আকাশ রায়
ঠিকই পড়েছেন, আমি ভূতের কথা বলছি না, বলছি ভুতোর কথা। ভুতো, আমার বারাসাতের পাড়ার প্রতিবেশী, আমার ছোটবেলার বন্ধু। বছর আটেক হলো ওরা পাটুলিতে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে চলে গেছে। ওরা বলতে ওর বউ, ওর একমাত্র ছেলে আর ওর বাবা-মা। আমাদের পাড়ায় ওদের পুরনো বাড়িটায় এখন ওর দাদা পরিবার নিয়ে থাকেন। আমিও বাবা মারা যাওয়ার পর সপরিবারে বাগুইআটিতে ফ্ল্যাট নিয়ে চলে এসেছি, তাও প্রায় বছর পাঁচেক হলো। পাড়ায় থাকতেও ভুতোর সাথে যোগাযোগ প্রায় ছিলই না। দিন-রাত কাজে ডুবে থাকতো । কখন অফিস যেত, বাড়ি ফিরত জানতেই পারতাম না। আর এখন ও থাকে সাউথে, আর আমি নর্থে, তাই দেখা সাক্ষাৎও বহুদিন বন্ধই ছিল। ফোন-হোয়াটসঅ্যাপ এ টুকটাক কথা হতো, করোনার চক্করে সেটাও ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। সেই ভুতোর সাথে যোগাযোগটা গত কয়েক মাস ধরে হঠাৎ করে খুবই বেড়ে গেছে, এমনকি এই করোনার বাজারেও আমাদের ঘুরতে যাওয়ার বা দেখা করার কোনো কমতি নেই। কেনো, কিভাবে এটা হলো সেসবে পরে আসছি। তার আগে আপনাদের ভুতো সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন দেওয়া দরকার, নইলে পুরো ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারবেন না।
ছোটবেলায় ভুতো আর আমি ছিলাম অন্তরঙ্গ বন্ধু। একসাথে স্কুলে যাওয়া, টিফিনে আলুকাবলি খাওয়া, বিকেলে মাঠে ক্রিকেট-ফুটবল খেলা, গাছ থেকে পেয়ারা পাড়া, পুকুরে স্নান করা…এক কথায় শৈশবটা আমরা দুজন একসাথেই কাটিয়েছি, আর প্রত্যেকটা মুহূর্ত চুটিয়ে উপভোগ করেছি। আমরা দুই বন্ধু দৌড়াদৌড়ি করতাম, খেলাধূলা করতাম, কিন্তু কারোর কোনো জিনিস নেওয়া বা ক্ষতি করা – সেইসব কক্ষনো করিনি। সেই জন্য পাড়ার সবাই এই মানিকজোড়কে ভালোইবাসতো। ভুতো বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিল। আমিও মন্দ ছিলাম না, কিন্তু ভুতো ছিল অনেক এগিয়ে। হবে নাইবা কেনো। ছোট থেকেই এত পরিপাটি কাজ, যে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবেনা যে সেটা প্রাইমারী স্কুলের একটা ছাত্রের করা। কিন্তু তাই বলে ওর মধ্যে হিংসা, বা ফার্স্ট হয়েছে বলে দম্ভ কোনোদিনই দেখিনি। তাই ওর পরীক্ষার রেজাল্টের আঁচ আমাদের বন্ধুত্বে কোনোদিনই পড়েনি।
কিন্তু শৈশবের সেই ছটফটে, চনমনে, মিশুকে ভুতো কৈশোরে পড়ার পর থেকেই কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগলো। মেলামেশা অনেক কমিয়ে দিল। আমার সাথে ওর দূরত্বও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। একা একা স্কুলে যেতো-আসতো । বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোতও না। তাই এক পাড়ায় থেকেও ভুতোর সাথে দেখাই হতোনা। ভুল করে দু-একবার যখনই সামনা সামনি দেখা হয়েছে, ভদ্রতার খাতিরে দু’চারটে কথা বলেই কেটে পড়েছে। প্রথম প্রথম খুব দুঃখ হতো, বাড়িতে এসে মন খারাপ করতাম। বাবা-মাকেও বলেছিলাম ভুতোর এই পরিবর্তনের কথা। ওনারা আমাকে অনেক করে বোঝালেন যে সময়ের সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়, আর ইচ্ছা না থাকলেও আমাদের সেগুলো মেনে নিতে হয়। দুনিয়ার সেই অমোঘ নীতি অনুসারে আমিও ভুতোর এই পরিবর্তন আস্তে আস্তে মেনে নিয়েছিলাম ।
