Site Overlay

বাজারী গপ্পো

অভিযান ভট্টাচার্য্য

জাতীয় সড়কের ধারে একটা অস্থায়ী বাজার বসছে বেশ কিছু বছর ৷ পাশের গ্রামগুলোর মাঠ থেকে সবজী নিয়ে এসে গুটি কয়েক লোক বাজার নিয়ে বসতে শুরু করেছিল বছর ১৫ আগে ৷ স্থানীয় ক্লাবের বদান্যতায় সে বাজারের আজ বেশ নামডাক – দুপুর অব্দি জনসমাগমে রমরম করে ৷ দূরপাল্লা বাসের দুরন্তপনা থমকে যায় বাজারের কাছাকাছি এসে ৷

সেই শুরুর দিন থেকে কাশেম রাস্তার পাশে একটা বাড়ির কোনে চাটাই পেতে বাজার নিয়ে বসছে ৷ অনেকদিনের চেনা ৷ পাশ দিয়ে গেলেই আর রক্ষে নেই।

“ বড়বাবু, তোমার জন্যি হেব্বি সব্জী আনছি৷ দুই কিলো নে যাও ৷” বলেই পাকড়াও করে টপাটপ আনাজ ঢুকিয়ে দেবে ব্যাগে ৷ বাড়ী ঢুকলেই স্ত্রীর বাক্যবান শুরু : “ পই পই করে বলেছি, ওই ডাকাতটার কাছ থেকে জিনিস নেবে না ৷ তোমাকে ভালো মানুষ পেয়ে ও ঝাঁকা খালি করে, দিনের মতো বেচাকেনা শেষ করে, দেখোগে এতক্ষনে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে ৷ আমার হয়েছে যত ঝঞ্ঝাট ৷ এতো সব্জী কোথায় রাখি, কোথায় তুলি ! এসব বেহিসেবী আপনভোলা লোককে নিয়ে সংসার করার যে কি জ্বালা!”

 তাই স্বগৃহে সম্মান ও শান্তি রক্ষার্থে আমি মাঝে মাঝেই বিবেক বর্জিত হয়ে ওর ওই “ বড়বাবু” ডাক উপেক্ষা করে পালিয়ে পালিয়ে বাজার করি ৷ কিন্তু ওই বড়জোর এক পক্ষকাল | তারপর ডাকে সাড়া দিতেই হয়; গৃহে অপেক্ষমান অবশ্যম্ভাবী কর্কশ ঝঙ্কারের ভয় স্বীকার করেই ৷

 এইভাবেই চক্রবৎ চলছে এতগুলো বছর ৷ তবে একটা কথা স্বীকার করা প্রয়োজন৷ এই যে কাশেম ব্যাটার ডাকে ধরা দিই, সেটা শুধু ওর ডাকের জন্য নয় ৷ বিশ্বাস করুন, ওই গেঁয়ো সম্বোধনে এমন কিছু সম্মোহন নেই ৷ কিন্তু চোখ টানে ওর আপদমস্তক বৈপরীত্যমাখা চেহারাটা ৷ ছেঁড়াফাটা স্যান্ডো গেঞ্জী, খাটো চেককাটা লুঙ্গী , কোমরে কষে বাঁধা ময়লা গামছা নিয়ে তার গ্রাম্য টানের সাথে পল্লীবাংলা সম্পৃক্ত হয়ে আছে ৷ কিন্তু সেসব ছাপিয়ে আমার বার বার নজর চলে যায় ওর অন্য সব্জী বিক্রেতাদের থেকে একদম পৃথক দেহ বৈশিষ্টের দিকে ৷ বেশ বড় কটা চোখ, তপ্ত তামাটে মসৃন লম্বা মুখমন্ডলে হাল্কা সোনালী গোঁফের পাতলা আস্তরণ, সাধারণ বাঙালীর থেকে অনেক পাতলা এবং লালচে ঠোঁট, উন্নত হনু ৷ উচ্চতা অবশ্য বেশী নয় ৷ মনে মনে ভাবি, ও যেন বাঙলা খবরের কাগজের মোড়কে এক কুঁচি আফগানী হিং! যবে থেকে ইতিহাসের পোকা মাথায় নড়েছে, তবে থেকেই ওর চেহারাটা দেখি, আর নানান অসংলগ্ন চিন্তা মাথায় আসে ৷ সব থেকে বড় কথা , এই চেহারাটা যেন আগে কোথায় দেখেছি মনে হয় ৷

