Site Overlay

তাবাকোশির ভূত, জ্বিন, বা অন্যকিছু

হাসান শরিফ

পুজোর ছুটিতে উত্তরবঙ্গে বেড়াতে এসেছি। জায়গাটার নাম একটু অদ্ভুত । তাবাকোশি। নামে কেমন জাপানি-জাপানি গন্ধ। আমি তো জানতামই না যে এরকম একটা জায়গা ভূ-ভারতে আছে। সুজয়ার আবিষ্কার। সুজয়া আমার কিশোর বেলার বন্ধু, ফটোগ্রাফি করে। সময় পেলেই ফেসবুকে ঘোরার গ্রুপগুলো ঘাঁটে। এখানেই বোধহয় কোথাও কেউ বলেছিল জায়গাটার কথা। ব্যাস, ওর নজরে পড়ে গেছে, আর ইন্টারনেটে ছবি দেখে মনেও ধরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে নয়ডা থেকে আমায় ফোন।

“পুজোতে ঘুরতে যাবি?”

তখন আমি ব্ল্যাক কফি বলে অখাদ্য যে তরলটি আছে তাতে চুমুক দিচ্ছি। প্রতিদিন আমার সকাল শুরু হয় এই কঠিন কাজটি দিয়ে। বারান্দায় বেশ ঝকঝকে রোদ্দুর। ভূমির গানের মত। তবে আমার ঘুলঘুলিতে চড়ুই নেই, দুটি পায়রা বাসা করেছে। তারা সারাদিন প্রেম করে। একজন আরেকজনকে খুব আদর করে পোকা খাওয়ায়।

বললাম, “যাবো।”

“কোথায়, সেটা জানতে চায়লি না তো?”

“ভরসা আছে তোর উপর।”

“শালা! সকাল সকাল ফাজলামি!”

“এটা ফাঁকিবাজি, বুঝলি। ঘুরতে গিয়ে অত গবেষণা করতে পারব না। এই জায়গা না ওই জায়গা! এই হোটেল না সেই হোটেল! ট্রেনে যাবি, না উড়ে! ওসব ভাল্লাগেনা। তুই যদি টিকিট কেটে দিস, হোটেল বুক করে দিস তো যেখানে বলবি চলে যাবো। তুই এখানে থাকলে তোকে বলতাম স্টেশনে যাবার উবারটাও বুক করে দিতে!”

“ল্যাদখোর!”

গায়ত্রী পাশে মোড়ায় বসে বিরক্ত মুখে কফি খাচ্ছিল। প্রতিদিন প্রথম চুমুকের পরে বলে, “এ খাওয়া যায় না। একটু গুঁড়ো দুধ দিলে হত না?” আমারও একই ইচ্ছে; কিন্তু বলি, “আমার তো দিব্যি লাগে আজকাল।” 

আমার ফোনের স্পিকার অন করা ছিল। সুজয়ার প্রস্তাব গায়ত্রী শুনতে পেয়েছে। গায়ত্রী একটু গলা তুলে বলল, “পুজোর পরের সপ্তাটা হলে কেমন হয়, সুজয়া? পুজোটা কলকাতাতেই থাকা যেত। বিতানের স্কুলও তো খুলছেনা।”

আমি সুযোগ বুঝে ফোনটা গায়ত্রীর হাতে দিয়ে উঠে পড়লাম। আমি নিশ্চিত, এরা দুজন ব্যবস্থা করে ফেলবে এবার। গতবার একই কায়দায় আমি একটুও মাথা না ঘামিয়ে, ইন্টারনেটে বিশেষ কোন ছবি না দেখেই রাজস্থান ঘুরে এসেছি।আমার ঘুরতে ভালো লাগলেও, প্ল্যান করতে একেবারেই ভালো লাগে না। বরং জায়গাটা সম্পর্কে একেবারে কিছু না জেনে যেতেই আমার ভালো লাগে। ছবি দেখা হয়ে গেলে আমার কেমন চেনা জায়গায় ঘুরতে এসেছি মনে হয়। তাছাড়া টিকিট কাটতে বা হোটেল বুক করতে কারো কি ভালো লাগতে পারে?

যথা সময়ে তাবাকোশিতে এসে পড়লাম। দারুণ জায়গা। আসার সময় গাড়ির মধ্যে ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে কুয়াশা ঢুকে পড়ছিল।ভুল বললাম। আসলে গাড়িটাই মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল। কাছ থেকে যেটা কুয়াশা দূর থেকে সেটাই তো মেঘ।  পুরো রাস্তাটাই তো মেঘের মধ্যে দিয়ে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে অসংখ্য চা বাগান। সবুজে সবুজ চারিদিক। তার উপর কাল রাতে বেশ বৃষ্টি হয়েছে মনে হয়। রাস্তাঘাট এখনো ভিজে। এখন রোদ উঠে ভেজা গাছগুলো চকমক করছে। এখানে আসার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য সুজয়ার প্রশংসা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু উলটে মুখ গম্ভীর করে বললাম, “কোথায় আনলি রে? দু’ঘর লোকের বাস এখানে । বিয়ার পাওয়া যাবে তো? নাহ, তোর উপর আর ভরসা করা যাবে না।”

সুজয়া দূরের উপত্যকার চা বাগান দেখছিল। দূরের দিকে তাকানো চোখ ভাসছে।আমার কথায় বোধহয় ঘোর কেটে গেছে। মুখে বিরক্তি এখন। 

“তোকে গাড়ি করে দিচ্ছি, দার্জিলিং চলে যা। ওখানে ম্যাল-এর পাশে থাকিস, হাঁটের মাঝখানে।তোর ওসবই ভালো লাগবে। হোটেলে বসে বসে বিয়ার খাবি। গায়ত্রী আর বিতান থাকুক। তুই বিদেই হ।”

আমাদের সঙ্গে আমার মাসতুতো ভাই সুমনও এসেছে। সুমন কবছর আগেও বেশ রোগা ছিল।পরিষ্কার কামানো মুখ। এখন সে যত্ন করে মুখভরতি দাঁড়ি রেখেছে। চেহারাটাকেও আর কোনোদিক থেকেই রোগা বলা চলেনা। সে কথায় কথায় ধূম্রপান করে। এই অভ্যাসটার কোন পরিবর্তন হয়নি। সুমন পকেট থেকে একটা সিগারেট  বের করে বলল, “হেবি জায়গা তো সুজয়াদি! একদম মেঘের রাজ্য! চারদিক পাহাড়ঘেরা আর কি সুন্দর নিরিবিলি।“ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসল,  “দা’, তোমার চয়েস নিয়ে আমার মুখ খুলিওনা।”

