুবক তার প্রেমিকাকে বিয়ের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলার কারণে বাবার হাতে খুন হলে প্রমাণিত হয়, এগুলো মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার ধারক-বাহকদের কাজ। কিন্তু, এরাও তো মনুষ্যসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী অংশ।…‘প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে-বাঁধন খুলে দাও…’ কে খুলবে তবে বাঁধন?…এই সমাজে তো ‘প্রেমে পড়া বারণ’।
ঘটনা (৩)- সমপ্রেম অপরাধ কি না, এই বহুল চর্চিত বিষয়টিও যখন বিচারালয়ে সম্মান প্রাপ্ত হয় বা মর্যাদা পায়, তখন এর ভয়ানক পরিণতির দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল এই কয়েকদিন আগে।…দুই বন্ধু, তারা সমকামী। স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, জীবনে বিয়ে করবে না কেউ। একসঙ্গেই থাকছিল। সরস্বতী পুজোর দিন ফেসবুকে পরিচিতির সুবাদে একজনের এক কাশ্মিরী বন্ধু তার বাড়িতে আসে। অপরজন তীব্র আপত্তি জানায়।…অভিমানে ‘ত্রিকোণ’ প্রেমের সন্দিগ্ধ পরিণতি হয়, একজনের অভিমানাহত আত্মহনন।…প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, প্রেমে পড়া কি বারণ?…এক বিখ্যাত আইনজীবী, স্বঘোষিত সমকামীর কলেজিয়ামের সদস্য পদ সমকামিতার প্রসঙ্গে খারিজ করে না দেশের শীর্ষ আদালত। কারণ, ব্যক্তিগত অভিমুখ তার কৃতিত্বের পরিচয়কে অস্বীকার করে না।
বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে কত পরিবারে শান্তি বিঘ্নিত হয়। চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয় একজন প্রেমিক বা প্রেমিকাকে। হাত কাঁপে না শানিত অস্ত্রে কারুর দেহাংশ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে।ফ্রিজে টুকরো টুকরো করে দেহাংশ রেখে দেওয়া হয়, বাড়ির পাশে পচা-গলা মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় কয়েকদিন পর। হরবখত্ ঘটে যাওয়া এবংবিধ ঘটনা কি প্রমাণ করে না আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিক আঁধারকে?
পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে পোপ গেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভ্যালেন্টাইনস-ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। ইতিহাস বলে, সন্ত ভ্যালেন্টাইন ছিলেন রোমের বাসিন্দা, পুরোহিত, চিকিৎসক। তাঁর আত্মত্যাগের স্মরণে উদ্যাপিত হয়েছিল এই দিবস।…হাল ফ্যাশনের এই দিনটিতে প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে গোলাপ থাকাটা মাস্ট। তাদের কাছে প্রেম-পার্বণ, ১৪ ফেব্রুয়ারি। তবে স্মর্তব্য, যে কেউই এই দিনটিতে তার প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতে পারে। প্রেম নিবেদন করতে পারে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা আত্মজন- সবারই জন্য ভ্যালেন্টাইন-দিবস। এক্সক্লুসিভলি প্রেমিক-প্রেমিকার দিন নয় মোটেই ভ্যালেন্টাইন-ডে।
সরস্বতী পুজোর দিনটিও যে কবে থেকে বাঙালির প্রেম-দিবসে পরিণত হল, সেই বিতর্কে নাই বা গেলাম। কিন্তু, এদিন বন্ধু-বন্ধুনি বা প্রেমিক-প্রেমিকারা যুগলে ঘোরেন যত্রতত্র। পার্ক, রেস্তঁরা, মল, মাল্টিপ্লেক্সে তাদের প্রেম-বিচরণ। একটু আধটু ফস্টিনস্টি, শরীরী স্পর্শ, তাও যদি হয়ে থাকে, হতেই পারে। প্রেম যে চিরকালীন প্লেটোনিয়ান হবে, তাই বা কে দিব্যি দিয়েছে?…হ্যাঁ, জনগণের চোখের সামনে প্রকাশ্যে চুম্বন, আলিঙ্গন নীতিপুলিশদের না-পসন্দ্। কিন্তু, এই দিনটি অলিখিত ভ্যালেন্টাইন্স-ডেতে রূপান্তরিত হওয়ার বিরুদ্ধে ফরমান জারি করার হক দিল কে দিয়েছিল বজরং দলকে? কে কার সঙ্গে ঘুরবে, থাকবে, কে কি খাবে এসবের অধিকার একান্তই ব্যক্তিগত নয়?…কণারক মন্দিরের মিথুন দৃশ্যর বহিরঙ্গটাই শুধু দেখব? অন্তর্নিহিতার্থ অনুধাবনের চেষ্টা করব না?…তরুণ প্রজন্মের একান্ত অতিবাহিত হওয়ার প্রেম-দিবস, সরস্বতী পুজো বা ভ্যালেন্টাইন-দিবসে যুগল ভ্রমণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া যায়? সতর্কীকরণ অমান্য করলে কড়া ব্যবস্থা নিতেও পিছপা হবে না, এ পোস্টারের নিচে ছাপা অক্ষরে বজরং দলের নাম ছিল। খবরটি চমকে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট … ভারতীয় সংস্কৃতিকে মান্যতা দিতে হলে বহুত্ কিছু ছাড়তে হবে, এমন অস্বাভাবিক নির্দেশকে মান্যতা দেওয়া যায় কি? তাহলে নেতাদের মুখনিঃসৃত অবিরাম অকথা-কুকথার বন্যা কোন্ সংস্কৃতির ধারক-বাহক এ প্রশ্নও কিন্তু উত্থাপিত হবে।
প্রেম-দিবস নিঃসঙ্কোচে অশালীনতার সীমারেখাকে টপকে না গিয়ে পালিত হোক, এটুকুই কামনা। ‘প্রেমের জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে, বাঁধন খুলে দাও…’ হ্যাঁ, বাঁধন কিন্তু খুলে দিতেই হবে। তবে, তা যেন কারুর চক্ষু পীড়ার কারণ না হয়।
Facebook Comments