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, কস্মিনকালেও আমি কোন কাবলিওলার ছায়া মাড়াইনি, বা কাবলিওলাদের দেশে যাইও নি ৷ তাই অন্য কোন চাক্ষুষ করা চেহারার সাথে কাশেমের অবয়ব মিলে বিভ্রান্তি ঘটার কোনরূপ অবকাশ নেই ৷

কিন্তু মহা বিভ্রাট বাঁধল এই কদিন আগে ৷ সেদিন আমার হিসেব মত ‘ কাশেম বর্জন পক্ষ’ চলছে ৷ ওর ডাক উপেক্ষা করে বাজারের ব্যাগ বগলদাবা করে হনহানিয়ে পাশ কাটাচ্ছি ৷ এমন সময় নিজের চাটাই ছেড়ে সে দেখি হঠাৎ আমার সামনে উপস্থিত !

“ বড়বাবু , আমারে ভুলি চলি যাচ্চ ! কতকরে ডাকতিচি!” দেখি পেল্লাই একটা সাদা চকচকে থোড় আমার সামনে বাগিয়ে ধরেছে ৷ " বিশ্বাস কর বড়বাবু , গোটা বাজ়ার ঢুঁইড়ে এরম কচি থোড় পাবে নি ৷ সেই সকালে তোমার মুখ মনে করেই কেইটে এনিচি ৷ আর সবারে আমি পঁচিশ ট্যাকার নীচে দেবই না ৷ কিন্তু তোমার জ়ন্যি বিশ ট্যাকা৷” বলতে বলতে নাকের ডগায় নধর কচি থোড়খানা কাশেম নাড়িয়েই চলেছে ৷ সকালের রোদ পড়ে থোড়খানার একপাশ থেকে আলোর দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে – যেন শানিত তরবারি ! মনে মনে গৃহকর্ত্রীর থেকে সম্ভাব্য গঞ্জনার পরিমাপ করতে করতে তাকিয়ে থাকলাম ওই তরবারি সদৃশ চিকন ঘূর্ণায়মান থোরের দিকে ৷

হঠাৎ যে কি হল ! দেখি হাটবাজার উধাও! ঘরবাড়ির জায়গায় সব লম্বা লম্বা গাছ ! চারিদিকে ঘন জঙ্গল ! আমাকে কারা যেন ঘিরে রেখেছে ! আমার গলার কাছে ফনার মতো উদ্ধত তরোয়াল ধরে আছে এক সৈনিক ৷ মাথায় উষ্ণীশ, গায়ে বর্ম, পিঠে চর্ম | মুখখানা দেখি বড় চেনা ! যেন একেবারে কাশেমের মতোই ! ঝকঝকে পাঠান সেনা! আশপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখি কতগুলো সৈন্য সঙ্গীন তাক করে আমায় ঘিরে রেখেছে ৷ মনে হয় পাঠান সেনার অধস্তন | চেহারায় মনে হয় তারা সকলেই নমঃশূদ্র বা বাগদী ইত্যাদি ভূমিপুত্রর দল | বগলদাবা করা বাজারের ব্যাগটা পাঠান ছিনিয়ে নেবার মতন টেনে নিল ৷ ওমা , কোথায় ব্যাগ! এযে ভূর্যপত্রে আঁকা মানচিত্র ! আমার পোষাকও হয়ে গেছে কোন সেকেলে ! গায়ের চাদর হয়ে গেছে নামাবলী ৷

