Site Overlay

অপ্রকাশিত

আকাশ রায়

“অবনীশ, এই অবনীশ!… চিনতে পারছিস?…… আমি আর্য, তোর স্কুল ফ্রেন্ড…..তোর পত্রমিতালী। আমার লেখাগুলো একটু খুঁজে দে না….কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছিনা…তুইই আমার শেষ ভরসা ভাই।”… অবচেতন মনে এই কথাগুলো কানে যাওয়ার সাথে সাথে একটা বরফের মতন ঠান্ডা ছ্যাঁকা লাগলো যেন অবনীশের লেপের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হাতে।

গভীর ঘুমটা এক ঝটকায় ভেঙে গেলো, আর “কে?” বলে চিৎকার করে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো অবনীশ। সহসা উত্তেজনায় হার্টবিটটা যেন অনেকটাই বেড়ে গেলো তার। কয়েক সেকেন্ড হতবাক হয়ে বোকার মতন তাকিয়ে থাকলো সে, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা একটু দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়লোনা তার। মোবাইলটাও চার্জে বসানো আছে হলঘরে। অন্ধকারে চোখটা একটু সয়ে গেলেপরে ডান হাতটা বাড়িয়ে ঘরের আলোটা জ্বালালো অবনীশ। নাহ, কেউ তো কোথাও নেই। চারিদিক পরিষ্কার। দেয়ালঘড়িতে দেখলো রাত দুটো বাজে। স্বপ্নই দেখছিলো নিশ্চই। কিন্তু হঠাৎ তার খেয়াল হলো, তার বাম হাতের পাতাটা কেমন যেন অসাড় লাগছে। ডানহাত দিয়ে সেটা ছুঁতেই চমকে উঠলো সে। বরফের মতন ঠান্ডা। এবার একটু নড়ে চড়ে বসলো অবনীশ। বিদ্যুতের মতো একটা শিরশিরানি যেন সহসা তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে চলে গেলো। যতটুকু ঘুমের ঘোর ছিল, সব এক পলকে উড়ে গেলো তার।

আর্য কি তাহলে সুস্থ হয়ে গেছে? কানাডা থেকে ইন্ডিয়া ফিরে এসেছে? কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব! আর্যকে সে শেষবারের মতন সামনা-সামনি দেখেছিলো, তাও প্রায় দশ বছর আগে। আর্যদেরই বাড়িতে। অবনীশের পরিষ্কার মনে আছে সেই দিনটার কথা। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার শেষ দিন ছিল সেটা। পরীক্ষা দিয়ে সোজাসুজি আর্যদের বাড়ি চলে গেছিলো অবনীশ; কারণ অসুস্থতার জন্য আর্য পরীক্ষা দিতে পারেনি সেবার। তখনই ও বেশ অসুস্থ ছিল আর মাঝে মাঝেই অসংলগ্ন ব্যবহার করছিলো। অবনীশকেও চিনতে পারেনি সে। অথচ তার মাস তিনেক আগেই আর্যের সাথে দেখা করে গেছিলো অবনীশ। কারণ তারও মাস দু-তিন আগে থেকেই আর্যের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিলো। আর্য অবনীশের সাথে বেশ কিছুক্ষন কথাও বলেছিলো সেদিন। যদিও কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে যাচ্ছিলো সে, আর নিজে নিজেই বিড়বিড় করে কিসব বলছিলো। কিন্তু এবার আর্য অবনীশকে চিনতে না পারাতে খুব দুঃখ পেয়েছিলো অবনীশ। মাথা নিচু করে হতাশ মনে বেরিয়ে চলে এসেছিলো আর্যদের বাড়ি থেকে। বাড়িতে ওর বাবা-মা ছিলেন না তখন। এক পুরোনো আয়া মাসি ছিলেন। তিনিই অবনীশকে একটা প্লেটে করে মিষ্টি আর গ্লাসে জল এনে দিয়েছিলেন। অবনীশ যখন বেরোচ্ছিল তখন উনি বলেছিলেন আর্য নাকি আজকাল নিজের বাবা-মাকেও চিনতে পারেনা। আর তারপরতো অবনীশের বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন আসানসোলে। অবনীশও সেখানে কলেজে ভর্তি হলো। মাঝেসাঝে আর্যের খবর পেতো। দিনকে দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিলো ওর শরীর। পরে জানা গেছিলো আর্য নাকি একটা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, যেটা নাকি হলেও বেশি বয়সীদেরই হয়। আর আর্যর বয়েসে সেটা হওয়াটা ছিল রেয়ারেস্ট অফ দা রেয়ার কেস। রোগটার নামটাও মনে আছে অবনীশের – “ইয়ং অনসেট ডিমেনশিয়া”।