কথাটা সত্যি। সুমন তো শুধু মাসতুতো ভাই না, আমার অধিকাংশ দুষ্কর্মের সঙ্গীও। আমার হাঁড়ির সব খবর ওর জানা।  তার মধ্যে বেশ কিছু, কম বললেও, বিব্রতিকর তো বটেই। যেমন আমরা দুজন একবার ব্যাঙ্গালোরে একটা পাহাড়ে ট্রেক করব বলে ঠিক করেছিলাম। জায়গাটা আমিই দেখেছিলাম। যাওয়ার আগে খুব আগ্রহ নিয়ে দুজন ট্রেকিং-এর জুতোও কিনলাম। কিন্তু জায়গায় পৌঁছে দেখা গেলো, সেটা একটা ফিল্ম সিটি। যে পাহাড়ে উঠবো ভেবেছিলাম সেটা একটা বড়সড় ঢিবির মত। ওটা দেখে সুমন আমায় যেগুলো বলেছিল, এখানে লেখা যাবে না।

তাবাকোশিতে যে দোতলা হোম-স্টেতে আমরা থাকছি সেটা একটা টিলার মাথায়। বিরাট একটা কাঠের বাড়ি, তাতে মাত্র তিনটে ঘর। তার মধ্যে একটিই ঘর দুতলায়। আমাদের জন্যই যেন বানানো ।একতলার ঘরগুলো সুমন আর আমরা নিলাম।সুজয়া মহানন্দে দোতলায় চলে গেলো। ছবি ভালো আসবে দোতলার জানলা থেকে। দোতলায় একটি বারান্দাও আছে। সেখান থেকে সামনের পাহাড়ের গা বেয়ে আসা গাড়িগুলো সুন্দর দেখা যায়। 

বাড়িটার পাশেই আর একটি ছোটখাটো খাওয়ার ঘর। আমাদের কেয়ারটেকার বিনোদ টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমাদের খেতে আসতে ডাকে সেখানে। ব্যাস আশেপাশে আর কিছু নেই। বাড়ীর মালিক থাকেন টিলার নীচের একটি বাড়িতে। ডিনারের পর বিনোদও নীচে নেমে যায়। সে আবার আসে সকাল ন’টার দিকে। রাতে খাওয়ার পর এই টিলাতে শুধু আমরাই কজন।

সকালে জায়গাটা ভীষণ সুন্দর লাগছিল, কিন্তু এখন ডিনারের পর একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুঝলাম গা ছমছম করছে। আমাদের বাড়ীর পিছনে পাহাড়ি পথের সাথে সাথে পাক খাওয়া চা বাগানের সারি। এখন সেটা কালো, দূর্ভেদ্য একটা পাঁচিল হয়ে গেছে।সামনে অনেকটা নীচে সরু একটা রাস্তা। রাস্তার এক কোণে একটা টিমটিমে বাল্ব। তার মলিন আলো রাস্তার ওই কোণাতেই শেষ হয়ে গেছে। কোন বাড়িতেই আলো জ্বলছেনা। সব পাহাড়ি জায়গার মত এখানেও সবাই হয়ত এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে। অথচ স্রেফ নটা বাজে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। আমাদের ঘরের আলো যেখানে ফুরিয়েছে তার ওপাশে সবই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে। সেই অন্ধকারে একটা জোনাকিও দেখা যাচ্ছে না। আমার হঠাৎ করে মনে হল আমরা কজন যেন একটা দ্বীপে রয়েছি।

আমাদের টিলাটার পশ্চিম কোণের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা ছোটো ঝরনা বয়ে গেছে। সকালে খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন এই নিস্তব্ধতায় ঝরনাটি রীতিমত গর্জন করছে। কাল একবার ঝর্ণাটি দেখে আসতে হবে।

বিনোদ নেমে গেলে আমরা সবাই আমাদের নীচের ঘরে বসলুম।

গায়ত্রী আর সুজয়া ডাল্লির আচার বানানোর পদ্ধতি আলোচনা করছে। খুব চিন্তিত দুজনই। পদ্ধতিতে ত্রুটি রাখলে চলবে না। এই ডাল্লি জিনিসটা বেশ ঝাল। একটুখানি চাখলেই জিভ থেকে ধোঁয়া বেরনোর অবস্থা হয়। কিন্তু ডাল্লি সম্পর্কে আমার পাণ্ডিত্য ওইখানেই শেষ। আলোচনায় ঢুকতে না পেরে আমি আর সুমন বরং বিয়ার খাওয়ায় মন দিয়েছি।

এক গ্লাস বিয়ার শেষ করে সিগারেট খেতে  সুমন আর আমি বারান্দায় এলাম। টানা বারান্দা। কাঠের রেলিং। দুটো বাল্ব জ্বালিয়ে গেছে বিনোদ। দূরের পাহাড়ের সারি দিনের আলোতে দিব্যি লাগে। এখন তো আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না, শুধু মনে হচ্ছে রেলিং-এর ওধারে অনন্ত খাদ।

সুজয়াও একটু পরে বেরিয়ে এলো। গায়ত্রী বিতানের জন্য বিছানা করবে। বিতান আর এক মাস পরেই চোদ্দ হবে। ঘুরতে-টুরতে তার একেবারেই ভালো লাগে না।শুধু ঘোরা কেন, কোন কিছুই তার ভালো লাগে না। সে সারাদিন উদাস মুখে মায়ের ফোনে বিচিত্র সব গান শোনে। কি শুনছিস, জিজ্ঞেস করলে ছোটো উত্তর দেয়, “গান”। 

“কি গান?” 

“কেন?”

“আমাকে বললে কি?”

“গান বললাম তো!”

“ইংলিশ গান?”

“জাপানিজ।”

“মানে? লিরিকস বুঝিস না তো!”

“বুঝি।”

“কি করে? তুই আবার জাপানি কবে শিখলি?”

“জাপানি জানিনা তো।”

“তবে লিরিকস বুঝিস বললি যে?”

“ফোনে দেখে নি।”

“হিন্দি, বাংলা গান কি দোষ করলো?”

“বোরিং!”