সে ভালো করে মানচিত্রে চোখ বোলাল ৷ ফারসী মেশানো বাংলায় জিঞ্জেস করল, “এটা কি?” আমি বললাম, "একমাত্র যশোরাধিপতি প্রতাপাদিত্যের বিশ্বস্ত সৈনিকের কাছেই সমস্ত বৃত্তান্ত বিধৃত করতে পারি ৷ নচেত প্রাণ থাকতে নয় ৷”

সে একজন দেশীয় সেনাকে ইশারায় কাছে ডেকে আমায় বলল, “ ও ভীম ৷ ওকে প্রশ্নসংকেত বল ৷ ও উত্তর দেবে ৷ ”

আমি বললাম, “খরার সেনা মরে কিসে ?”
উত্তর এল, “ জলার দেশের আশীবিষে ৷”

এবার পাঠান তরবারি নামিয়ে প্রশ্ন করল, “ বল তুমি কে? কোথায় যাচ্ছ ? এই মানচিত্র সঙ্গে কেন?”

বললাম, “ আমি আন্দুলিয়া নিবাসী ব্রাহ্মণ ৷ পূজা অর্চনার কাজে ভবানন্দ মজুমদারের বসতবাটিতে আমার প্রায়ই যাতায়াত আছে ৷”

এই টুকু শুনেই সমস্ত সৈন্য আবার অস্ত্র উঁচিয়ে আমার দিকে নিশানা বাগালো ৷ যেন হুকুম পেলেই আমায় ফালাফালা করে শেষ করে দেবে ৷ ভীম চিৎকার করে উঠল, “ তুই বিশ্বাসঘাতক ভবানন্দের অন্নে পালিত ? আজ তোর রক্ষে নেই ! আকবর বাদশার আমল থেকে যশোর লুটে নেবার জন্য মুঘল দরবার একের পর এক সেনাপতি পাঠিয়েছে ৷ সবাইকে এই মাটিতে নিকেশ করেছি ৷ আজম খাঁ-কে যেমন শেষ করেছি, ঠিক সেইরকম সব কটা মুঘল বাহিনীকে ফাঁদ পেতে হয় গঙ্গা , নয়তো যমুনার ধার অব্দি টেনে নিয়ে এসে রসদ ফুরিয়ে দিয়ে ভাতে মেরেছি ৷ তারপর সিংহের মতো আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে মনের সুখে হাতে মেরেছি ৷ জাহাঙ্গীর বাদশা যখন বাংলার হাতে দিল্লীর দরবারের লজ্জা বরদাস্ত না করতে পেরে মানসিংকে পাঠাল, তখনও একই রকমভাবে যশোরাধিপতি প্রতাপ মানসিংয়ের জন্য যমের দুয়ারের পথ তৈরী করছিলেন ৷ বাংলার প্রজারা দিল্লীর লুটেরাদের জন্য একমুঠো তন্ডুলও দেয় নি ৷ এতদিনে মানসিংহকে দলবল শুদ্ধু যমুনায় চুবিয়ে নিকেশ করে দিতাম, যদি না তোর ভবানন্দ আর কচু রায়রা মিলে বিশ্বাসঘাতকতা করত ৷ যমুনার তীরে ওরাই মানসিং -এর শিবিরে যোগ দিয়ে রসদ জোগাড় করেছে ৷ বাংলার সাধারণ কৃষক, প্রজা স্বাধীনতার মূল্য বোঝে ৷ কিন্তু তোর মালিকেরা বোঝেনা | তারা বোঝে শুধু ঈর্ষা আর ক্ষমতা ৷ বিশ্বাসঘাতী ভবানন্দকে কবে পাব জানিনা | আয় আজ তোকে নিকেশ করেই মনের জ্বালা মেটাই ৷”

