Site Overlay

সৌরভী

দেবযানী ভট্টাচার্য্য

  সন্ধেবেলা হদ্দ মফস্বলের অলিগলিতে হাঁটলে বেশ হরেকগন্ধী বাবল্ জগৎ টের পাওয়া যায়। এক বাবল্ থেকে বেরোলেই ঢুকে পড়া আরেক বাবল্-এ। এই বেরোনোটা আবার দোর হাট খুলে বেরোনো নয়, মোলায়েম ঝিল্লি দিয়ে বেশ অনায়াস চুঁইয়ে যাওয়া একটা থেকে আরেকটায়। সদরের পাশে তুলসীমঞ্চে সর্ষের তেলের প্রদীপ জ্বলে বা চার নম্বর মোম। চিলতে আলোয় নজর হয় ধূপ-ধোঁয়া ভাসছে উঠোন বাতাসে। সে যৌথ গন্ধে মিশতে থাকে একে একে গলা ঘিয়ে চিনেবাদাম চিঁড়ে ভাজা, খোসাওলা আলু জড়ানো কালজিরের ফোড়ন, রুটির আটপৌরে সেঁকা ও লুচি ডালডায় পড়ার কালেভদ্রে খুশমিল গন্ধ।

  গন্ধগোলক গড়ায়, বদলে যায় দুধ চা চলকে ঘোর-তাতে পড়ে যাওয়ার ঘন বাস, ঠাকুর ঘরে বেখেয়ালের মোম পোড়া ঝাঁঝ, পুরোনো হারমোনিয়ামের হাঁসফাঁসে বেলোর ভাপ ইত্যাদি প্রভৃতিতে। মাঠ ধামসে ফেরা কিশোরের পা ধোয়া কাদাজলের ধুমগাঢ় গন্ধ নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয় তরুণীর গা ধোয়া ফেনাদার জলের ফিনফিনে গন্ধে, আরেক বাবলে। পরেরটায় অফিস ফেরত প্রৌঢ়ের নস্যির ঝিমবাসে নিজেকে মিশিয়ে দেয় সদ্য যুবকের জলন্ত চার্মিনার আঘ্রাণ।

  চার্মিনার মাথায় এল যেই, মোহিতের গলাটা শুকনো শুকনো ঠেকতে লাগল। খুঁজে পেতে পকেট হাতড়ে একটা বেরোল, না সিগারেট নয়, সুতো ঢিল হয়ে যাওয়া বাসী বিড়ি। সেটাকে ধরাতে যেতেই ধাঁ করে মস্তিষ্কে বুড়বুড়ি দিল এক দৃশ্য। "খাবার পরে একটা করে, কথা দিয়েছ"।

  পিত্তিজল উঠল গলা বেয়ে। থু থু করে সেটাকে পিচের ধুলোয় ছেতরে দিয়ে ধরাল বিড়িটা। কণ্ঠা অবধি গরম ধোঁয়া পৌঁছে দিল জোর টানে। একসময় যেমন আগ্রাসী টানে সুরভীর লিপস্টিকের গন্ধ পৌঁছে দিত নিজের আলটাকরায়।
  
  আচ্ছা, মনে পড়ছে না কেন কেমন গন্ধ ছিল সুরভীর লিপস্টিকটার? ওরই ডান ভ্রূর পাশে ওই জমাট আঁচিলের মত লাল রঙের লিপস্টিকটার। হাঁটার গতি ঝিমিয়ে এল। গতি বাড়াল মস্তিষ্কের মনে পড়া দপ্তর।

...

– দুপুরে ফোন করে যে বললে আজ কী এক মন ভরানো ফুল আনবে আমার জন্য, দেখি দেখি কী ফুল এনেছ তুমি। আহা, হাত পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছ কেন? দেখাও তো!
– এই, এই যে। মোড়কটা খোল আলতো করে, ভোরের বেলা কুড়িয়ে এনেছিলাম। বেলা গড়ালে আর মেলে না জান। কারা সব ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে যায়। দিনভর থেকে থেকেই জলের ছিটে দিয়ে দিয়ে তাজা রেখেছি। এখনও বেশ গন্ধ, নয়?
– কাঠচাঁপা?
– ভাল লাগেনি? খোঁপায় দেবে? ওই কানের পাশে একখানি যদি ক্লিপে বাঁধাও।
– নাহ, ভাল। এই না না, প্লিজ। ভীষণ গেঁয়ো গেঁয়ো লাগবে আমায়। বোঝই তো। আমি ভেবেছিলাম হেলিক্রিসাম কিংবা কারনেশন আনছ বুঝি বা...