বছর তিনেক আগে অবনীশ শেষবারের মতন খবর পেয়েছিলো যে আর্যের রোগটা খুব বাড়াবাড়ি জায়গায় পৌঁছে গেছে। সে কাউকে আর চিনতে পারতোনা, জড় পদার্থের মতন হয়ে গেছিলো। ইন্ডিয়াতে ওই রোগের ভালো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বলে আর্যের বাবা-মা ওকে কানাডাতে এক কাকার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নামী নিউরোলজিস্ট, আর কানাডাতেই সেট্লড ছিলেন। আসলে আর্যদের পরিবারটা ছিল খুবই শিক্ষিত।। ওর বাবা ছিলেন প্রোফেসর আর মা ছিলেন একটা নামী হাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস। ওদের অনেক আত্মীয়-স্বজন দেশে বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন, যাঁরা নিজের নিজের ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সায়েন্টিস্ট আবার কেউবা প্রোফেসর।

এরপর অবনীশ আর্যের আর কোনো খবর পায়ওনি, নেওয়ার চেষ্টাও করেনি। নিজের পড়াশুনা, কেরিয়ার, চাকরি – এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। সাধারণত মানুষ যেটা নিয়ে ভাবে, তারই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আর্যের কথা তো সে এর মধ্যে একবারও ভাবেনি। বিশেষ করে যখন অবনীশ বুঝে গেছিলো যে আর্যের সুস্থ হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই, তখন সাময়িক ভাবে দুঃখ পেলেও সময়ের সাথে সাথে সে সেটা মেনেও নিয়েছিল। আর উঠতি কবি হিসেবে যবে থেকে অবনীশের একটু-আধটু নাম-ডাক হতে শুরু করেছিল তবে থেকেতো অবনীশ ক্রমাগত চেষ্টাই করে গেছে আর্যকে ভুলে থাকার। তার জন্য অনবরত নিজের সাথে নিজে লড়াইও করে গেছে সে। তাই একটা অপরাধবোধও জমাট বাঁধছিলো ওর মনের মধ্যে।

অবনীশ রেলে চাকরি করে উত্তর প্রদেশের গোরখপুরে, আর রেলের কোয়ার্টারে একাই থাকে। জানুয়ারি মাস, কনকনে ঠান্ডা এখন গোরখপুরে। বছর খানেক হলো ওর পোস্টিং হয়েছে এখানে। রেল কলোনিতে এমনিতেই লোকজন কম, নিঃঝুম পরিবেশ। আর এই সময়টায় রাত আটটার পরে লোকে খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোয়ও না। তাই অবনীশও অফিস থেকে ফিরে সয়াবিনের তরকারি আর রুটি খেয়ে সাড়ে নটার মধ্যেই বিছানায় কম্বলের নিচে চলে এসেছিলো। আর এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছিল। তার পরে এই উদ্ভট হয়রানি। একবার সে ভাবলো উঠে হলঘরটা দেখে আসবে। কিন্তু সে যেতে পারলো না। শরীরটা যেন কেমন অসাড় লাগছে, আর এই ঠান্ডাতেও অবনীশের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। আসলে এরকম অনুভূতি আগে কোনোদিন হয়নি অবনীশের। স্বপ্ন যে সে দেখেনা তা নয়, কিন্তু আজকের মতো এরকম জীবন্ত স্বপ্ন সে আগে কোনোদিন দেখেনি। মনে হয়েছিল যেন সত্যি তার ছোটবেলার বন্ধু এসে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে ডাকছে। গলাটা স্পষ্ট শুনেছিলো সে; পরিষ্কার আর্যর গলা। শুধু তাই নয়, সে যেন ঘরের মধ্যে অনুভবও করেছিল আর্যর উপস্থিতি। আর বাম হাতটা হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে যাওয়াটাতো কোনো যুক্তি দিয়েই ব্যাখ্যা করতে পারছিলোনা সে। আরো কিছুক্ষন এইভাবে কাটলো। সময়ের সাথে সাথে একটু ধাতস্থ হলো অবনীশ। মনে মনে মা কালীকে স্বরণ করে, একটু সাহস সঞ্চয় করলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। তারপর টয়লেট যাওয়ার জন্য অবশেষে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ঘড়িতে দেখলো সাড়ে তিনটে বাজে।

ফার্স্ট ফ্লোরে ওয়ান বেডরুম কোয়ার্টার অবনীশের। খুব বড়ো না হলেও, ওর একার পক্ষে যথেষ্ট। দরজা খুলেই একটা মাঝারি সাইজের হল ঘর-কাম-ডাইনিং। ডানদিকে রান্না ঘর, আর বামদিকে টয়লেট। সোজা এগিয়ে গেলে একমাত্র বেডরুম। হল ঘরে একদিকে রয়েছে একটা বেতের সোফা, চৌকো টি-টেবিল, আর অন্য দিকে একটা রট আয়রনের গোল ডাইনিং টেবিল আর চারটে চেয়ার। বেড রুমে রয়েছে একটা সিঙ্গেল খাট। অবনীশের একটু পড়ার আর লেখার শখ আছে। তাই খাটের পাশেই রাখা আছে একটা বড় স্টাডি টেবিল আর সঙ্গে চেয়ার। টেবিলে থাকে থাকে সাজানো আছে অনেক কবিতা আর গল্পের বই। ঘরের অন্য দিকে রয়েছে একটা লোহার আলমারি আর জামা-কাপড় রাখার একটা ওয়ারড্রোব। সেখানে কয়েকটা থাকে জামা কাপড় থাকলেও বেশিরভাগটাই জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন বই। এখানে তার বন্ধুবান্ধব তেমন কেউ নেই, আর অফিসার সহকর্মীরাও বেশিরভাগই বিবাহিত সংসারী মানুষ। তাই এখন বইই তার সব থেকে ভালো বন্ধু। ঘুমানোর সময় সোয়েটারটা খুলে চেয়ারে রেখেছিলো অবনীশ। সেখান থেকে সোয়েটারটা নিয়ে গায়ে গলিয়ে, পায়ে চপ্পল পরে হলঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