শেষের শব্দটা যেরকম বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসে, তাতে আমি আর কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার সাহস পাই না। আমি বোরিং না হিন্দি, বাংলা বোরিং নাকি পৃথিবীটাই বোরিং আর জিজ্ঞেস করিনা। ছেলে খুব দ্রুত বোর হয়ে যায় আজকাল। এই বছর খানেক আগেও হাসতো-টাসতো বেশ। ওর হাসি দেখলে আমার মন ভালো হয়ে যেত। ওকে চেপে জড়িয়ে ধরতাম, তাতে ওর হাসি আরও বেড়ে যেত। করোনার সময়ে বাড়িতে বন্ধুবান্ধবহীন, স্কুলহীন, খেলাহীন দুটি বছর কাটিয়ে ও অনেকটাই বদলে গেছে। এখন বোধহয় হাসাটাও ওর বোরিং লাগে। সব থেকে বেশি বিরক্ত হয় প্রশ্ন করলে। এটাও কি করোনার জন্য নাকি সব টিন-এজারদেরই একই সমস্যা?

তাবাকোশিতে এসে ছেলে জাপানি  গান শোনার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। সেই জন্যই মাকে বারবার বলছে ঘুম পেয়েছে। অথচ গভীর রাত পর্যন্ত ওর কানে ইয়ারফোন গোঁজা থাকবে। 

আমরা চেয়ার টেনে বসলাম। খুব বেশি ঠাণ্ডা লাগছেনা। বরং ঠাণ্ডার আমেজটা দিব্যি লাগছে। 

সিগারেটে একটা টান দিয়ে সুমন বলল, “দা, এই জায়গাটা কেমন ভূতুড়ে।”

ভূতুড়ে আবার কি! একটু নির্জন, আর কিছু না। 

না দা। ভূতুড়েই। নির্জন তো বটেই। কিন্তু ভূতুড়ে টাইপের নির্জন। আমার মাধোপুরে থাকার সময়ও এমন মনে হত।

উফ তুই আর ওই মিডিয়াম টাইপের হাব ভাব করিস না তো! ওই ফিল্মে দেখায় না? কঞ্জিওরিং দেখেছিলি? সেই যে ঘরে ঢুকেই মহিলার মুখের ভাব বদলে গেলো, অশুভ আত্মার উপস্থিতি টের পেল!

সুমন হেসে ফেলল, “কুছ তো গড়বড় হে দয়া!”

ভূত থাকলে খুব জমে যাবে, না? ভূত ভূত করছে মনটা?

তুমি শালা সিরিয়াসলি নাও না কিছু।

সুমন চুপ করে গেলো। সুজয়া মন দিয়ে ক্যামেরার পিছনের স্ক্রিনে আজকের তোলা ছবিগুলো দেখছিল। এখন মুখ তুলে বলল, “মাধোপুর মানে বিহারে?” কোনো জায়গার নামে ও কর্ণপাত করবে না এমনটি হবার নয়।

“মাধোপুর এত বিখ্যাত জায়গা জানতাম না!” সুমন বলল।

সুজয়া বলল, “আরে, তুই বললি না আসার সময়? বিহারে ছিলি কিছুদিন? তাই বলছি।”

“ ও আচ্ছা, তাই বল।”

“মাধোপুরে কি হয়েছিল?”

সুমন আমার দিকে তাকাল, “দা’কে বলেছি।”

আমি বললাম, “আবার বলে ফেল। ইন্টারেস্টিং গল্প।”

“ওসব মনে করলে ভয় লাগবে, এখানে একা শুতে আমার চাপ হয়ে যাবে।”

“এখন তো মনে পড়েই গেছে, বলেই ফেল।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল, বল,” সুজয়া বলল।

“আরে ওসব ফিলিং ঠিক বলে বোঝানো যায় না,” বলে সুমন ওর কাঁচাপাকা দাঁড়ি চুলকে আর একটা সিগারেট ধরাল। এক গাল ধোঁয়া ছাড়ল।

“আমাদের রেল ফ্যাক্টরি যেখানে, আমাদের কোম্পানি তাকে ঘিরে একটা ছোট টাউনশিপ মত করে ফেলেছে, বুঝলে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তো, ওদের ব্যাপারই আলাদা।” 

“ওটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ব্যাপার বলে নয়। এতগুলো মানুষ একসাথে একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে, তাদের জন্য সব ব্যাবস্থা রাখতে তো হবেই।” সুজয়া বলল।

সুমন বলল, “হ্যাঁ সেটাই। তো যাই হোক, ওখানেই একটা হোস্টেল গোছের একটা বাড়িতে আমরা থাকতাম, বুঝলে। আমাদের থাকার কোয়ার্টারগুলোর জায়গাটায় আগে কবরখানা ছিল একটা । প্রাচীন কবরখানা। এটা পরে শুনেছি। বুঝলে?”

সুজয়া ঘাড় নাড়ল।

আমি বললুম, “এই যে কবরখানার উপরে বাড়ি বলিস, এতেই তো আমার ভক্তি চটকে যায়। সব ভূতের গল্পে এটা কেন এত কমন বল তো?”

“ধুর, বলবো না। তুমি বড্ড এনালাইজ করো।”

বিতানকে শুইয়ে দিয়ে গায়ত্রীও এসেছে। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সে বলল, “এই তুমি থামো তো। বল তো সুমন।”

“আমাদের সবার আলাদা আলাদা রুম ছিল।  কাজের খুব প্রেশার থাকত সে সময়। ফ্যাক্টরির ক্যান্টিনেই খেয়ে নিতাম। রাতে ঘরে ফিরতে ফিরতে দশটা। ফিরে মাকে ফোন করতাম। একদিন রাতে ফোনে মার সাথে কথা বলছি, হঠাৎ একটা শব্দ হল। যেন চুড়ির রিনঝিন। শব্দটা তারপর একটু থেমে থেমে হতেই থাকলো।”

আমি ফোড়ন কাটলাম, “ঘরে সুন্দরী কেউ ছিল নিশ্চয়ই।”

“এই জন্যই আমি বলিনা।”

“হাসান, তুই থামবি?” সুজয়ারও বেশ আগ্রহ জন্মেছে গল্পে, “তারপর কি হল?”

