অভিযান ভট্টাচার্য্য
লাল মুখো সাহেবদের সাথে তাল ঠুকে গুলি, বোমা, ছোরা, বন্দুক নিয়ে বাঙলার পোলাপান কম লড়ে নি। হাজারে হাজারে মরেছে। মেরেছেও। আবার নকশাল আমলে ভঙ্গ-বঙ্গের পশ্চিম পাড়ে কাঁড়ি কাঁড়ি তরতাজা ছেলেপুলে হঠাত ক্ষেপে গিয়ে বোমা বন্দুক নিয়ে সে এক বিস্তর রক্তগঙ্গা বাঁধালো। তারও আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পদ্য লেখা হাতে বন্দুক তুলে নিয়ে কাজী সাহেব নাম লিখিয়েছিলেন 49th Bengali Regiment –এ । কলম-কাগজ ব্যাগে গুটিয়ে রাইফেল নিয়ে ইংলন্ডের রাজার সম্মান রাখতে মেসোপটেমিয়ার দিকে মার-মার কাট-কাট করে আরও গুচ্ছের বঙ্গসন্তানের সাথে কদমতালে এগিয়ে গেছিলেন। নিন্দুকে বলে, লালমুখোদের রাজার সেনায় নাম লিখিয়ে বাঙ্গালী পোলাপান আসলে যুদ্ধ-করার কৌশল আর বোমা-বন্দুকে রপ্ত হয়ে লাল মুখোদের ওপরেই সেগুলো গুরুমারা বিদ্যের মতো কাজে লাগানোর ফন্দি এঁটেছিল। সাহেবরা নাকি সেটার আঁচ পেয়ে যুদ্ধ মিটতে না মিটতেই পত্রপাঠ ওই রেজিমেন্ট গুটিয়ে দিয়ে সবাইকে ডিসমিস করে সে যাত্রা খ্যান্ত দিয়েছিল। তারপর ভুলেও আর বাঙ্গালীদের রেজিমেন্ট বানানোর কথা মাথায় আনেনি। স্বাধীন ভারতের সরকারও ওই পথে মাড়ানোর সাহস করে নি। ভারতে আজও পাঞ্জাব, মারাঠা, বিহার, আসাম, জাট ইত্যাদির নামে রেজিমেণ্ট থাকলেও, বাঙালীদের নামে কোন রেজিমেন্ট নেই। যদিও, ভারতের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে হাবিলদার, সর্বত্রই বাঙ্গালীদের ছড়াছড়ি। জয়ন্ত নাথ চক্রবর্তী, শঙ্কর রায় চৌধুরীদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম – কারগিল হোক, পুলওয়ামা বা লাদাখ – বাঙ্গালী ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর শহীদের তালিকা তৈরী হয় না আজও। আবার বাঙলার ভাগাভাগির সংসারে পুব-পাড়ে যারা পড়ে রইল, তারা অঝোরে রক্ত ঝরিয়ে, খান সেনাদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো ১৯৭১-এ। পড়শি ভারতের সামরিক সাহায্যে গড়ল স্বাধীন বাঙালী রাষ্ট্র। বাঙ্গালীকে দুর্বল ভেবে অবজ্ঞা করার ফল হাড়ে হাড়ে টের পেল পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্ঠুর শাসকেরা। মুজিব বললেন, “এতো রক্ত দুনিয়ার কোন দেশ কোন জাত দেয় নাই যা আমার বাঙলার মানুষ দিয়েছে”।
কিন্ত, তবু বাঙ্গালীর গা থেকে “ভীতু” অপবাদ আর ঘোচে না। তার না আছে শিবাজী, না রাণাপ্রতাপ, না তেগবাহাদুর। বাঙ্গালীর নবজাগরণের সাহিত্য জুড়ে শুধু রাজপুত, নয়তো মারাঠাদের গুন গেয়েই পাতার পর পাতা খরচ হয়ে গেল। বাঙ্গালীর আর বাঙ্গালী “ওয়ার হিরো” জুটল না। ভাগ্যিস সুভাষ চন্দ্র বসু আসমুদ্র-হিমাচল মাতিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে ব্রিটিশ ভারতের দোরগোড়ায় কষাঘাত করেছিলেন! অগত্যা বাঙলার রাস্তার মোড়ে মোড়ে দীর্ঘ কংগ্রেসী জীবনের খদ্দর ছেড়ে ফৌজি