টয়লেট থেকে বেরোনোর সময় বেসিনের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই অবাক হলো অবনীশ। আঠাশ বছরের একজন সুপুরুষ সে। নিয়মিত ব্যায়াম করা সুঠাম চেহারা। মুখ চোখও তার বেশ পরিষ্কার। কিন্তু আয়নায় যাকে দেখলো, সে যেন এক অন্য মানুষ। এই কয়েকঘন্টায় যেন তার বয়েসটাই বেড়ে গেছে কয়েকবছর। রাতজাগা ক্লান্ত অবসন্ন শরীরের সাথে তার মুখে-চোখে মিশে ছিল একটা চাপা আতঙ্কের ছাপ। বেশ কয়েকবার চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিলো সে। তারপর তোয়ালেতে মুখ মুছে হলঘর পেরিয়ে বেডরুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। বেডরুমের দরজায় একটা পাতলা পর্দা টাঙানো। বেডরুমে আলো জ্বলছে বলে সেই পর্দার ভেতর দিয়ে বেডরুমের ভেতরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। অবনীশের মনে হলো কেউ যেন লাল জ্যাকেট বা সোয়েটার পরে টেবিলের দিকে ঝুঁকে তার বই-খাতা ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ঘরে কি তবে চোর ঢুকেছে?

পুলিশের ছেলে সে, একমুহূর্তে ভয়টা সরিয়ে ফেলে সতর্ক হয়ে গেলো অবনীশ। পা টিপে টিপে দরজার কোনার দিকে চলে গিয়ে পর্দাটা অল্প সরিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার, ভেতরে কেউ নেই! এটা কি করে সম্ভব? সে নিশ্চিত যে ঘরে কেউ ছিলো। কিন্তু সে গেলো কোথায়? হাওয়ায় তো উবে যাবেনা! ঘরে আসবাব বিশেষ নেই বলে লুকানোর তেমন কোনো জায়গাও নেই। আর ঘর থেকে বেরোনোর একটাই দরজা, সেখানে অবনীশ নিজেই দাঁড়িয়ে আছে। খাটটাও বক্স খাট। তার নিচে একটা মানুষের লুকিয়ে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। জানালাগুলোও সব বন্ধ। তবু ভালো করে দেখার জন্য আস্তে করে পা টিপেটিপে ঘরে ঢুকলো অবনীশ। আশপাশটা ভালো করে দেখলো। নাহ, কেউ কোথাও নেই। নিশ্চই ভয়ের চোটে সে ভুল দেখেছে বা মনে মনে ঘরে কেউ আছে সেটা কল্পনা করে নিয়েছে সে। এবার সে স্টাডি টেবিলটার দিকে ভালোভাবে তাকাতেই তার আতঙ্কটা আবার ফিরে এলো, এবং এবার আরও বেশি করে। কারণ, সে দেখলো স্টাডি টেবিলের ওপর বই-খাতা গুলো এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে রাখা। অথচ টয়লেট যাবার আগেও সেগুলো গুছিয়ে রাখা ছিল, সোয়েটার পরার সময় পরিষ্কার দেখেছিলো অবনীশ।

আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলোনা অবনীশ। একটা অস্ফুট চিৎকার করে একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরে চলে এলো সে। মাথাটা যেন কেমন টনটন করে উঠলো তার। তার নিজের বেডরুমটাই যেন আজ তাকে গিলে খাচ্ছিলো। অথচ এই ঘরটাই তার সব থেকে প্রিয়। এই কোয়ার্টারে থাকার বেশিরভাগ সময়টাই সে কাটায় এই বেডরুমে – হয় স্টাডি টেবিলে লেখালেখি করে, অথবা বই পড়ে, অথবা বিছানায় শুয়ে। কিন্তু আজ একটা স্বপ্ন আর তার পরের কিছু ঘটনা সব কিছু কেমন যেন ওলটপালট করে দিচ্ছিলো। সে কোনোরকমে মোবাইলটা হাতে নিয়ে, কানঢাকা একটা টুপি পরে নিজের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে পড়লো। টিমটিম করে জ্বলা সিঁড়ির আলোতেই পড়িমরি করে নেমে সামনের ঢালাই করা রাস্তায় চলে এসে তবে একটু থামলো অবনীশ। মোবাইলে দেখলো চারটে মতন বাজে, আর বাইরে রীতিমতন অন্ধকার। রাস্তার ধারে লাইট পোস্টে কয়েকটা লাইট জ্বলছে। রাস্তার বাঁদিকে রেল কলোনির একটা বড় খেলার মাঠ আর তার উল্টো দিকে বাচ্চাদের একটা পার্ক। ঢালাই রাস্তাটা চৌকো মাঠটাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। একপাক প্রায় এক কিলোমিটার। সকালের দিকে কিছু লোক সেখানে মর্নিং ওয়াক করতেন। অবনীশও মাঝে সাঝে ওয়াকিং বা জগিং এ যেত। কিন্তু শীতটা জমিয়ে পড়ার পর থেকে সেসব সাময়িক ভাবে বন্ধ। রাস্তাটা একদম সুনসান, জনমানবশূন্য। আর তাছাড়া ঠান্ডার সময় এই অন্ধকারে ভোর চারটের সময় কেই বা বেরোবে। অবনীশ সেই রাস্তা বরাবর হাঁটা শুরু করে দিলো। মাঠে শুয়ে থাকা কয়েকটা মুখচেনা কুকুর অবনীশকে এই অসময়ে দেখে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু অবনীশের সেসব দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিলোনা। সে যেকোনোভাবে চাইছিলো সময়টা পার করতে, খোলামনে একটু চিন্তা করতে। একবার ভেবেছিলো মাকে ফোন করবে, কিন্তু ফোনটা করতে গিয়েও করতে পারেনি। এতো ভোরে ফোন করে বয়স্ক বাবা-মাকে অহেতুক আতঙ্কিত করার কোনো মানে হয়না। উদাস মনে সে হনহন করে হাঁটতে থাকলো আর তার মনটা এক মুহূর্তে পৌঁছে গেলো বারো তেরো বছর আগে, যখন ওর বাবার পোস্টিং হয়েছিল শেয়ালদাতে আর অবনীশ ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিল মানিকতলার একটা গভর্নমেন্ট স্কুলে। আর্যের সাথে তার পরিচয় সেই স্কুলেই।

আর্যও ক্লাস ইলেভেনে নতুন ভর্তি হয়েছিল সেই বছর। খুব শান্ত চুপচাপ স্বভাবের ছেলে ছিল আর্য; অনেকটা অবনীশেরই মতন। তার ওপর নতুন স্কুলে ওকেও মানিয়ে নিতে হচ্ছিলো। তাই অবনীশের সাথে আর্যর বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি। দুজনেই শান্ত স্বভাবের আর স্কুলে নতুন হওয়াতে দুজনকেই একটু-আধটু আওয়াজ, টিটকিরি শুনতে হতো পুরোনো ছাত্রদের থেকে। তার পর অবনীশ যখন শুনলো আর্যের হবি কবিতা লেখা, তখন বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হলো। কারণ অবনীশেরও কবিতা লেখার বেশ শখ ছিল তখন। যেহেতু স্কুলের পরিবেশটা কবিতার জন্য একেবারেই অনুকূল ছিলোনা, ওরা ঠিক করেছিল ওরা পত্রমিতালী বা pen-friend হবে। আর চিঠির মূল বিষয় হবে কবিতা। সেই থেকে ওরা পরস্পরকে চিঠিতে স্বরচিত কবিতা লিখে পাঠাতে শুরু করলো। দু-তিন পর্ব চিঠি আদান-প্রদানের পরেই অবনীশ বুঝে গেছিলো আর্যের লেখার ক্লাসটাই ছিল আলাদা। অবনীশের লেখার থেকে অনেক অনেক উন্নত মানের। কথায় বলে সৎসঙ্গে স্বর্গবাস। আর্যের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অবনীশও আগের থেকে অনেক ভালো লিখতে শুরু করেছিলো। বেশ কিছুদিন এভাবে যাওয়ার পরে একদিন আর্যের অনুরোধে ওদের বাড়ি গেছিলো অবনীশ। কারণ আর্য বলেছিলো ওকে একটা জিনিস দেখাবে।

আনমনা ভাবে পুরোনো-নতুন হাজারো কথা কথা ভাবতে ভাবতে অনেকগুলো পাক হাঁটা হয়ে গেলো অবনীশের। এই শীতেও একটু গরম লাগতে শুরু করলো তার। মাথার টুপিটা খুলে ফেলে মাঠের ধারে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো সে। কয়েকজন বয়স্ক লোক মাঠে হাঁটাহাঁটি, যোগ-ব্যায়াম শুরু করছেন। মোবাইলে দেখলো সাড়ে ছটা বেজে গেছে। দিনের আলো একটু একটু ফুটতে শুরু করেছে। এবার মাকে ফোন করলো সে। কারণ অবনীশদের বাড়িতে সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে, আর সাড়ে ছটার মধ্যে তো চাও খাওয়া হয়ে যায়।