“ ভুল করছ ভাই” , দৃঢ় ভাবে বললাম আমি, “ ভবানন্দের অন্তঃপুরের সংবাদ সংগ্রই আমার কাজ ৷ আমি যশোরাধিপতি -র গূঢ়পুরুষ বাহিনীর সহায়ক হয়ে কাজ করি ৷ আমার নাম রামজয় ভট্ট ৷ স্বজাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ক্লিষ্ট বঙ্গভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে আমি গূঢ় পুরুষদের উদ্দেশ্যে গোপনে আন্দুলিয়ায় ভবানন্দের প্রাসাদ ছেড়েছিলাম ৷ কিন্তু, শুনতে পেলাম সলকার যুদ্ধে যশোরবাহিনীর পশ্চাদপসরনের পর গূঢ় পুরুষরা অনেকেই ধূমঘাটের দূর্গ রক্ষার্থে যশোর বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন ৷ অবগুণ্ঠন মুক্ত হয়ে তাঁরা জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষার শেষ লড়াই লড়তে সম্মুখ সমরেই প্রাণ দেবার মনস্থ করেছেন ৷ কিন্তু যে সংবাদ আমি নিয়ে চলেছি, তা যদি অতি দ্রুত ধূমঘাট না পৌঁছায়, তবে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য হয়তো চিরতরে মোগলের হাতে অস্তমিত হবে ৷ "

“ বটে! কী সেই সংবাদ ? আর এই পথেই বা তুমি হেঁটে এসেছ কেন?” প্রশ্ন করল পাঠান ৷

“ গূঢ় পুরুষদের সন্ধান না পেয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম ৷ আমার নিজেরও কোন অশ্ব নেই যে ধূমঘাটের পথে আমি একাই ছুটে যাব ৷ হঠাৎ মনে পড়ল, এক গূঢ়পুরুষ আমায় বলেছিলেন, যমুনা আর ইছামতীর মাঝে কিছু কিছু অরণ্যভূমিতে যশোরবাহিনীর ছোট ছোট সশস্ত্র সৈন্যদল নজরদারী রাখছে এক ত্রক জন অধিকারীর অধীনে ৷ মুঘল বাহিনী যদি যমুনার তীর থেকে অরণ্য পথে ইছামতীর তীর প্রান্তে এসে যশোরের গোপন নৌ-সজ্জাকে ধ্বস্ত করতে অগ্রসর হয়, তবে যশোরবাহিনীর এই ছোট অরণ্যচারী দলগুলি অগ্রসরমান মুঘলবাহিনীদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করবে ৷ গুপ্ত তথ্য অনুযায়ী আন্দুলিয়ার নিকটতম এই স্থানেই মীর কাজ়িম কররানী নামে এক অধিকারী ঢালী, রায়বেঁশে আর কুকী বাহিনীর থেকে কিছু কিছু সৈন্য নিয়ে অবস্থান করছেন ৷ এখন বোধ হচ্ছে আমি সঠিক স্থানেই এসেছি ৷”

"হ্যাঁ, আমিই সেই !” পাঠান বলে উঠল, “ গৌড়ের সুলতান দায়ুদ কররানী আমার বংশের পূর্বপুরুষ ৷ দায়ূদের মুন্ডচ্ছেদন করে দিল্লী পাঠিয়ে যখন মুঘল সেনারা গোটা বাংলা মুলুকে ধ্বংস চালিয়ে পাঠান আর বাঙালী বীরদের খুঁজে খুঁজে মারছিল, আমরা কররানীরা তখন আত্মগোপন করি অরণ্যের গভীরে ৷ প্রতাপ যখন আবার স্বাধীনতার নিশান উড়িয়ে দিলেন, শঙ্কর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পাঠান আর বাঙালীরা রাজমহলে মুঘলের শক্তি তছনছ করে বীরদর্পে যশোর ফিরলেন, সেদিন বিশ্বাস হল প্রতাপ এক পাঠানের মতোই সাচ্চা যোদ্ধা ৷ আমার মতো লুকিয়ে থাকা পাঠানেরা দলে দলে জামাল খানের নেতৃত্বে আফগানী বাহিনীতে যোগ দিলাম ৷”