টুপি আর উর্দি পরে আসমানে হাত তুলে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সুভাষ চন্দ্র বসু । না, তিনি রাণা প্রতাপ বা শিবাজীর মত প্রকাশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে সমর নৈপুণ্য দেখান নি। আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান ছিলেন, কিন্তু সরাসরি কোন যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন না। তবু আজ মনেহয় নেতাজীই বাঙ্গালীর একমাত্র “ওয়ার হিরো”। বলিউডের হিন্দি সিনেমা থেকে সর্বভারতীয় নানা আলোচনায় স্বাধীন ভারতে বাঙ্গালীর বীর্যের, তার অকাতরে রক্ত বিলানোর ক্ষমতার উল্লেখ বিশেষ নেই। বরং তাকে নরম সরম ভীতু বলে ভাবতে এবং ভাবাতেই বোধ হয় স্বাধীন ভারত বেশী আগ্রহ দেখিয়েছে। বাঙ্গালী নিজেও বোধ হয় এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তাই হয়তো পথ চলতি নেতাজী-মূর্তির সামরিক বেশের দিকে তাকিয়ে বাঙ্গালী অবচেতন মনে তার রক্ত প্রবাহে বয়ে চলা আগুনের সন্ধান করে!
আসলে ভারতের স্কুল-পাঠ্য ইতিহাস আজও অনেকাংশেই ইংরেজদের তৈরী ইতিহাস। ইংরেজরা এদেশে আসবার এক শতাব্দী আগে এবং পরে রাজপুত, মারাঠা বা শিখেরা নিজেদের এক একটা শক্তিশালী রাজত্ব গড়ে তুলেছিল। তারা একসময় ইংরেজদের বেগ দিলেও তাদের পরবর্তী জ্ঞাতি-গুষ্টিরা সাহেবদের সাথে এঁটে উঠতে পারবে না বুঝে মিটমাট করে নেয়। বাঙ্গালীর হাতে এইসময় বলার মতো কোন শাসন ক্ষমতা ছিল না – কিছু সামন্ত-জমিদার ছাড়া। পলাশীর যুদ্ধের সময় পর্যন্ত বাঙলার নবাবরা এই মাটিকে রক্ষা করেছেন, ভালো বেসেছেন, জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা বাঙলার ভুমিপুত্র ছিলেন না – বাঙ্গালী ছিলেন না। সমরকুশলী রাষ্ট্র নায়ক হবার সম্ভাবনা কিছুটা ছিল বাঙ্গালী কায়স্থ প্রতাপাদিত্যের। বাংলায় তখন বারো ভুঁইয়ার ভাগাভাগির সংসার। কেন্দ্রীভূত শাসনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে একের পর এক মুঘল আক্রমণ আছড়ে পড়ছে বাংলায় । বাঙলার বিপুল সম্পদের ওপর দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য দিল্লীশ্বর আকবর তখন মরীয়া। রাজপুত একে একে বশ হয়ে গেল, অথচ বশ করা যায় না বেয়াড়া বাঙ্গালীদের! প্রতাপাদিত্য দক্ষিণ বঙ্গের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন কায়েম করলেও সমস্ত বাংলা জুড়ে কোন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন নি। মুঘলদের সাথে লড়তে লড়তেই তিনি নিঃশেষিত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন জাহাঙ্গীরের আমলে। সেই সঙ্গে বাঙ্গালী বীরের রাজত্ব চালানোর সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেল। ইংরেজ তখন জাহাঙ্গীরের বদান্যতায় ভারতের পশ্চিমে, দক্ষিণে নোঙ্গর ফেলে শিকারী নেকড়ের মতো সুযোগের অপেক্ষা করছে ভারতের সম্পদ লুট করার জন্য। বাকী