  সে ফুলগুলো তো চেনা হয়ে ওঠেনি। তাদের বুকেও সুখে বুঁদ হওয়ার মত গন্ধ থাকে? ভাল লাগায় মরে যাওয়ার আশ্লেষ থাকে? কাঠচাঁপায় যেমনপারা থাকে!

– স্যরি স্যরি, দেরী হয়ে গেল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে, তাই না?
– নাহ, এই কিছুক্ষণ আর কী। বাস পেতে সমস্যা হয়েছিল?
– হ্যাঁ। সে ভীষণ সমস্যা। অপেক্ষায় অপেক্ষায় জেরবার। এত ধোঁয়া ধুলো, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অ্যাভেল করা বিরক্তির একশেষ।
– চলো। এগোনো যাক।

  আসা ইস্তক মোট চারটে বাস একের পর এক কালো ধোঁয়া মাখিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। পোড়া তেলের গন্ধ অলফ্যাক্টরি কোষে কোষে বোঝাই। মনে মাথায় কালি ছোপানো এই বাসগুলো ওর স্টপেজে দাঁড়ায়নি? যায়নি সামনে দিয়ে?

– অনেকবার ফোন করেছিলাম। বেজে গেল। তোমার শরীর খারাপ নয় তো? বাড়ির সবাই ঠিক আছেন?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ। কোনও সমস্যা নেই কোথাও। রাশি খানেক নতুন সিল্কের শাড়িতে নাক মুখ ডুবিয়ে বসে ছিলাম। গন্ধে নেশা ধরে গেছিল পুরো। শুনতেই পাইনি ফোন বাজছে।
– নতুন শাড়ি। উপহার পেলে বুঝি?
– হ্যাঁ। পরিমলদা, রাঙাদার বন্ধু এসেছে ষ্টেটস থেকে। মার্কেটিংয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এখন ছাড়ছি। খেতে যাব, চাইনিজ। তারপর বেড়াতে।

  সেবারে গোলাপি ফুলকারী ওড়না এনেছিল সে, আর একজোড়া ঝাড়বাতি দুল, হস্তশিল্প মেলা থেকে। পাঞ্জাবি দোকানীর বুঝদার হাসিটা বেজায় লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। তখনও কারোরই ফোন এভাবেই ধরেনি ও? এভাবেই গলায় মুখে ঠোঁটে মেখে নিয়েছিল প্রতিটি তন্তুর প্রেম?

 আচ্ছা, এই যে ধরল না ও, সেও কী কারোর দলে পড়ে তবে? আলাদা নয়!

…

  বিড়িটা তার টানের অভাবে নিভে গেছে বহুক্ষণ। খেয়াল পড়েনি। একটার পর একটা বাবলে গড়িয়ে গড়িয়ে কখন পাড়া পেরিয়ে খালপাড়ে এসে উপস্থিত হয়েছে সে। খেয়াল করেনি। বেভুল দাঁড়িয়েছিল হয়তো বা। আচমকা সস্তা আতরের ঝাঁঝালো উপস্থিতি সচকিত করল। একটি মেয়ে, বছর আঠারো হবে, খাল ধারে দাঁড়ানো শুরু করেছে কিন্তু শরীরের ভঙ্গি বলে দিচ্ছে আড় ভাঙেনি এখনও, এগিয়ে এসেছে। এই হাত চারেক দূরে, জ্যালজ্যালে সিন্থেটিক আঁচল গোটানো রোগা কাঁধে, অপুষ্ট আঙুলে আঙুল আড়াল করে চলেছে কেবল অস্বস্তি, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে। চোখদুটি মাটি কামড়ে রেখেছে।

– বসবেন? হাফে করে দেব।
– নাম?
– খুশবু।

Facebook Comments

3 thoughts on “সৌরভী

Comments are closed.