রূপক মালাকার
২৫শে মে, ২০২০। আমেরিকার মিনিয়াপলিশ শহরে, জর্জ ফ্লয়েড নামে এক জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে মিনিয়াপলিশ শহরের শ্বেতাঙ্গ পুলিশ হাঁটুর তলা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলে। সে অনেকবার বলার চেষ্টা করে যে সে দম নিতে পারছেনা, কিন্তু সেই নির্মম পুলিশ তার আর্তনাদ শোনেনি এবং তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। অন্য পুলিশ সহকর্মীরা সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।
সেই ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং সামাজিক মাধ্যম গুলোর দৌলতে ভাইরাল হতে বেশিক্ষণ লাগেনি। শুরু হল প্রতিবাদ । প্রথমে মিনিয়াপলিশ শহর, সেখান থেকে আমেরিকার অন্যান্য শহর এবং পরবর্তী কালে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে। সেই প্রতিবাদের নাম দেওয়া হল ’ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’।
এবার আমরা যদি একটু পিছিয়ে গিয়ে আমেরিকার ইতিহাস দেখি, বিশ্ব বিখ্যাত আফ্রিকান আমেরিকান, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধি, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ডঃ মারটিন লুথার কিং জুঃ, বর্ণবিদ্বেষ এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং বিপুল জনমত গঠন করেন।
২৮শে অগাস্ট, ১৯৬৩ সালে, তিনি আমেরিকার ওয়াশিংটন ডি সি রাজ্যের লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এক বিপুল জনসভার আয়োজন করেন| তাতে লক্ষাধিক মানুষ যোগদান করে। সেই সভামঞ্চ থেকে দেন তার সেই ১৭ মিনিটের বিখ্যাত বক্তৃতা যা সকলের কাছে পরিচিত ‘আই হ্যাভ আ ড্রীম’ নামে।
সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে তিনি সেই আমেরিকাকে দেখতে চান যেখানে ক্রীতদাসের ছেলে এবং ক্রীতদাস মালিকের ছেলে একই টেবিলে বসবে। বলেছিলেন যে সেই আমেরিকাকে দেখতে চান যেখানে তার ছেলেমেয়েদের গায়ের রঙ না দেখে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে যেন বিচার করা হয়।
যদিও দুর্ভাগ্যের বিষয় তার সেই বিখ্যাত বক্তৃতার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়। সন্দেহ করা হয় তার হত্যার পিছনে রাষ্ট্রের হাত ছিল।
সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখি, আমেরিকা তাদের ইতিহাসে প্রথমবার আফ্রিকান আমেরিকান, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বারাক ওবামাকে তাদের দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন, এবং পরে দ্বিতীয় বারের জন্য পুনঃনির্বাচিত হন| এরপরেও প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্তে দেখি চারিদিকে বর্ণবিদ্বেষ এর বিষ ছড়িয়ে আছে বাসে, ট্রেনে, রেস্তোরাঁ, অফিসে, আদালতে সর্বত্র।
এর মধ্যে আমেরিকা সহ অনেক উন্নত দেশে বর্ণবিদ্বেষ এর বিরুদ্ধে অনেক আইন বলবত করা হয়েছে। যদিও বাস্তব হল বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গরা আগেও কৃষ্ণাঙ্গদের ঘৃণা করত ,মনে প্রানে এখনও করে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
এবারে আসি ভারতবর্ষের নিম্নবর্ণ হিন্দুদের কথায়, যাদের অপরনাম অস্পৃশ্য। এই কিছুদিন আগেও তাদের স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত এমনকি মন্দিরেও ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। শারীরিক, মানসিক নির্যাতন ছিল দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী।
তাদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এলেন সমাজ সংস্কারক এবং নিম্নবর্ণ হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকর। যার বাল্য ও কৈশোর জীবনে প্রতিনিয়ত ছিল লাঞ্ছনা, অপমান, অত্যাচার এবং প্রতিকুলতায় ভরা। তিনি এই চরম বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে সমর্থ হন। তিনি বুঝে ছিলেন দলিত সমাজকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে গেলে তাদের জন্য চাই সংরক্ষণ। একমাত্র শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পারবে এই উচ্চবর্ণ হিন্দুদের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে। যদিও প্রতিনিয়ত ভারতের উচ্চবর্ণ হিন্দুরা এর প্রবল প্রতিবাদ করে, এমনকি সমসাময়িক ভারতবর্ষের বিখ্যাত উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারাও সর্বদা প্রতিরোধের সম্মুখীন হতেন।
যাইহোক তার মানসিক দৃঢ়তা অবশেষে ভারতবর্ষের সংবিধানে নিম্নবর্ণ হিন্দুদের শিক্ষা, চাকুরী এবং আইন সভায় সংরক্ষণের মাধ্যমে যোগদানের সুব্যবস্থা করে।
যদিও আজ ওই আইন প্রণয়নের সত্তর বছর পরেও ভারতবর্ষের দশ শতাংশ নিম্নবর্ণ হিন্দুরা ওই সুযোগের আওতায় আসতে পারেনি। প্রতিনিয়ত নিম্নবর্ণ হিন্দুদের অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা শুনতে হয় উচ্চবর্ণ হিন্দুদের থেকে, সে শিক্ষা ক্ষেত্র হোক বা চাকুরী ক্ষেত্র।
কৃষ্ণাঙ্গ বা নিম্নবর্ণ হিন্দুদের উপর এই বৈষম্য অনন্তকাল থেকে চলছে এবং চলবে। সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ বা নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রতিটি মানুষকে সর্বদা প্রতি মুহূর্তে একটাই কথা মনে রাখতে হবে যে আমাদের শিক্ষিত হতে হবে। একবেলা অনাহারে থাকলেও বাবা মায়েরা যেন তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করেন। শিক্ষা সুনিশ্চিত হলে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, যা এই সমাজে জরুরী।
শিক্ষাই হল আসল হাতিয়ার যেটা এই বর্ণ বৈষম্যকে চেপে রাখতে পারে। বলাই বাহুল্য, বর্ণ বৈষম্য ছিল, আছে এবং থাকবে।
সময়োপযগী লেখা ৷
শুভেচ্ছা রইল রূপক।
Very relevant article, Rupak! Hope to see more from you.