মায়ের মন, ফোনে অবনীশের গলা শুনেই জিজ্ঞেস করলেন তার শরীর ঠিক আছে কিনা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবনীশকে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলতে হলো যে ওর একটু ঠান্ডা লেগেছে। সেটা শুনে আর কথা না বাড়িয়ে উল্টে অনিতা দেবীই বললেন যে উনি সকাল হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। অবনীশকে তাঁর কয়েকটা ঘটনা বলার আছে। অবনীশের ফোন না আসলে উনিই ফোন করতেন তাকে। আগের দিন নাকি মাঝ রাতে কিছু একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেছিলো অনিতা দেবীর। অবনীশের বাবা, অনিমেষ বাবুর নাইট ডিউটি ছিল বলে অনিতা দেবী একাই ছিলেন বাড়িতে। শব্দটা আসছিলো পাশের ঘর থেকে। যেটা অবনীশের ঘর। বইয়ের আলমারিটা খোলার শব্দ। কিন্তু ওই ঘরে তো কেউ নেই। শেষে কি খোদ রেল পুলিশের ফ্ল্যাটে চোর ঢুকলো? কয়েকবার ‘কে’ বলে চিৎকার করে মাথার কাছ থেকে টর্চটা জ্বালিয়ে অনিতা দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে হল ঘরের আলোটা জ্বালাতেই তাঁর মনে হলো হুশ করে একটা মানুষ যেন এক মুহূর্তে বেরিয়ে গেলো অবনীশের ঘর থেকে। অথচ আশেপাশে কেউ ছিলোনা। খুব ঘাবড়ে গিয়ে অনিতা দেবী অবনীশের বাবাকে ফোন করাতে তিনি এক রেল পুলিশের অফিসারকে পাঠালেন। তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলেননা। আরও অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, অবনীশের ঘরটা খুলে দেখা গেলো বইয়ের আলমারির পাল্লাটা খোলা আর ভেতরের বইগুলোও ওলোটপালোট হয়ে আছে। এটা শুনেই আবার আগের রাতের ভয়টা ফিরে এলো অবনীশের, যেটা সে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিল। কাঁপা গলায় সে মাকে জিজ্ঞেস করলো যে তিনি মানুষটাকে চিনতে পেরেছিলেন কিনা আর সে কি রঙের জামা পড়েছিল। অত অল্প সময়ে ঘুম চোখে তাকে চিনতে না পারলেও তার জামার রংটা পরিষ্কার মনে ছিল অনিতা দেবীর। রংটা ছিল লাল।

ভয় জিনিসটা বড় অদ্ভুত। সেটা যতটা না থাকে কোনো পোড়ো বাড়িতে, বা কোনো ভয়ের সিনেমায়, তার থেকে অনেক বেশি থাকে মানুষের মনে। মানুষই বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজের মনেই অনেক কিছু কল্পনা করে নেয়, আর ভয় পায়। তাই গুজব শোনা গ্রামের মানুষ কখনো জোৎস্না রাতে হাওয়ায় নড়া কলাপাতাকে দেখে সাদা শাড়িপরা পেত্নী কল্পনা করে ভয় পায়। আবার ছোট ছেলেমেয়েরা কখনো অমাবস্যার রাতে অন্ধকার ঘরে চোদ্দ ভূতের ভয় পায়, আবার বর্ষার সন্ধ্যায় লোডশেডিং এর সময় একটা গাঁজাখুরি ভয়ের গল্প শুনেও ভয়ে কেঁপে ওঠে। অবনীশেরও মনে মনে একটা সুপ্ত ভয় বেশ কয়েক বছর ধরেই ছিল। আর আগের রাতের ঘটনাগুলো সেটাকে আরও প্রবল ভাবে জাগিয়ে তুলেছিল। সে চেষ্টা করেও কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলোনা। আস্তে আস্তে যেন হ্যালুসিনেশনে শিকার হচ্ছিলো। তাই দিনের বেলাতেও লোকভর্তি ট্রেনের কামরায় সে বেশ কয়েকবার ভয় পেয়ে চমকে উঠেছে। বিশেষ করে লাল রঙের সোয়েটার বা জ্যাকেট পরা কাউকে দেখলেই তাকে আর্য বলে কল্পনা করে নিচ্ছিলো। বিকেল সাড়ে চারটে বাজে, প্রায় পাঁচ ঘন্টা হলো সে গোরখপুর-শিয়ালদা স্পেশাল ট্রেনে চেপেছে। একটু আগে ট্রেনটা ছাপড়া ছাড়লো। শেয়ালদা পৌঁছনোর কথা পরদিন সকাল সাড়ে ছটায়। আরও চোদ্দ ঘন্টা যে সে কিভাবে কাটাবে কে জানে। রেলের স্টাফ হওয়াতে আর চেনা টিটি থাকাতে একটা সিটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সকাল সাড়ে এগারোটায় ট্রেন চাপার আগে একবার অফিস যেতে হয়েছিল। বড়সাহেব অবনীশকে খুব স্নেহ করেন। ওকে দেখেই বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে। তাই অবনীশ তিন দিনের ছুটি চাওয়াতে কোনো আপত্তি করেননি, এটা জেনেও যে দু সপ্তাহ পরে অবনীশের একটা সাতদিনের ছুটি আগে থেকেই নেওয়া আছে। আসলে ওই সময় কলকাতা বইমেলা, আর অবনীশের একটা কবিতার বই সেখানে প্রকাশিত হবে।