“ হ্যাঁ, প্রতাপ যখন আকবরের দরবারে পিতার প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রায় অবস্থান করছিলেন, আমি তাঁকে ঘৃণাই করতাম ৷ কিন্তু, পরে বুঝলাম চন্দ্রগুপ্ত যেমন সেকেন্দর শা-র শিবিরে ঢুকে গুরুমারা বিদ্যে আয়ত্ব করেছিলেন, প্রতাপ ও তাই করতে চেয়েছে ৷” বললাম আমি |

“ হ্যাঁ দোস্ত ৷ আমরা পাঠানরা কাবুল নদীর তীর ছেড়ে এসে গঙ্গার ধারে গৌড়কেই আপন করে নিয়েছি ৷ মিষ্টি বাংলা ভাষাকে ভালবেসেছে গৌড়ের সুলতানেরা | স্বাধীন বাংলা গোটা জাহানের ঈর্ষার কারণ হয়েছে ৷ কিন্তু এই মুঘলদের নিয়ত ঠিক নেই ৷ এরা বাংলার খাজনা লুটে দিল্লীর দরবার সাজাতে চায়; বাংলার সোনা আর রূপায় ভর করে হিন্দুস্থানে হুকুমত কায়েম করতে চায় ৷” মুহূর্তের জন্য থামল মীর | প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “বাদ দাও সে সব ৷ তোমার গুপ্ত সংবাদ কি সেটা বল ৷”

“ মানচিত্র টা খুলে মাটিতে রাখ”, বললাম আমি ৷

“ কিসের মানচিত্র এটা?”

“ ধূমঘাট; দূর্গের !” সচকিত হয়ে মীর মানচিত্র মাটিতে রাখল ৷ ভীম সহ অন্যান্যরা ঝুঁকে পড়ল মানচিত্রের ওপর৷ আমি বোঝাতে শুরু করলাম, “ দূর্গের সম্মুখভাগে প্রশস্ত ভূমি৷ মূল ফটক আপাত অরক্ষিত | উত্তর দ্বারের সামনে পাহারা দিচ্ছে রঘুর নেতৃত্বে বাঙালী বীরের দল | উপরে কামাল খোজা চারিদিকে কামান সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকবে ৷ দক্ষিণে থাকবে জামাল খান ৷ মধ্যভাগে শঙ্কর থাকবে যশোরের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের নিয়ে ৷ আরও দক্ষিণে পর্তুগীজ পেড্রো তার নৌবাহিনী নিয়ে ওত পেতে থাকবে ইছামতীর পূর্বতীরে ৷ সময় বুঝলেই মোগলের বাহিনীকে পেছন থেকে নদীর বুক থেকে গোলা আর গুলিতে বিধ্বস্ত করবে ৷ দূর্গের মূল ফটকের সম্মুখ ভাগ ইচ্ছা করেই অরক্ষিত রাখা হয়েছে ৷ ওই প্রশস্ত সমভূমির নীচে বারুদ ঠাসা আছে ৷ ওই অরক্ষিত দ্বারে মানসিংহ উপস্থিত হলেই | দুর্গের অভ্যন্তর থেকে সুড়ঙ্গে অগ্নি সংযোগ করা হবে ৷ বারুদের স্তূপে আগুন পৌঁছালেই বিশাল বিস্ফোরণে মানসিংহের বাহিনী ছারখার হবে ৷” এক নিঃশ্বাসে সবটুকু বলে থামলাম আমি |

“ এত নিখুঁত যুদ্ধ-পরিকল্পনা তুমি কি করে জানলে!” অবাক বিস্ময়ে বলল মীর |

“ ভবানন্দের কাছ থেকে শুনলাম ৷” নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম আমি |