আসলে, ভুতো ছিল বামুন বাড়ির ছেলে। ওরা দুই ভাই। ছোট ভাই ভবতোষ মুখার্জী, অর্থাৎ ভুতো, আর ওর বছর পাঁচেকের বড় দাদা প্রাণতোষ মুখার্জী, আমরা ডাকতাম প্রাণদা বলে। ওদের বাড়িতে অনেক নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে পুজো-আর্চা হতো। ওর মা’র একটু শুচিবাই ছিলো । কাজের মেয়েটাকে নোংরা কাজের জন্য দিনরাত বকাবকি করতেন আর দিনে বার দশেক ঘর মোছাতেন। আমাকে অবশ্য খুব ভালোইবাসতেন, গেলে ভালো ভালো খাবারও খাওয়াতেন। ছোটবেলায় সব ঠিক থাকলেও, বয়স বাড়ার সাথে সাথে কাকিমার শুচিবাইয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব আমরা ভুতোর ওপর দেখতে পেতে লাগলাম। যে ছেলে ড্রেনে বল খোঁজার এক্সপার্ট ছিল, সেই ছেলে ড্রেনে বল পড়লে সেটা আর ছুঁতে চাইতোনা। বাধ্য হয়ে যদি ছুঁতেও হতো, বাড়ি ফিরে শীতকালের সন্ধে বেলা কাঁপতে কাঁপতে স্নান করে ঘরে ঢুকত। এ আমার নিজের চোখে দেখা। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যে কাকু-কাকিমাও ওকে বোঝাতে শুরু করলেন যে ছোটদের এত নিয়ম মানার প্রয়োজন নেই, তার জন্য বড়রা তো আছেই। কিন্তু কে কার কথা শোনে। আসলে ভুতোর মনে কোনো একটা বিশ্বাস জন্মালে সেটা ওর মনের মধ্যে এক্কেবারে গেঁথে যেত। আর ও সেটাকে অন্ধের মত মেনে চলতো। ওটাই ছিল ওর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য । একদিনতো দেখলাম ওর মাথায় ব্যান্ডেজ। জিজ্ঞেস করাতে পরিষ্কার করে কিছু বলল না। শেষে প্রাণদা কে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে ভুতো কার থেকে শুনেছে যে নতুন গামছা নিয়ে ১০৮ বার “হর হর মহাদেব” বলতে বলতে কপালের মাঝখানে ঘষলে নাকি ভগবানের দেখা পাওয়া যায়। ব্যাস, যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। সেই কপালের ঘা সারতে সারতে প্রায় এক মাস লেগে গেছিল।
ক্লাস এইট থেকে ভুতো বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা আর বাইরে বেরোনো পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। দিনরাত বই নিয়ে ঘরের মধ্যে গুঁজে থাকতো – হয় পড়ার বই, নইলে গল্পের বই। পরীক্ষায় ফার্স্ট হতো বটে, কিন্তু ওর এই পাগলামিটা বাড়ির লোকেও ভালো চোখে নেয়নি। ওর বাবা-মা-দাদা কেউই ওকে বোঝাতে কোনো কসুর করেনি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। পরে শুনেছিলাম ওর মাথায় ঢুকেছে যে জীবনে বড় হতে গেলে প্রথমেই যেটা ছাড়তে হবে সেটা হলো বন্ধু-বান্ধব। সেতো আমরা সবাই জানি। কিন্তু ভুতো সেটা জানাতে আর মন থেকে বিশ্বাস করাতে কি ফল হয়েছিল সেটা সারা পাড়া, স্কুল এমনকি পরে কলেজের বন্ধুরাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল।
