ধ্রুবজ্যোতি বাগচী
‘ধূপধুনোর সুগন্ধ, কাঁসরঘন্টা বাজছে শঙ্খধ্বনি- সরস্বতী পুজো হচ্ছে। দিদির বাবা শ্রী সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় আছেন, আছেন মা শ্রীমতী সুবর্ণালতা দেবী, লাল পাড় শাড়ি পরে বাড়ি থেকে পুজোর বাসন, প্রদীপ এনে সব দেখাশোনা করে বিশুদ্ধ, সুশৃঙ্খলভাবে, নিষ্ঠাভরে পুজো সারা হল। সন্ধ্যায় গান- এই ছিল তখনকার ছবি। গম্ভীর, শান্ত, পবিত্র পরিবেশ, আনন্দ তো আছেই’ (স্মৃতিচারণ করেছিলেন উমা দে শীল তাঁর ‘যে পথ দিয়ে চলে এলি’ নিবন্ধে)।
শ্রী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বনামেই খ্যাত, পেশায় আইনজীবী, নেশায় সাহিত্য-শিল্পকর্মী। গান, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র কাহিনী, বেতার নাট্য, অনুবাদ সাহিত্য বাদেও ছোটদের জন্য তিনি অসংখ্য সৃষ্টি করে গিয়েছেন। তাঁর অন্য পরিচয়, তিনি কিংবদন্তী রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র-র পিতা।…কথা হচ্ছিল ‘রবিতীর্থ’র সারস্বত সন্ধ্যার বিষয়ে। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমাদের স্মরণে চিরায়ত হয়ে আছে সরস্বতী পুজোর দিনটি।
৩৭ নম্বর পরাশর রোডের বাড়িটার গলির মুখে তখনও লেক-মল মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। নয়ের দশকের শুরু থেকে তাঁর পরপারে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সরস্বতী পুজো-কেন্দ্রিক বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষায়তন কেন্দ্রটির অন্যরকম চেহারা দেখতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম আমরা।পুজোর ভার পড়ত চতুর্থ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর। সুচিত্রাদির একটিই দাবি, প্রতিমার রঙ শ্বেতশুভ্র যেন না হয়। তাই ‘রবিতীর্থ’র সরস্বতী প্রতিমা অফ-হোয়াইট বর্ণের হত।দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীরা পুজোর চাঁদা আদায় থেকে প্রতিমার অর্ডার দেওয়া, বাজার করা, মায় রবিতীর্থর সব চাইতে বড় ঘরটায় স্নিগ্ধ-সাজ, সুশ্রী আলিম্পন পর্ব সম্পন্ন করত।
পুজোর দিন সকালেই রবিতীর্থতে চলে আসতেন সুচিত্রাদি। সেদিন যেন তিনি রবিতীর্থর কর্ণধার নন, একজন অভিভাবিকা। দলে দলে ভীড় করত প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীর দল। গানের জগতের সেলিব্রিটিরা একটি বারের জন্য হলেও রবিতীর্থতে আসতেন।পুজো শেষে খিচুড়ির স্বাদ এখনও পাই।তারপর, সন্ধেবেলায় পুজোর ঘরে সন্ধ্যারতির পর শুরু হত গানে গানে সারস্বত বন্দনা।স্মৃতির ফ্রেমে এখনও টাটকা সে ছবি। হারমোনিয়ামে সুচিত্রাদি। তবলায় দুলালদা। এক দিকে রবীনদা, কাশীদা। সেই সন্ধে মুখরিত হত সব ক’টা সমবেত গানে। ‘মন্দিরে মম কে আসিলে হে’, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,’ ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে’, ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে’, ‘ওই আসনতলের মাটির পরে’…কত গান যে গাওয়া হত পর পর, তার ইয়ত্তা নেই।বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীরা বসে পড়ত পুজো-ঘরে, যার যেখানে জায়গা হত। সেই ভীড় উপচে পড়ত বারান্দায়। পরাশর রোড দিয়ে যাতায়াত করা লোকজন দাঁড়িয়ে পড়তেন। দেখতেন সরস্বতী প্রতিমার সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে সুচিত্রা মিত্র, একান্ত ভাবেই তাঁর নিজস্ব স্টাইলে সুরে নিমগ্ন।