ট্রেনে রাতটা প্রায় জেগেই কাটলো অবনীশের। একেতো হাজারো চিন্তা মাথায় ভিড় করছিলো, তার ওপর একটা ভয়ও ছিল যে ঘুমোলে পাছে আবার স্বপ্নটা দেখে। রাতটা পেরিয়ে দিনের আলো ফুটলো। ট্রেন প্রায় এক ঘন্টা লেট, তাই নৈহাটী পেরোতেই মাকে ফোনে জানিয়ে দিলো অবনীশ যে ওর বাড়ি ঢুকতে একটু দেরি হবে। কিছু কাজ আছে, সেগুলো সেরে বাড়ি ফিরে বাবা-মায়ের সঙ্গে একসাথে লাঞ্চ করবে সে। ট্রেন শেয়ালদা পৌঁছতেই অবনীশ ব্যাকপ্যাক কাঁধে চাপিয়ে সোজা হাঁটা দিলো সুরেন্দ্রনাথ কলেজের দিকে, কারণ আর্যদের বাড়িটা ওদিকেই, অখিল মিস্ত্রি লেনে। বাড়ির সদর দরজা খোলাই ছিল আর ভেতরে লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। অবনীশ ভেতরে ঢুকে দেখলো হল ঘরে কিছু লোকজন জড়ো হয়েছেন, আর কিছু একটা নিয়ে ফিসফাস আলোচনা চলছে। দূরে এক কোনায় সোফাতে আর্যের বাবা আর মা কার্যত বিদ্ধস্ত অবস্থায় বসে আছেন; এক বয়স্ক মহিলা ওদের অনেক কিছু বোঝাচ্ছেন আর সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক অবনীশের দিকে এগিয়ে এলেন, পরে জানা গেলো তিনি আর্যের কাকা হন। বেশ মিশুকে মানুষ। অবনীশ আর্যের ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু শুনে উনি অবনীশকে অন্য দিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন আর পুরো ব্যাপারটা বললেন।

তাঁর কাছ থেকেই অবনীশ জানতে পারলো যে কানাডার টরোন্টোতে একটা রিহ্যাব সেন্টারে আর্যের চিকিৎসা চলছিল গত কয়েকবছর ধরে। যদিও চিকিৎসায় তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলো না। আর্য কথাবার্তা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলো। জড় পদার্থের মতোই শুয়ে-বসে থাকতো দিনরাত। যদিও কোনো উপদ্রবও করতোনা। বসিয়ে দিলে বসে থাকতো, শুইয়ে দিলে শুয়ে থাকতো। খেতে বললে খেত, টয়লেটও নিজেই যেত। তিনদিন আগে, অর্থাৎ রবিবার, ওখানকার সন্ধেবেলা থেকে আর্যকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ওইদিন সকাল থেকেই আর্য একটু অন্য রকম ব্যবহার শুরু করেছিল। নিজে নিজেই বকবক করছিল, মাঝে দু-একবার চেঁচিয়েও উঠছিলো। খবর পেয়ে ওর কাকাও এসে ওর সাথে দেখা করে গেছিলেন। সেদিন নাকি অনেক বছর পরে ও কাকাকে চিনতে পেরেছিলো আর ডক্টর না বলে কাকু বলে সম্বোধন করেছিল। নিজের বাবা-মার কথা জিজ্ঞেসও করেছিল এতো বছরে প্রথমবার। বাবা-মার সাথে ভিডিও কলে দু-একটা কথাও বলেছিলো সে। সবাই আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। সন্ধেবেলা নার্স ওয়াশরুম থেকে এসে দেখেন ঘর খালি আর বাইরে যাওয়ার দরজাটার খোলা, যদিও সেটা চাবি দিয়ে লক করা ছিল। পরে সিসিটিভিতে দেখা যায় আর্য বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল, বা বলা ভালো ঘুমের ভান করে অপেক্ষা করছিলো। নার্স ওয়াশরুমে যেতেই আর্য বিছানা ছেড়ে উঠে চাবি রাখার জায়গা থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়। কাকার মোবাইলে সিসিটিভি ফুটেজটাও দেখলো অবনীশ। দেখলো তার বড় আর মোটাসোটা হয়ে যাওয়া বন্ধু ঘরের লক খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর তার পরনে একটা লাল রঙের জ্যাকেট।

পুলিশে খবর দেওয়া হলেও, ওইদিন আর্যকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনিতেই ওইদেশে এখন ভয়ঙ্কর শীত, আর সন্ধে থেকে খুব স্নো-ফলও হতে শুরু করেছিল সেদিন। আর সন্ধেটা বাড়তেই এমন ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়েছিল যে আর্যকে খোঁজাখুঁজিটা সাময়িক ভাবে বন্ধই রাখতে হয়েছিল পুলিশকে। আবহাওয়া একটু ভালো হওয়ার পর আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হয় পরদিন সকালে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, অবশেষে ওখানকার সোমবার সন্ধেবেলা, অর্থাৎ ভারতীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে আর্যকে খুঁজে পাওয়া যায় – রিহ্যাব সেন্টার থেকে অনেকটা দূরে বরফের নিচে চাপা পড়া অবস্থায়। যদ্দুর জানা গেছে ও হয়ত পা পিছলে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়, তার পর প্রচন্ড ঠান্ডায় ওর মৃত্যু হয়, রবিবার রাতেই। বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে অবনীশের দুঃখ লাগলো ঠিকই, কিন্তু সে খুব একটা অবাক হলোনা। কারণ সে আগেই ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল। ডাক্তারি পরিভাষায় মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে প্রোফাউন্ড একসিডেন্টাল হাইপোথারমিয়া। তার মানে অবনীশ যে সময় স্বপ্ন দেখেছিলো, ঘরে আর্যের উপস্থিতি অনুভব করেছিল, অনিতা দেবী যে সময় কাউকে একটা বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন অবনীশের ঘর থেকে, তখন আর্য মৃত। সুদূর কানাডায়, লাল জ্যাকেট পরে, বরফচাপা অবস্থায়।