ইউরোপীয় শক্তিদের সাথে তারাও অচিরেই বুঝে গেছিল ভারতের কামধেনু আসলে বাংলা! কেন্দ্রীভুত কোন বাঙ্গালী রাজশক্তির বাংলা শাসনের সুযোগ আর আসে নি। পলাশীর যুদ্ধের পর, মুর্শিদাবাদের পুতুল শাসক এবং বাঙ্গালী সামন্ত-জমিদারেরা বাংলার সম্পদকে ইংরেজ বেনিয়াদের হাতে অকাতরে বিলিয়ে দিতে লাগলেন শুধু নিজেদের জীবন-অস্তিত্ব রক্ষা করতে। কয়েকশো বছরের মধ্যেই পৃথিবীর ধনীতম ভূখণ্ড থেকে নিঃসীম দারিদ্রে নিক্ষেপিত হল সোনার বাংলা। মন্বন্তর-মহামারী বরণ করে বাংলা পড়ে থাকল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক শোষণের কেন্দ্রভূমি হয়ে।
সে যাই হোক। মোদ্দা কথাটা হল, তাহলে বাঙ্গালীর হাতে তো রইল পেন্সিল! তার কোন সাম্রাজ্য নেই, শাসন ক্ষমতা নেই, সাম্রাজ্যের বিস্তারও নেই, শত্রুহন্তা যুদ্ধের পরাক্রম নেই! তাহলে, এই যে ফকির-সন্ন্যাসী দের বিদ্রোহ থেকে শুরু করে, নীল-বিদ্রোহ হয়ে, বিপ্লবের অগ্নিযুগ পার করে ’৭১-এর মাটি-কামড়ানো লড়াই – এই সব কিছু কি হঠাত হোলো? বাঙ্গালী হঠাত জেগে উঠল তার যোদ্ধা-সত্ত্বা নিয়ে মাত্র দেড়’শ বছরে? এর কি কোনও অতীত নেই?
*********************************************************************
মহাভারতের ঐতিহাসিকতাকে যদি মান্যতা দেওয়া যায় এবং যদি মেনে নিই যে হস্তিনাপুরই আমাদের আজকের দিল্লী, তবে বলতে হয় যে, মহাকাব্যিক আখ্যানের যুগ আর ভারতে তুর্ক -আফগানী মুসলমান শাসকদের গেঁড়ে বসার মধ্যের কয়েক হাজার বছরে দিল্লী এবং উত্তর ভারত কিন্তু ভারতের রাজনীতির কেন্দ্র-ভূমি ছিল না। ছিল পূর্ব ভারত। এমনকি মহাভারতের রচনাকারও বলেছেন, কৌরব পক্ষকে দূর্বল করতে শ্রীকৃষ্ণ কৌশলে ভীমকে দিয়ে মগধ-নৃপতি জরাসন্ধকে হত্যা করান। প্রবল প্রতাপ মগধ নৃপতি ছিলেন দুর্যোধনের সুহৃদ।
শোনা যায় আলেকজান্ডার নাকি মগধের নন্দ বংশের প্রবল প্রতাপ এবং দুদ্ধর্ষ যোদ্ধাদের কাহিনী শুনে বিপাশার তীর থেকে ফিরে যান ভারত-বিজয়ের আশা অপূর্ণ রেখে। নন্দ বংশ ধ্বংস করে চন্দ্রগুপ্ত সূচনা করলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের। আলেকজান্ডারের সাথে ফিরে না গিয়ে যে সমস্ত গ্রীক সেনাধ্যক্ষ ভারতে সেই সময়েই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের পত্তন করবেন বলে ফন্দী আঁটছিলেন, তাদেরকে বেদম প্রহার করে ভারত ছাড়া করে এক বিপুল সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তুললেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। বিম্বিসার-অশোকের নেতৃত্বে প্রায় সমস্ত ভারত-ভুখন্ড এক অখন্ড রাজনৈতিক সীমানা পেল যার শক্তির কেন্দ্র ছিল পূর্ব প্রান্তের নগরী পাটলিপুত্র। এই সময়েই বুদ্ধের জ্ঞানের দীপ্তীতে শুরু হল সময়ের সাথে মর্চে ধরে যাওয়া সনাতন ধর্মাচারের ক্লেদের বিরুদ্ধে এক নব্য সহজিয়া দর্শনের আঙ্গিকে ভারতের মানুষের মুক্তি আন্দোলন। কিন্তু, সম্রাট