“আমি একটু ভাল করে শুনে বুঝলাম শব্দটা আসছে আমার কাঠের ওয়ারড্রোব থেকে। আমি ভাবলাম বাদুড়-টাদুড় ঢোকেনি তো? হয়তো দরজা খোলা রেখে সকালে বেরিয়ে গেছিলাম, সন্ধ্যেবেলা বাদুড় ঢুকে পড়েছে? এখন আর বেরোতে পারছে না? আমি মাকে বললাম ফোনটা ধরে থাকতে। ফোন বিছানায় রেখে আমি আলমারির কাছে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাত লম্বা করে আলমারির পাল্লা খুললাম যাতে বাদুড়টা পালানোর সময় আমাকে গুঁতো না মারে। বুঝলে?দরজাটা খুলে গেলো বেশ সহজেই, কিন্তু ভেতরে বাদুড় কেন, কিছুই নেই। কিন্তু আমি দেখলাম কি জানো! প্রত্যেকটা হ্যাঙ্গার পাগলের মত দুলছে। যেন কেউ ওগুলো নিয়ে ঘাঁটছিল। আর আমি খোলামাত্র শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো।”

সুজয়া বলল, “হয়ত ভূমিকম্প হচ্ছিল?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, লোকালাইজড ভূমিকম্প! সুমনের আলমারির ভিতরে।”

সুমন বলল, “ভূমিকম্প হলে তো আমিও বুঝতে পারতাম।”

“তাহলে এটার এক্সপ্ল্যানেশন কি?” সুজয়া উত্তর খুঁজছে।

আমি বললাম, “খুবই গ্রহণযোগ্য এক্সপ্ল্যানেশন আছে একটা।”

“কি?”

“সুমন ঢপ দিচ্ছে।”

“খোদার কসম ঢপ না। আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। তুমি মাকে জিজ্ঞেস কোরো। মা শুনেছিল,” সুমন উত্তেজিত।

“তুই ইঁদুর-টিদুর দেখে চিৎকার করেছিলি। খালামা সেটাই শুনেছে। খালামা কি করে জানবে তুই কি দেখেছিস?”

“তোমাদের বিশ্বাস না হলে আমার কিছু করার নেই।” সুমনের মুখ গম্ভীর।

সুজয়া বলল, “না রে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে। রাজস্থানে জানিস তো ভানগড় বলে একটা দুর্গ আছে। ওখানে সূর্য ডোবার পর কাউকে ঢুকতে দেয়না। ভূতের উপদ্রব আছে নাকি! সরকার থেকেই নিয়ম করেছে।”

আমি বললাম, “হতে পারে ওটাই ওদের টুরিস্ট আনার ছল?”

সুমন আমার উপর খুব বিরক্ত হল, “হ্যাঁ দাদা, তুমি সবই জানো। সবাই ঢপ দিচ্ছে। বিশ্বাস করোনা বলে যা ইচ্ছে একটা বললেই হল!” তারপর একটু থেমে বলল, “একটা অভিজ্ঞতা তো আমাদের দুজনেরই হয়েছিল। সেটা বল তাহলে কেন হয়েছিল? ওটা এক্সপ্লেন করো দেখি!”

আমি জানতাম সুমন এটার কথা তুলবে। ভূতের গল্প হলেই ও এই গল্পটা করে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত সন্দেহ নেই। তবু আমার ভূত বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।

গায়ত্রী একটা চাদর জড়িয়েছে গায়ে। বলল, “সেই কুর্গের ঘটনাটা?”

সুমন বলল, “হ্যাঁ সেই যে আমরা সিগারেট কিনতে বেরলাম, তারপর কফি বাগানে শর্টকাট নিতে গিয়ে অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম?”

গায়ত্রী হাসল, “সেই কুকুরের গল্পটা তো?”

সুজয়ার আগ্রহ তুঙ্গে পৌঁছেছে, “আরে কি গল্প, বল না। আমি তো কিছুই বুঝছিনা।”

সুমন বলল, “দা, তুমিই বল।”

আমি গায়ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, “বিতান ঘুমাচ্ছে?”

“শুয়ে তো পড়েছে। গান শুনছে মনে হয়। তুমি বল।”

আমি বললাম, “দেখ সুজয়া, ওরা যা হাইপ করছে সেরকম কিছুই নয়। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত এটুকুই।”

সুজয়া বলল, “সেটা নাহয় আমি বুঝে নেবো। তুই বল তো!”

“দেখ বাঙ্গালরে তো আমরা বেশ কয়েক বছর ছিলাম, সে তো তুই জানিসই। ওখান থেকে কুর্গ খুব একটা দূরে নয়। গাড়িতে পাঁচ-ছ’ ঘণ্টা। তো মনে হয় ২০১৫ তে, সুমন, মেজমামা, সেজোখালামা, আর আমরা তিনজন মিলে একবার কুর্গে ঘুরতে গেছিলাম। দুটো গাড়ি নিতে হয়েছিল। একটা আমি চালালাম, আর একটা সুমন। তো জায়গাটা অনেকটা এরকমই। তাবাকোশির মতই। এখানে চা বাগান, ওখানে কফি। তাবাকোশি অবশ্য অনেক বেশি সুন্দর লাগছে আমার। যাক গে, আমরা সন্ধ্যে সন্ধ্যে পৌঁছেছিলাম। হোমস্টেতে ঢোকার পরপরই বেশ অন্ধকার নেমে গেলো। সিগারেট খেতে গিয়ে দেখি একটাও আর পড়ে নেই। আমার কাছেও নেই, সুমনেরও শেষ। তখন সুমন বলল, “চলো কিনে নিয়ে আসি। চাঁদনি রাত। ভালো লাগবে হাঁটতে।”

আমি বললাম, “এখানে আদৌ দোকান আছে কিনা কে জানে!”