এরকম ঝটিকা কলকাতা সফরে আগে কোনোদিন আসেনি অবনীশ। এই সে গোরখপুরে ট্রেনে চেপেছিল কলকাতা আসার জন্য, আর এখন সে ট্রেনেই আছে, কিন্তু গোরখপুর ফেরার ট্রেনে। মাঝের কয়েকটা ঘন্টা যেন ঝড়ের মতন কেটে গেছে। গত দুদিনে একটা জিনিস অবনীশ বুঝে গেছে যে খ্যাতির মোহ বড় ভয়ঙ্কর। সেটা একটা মানুষকে অনেক নীচ ও স্বার্থপর বানিয়ে দেয়। অবনীশও নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। কিন্তু আর্যের মৃত্যু আর তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অবনীশের চোখ খুলে দিয়েছিলো। অবনীশ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলো। যে কথাটা অবনীশ কাউকে বলতে পারেনি, এমনকি নিজের মাকেও, সেটা হলো আর্যের অতৃপ্ত আত্মা যেটা খুঁজছিলো, সেটা ছিল অবনীশেরই কাছে। আর্যের কবিতার ডায়েরি। যেটা আর্যই বিশ্বাস করে অবনীশকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলো। আর অবনীশও যেটার কয়েকটা পাতা পড়ে রীতিমতন অবাক হয়ে সেদিন বলেছিলো “করেছিস কি? এতো পুরো খাজানা। এ জিনিস কেউ লুকিয়ে রাখে?” আর্যকে উৎসাহিত করে এটাও বলেছিলো যে সে যেন লেখা চালিয়ে যায়। অবনীশের মামার একটা নামি পাবলিশিং হাউস আছে। অবনীশ কথা দিয়েছিলো সে মামাকে বলে এই কবিতা গুলো বইয়ের আকারে প্রকাশ করাবে। সেটা শুনে আর্যের চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে উঠেছিল সেদিন। কিন্তু বরাবরই অন্তর্মুখী আর প্রচারবিমুখ স্বভাবের আর্য মুখে উত্তেজনাটা প্রকাশ করেনি।

শেষ যেদিন আর্যকে দেখতে গেছিলো অবনীশ, আয়া মাসি রান্না ঘরে যাওয়ার পরে আর্যের অসুস্থতা আর উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে স্টাডি টেবিলের ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা চট করে ব্যাগে লুকিয়ে ফেলেছিলো সে। ভালো মনেই নিয়েছিল তখন। ইচ্ছা ছিল মামাকে বলে পরে বই বের করিয়ে আর্যকে চমকে দেবে। কিন্তু সেটা সে করেনি। আর্য অসুস্থ হওয়াতে ওই ডায়েরির খবরও কেউ নেয়নি। হয়তো কেউ জানতোই না। তার ওপরে সময়ের সাথে সাথে একটা ঈর্ষা ও স্বার্থপরতা অবনীশের মধ্যে দানা বেঁধে উঠছিলো; আর মামার দৌলতে নিজের কয়েকটা কবিতা কিছু নামিদামি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর সেটা যেন আরও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিলো আসলে একটা খ্যাতির মোহপাশে বাঁধা পরে গেছিলো সে। এটা ঠিক যে অবনীশও ভালোই কবিতা লিখতো, আর আর্যের কোনো কবিতাও সে কখনো চুরি করেনি, কিন্তু তার একটা ভয় ছিল যে আর্যের কবিতা প্রকাশ পেলে সেগুলো ছেড়ে তার কবিতা হয়তো কেউ পড়বেনা। তাই ওর লেখাগুলো বেমালুম চেপে দিয়েছিলো সে। তারজন্য গত দুদিনে সে নিজেকেই নিজে ভর্ৎসনা করে গেছে আর আর্যের কাছে মনে মনে ক্ষমা চেয়েছে, বারংবার । লেখাওতো একটা শিল্প। আর একজন প্রকৃত শিল্পীর নৈতিক দায়িত্ব অন্য গুণী শিল্পীদেরও উপযুক্ত সম্মান দেওয়া, তাদের পাশে দাঁড়ানো। এই সাধারণ ব্যাপারটা যেন বেমালুম ভুলে গেছিলো অবনীশ।