পুরনো অ্যালবাম থেকে ধৃত সারস্বত দিনের ছবি পাওয়া যায় ‘রবিতীর্থ সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ’র (১৯৪৬-১৯৯৬)পাতায়। স্বমহিমায় উজ্জ্বল উপস্থিতিতে রয়েছেন সর্বশ্রী সমরেশ রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, অজিত চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দ্বিজেন চচধুরী, নৃপেন চন্দ্র মিত্র প্রমুখ। ছবিই তো সম্পদ পরবর্তী প্রজন্মর জন্য। আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি সুচিত্রাদির কাছে রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষায়। কতটুকু নিতে পেরেছি তার হিসেব নাই বা হল! কিন্তু, অনন্য অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছে আমাদের জীবন।
সরস্বতী পুজোয় আড়ম্বর কি খুব প্রয়োজন? সুরের দেবীর পুজোয় অনুষঙ্গ তো হতেই পারে একখানি গীতবিতান বা সঞ্চয়িতা। যাঁরা অন্য ধরনের সঙ্গীতে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন, তারাও তাঁদের আন্তরিক পুজো নিবেদন করুন নিজ নিজ গানে, কবিতায়।দোহাই, গাঁক গাঁক করে মাইকে অমায়িক সঙ্গীত সুধা বিতরণ করে সারস্বত দিনটিকে মাটি করবেন না!
ইতিহাস বলে জেদ ধরে জেলে সরস্বতী পুজো করিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯২৩ সালে। তখন তিনি বহরমপুর জেলে বন্দি। বাংলার পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ। জেলে সরস্বতী পুজোর রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের জেদে শেষে জেলে পুজো হল।আলিপুর জেলে বন্দি থাকার সময়েও সরস্বতী পুজো করিয়েছিলেন সুভাষচব্দ্র বসু।মান্দালয় জেলে বন্দি থাকার সময় পুজো ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য ভাতা চেয়ে বার্মা সরকারের চিফ সেক্রেটারিকে সুভাষচন্দ্র চিঠি লিখেছিলেন (তথ্য ঋণ- অহর্নিশ)।
এখন দুর্গা পুজোর মতো পাড়ার মোড়ে ফ্লেক্সে সরস্বতীর ছবি দিয়ে ‘পলাশপ্রিয়ার আরাধনায়’ অমুক সংঘ, তমুক সংঘের প্রচার দেখতে পাওয়া যায়। রীতিমতো ঢক্কানিনাদে তাঁর আরাধনার আয়োজন হয়, এবং পুজো মানেই তো নিদেনপক্ষে চারটি দিন বরাদ্দ।কাগজেই দেখলাম এই বঙ্গের কোথায় যেব ৫১ফুটের সরস্বতী প্রতিমা হচ্ছে। এও দেখনদারির এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা বলেই মনে হয়। মতামত একান্তই ব্যক্তিগত।পুজো মানেই দেদার বাজবে মাইকে বাংলা, হিন্দি গান। তদুপরি এবার প্রেমদিবস এবং সারস্বত আরাধনা মিলেমিশে একাকার। প্রেমিক-প্রেমিকার দল এবং বন্ধু-বন্ধুনীরা সদলবলে সেদিন নিখাদ বাঙালি সাজে মাল্টিপ্লেক্স-রেস্তঁরা মাতাবেন। এক দিনের জন্য বাঙালি সাজার পর্বও সারস্বত দিবস। হবু প্রেমিক প্রেমিকারা প্রোপোজ করবেন। আর যাদের এ বারও কিছু জুটল না, তাদের অপেক্ষা পরের বছরের জন্য।
স্মৃতির সরণি বেয়ে কয়েকটা মধুর স্মৃতি মনে পড়ে।বেশ কয়েক বছর আগে সরস্বতী পুজোর আগে সবান্ধবে যাচ্ছিলাম দিঘায়। রাস্তায়, গ্রামের মেঠো পথে কতবার যে গাড়ি আটকেছিল কচি-কাঁচার দল! হাতে তাদের হলদে ছাপা কাগজে ছাপা বিলবই। “চাঁদা দিতে হবে…”। “কিসের?” “সরোস্যতি পুজোর”। তারপর সেই চিরাচরিত দুষ্টুমি। এক বন্ধুর আদেশ, “দেব। আগে বল্ সরস্বতী বানান…”। মাথা চুলকে, বিশাল আতান্তরে পড়ে তাদের পরিত্রাণ পাওয়ার চিন্তা তখন আমাদের হাসোদ্রেক করেছিল।শিক্ষার বেহাল অবস্থা কি একটুও বদলেছে?