সুমন বলল, “দা, তুমি সিগারেটের দোকান দেশের যেকোনো জায়গায় পাবে। এটা তো আর ভুটান না।”

হোমস্টেতে ওঠার সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম পাকা রাস্তা থেকে হোমস্টেটা অনেকটাই দূরে। গাড়ি দুটো আমরা ওখানেই মানে পাকা রাস্তার ধারেই একটা খোলা জায়গায় পার্ক করেছিলাম। সেখান থেকে একটা পায়ে চলা রাস্তা অনেক ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠেছে। সেই পথের দুদিকে সুন্দর কফি বাগান। 

তো সিগারেট কিনতে যাবার সময় আমরা ঠিক করলাম পায়ে হাঁটা পথটা দিয়ে না গিয়ে আমরা কফি বাগানের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট নেবো। অত পাক খেয়ে খেয়ে নামতে তখন আর ইচ্ছে করছিলোনা।  ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে আমরা হাঁটছিলাম। সুমন একটু পর পরই বলছিল, “দা, কফি বাগানে সাপ থাকে? থাকলে গেছি আজ।” আমি ওকে ভয় দেখাচ্ছিলাম আরও, “কিং কোবরা থাকতে পারে। কিং কোবরা জানিস তো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে। ছোবল দিলে একেবারে মুখে কিস দেবে!” এসব বকতে বকতে একটু পরেই আমরা বুঝলাম পথ ঘেঁটে গেছে। এখান থেকে নীচের পাকা রাস্তা মোটেও আর দেখা যাচ্ছে না। সাপের ভয়ে কফি বাগান থেকে বেরতে আমরা দুজনেই ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছি। পাকা রাস্তায় কি করে পৌঁছানো যাবে, সেই সব ভাবছি। আর ভাবছি, একটাও লোক কেন দেখা যাচ্ছে না। মেজমামা বা গায়ত্রীকে ফোন করা যেত যাতে ওরা কেয়ারটেকারকে পাঠায়। কিন্তু এসব শুনলে মামা ভয়ানক বকবে। তবু ঠিক করলাম ফোন করব। ফোন করতেই যাচ্ছি ঠিক সে সময় একটা কুকুরকে দেখলাম। চাঁদের আলোয় কুকুরটার ঝাঁকড়া সাদা লোমগুলো ঝকঝক করছে। কুকুরটা একটু দূরে আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে লেজ নাড়ছে। আমরা দুজনেই কুকুরটার দিকে একটু এগিয়ে গেলাম। কুকুরটা পালালোনা। সে যে পথের উপর দাঁড়িয়েছিল, সেটা ধরেই একটু এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা আবার কুকুরটার দিকে এগোলাম। কুকুরটাও একটু এগিয়ে গিয়ে আবার অপেক্ষা করতে লাগল। সুমন বলল, “দা ওর পিছন পিছন চলো, পোষা মনে হচ্ছে। কারো না কারো বাড়ীতে তো নিয়ে যাবে।”

কুকুরটা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পাকা রাস্তায় নিয়ে এসে ফেলল।

এতক্ষণ এক টানা কথা বলে আমি চুপ করলাম। 

সুজয়া বলল, “এর মধ্যে আবার ভূতুড়ে কি আছে!”

“নেই তো।”

“রহস্যজনকও কিছু নেই। কুকুরটা নিশ্চয় পোষা। তোদেরকে দেখে বুঝতে পেরেছে তোরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিস। তাই তোদের হেল্প করেছে।”

“হ্যাঁ পোষাই হয়ত। কিন্তু রহস্যজনক ব্যাপারটা এখনো তো বলিনি।”

“ও আচ্ছা, সরি। বল, বল।”

“কুকুরটা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে শুধু যে রাস্তায় নিয়ে এলো তাই নয়। রাস্তায় আসার পরও আমরা ওর পিছন পিছন হাঁটছিলাম। কুকুরটা একটা চায়ের দোকানে সামনে এসে দাঁড়াল একটু পরেই।”

সুজয়া হাসল, “ও! বিস্কুট খাবে বলে এতোসব করছিল।”

“ঠিক, আমরাও তাই ভেবেছিলাম। আমরা কুকুরটার দিকে বিস্কুট ছুঁড়ে দিলাম, কুকুরটা কিন্তু শুঁকেও দেখলনা। সুমন তারপর একটা পাউরুটী ছুঁড়ে দিলো। কুকুরটা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যেন বিরক্ত হয়েই একটু দূরে চলে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। যেন আমাদের নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা ছাড়া আর ওর অন্য কোন কারণই নেই এখানে আসার।”

আমরা বেশ অবাক হয়েছিলাম। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অন্য কুকুর একটা দুটো করে ওখানে জড়ো হয়েছে দোকানটার সামনে। এতক্ষণ খেয়াল করিনি কিন্তু এখন দেখলাম  সেগুলো আমাদের ওই কুকুরটাকে ঘিরে ফেলেছে। তারা তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল।

“বেপাড়ার কুকুর দেখলেই কুকুরগুলো চিল-চিৎকার জোড়ে।” সুজয়া বলল।

“তা তো জোড়েই। আর বেপাড়ার কুকুরও চেঁচিয়ে ঝগড়া করে। তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“ওটাই অদ্ভুত। আমাদের এই কুকুরটা একটিও শব্দ করছিল না । শান্ত মনে যেভাবে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, একটুও না সরে একই ভাবে বসে থাকলো। আর ওকে ঘিরে সবকটা কুকুর যেন পাগল হয়ে উঠেছিল।”

“হুম,” সুজয়া চুপ করে গেলো।

সুমন অধৈর্য হয়ে উঠেছে, “দা, তারপরের ঘটনাটা বল?”

সুজয়া জিজ্ঞেস করলো, “হ্যাঁ, তারপর আবার কি হল? গায়ত্রী কিছু বলছে না? ও সব জানে এগুলো?”

গায়ত্রী বলল, “হ্যাঁ, এই গল্পটা মাঝে মাঝেই শুনতে হয়। তবে সে রাতে ওরা যা দেরি করে ফিরেছিল, আমিই টেনশনে পড়ে গেছিলাম।”

সুজয়া হাসল, “বল বল, তারপর?”

আমি সুমনের দিকে হাত বাড়ালাম। ও ওর আধ খাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে দিলো। সেটাতে একটা টান দিয়ে বললাম, “পরের কথাগুলো তো বিশ্বাস হবে না।”

সুজয়া বলল, “সেটা আমার ব্যাপার। তোর গল্পটা তো শুনি।”

আমি বললাম, “তুই কুকুরকে কখনো উলটোদিকে হাঁটতে দেখেছিস? মানে তোর দিকে তাকিয়ে আছে? কিন্তু পিছন দিকে হাঁটছে?”

“দেখেছি, ভয় পেলে অনেক সময় ওভাবে পিছিয়ে যেতে দেখেছি।”

“ফেরার সময় আমাদের কুকুরটা উলটো দিক করে হাঁটা শুরু করল। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু হাঁটছে উলটো দিকে। ব্যাটা ওভাবে হাঁটতেই থাকলো। হাঁটতেই থাকলো। সোজা হলই না।”

“ধুর! এ আবার হয় নাকি!”