পড়াশুনাতে ভুতো বরাবরই টপ ক্লাস হলেও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, বিদেশ যাওয়া – এসব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভুতোর মধ্যে কোনোদিনই ছিল না। থাকলে অনায়াসে সেটা ও করতেই পারতো। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেলাম। আর ভুতো অনার্স গ্র্যাজুয়েশন, মাস্টার্স করে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে এক চান্সে একটা ভালো সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এর চাকরি পেলো। অবশ্য পাবে নাই’বা কেনো। রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে ঠান্ডা জলে স্নান করে, আহ্নিক সেরে, যোগ ব্যায়াম করে পড়তে বসতো । শীতকালেও এই নিয়মের অন্যথা হতনা। এতো পড়া নয়, যেনো মুনি-ঋষি দের তপস্যা। বছর চোদ্দো আগে সেই ভুতোর যখন এক স্কুল টিচারের সাথে বিয়ের ঠিক হলো, আমরা বন্ধুরা তখন ওর হবু বৌয়ের ভবিতব্যের কথা ভেবে চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু বাছাধন দেখলাম যাকে বলে “জাতে মাতাল, তালে ঠিক”। বিয়ে ঠিক হতেই বন্ধুদের সাথে একটু আধটু মেলামেশা, মাঝে মধ্যে বাজার-ঘাট করা শুরু করে দিলো । এখন নয় করোনা আসার পরে আমরা হাইজিন নিয়ে সচেতন হয়েছি, ভুতোকে সেই অত বছর আগেই দেখেছি সার্জিক্যাল মাস্ক পরে বাজারে বেরোতে। পকেটে সাবানের টুকরো রাখতো। কাউকে স্পর্শ করতো না। সেটা নিয়ে ওকে খ্যাপালে বলতো যে মানুষই হলো রোগের বাহক। তাই সুস্থ থাকতে গেলে মানুষের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তখন কে জানতো যে ভুতোর সেই পাগলামিই একদিন “আইসোলেসন” আর “সোশ্যাল ডিস্টান্সিং” নামে মানবজীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে।
তাই করোনা আসার পরে ভুতোকে আলাদা করে কিছু করতে হয় নি। খালি ওর “হাইলি হাইজিনিক” স্বভাবটা আরো প্রবল ভাবে প্রকাশ পেয়েছিলো। তার ওপর বাড়িতে ওর বয়স্ক বাবা-মা আর ওর বছর সাতেকের ছেলে থাকাতে বাড়িটাকে ও হাইজিন-এর ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলেছিল। প্রাণদার থেকে সেরকমই শোনা। নিজেরা তো বেরতোই না, বাড়িতে কাউকে ঢুকতেও দিত না। টাকা-পয়সা, খাবারদাবারও শুনেছি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারে বারে ধুতো। একটা অজানা ভয় ভুতোকে গ্রাস করেছিল। ২০২০-র মাঝামাঝি নাগাদ হঠাৎ একদিন ভুতোর ফোন পেলাম। বললো একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগবে। বাড়িতে বয়স্ক মানুষ আছে , তাই রেখে দেবে। সাবধানের মার নেই। আমি বোঝালাম যে শুধু শুধু বাড়িতে রেখে দেওয়ার জন্য সিলিন্ডার নিস না, এমনিতেই তখন অক্সিজেনের ক্রাইসিস। ওই সিলিন্ডারটা একটা মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে পারে। এটাও বলেছিলাম যে সত্যিই যদি প্রয়োজন হয় আমি কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা করে দেবো। মনে হয়না কথাটা ভুতোর মনঃপুত হয়েছিল, কারণ তার পর মাস ছয়েক আর কোনো যোগাযোগ করেনি। এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হলো না। ২০২০ র শেষের দিকে শুনলাম ওদের পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত। ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি। মাসখানেক পরে ওর বাবা মারা গেলেন। শুনেছিলাম হাসপাতাল থেকে আর বাড়িই ফিরতে পারেননি। প্রায় এক মাস হাসপাতালে ছিলেন। সান্ত্বনা জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ করেছিলাম। তার পর মাস ছয়েক কোনো যোগাযোগই হয়নি, কোনো খবরও পাইনি।
২০২১ এ সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ দেখি ভুতোর ফোন। দেখা করতে চাইছে। আমি বাড়িতে আসতে বললাম, রাজি হলো না। বললো নিরিবিলি কোথাও দেখা করতে চায়। আমি পরের শনিবার সকালবেলা ইকো পার্কের পাশে আসতে বললাম, কারণ আমি ওখানে মর্নিং ওয়াক করতে যাই। ভুতো এমনিতেই আর্লি রাইজার, কিন্তু ওর বাড়ি থেকে ইকো পার্ক যথেষ্ট দূর, কিন্তু তবু দেখলাম এককথায় রাজি হয়ে গেল। বুঝলাম দেখা করার জন্য উদগ্রীব। যাই হোক, পরের শনিবার যথারীতি ঘড়ি ধরে সকাল ৭টায় বাবাজীবন হাজির। আমাকে দেখে বললো “নীলু, তোকে এতদিন পরে দেখে কি ভালোই না লাগছে”। আমার ভালো নাম নীলোৎপল সেন হলেও বাড়িতে আর বন্ধুরা নীলু নামেই ডাকে। আমি ভয়ে ভয়ে দুটো N95 মাস্ক পরে, দু-তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে সবে কথা বলতে যাবো, তখনই হলো প্রথম চমক। ভুতো হঠাৎ “নীলু, আমি ভুল ছিলাম রে” বলে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করে দিলো , ঠিক একটা বাচ্চা ছেলের মতন। এটার জন্য আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না , তাই যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম । যে বন্ধু হ্যান্ডশেক পর্যন্ত করতোনা, সে আজ আমায় বুকে জড়িয়ে ধরবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কাঁদতে কাঁদতে কতো কি যে বলে গেলো, আমি থামাতেই পারছিলাম না। যেনো বহুদিন ধরে জমে থাকা অনেক দুঃখ, মনের অনেক চাপা কথা আগল খুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তাই ওকে আর থামালাম না। হাজার হোক , ভুতো আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ভালো ছেলে, কোনোদিন কারো ক্ষতিও করেনি। বন্ধুর চোখের জল দেখে ওর প্রতি আমার সমস্ত রাগ-অভিমান এক মুহূর্তে কোথায় যেন উবে গেলো। আমি ওর সব কথাগুলো শুনলাম, আর পিঠ চাপড়ে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে গেলাম।