ডায়েরিটা আর্যের কাকার হাতে দিয়ে এসেছে সে। উনি সেটা আর্যের বাবা-মাকে দিয়ে দেবেন বলেছেন। ওনাকে অবনীশ জানিয়ে এসেছে যে এবারের বইমেলায় অবনীশের নিজের বইয়ের সাথে সাথে আর্যের কবিতার বইও প্রকাশিত হবে। বইয়ের নামও ঠিক হয়ে গেছে “অপ্রকাশিত”। শুনে কাকা খুশিই হলেন, খালি আফসোস করলেন যে আর্য বেঁচে থাকতে বইটা বেরোলে ও খুব খুশি হতো। বইয়ের মুখবন্ধে আর্যের বাবা, মায়ের নাম উল্লেখ করার অনুমতি তিনিই দিয়ে দিলেন অবনীশকে। খালি বললেন যে গ্রন্থস্বত্বটা যেন আর্যের বাবাকে না দিয়ে একটা NGO কে দেওয়া হয়। আর্যের বাবা-মাই সেটা চালান সেটা। নাম “আশা”।

আর্যদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বেহালায় মামাবাড়ি চলে গেছিলো অবনীশ। মামাকে আগেই ফোনে সব বলা ছিল। বইমেলার আর বেশিদিন বাকি নেই, তবুও অনেক জোরাজুরি করে মামাকে সে রাজি করিয়েছিলো বইটা ছাপানোর ব্যাপারে। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য সেটা তাকে করতেই হতো। ওখানে ডায়েরির পাতার স্ক্যান করা সফ্ট-কপিগুলোর প্রিন্ট আউট নিয়ে, ঘন্টাখানেক ধরে প্রুফ-রিডিং করে, তার পর ফুলবাগানে ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিলো অবনীশ, বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। বাবা-মা অধীর অপেক্ষায় বসেছিলেন ওর জন্য। খেতে বসে বাবা-মাকে সংক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা জানালো অবনীশ। তাঁরা জানালেন অবনীশ আর্যের জন্য যেটা করতে চাইছে তার জন্য তাঁদের পূর্ণ সমর্থন আছে। শরীরে ক্লান্তি থাকলেও মনটা যেন অনেকটাই হালকা হলো অবনীশের। বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেলো তার। মায়ের হাতের রান্না খেয়ে মায়ের কথাতেই ঘন্টা খানেক নিজের ঘরে একটু বিশ্রাম নিলো সে। তারপর বিকেল পাঁচটা নাগাদ চা খেয়ে, বাবা-মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লো শেয়ালদা থেকে গোরখপুরের ট্রেন ধরবে বলে। বেরোনোর সময় মা তাকে একটা টিফিন বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন তাতে রাতের খাবার আছে, অবনীশ যেন সময় মতন খেয়ে নেয়।

ট্রেনের টিটি, শর্মাজী, গোরখপুরের লোক, অবনীশের চেনা। তিনি অবনীশকে একটা সাইড আপার বার্থের ব্যবস্থা করে দিলেন। অবনীশ লোয়ার বার্থের একটা সিটে হেলান দিয়ে বসে কাটালো অনেক্ষন। আসলে সে চোখ বন্ধ করে আর্যের কথাই ভাবছিলো। একটা প্রতিভাবান ছেলে কেমন অকালে চলে গেলো। সে আর ফিরবেনা। আর কোনো পিছুটান তার নেই। সব মায়ার বাঁধন ছাড়িয়ে অনেক দূরে, না-ফেরার দেশে চলে গেছে সে। বেঁচে থাকতে সে অবনীশকে প্রকৃত কবিতা লিখতে শিখিয়েছিলো, আর চলে গিয়ে সে অবনীশকে একজন প্রকৃত মানুষ হতে শিখিয়ে গেলো। অবনীশের বিশ্বাস, আর্য তাকে ক্ষমা করে দেবে। কারণ কারোর সাথে রাগারাগি করার ছেলে সে কোনোদিনই ছিল না। আর সোমবার রাতে স্বপ্ন দেখে মঙ্গলবার সকালে যখন অবনীশ তার লোহার আলমারির থেকে ডায়েরিটা বের করেছিল, আর ঠিক করেছিল সেটা সে আর্যের বাবা-মাকে গিয়ে দিয়ে দেবে, কবিতাগুলো ছাপানোর ব্যবস্থা করবে; তারপর থেকে অস্বাভাবিক কিছু চোখেও পড়েনি তার। বর্ধমানটা পেরোতেই খুব ঘুম পেয়ে গেলো অবনীশের। সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ গত দু-রাত সে প্রায় ঘুমাতেই পারেনি। ঘড়িতে দেখলো সাড়ে আটটা বাজে। মায়ের বানানো তার প্রিয় চিলি চিকেন আর রুটি চেটেপুটে খেয়ে, নটার মধ্যে নিজের বার্থে চলে গিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো সে। ট্রেনের দুলুনিতে চোখ দুটো যেন তার জড়িয়ে আসছিলো। লালমোহন বাবুর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে গেলো অবনীশের…”ওটা তো হেল্প করে মশাই “। 

Facebook Comments