সুমন এতক্ষণে বলল, “সুজয়াদি, আমি ছিলাম সেসময় ভুলে যাচ্ছো নাকি! আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

“এতো স্বাভাবিক ব্যাপার না!”

“সেটাই তো বলছি।”

“তারপর কুকুরটা কতদূর এলো? পুরো পথটাই এসেছিল? তোদের ঘর অবধি?”

সুমন বলল, “না গো, আমরা কুকুরটার পিছনে আর যাইনি। ও পিছনের দিকে হাঁটা শুরু করার পর আমরা দুজনেই অবাক হয়ে গেছিলাম খুব। কিছুক্ষণ হেঁটে দুজনেই দাঁড়িয়ে পরেছিলাম। দা বলল আর না এগোতে। কি ভিতু দেখো! অথচ প্রচুর হাবভাব নেয়। ভূতে বিশ্বাস করেনা, ইত্যাদি। ভয় কিন্তু ষোল আনা। দা না বললে আমি ঠিক ওর পিছন পিছন যেতাম।”

“পিছন, পিছন না । সামনে, সামনে!” আমি বললাম।

“তা তোরা ঠিকঠাক ফিরে গেলি তারপর?”

“হ্যাঁ, পাকা রাস্তাতে তো ছিলামই। রাস্তাটাও চিনতে পারছিলাম। একটু এগোতেই আমাদের গাড়িও দেখতে পেলাম। ফিরতে অসুবিধে হয়নি। যাওয়ার সময় তো স্রেফ শর্টকাট মারতে গিয়ে ফেঁসে গেছিলাম।” সুমন বলল।

“কুকুরটার কি হল?”

“ও হাঁটতেই থাকলো। কিছুক্ষণ পরে আর দেখতে পেলাম না। কুয়াশা ছিল খুব। ”

“না, রে । এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে কিন্তু খুব অদ্ভুত। তো হাসানবাবু আপনি নিশ্চয় তারপর অনেক অ্যানালিসিস করলেন ঘরে ফিরে?” সুজয়া হাসছে।

“তা করলাম। গিয়েই গুগল-এ সার্চ মারলাম, Can dog walk backwards! তাতে দেখলাম ট্রেনিং পেলে কুকুর এমন হাঁটতেই পারে। কুকুরের পক্ষে পিছনের দিকে হাঁটা অসম্ভব কিছু নয়। অস্বাভাবিক যদিও। কুকুরের নিউরোলজিকাল প্রবলেম থাকলেও এমন হতে পারে।”

সুমন বলল, “যা তা বলছ দা, আসার সময় হঠাৎ করে কুকুরের নিউরলজিকাল প্রবলেম শুরু হল!”

গায়ত্রী বলল, “আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে কুকুরটার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম ছিল? ওকে ঘিরে যখন অন্য কুকুরগুলো চিৎকার শুরু করল তখন সেটা ট্রিগার হল?”

সুমন হো হো করে হেসে উঠল, “ভাবী, কুকুরের মানসিক সমস্যা?”

সুজয়া বলল, “মানুষের হতে পারে, কুকুর কি দোষ করলো? কুকুরেরও তো মন আছে।”

আমি বললাম, “কে জানে কি! মোদ্দা কথা ব্যাপারটা অদ্ভুত।”

রাত প্রায় বারোটা। সুমন বলল, “দা, আরেকটা বিয়ার হোক?” আমি বললাম, “একদম!” গায়ত্রী বলল, “আমারও খিদে পাচ্ছে। একটু চিপস খাই?”

আমি বললাম, “বাড়িতে ব্ল্যাক কফি আর বাইরে বেরিয়ে চিপস!”

সুজয়া বলল, “দাঁড়াও আমার ব্যাগটাতে আছে, উপর থেকে নিয়ে আসি।”

সুজয়া উপরে গেলো। গায়ত্রী বিতানকে দেখে এলো উকি দিয়ে। এসে বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছে।” 

আমি বললাম, “অথবা জাপানি গান শুনছে।”

সুজয়া ফিরে এসেছে। হাতে তিনটে বড় বড় চিপসের প্যাকেট। বলল, “তোরা যেসব গল্প শোনাচ্ছিস! উপরে একা একা ভয় লাগছিল।”

সুমন হেসে বলল, “আরে ঘাবড়িয়ো না, দা আছে তো। সব এক্সপ্লেন করে দেবে। নো ভূত!”

আমি বিয়ার-এ চুমুক দিলাম, “আরবি রূপকথায় জ্বিন বলে একটা কিছু হয়, সেটা জানিস?”

“জানি জানি,” সুমন বলল।

“সুজয়া জানিস?”

“না রে, সেরকম কিছু একটা শুনেছিলাম। কিন্তু বুঝিনি। জ্বিন মানে আরবের ভূত?”

“ঠিক তা না। আরবি রূপকথা বলছে জ্বিন একটা লিভিং বিইং। মানুষের মতই বা অন্য যেকোনো প্রাণীর মত। খালি কয়েকটা ডিফারেন্স আছে। তার মধ্যে একটা হল, মানুষ জ্বিনকে দেখতে পায়না। জ্বিন কিন্তু মানুষ দেখতেও পায় আবার মানুষের উপর ভরও করতে পারে।কুকুরও জ্বিন দেখতে পায়।”

“এটা কি কুকুরের গল্পটার সাথে রিলেটেড?”

“কে জানে! আসলে তুই যে বললি না, কুকুর ভয় পেলে ওভাবে হাঁটে! ধর এমন যদি হত যে আমার বা সুমন-এর মধ্যে জ্বিন ছিল? সেটা কুকুরটা বুঝতে পারার পরই ভয় পেয়ে ওভাবে হাঁটতে শুরু করেছিল? আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে যে খালা কাজ করতো সে বলতো, মগরেবের পর গাছতলায় জাবা না। জ্বিন ধরব্যানি। আমরা তো সেরাতে কতক্ষণ বাগানেই ঘুরঘুর করছিলাম।”

সুমন বিয়ারে চুমুক দিতে গিয়েও দিলো না। গ্লাস নামিয়ে রেখে বলল, “দা, এসব কি বলছ? তুমি সিরিয়াস?”

আমি বললাম, “অবশ্যই সিরিয়াস!”