যা বুঝলাম, ভুতোর বাবার মৃত্যুটা ওকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভুতো নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না, কারণ ওর মনে হয়েছে অহেতুক প্যানিক না করে বাকি সবার মতন বেসিক হাইজিন মেনে চললে, বাড়িতে একটা সুস্থ, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রাখতে পারলে হয়তো কাকু আরো কিছুদিন বাঁচতেন। ও অবশেষে বুঝেছে যে হাইজিনটা যেমন জরুরি, তার সাথে শারীরিক আর মানসিক সুস্থতাও জরুরি, পুষ্টিকর খাবারও জরুরি । করোনাকালে ঘরের দরজা-জানলা পর্যন্ত খুলতোনা, বাইরের রোদ -বাতাস ঘরে ঢুকতে দিতো না । ভয়ে বাজার-ঘাটও ঠিক মতন করেনি। আরে বাবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে তো আর ইমিউনিটি বাড়ানো যায়না। এটাও বললো যে ওর নিজেরই চল্লিশের ওপর বয়স হয়ে গেলো, অথচ নিজেও কোথাও কোনোদিন বেড়াতে যায়নি, বাড়ির লোককেও নিয়ে যায়নি। খালি পড়াশুনো, হাইজিন, অফিস আর বাড়ি – এসব করেই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। কাকু কাকিমাকেও কোথাও যেতে দেয়নি, অসুখ-বিসুখ হওয়ার ভয়ে। এটাও স্বীকার করেছে যে আমাদের সাথে কাটানো ছেলেবেলাটাই ওর জীবনের সেরা মুহূর্ত। তার পরের জীবনটায় সাফল্য ছিল, আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, কিন্তু আনন্দ ছিলনা, বন্ধু ছিলনা, হাসি ছিলনা। প্রায় কুড়ি বছর চাকরি হয়ে গেলো, অনেক উন্নতিও করেছে, কিন্তু জীবনটা বাঁচতে ভুলে গেছে। বউ-ছেলের সাথেও আসতে আসতে দূরত্ব বেড়েছে । ওরাও এই ভাবে আর বাঁচতে চাইছে না। তাই আমাদের ভুতো নতুন করে, নতুন ভাবে জীবনটা বাঁচতে চায়, দুনিয়াটা ঘুরে দেখতে চায়, সমাজের জন্য কিছু করতে চায়। গত কয়েকমাসে নাকি একা একাই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে – নর্থ বেঙ্গল এর প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা, পুরুলিয়ার সাঁওতালদের গ্রাম, সুন্দরবনের জেলেদের গ্রাম, আরো অনেক জায়গায়। একটা NGO- সাথে গ্রামে গ্রামে জামাকাপড়, খাবার-দাবার, মাস্ক, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজারও বিলি করেছে। মাঝে ফ্যামিলি নিয়ে পুরীও ঘুরে এসেছে, কারণ বাঙালি হয়েও “দী-পু-দা” টাই ঘোরা হয়নি ওর। পুজোর সময় দার্জিলিং যাবারও প্ল্যান হয়ে গেছে । যা ঘুরেছে সব হাইজিন মেনেই, কিন্তু পাগলামিটা করেনি। অহেতুক ভয় পায়নি বা প্যানিক করেনি। এতে নাকি ও প্রত্যক্ষ উপকারও পেয়েছে। ওর সুগার আর প্রেসারের প্রবলেম পুরোপুরি গায়েব। ছেলে-বউও খুশি। কাকিমাও বয়সের হিসেবে ভালই আছেন। ছেলের ইমিউনিটিও বেড়েছে, সর্দি-কাশির সমস্যাটা অনেকটাই কমে গেছে। কথায় কথায় অ্যান্টি-বায়োটিক দিতে হচ্ছেনা আর। হ্যান্ড স্যানিটাইজার এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমানোয় ওর বৌয়ের এলার্জিটাও সেরে গেছে । কিন্তু ভুতোকে আমি যতটুকু চিনি, আমার মন বলছে আরো চমক অপেক্ষা করছে। কারণ, ঘোরাঘুরি আর সমাজসেবার রোগটা বেশ ভালোভাবেই ভুতোর মনে গেঁথে গেছে, আর জীবনের এতদিনের না-পাওয়া আনন্দগুলো গোগ্রাসে গেলার জন্য ও মুখিয়ে আছে।