গত বছর, সরস্বতী পুজোর দিন অনেক রাতে ফিরছিলাম ট্রেনে। বারাসাতে নামব। দমদম থেকে মেট্রো পথ ছেড়ে আমাদের বনগাঁ লাইনের অতি বিখ্যাত লোকাল-ট্রেন।তখনও যুগলে যুগলে প্রেমের কলতানে ট্রেন ছয়লাপ।বাড়ির পথে টোটোতে যেতে যেতে এক জায়গায় দেখলাম, বাঁশের তৈরি সুচারু খাঁচায় একলা বসে আছেন ছাঁচের মা সরস্বতী।সম্ভবত আয়োজকবৃন্দ খুদেদের দল সারাদিনের ধকল কাটাতে বাড়ি ফিরে গেছে। একশো পাওয়ারের বালবের আলোয়, একটু একটু হিমের রাতে বিদ্যার দেবী একলা বসে থাকতে দেখে কেমন দুঃখ হল।কেন এই বৃথা আয়োজন? কাকেই বা বলব?তখনও পথে যথেষ্ট লোকজন। কিন্তু, কারুর সময় নেই ওদিকে তাকানোর। কীই বা হবে? ভাবখানা এমন, একলা এসেছেন, একলাই তিনি যাবেন। না, থুড়ি, ব্যান্ডপার্টি, তাসাপার্টি সহযোগেও তিন/ চার রাত্তির পেরিয়ে তাঁকে বিসর্জিতা হতে অহরহ দেখা যায়। ভক্তবৃন্দ তখন নাচা-গানায় মত্ত।পুজো-আচ্চায় একটু-আধটু কারণ-বারি সেবন যে অবশ্য-অনুষঙ্গ!
সাতাশি সাল নাগাদ আমার কলকাতায় থিতু হওয়া।মনে পড়ে, আমার স্বভূমি শিলিগুড়িতে সব ক’টি ব্যাঙ্কের সব ক’টি শাখায় মহা-সমারোহে সরস্বতী পুজোর কথা। শিলিগুড়ি শহরে ব্যাঙ্কগুলোর আয়োজনে সরস্বতী পুজো ছিল একটি ইতিহাস। এটি নিয়ে এখনও কোনো চর্চা চোখে পড়েনি।না, এখন স্টাফ কমতে কমতে প্রায় নিবু-নিবু শাখা অফিসগুলোতে কর্মীদের হাতে অত সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই।
তবে, স্কুলের সরস্বতী পুজোর আনন্দ যেমন খিচুড়ি-লাবড়া-চাটনির অনবদ্য স্বাদে আদ্যন্ত স্মৃতি-জাগানিয়া।
…ওই তো মধুর মধুর ধ্বনি বাজছে। ‘মধুঋতু জাগে দিবানিশি পিককুহরিত দিশি দিশি…’
‘এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার তোরে দেখি চোখে…’
Facebook Comments