“তুমি তো ভূতেই বিশ্বাস করোনা। মানে আমি তো তাই জানতাম।”

“বিশ্বাস করিনা তো। কিন্তু আমি ভূতের রুলবুক দিয়ে ভূতুড়ে গল্প বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া রহস্যজনক অনেক কিছুই তো পৃথিবীতে ঘটে! আমাদের উচিত চোখ, কান, মাথা খোলা রাখা।”

সুজয়া বলল, “একবার বলছিস ভূতে বিশ্বাস নেই, আবার বলছিস রহস্যজনক কিছু ঘটতেই পারে।”

আমি বললাম, “আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমার এরকম কয়েকটা অভিজ্ঞতা হয়েছে যেটা আমি হাজার চেষ্টা করেও ব্যাখ্যা করতে পারিনি। অথচ আমি কিন্তু ভীষণ চাই কারণটা খুঁজে বের করতে। যেমন এই কুকুরের গল্পটা । এটার কোন ব্যাখ্যাই মনে ধরেনা। মনে হয় গোঁজামিল দিচ্ছি!”

“তাই বলে, জ্বিন, ভূত এসব আটভাট ভাববি?”

“ভূতের গল্প শুনছিসই বা কেন তাহলে!”

“আরে শুনতে মজা লাগে তাই শুনি! বেশ গা ছমছম করে! কি বল, সুমন!” সুজয়া হাসল।

সুমন বলল, “আমি সব বিশ্বাস করি। সব আছে। জ্বিন, ভূত, ভগবান, আল্লা, নরক, দোজখ!”

গায়ত্রী বলল, “ধুর, এর মধ্যে আবার ভগবানকে টানিস না তো! তবে ভূতের সিনেমা দেখতে কিন্তু ভালোই লাগে, বল সুমন?”

“আমার আজকাল সিনেমা দেখার টাইমই হয়না, ভাবী। তবে আগে যখন দেখতাম ভালোই ভয় লাগতো। রাতে আর ঘুমাতেই পারতাম্ না। বাথরুম যেতেও ভয় লাগতো!”

“তোর দাদা কিন্তু রাতে ভূতের সিনেমা দেখে আজও। তাও আবার লাইট টাইট নিভিয়ে। একা একা। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে।”

আমি গায়ত্রীর দিকে তাকাই। হেসে বলি, “ও তুমি ভাবো আমি রাত হলে জেগে জেগে ভূতের সিনেমা দেখি?”

গায়ত্রী বলে, “না তা বলছিনা, তুমি গল্পটল্পও লেখ। কিন্তু কম । সিনেমাটাই বেশি দেখো!”

আমি বললাম, “ভালো মনে করিয়েছ। তোমাদের কাউকেই একটা ঘটনার কথা বলা হয়নি। আসলে ব্যাপারটা তো কিছুই না সেরকম! আমিও ভুলে গেছিলাম। এখুনি মনে পড়ল।”

সুমন বলে, “এটা কি কেস?”

“ঘুম টুম পাচ্ছেনা তো?” 

“আরে না না, বিয়ার শেষ হতে হতে এখনো আধ ঘণ্টা। বলো না।”

“সুজয়া, শুনবি নাকি ঘুমাতে যাবি?”

“না, না। আমার একটুও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। চিপস একটু বেশি কিনলে হত, বলো গায়ত্রী?”

গায়ত্রী বলল, “আমার কাছে শোনপাপড়ির একটা প্যাকেট আছে। দাঁড়াও নিয়ে আসি।”

“বিয়ারটা বেশি খাওয়া যায় না। বিচ্ছিরি টেস্ট।” সুমন বলল।

“বিয়ারের নামটা বেশ, বল? হিট! গা গরম করে বলে?” আমি হাসলাম।

গায়ত্রী শোনপাপড়ির একটা বড় প্যাকেট নিয়ে এসেছে। প্যাকেটটা মাঝখানে রেখে আমরা সবাই একটা দুটো করে তুলে নিলাম।

সুমন বলল, “বলে ফেল এবার, দা।”

আমি শোনপাপড়ি খেতে খেতে বললাম, “আমার একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে জানিস তো? যেখানে আমি গল্পটল্প পড়ি মাঝে মাঝে?”

“জানি, জানি, গপ্পোবাজ নাম তো?”

“হ্যাঁ। তো সেখানে তুই শুনেছিস কিনা জানিনা, তবে “দ্য এক্সরসিস্ট” বলে গল্পটা যখন রেডি করছিলাম তখন একটা ব্যাপার হয়েছিল।”

“কি?”

আমি সে রাতটার কথা মনে করলাম আবার। বেশি চেষ্টা করতে হলনা। ঘটনাটা স্মৃতির খুব উপরের দিকেই আছে। চোখ বুজে ভাবলেই সে রাতের শব্দ, গন্ধ সব মনে পড়ে যায়।

“আমি তো গল্পের আবহটাও তৈরি করতাম। নানা ধরনের শব্দ নিয়ে নানা রকম ভাবে মিক্স করে দেখতাম কিভাবে সেটা আমার পাঠের আবহতে ইউজ করা যায়, কোন কোন শব্দে শ্রোতাকে আরও ভয় দেখানো যায়। এই সব। যেমন ধর যদি কথার পিচটা কমিয়ে দিস তাহলে কথাটা আরও ভারি শোনায়। পিচ খুব কমিয়ে দিলে ভয়ঙ্কর রকমের ভারি হয়ে যায়। তার সাথে একটু ডিস্টরশন এফেক্ট দিয়ে অথবা ইন্টারনেট থেকে কোন একটা বিদঘুটে চিৎকারের শব্দ জুড়ে দিয়ে বিকট ধরনের সব শব্দ তৈরি করা যায়। বুঝলি?”