ভুতোর সাথে দেখা হওয়ার পরে প্রায় একমাস কেটে গেলো। মাঝে ছোটখাটো কিছু চমক ছিল, যেমন হোয়াটসঅ্যাপ-এ “TravelManiac” বলে একটা গ্রূপে আমায় অ্যাড করা হলো। “চলাই জীবন” বলে একটা ফেসবুক গ্রূপেও আমায় অ্যাড করা হলো। বলার অপেক্ষা রাখেনা, নেপথ্যে আমার গুণধর বন্ধু ভুতো। আমার আশঙ্কা সত্যি করে সবথেকে বড় চমকটা পেলাম অক্টোবরের মাঝামাঝি, তাও আবার কুরিয়ারে। একটা বড় বাক্স এলো। গত কয়েক সপ্তায় অনলাইনে কোনো অর্ডার করেছি বলেতো মনে নেই। বাজারও অফলাইনে নিজেই করি। বাক্সটার গায়ে দেখলাম আমারই নাম ঠিকানা। কোথা থেকে এসেছে সেটাও ঠিক বুঝতে পারলাম না। তাই কিন্তু কিন্তু করে বাক্সটা রিসিভ করলাম। এর পরের দৃশ্য – বাড়ির সবাই আমাকে ঘিরে রয়েছে, আর আমার সামনে বাক্সটা। আমার হাতে ছুরি, সেটা দিয়ে বাক্সের সেলোটেপ গুলো খুলছি আর সবাই উদগ্রীব হয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবখানা এমন যেন আমার জন্মদিনের কেক কাটছি। যাই হোক, বাক্সটা খুললাম। বাক্সটার ভেতরে আবার তিন খানা ছোট বাক্স, একটার ওপর আর একটা গুছিয়ে রাখা। প্রত্যেকটা বাক্স আবার রঙিন কাগজ দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে মোড়া। সবার নিচে সাদা রঙের একটা খাম। কাজের পরিপাটি দেখে প্রেরক কে হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। যাই হোক খামটাই প্রথমে খুললাম। হাতে লেখা একটা লম্বা চিঠি, বাংলায় বল পেনে লেখা, ঝরঝরে হাতের লেখা যেটা ছোটবেলা থেকেই আমার চেনা। চিঠিটা নিচে তুলে দিচ্ছি, পড়লেই সব খোলসা হবে আর ভুতোর মুখে রামনামের আলটিমেট ভার্সনটাও জানতে পারবেন।
“আমার প্রাণের বন্ধু নীলু,
মনে পড়ে স্কুলে থাকতে তোকে গুটি কতক চিঠি লিখেছিলাম। বাইরে বেরতাম না বলে চিঠি লিখে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। তুই কিন্তু তার একটারও জবাব দিসনি। কেনো দিসনি এখন সেটা বুঝি, আর আমার নিজের তখনকার কথা ভেবে খুব হাসিও পায়। তোর সেই “শুচিবাই” বন্ধু যে এখন অনেকটাই শুধরে গেছে সেটা হয়তো আগেরদিনই বুঝেছিস। আমি চাইলেই তোকে ফোন করতে পারতাম, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও করতে পারতাম, কিন্তু করিনি। করলে বাক্সটা নিয়ে তুই উৎকণ্ঠাও দেখাতিস না, আর এই চিঠিটাও এত মন দিয়ে পড়তিস না। মোটকথা ব্যাপারটা এতটা নাটকীয় হতনা। কি ভাবছিস? ছেলেমানুষি? আসলে জীবনের স্টপওয়াচ-টা রিসেট করে নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চাইছি রে। (এর পরে হাতে আঁকা দুটো স্মাইলি)
যাই হোক, আসল কথায় আসি। বড় বাক্সের মধ্যে দেখবি তিনটে কাগজে মোড়া ছোট বাক্স আছে। যেভাবে বলছি সেভাবেই সেগুলো খুলবি। প্রত্যেকটা বাক্সের গায়ে নম্বর দেওয়া আছে। প্রথমে ১ নম্বর, তার পর ২ নম্বর আর সব শেষে ৩ নম্বর বাক্সটা খুলবি।