“ ভবানন্দ !” সমস্বরে চিৎকার করে উঠল বিস্ময়ে বিহ্বল সৈন্যদল |

“ ভবানন্দ সমস্ত যুদ্ধ পরিকল্পনা আগেই জেনে গেছে ৷ মন্ত্রণা কক্ষে মোগল প্রতিনিধিকে যখন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সব বলছিল, আমি তখন পূজার উপাচার অনুসন্ধানের ছলে আড়ালে দাঁড়িয়ে যা যা শুনেছি সেইমত ভূর্জপত্রে এই মানচিত্র এঁকে নিয়েছি ৷”

“ তাহলে? যশোর বাহিনীর রণনীতি তো মোগল বাহিনী সবই জেনে গেছে ! অতঃপর?” হতাশায় বলল ভীম ৷

“ ওরা প্রধান ফটক দিয়ে আক্রমণ করবে না ৷”

“ তবে?” প্রশ্ন করল মীর |

“ মোগল বাহিনী উত্তর দিকে আনুলিয়া দিয়ে যমুনা পার হচ্ছে ৷ হয়তো এতক্ষণে পার হয়ে গেছে ৷ আক্রমণ হবে উত্তর দ্বারে ৷”

“ তাতে কি ? বাঙালী বীরেরা রুখে দেবে মোগলদের ৷” সমস্বরে বলল সৈন্যরা ৷

“ উত্তর দ্বার খুলে দেওয়া হবে ৷”

“ মানে, বিশ্বাসঘাতকতা! কেল্লার মধ্যে?” বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে মীর আর তার সৈন্যরা ৷

“ হ্যাঁ ৷ দ্বার খোলামাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করবেন যশোরেশ্বরী মন্দিরের এক নবীন পুরোহিত ৷ প্রচার করা হবে, যশোরেশ্বরী প্রতাপকে বর্জন করেছেন ৷ বলা হবে, প্রতাপ যখন মা-এর মন্দিরে আশিস নিতে গেছিলেন, মা-এর বিগ্রহ প্রতাপের থেকে মুখ ফিরিয়ে পশ্চিমমুখী হয়ে মানসিংহকে আশিস বর্ষণ করেছেন ৷ এভাবেই যশোর বাহিনীর মনোবল ভেঙে সৃষ্টি করা হবে তুমুল বিশৃঙ্খলা ৷”

মীরের মুখ যেন সর্পাঘাতে আবিষ্টের মতো নীলবর্ণ হয়ে গেল ৷

“ হয়তো এর মধ্যেই বড় দেরী হয়ে গেছে ৷ ধূমঘাটে শঙ্করের কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করবে ভাই?” আকুল হয়ে বললাম আমি |

“ ভীম তুমি বাহিনী সামলাও ৷ আমি চললাম ধূমঘাট ৷”  চাকিতে একটা ঘোড়ায় উঠে বলল মীর | আমি মাথা নীচু করে হাঁটা শুরু করলাম বাড়ীর পথে ৷

হঠাৎ শুনলাম, “ বড়বাবু , ট্যাকাটা দিলা না তো | কাল নিব খন ৷ সাবধানে বাড়ী যাও ৷ খুব ভালো থোর ৷” পেছনে তাকিয়ে দেখি মীর হাসছে ৷ নানা, মীর নয়! কাশেম !

Facebook Comments

1 thought on “বাজারী গপ্পো

  1. অভিযান, তোমার ইতিহাস -আশ্রিত গল্প “বাজারী গপ্পো” পড়লাম। এক কথায় অসাধারণ! নিঃসন্দেহে অভিনব প্লট… দারুণ লিখেছ! সংলাপ এবং বর্ণনামূলক অংশ— দুটোতেই তোমার স্বচ্ছন্দ সাবলীল চলন আমাকে বিস্মিত করল। শুধু তাই নয়, দুইয়ের মধ্যে সুসমঞ্জস অনুপাতও রক্ষা করেছ নিখুঁত দক্ষতায়। এভাবেই তুমি লিখে চলো, থাকছে অফুরান শুভকামনা নিরন্তর❤️👨‍❤️‍👨❤️

    দেবব্রত দাশ says:

Comments are closed.