“বুঝলাম, সাউন্ড মিক্সিং করতে।”

“ঠিক। যেমন এক্সরসিস্ট পড়ার সময় আমাকে ভূতটার ভয়েস বানাতে হয়েছিল। সেসব নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট  করতে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন সব শব্দ তৈরি   করে ফেলতাম যেটা শুনে আমি নিজেই ঘাবড়ে যেতাম। আর এসব করতাম একা আমার ঘরে। সবাই শুয়ে পড়লে, মাঝ রাতে। ঘর অন্ধকার করে। ল্যাপটপ, হেড ফোন নিয়ে মশারির ভিতর ঢুকে যেতাম। তাতে বেশ ফিল আসত। ভয় পেতে মজাও লাগতো। এক রাতে এসব করতে করতে এমন একটা শব্দ বানিয়ে ফেলেছিলাম যে আমি ঘাবড়ে গেছিলাম বেশ। বানিয়েছিলাম বলাটা ভুল অবশ্য। আমি বানালে তো আমি এক্সপ্লেন করতে পারতাম।  শব্দটা কিভাবে এলো আমি বুঝেই পাচ্ছিলাম না। কয়েকবার শব্দটা শুনে আমার কেমন অস্বস্তি আর ভয় লাগতে শুরু করল। যেন এটা শোনা আমার ঠিক হচ্ছে না। তখন রাত প্রায় তিনটে। আমি ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছিল না। আমি ল্যাপটপ পাশে রেখেই ঘুমিয়ে পড়তাম, কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিল ল্যাপটপটা মশারির বাইরে রেখে আসি। আমার কোনদিন এর আগে এরকম ভয় লাগেনি। কিন্তু সেদিন বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। কানে বাজছিল শব্দটা।”

“শব্দটা কি রকম?” সুজয়া প্রশ্ন করল।

“যেন ভীষণ শক্তিশালী একজন কেউ পাশে আছে। তার শ্বাসের শব্দ। ঘড়ঘড়ে নয় কিন্তু খুব ভারি। ঠিক যেন ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে সে। ভয়ঙ্কর একটা শব্দ।”

“শোনাতে পারবি? তোর কাছে আছে নিশ্চয়?”

“না, নেই।”

“যাহ ডিলিট করে দিয়েছিস?”

“হ্যাঁ।”

“ডিলিট করলি কেন?”

“ওই যে বললাম, শোনাটা ঠিক মনে হচ্ছিল না।”

সুমন বলল, “জানি, তুমি হেবি ভিতু। কিন্তু তুমি ডিলিট করে দিয়েছ আমার বিশ্বাস হয়না। শালা কুড়ি বছর আগের তোলা ছবি তুমি নতুন হার্ড ড্রাইভ কিনে সেভ করে রাখো। আর সেই তুমি এমন জিনিষ ডিলিট করে দেবে?”

আমি বললাম, “ডিলিট না করলে নিশ্চয় ওটা “দ্য এক্সরসিস্ট” গল্পটাতেই আছে। শুনে দেখিস তো একবার ওরকম কিছু আছে কিনা।”

“ওসব ঠিক আছে, কিন্তু তুমি এত ভিতু কেন বল তো?” সুমন রাগ রাগ চোখ করে আমার দিকে তাকায়। যেন ও সত্যি আমার উপর খুব বিরক্ত হয়েছে।

গল্পের ঠিক এই পর্যায়ে আমাদের ঘরের ভেজানো দরজা খুলে বিতান বেরিয়ে এলো। বিতান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চশমাটাও পরেনি। চোখে ঘুম লেগে আছে এখনো। দৃষ্টি কেমন অদ্ভুত।

গায়ত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হল, বেটা? ঘুম ভেঙে গেলো?”

ছেলের মুখটাতে কেমন ভয় মেশানো। বলল, “পাপা, আমি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুমি কি আমার কানে  জোরে জোরে ব্রিদ করছিলে? ওতেই তো আমার ঘুম ভেঙে গেলো।”

আমার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। ঠিক শুনলাম?

সুমন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

গায়ত্রী দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকল। কি দেখবার জন্য কে জানে! সুমন এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সুজয়া চুপচাপ বসে আছে। কি ভাবছে বুঝতে পারলাম না। গায়ত্রী বেরিয়ে এসেছে। এখন বিতান আর গায়ত্রী দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  যেন আমি ঠিক বুঝিয়ে দিতে পারবো কি হয়েছে।

আমার মাথায় কিছুই আসছে না। কাছে এসে ছেলেকে জড়িয়ে বললাম,”হ্যাঁ বাবা, আমিই শুয়েছিলাম। জাস্ট উঠে এসেছি।”

ছেলে অল্প অল্প কাঁপছে মনে হল। আমি যে মিথ্যে বলছি ও কি বুঝে ফেলেছে?

আমার অবশ্য ভয় লাগছেনা। খারাপও লাগছে না। এই পৃথিবীতে ইন্টারনেট ছাড়াও অনেক অদ্ভুত ব্যাপার আছে, রহস্য আছে, অজানা আছে, রূপকথা আছে। এসব আছে বলেই না পৃথিবীটা এত সুন্দর? 

আমি বোধহয় একটু খুশিই হয়েছি ছেলের সাক্ষাৎ হয়েছে এই রহস্যময়তার সাথে। একটা চোদ্দ বছরের ছেলের কাছে পৃথিবী বোরিং হওয়ার চাইতে এ ঢের ভালো।

একটু পরে সুমন বলল, “দা, আমি তোমাদের ঘরে ঘুমালে অসুবিধে হবে?”

গায়ত্রী বলল, “এই কদিন সবাই এক ঘরেই তো ঘুমানো যায়।”

শেষ অবধি তাই ঠিক হল। 

আমরা পাঁচ জন আমাদের ঘরের বিছানায় আড়াআড়ি শুলাম। বিতানের এক পাশে আমি, অন্য পাশে গায়ত্রী। আমার অন্য পাশে সুমন। গায়ত্রীর পাশে সুজয়া। সুজয়া আবার ক্যামেরা সাথে নিয়ে শুয়েছে। ও নাকি আধ  ঘণ্টা পর পর ঘরের ছবি নেবে। যদি ছবিতে কিছু ধরা পড়ে!

খাটের বাইরে পা কিছুটা বেরিয়ে আছে বলে একটু একটু ভয় লাগছে। কিন্তু তার থেকে বেশি আমার ভালো লাগছিল। এতজন এক বিছানাতে শুয়েছি সেই ছোটবেলায়। নানিমা বেঁচে ছিল তখন। মামাবাড়ি গেলে আমার এক পাশে নানিমা শুতো, অন্য পাশে মা। আমি কখনো মাকে, কখনো নানিমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম। এখন বিতান ঠিক তাই করছে। জাপটে ধরে আছে আমাকে। ইয়ারফোনও নেয় নি । মজার কথা হচ্ছে সুমনও আমার কাঁধে আলতো করে হাত ঠেকিয়ে রেখেছে। 

ভালবাসার এই বর্ম ভেদ করে কোন ভূত, জ্বিন, হাবিজাবির ঢোকার উপায় নেই আর।

Facebook Comments