১নং: এটা কাকিমাকে দিবি আর কাকিমাকে আমার প্রণাম জানাবি।”
চিঠিটা পাশে রেখে, ১নং বাক্সের মোড়কটা খুললাম। কাজু বরফির একটা বাক্স। মা’র প্রিয় মিষ্টি। সেটা রেখে দিয়ে চট করে আবার চিঠিতে ফিরে গেলাম।
“২নং: এটা তোর মেয়েকে দিবি। বলবি এরপর যেদিন দেখা হবে ভুতো কাকু অনেক মজার মজার গল্প শোনাবে।”
২নং বাক্সের মোড়কটা খুললাম। ওয়াটার কালার সেট। বলে রাখা ভালো, আমার মেয়ে দিন-রাত ওয়াটার কালার দিয়ে পেইন্টিং করে আর সেগুলোকে আমায় ফেসবুকে পোস্টও করতে হয়। ৩নং বাক্সে কি চমক অপেক্ষা করছে কে জানে। দেখি পড়ে।
“৩নং: এই বাক্সটা খোলার আগে তোর কয়েকটা জিনিস জানা দরকার। আমি চাকরীতে রিজাইন করে দিয়েছি। এই মাসেই আমার চাকরি জীবনের ইতি। একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলছি, ডিসেম্বরে। শুধু ব্যবসার জন্য নয়, নিজেকে এন্গেজড রাখার জন্য, মনটা ভালো রাখার জন্য, আর আমার মতন অন্যান্য কূপমণ্ডূকদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য। যারা টাকার অভাবে বেড়াতে যেতে পারেনা, তাদেরকে সস্তায় বেড়িয়ে আনার জন্য। কয়েকটা NGO-এর সাথেও যুক্ত হয়েছি। ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে অনাথ আর প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিয়েও বছরে দু-তিনটে ট্রিপ করাবো। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এসব নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়বো, তাই তার আগেই নভেম্বরের ফার্স্ট উইকে একটা ফ্যামিলি ট্রিপ করছি, রোড ট্রিপ, ওভার দা উইকেন্ড। খালি শুক্রবারটা একটু ম্যানেজ করতে হবে। বোলপুর-শান্তিনিকেতন আর আশেপাশের কিছু ভালো জায়গা ঘুরবো, যেগুলো অনেকেই জানেনা। শুক্রবার ভোরে বেরোবো, রবিবার রাতে বাড়ি। হোটেল, টেম্পো ট্রাভেলার গাড়ি সব বুক করা হয়ে গেছে। হাইজিন মেনেই ট্যুরটা হবে। তোকে এতো কিছু বলছি, কারণ তুইও ফ্যামিলি নিয়ে এই ট্রিপে আসছিস। ওই সময় স্কুলে পুজোর ছুটি। আর তোর আর তোর বৌয়ের তো ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তাই একটা দিন ম্যানেজ করতেই পারবি। তিনটে ফ্যামিলি – তোর ফ্যামিলি, আমার এক কলেজ ফ্রেন্ডের ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলি। ওই ৩নং বাক্সে এই ট্যুরের সব ডিটেলস দেওয়া আছে। আমার নতুন ট্রাভেল এজেন্সির কিছু লিফলেটও আছে । তোর চেনা-জানা বন্ধুদের, প্রতিবেশীদের একটু ডিস্ট্রিবিউট করে দিস প্লিজ। ভালো থাকিস, পরে ফোন করবো। ইতি – তোর বন্ধু ভুতো”
একসাথে এত চমক হজম করতে করতে ৩নং বাক্সটা খুললাম। একটা খাম রয়েছে, তার মধ্যে ট্রাভেল আইটেনারি । বেড়ানোর সমস্ত খুঁটিনাটি দেওয়া। আর সঙ্গে আছে পরিপাটি করে রাখা অনেকগুলো লিফলেট। একটা লিফলেট বের করে দেখতে শুরু করলাম। প্রথমেই চোখ আটকে গেলো বড় বড় হরফে লেখা ট্রাভেল এজেন্সির নামটায় – “কাল হো না হো ট্রাভেলস”।
Darun laglo.