অশোকের পর মাত্র একশ বছরের আশপাশেই মৌর্য বংশ হীনবীর্য হয়ে অবলুপ্তির পথে যেতে শুরু করল । কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে খন্ড-বিখন্ড ভারতে কব্জা করতে শুরু করল কখনো শক, কখনো হূণেরা। আবার, প্রায় পাঁচশ বছর পর, সেই পাটলি পুত্রেই নতুন করে ভারতের রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণ করার সূচনা হল আরেক চন্দ্রগুপ্তের হাতে। তবে ইনি মৌর্য নন, গুপ্ত। শুরু হল গুপ্ত সাম্রাজ্য। অবশ্য তা কলেবরে পূর্বসূরি শ্রেষ্ঠ মৌর্য সম্রাটদের মতো প্রায় সমস্ত ভারত ভূখণ্ডব্যাপী ছিল না এবং মূলতঃ বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরেই , যাকে এককথায় আর্যাবর্ত বলা হয় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবু সেই সময়টা ছিল ভারতের ইতিহাসের এক সুবর্ণ-অধ্যায়। সমুদ্র গুপ্ত গড়ে তুললেন এক বিশাল সাম্রাজ্য। কিন্তু তাও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পর বেশীদিন স্থায়ী হল না। স্কন্দগুপ্ত যদিও হূণদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হলেন, কিন্তু অচিরেই ভারতবর্ষ টুকরো টুকরো হয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাগ্যান্বেষী শাসক গোষ্ঠীর অধীনে ছোট বড় সাম্রাজ্যে বিভাজিত হয়ে গেল।
কিন্তু পাটলিপুত্রের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রে থাকার পেছনে মূল উপজীব্য ছিল তার পৃষ্ঠভূমি, যাকে আমরা আজকের বাংলা বলে চিনি। বাংলার কৃষক ও তাদের সৃষ্টি করা কৃষিজ সম্পদ, বাংলার শিল্পীদের উদ্ভাবনী কর্মকুশলতা, সেযুগের বাংলার অসংখ্য নদী ও সমুদ্র বন্দর, বাংলার বৌদ্ধিক সম্পদ এবং সর্বোপরী বাংলার নাম না জানা অসংখ্য ছোট ছোট সামন্ত রাজাদের অধীন দুর্ধর্ষ হস্তি, পদাতিক এবং নৌ-বাহিনী – এই সবই পাটলিপুত্রের শাসকদের অনন্য সম্পদ ও শক্তি যুগিয়েছে। কিন্তু, একটি জাতি হিসেবে বাঙ্গালীর গড়ে উঠবার সময় আসতে তখনও দেরী আছে।
*********************************************************************
গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বাংলার কর্ণসুবর্ণে “শালপ্রাংশু মহাভুজ”-এর মতো উঠে দাঁড়ালেন শশাঙ্ক। বাঙ্গালী বলতে আমাদের মনে যে ধারণা তৈরী হয়, সেই অর্থে শশাঙ্ক বাঙ্গালী ছিলেন কি না ঠিক বলা যায় না। তবে তিনিই সেই ঐতিহাসিক রাজপুরুষ, যাঁর বাহুবলে বাংলার মাটি থেকে প্রথম ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। কিন্তু সে যেন ছিল উল্কার মতো জ্বলে উঠে মাটিতে আছড়ে পড়া।
প্রাকৃতিক ও বৌদ্ধিক সম্পদে পূর্ণ বাংলা আজকের মতোই গোটা ভারতভূমির কামধেনু ছিল। যুগে যুগে সব ভারত-শাসকই চেয়েছে বাংলার দখল পেতে। ইংরেজরা অনেকের থেকে বুদ্ধি বেশী ধরে। তাই তারা কিছুটা খলের মতো ছল এবং বেশ কিছুটা বল-প্রয়োগ করে সবার আগে বাংলা পকেটে পুরে নিয়েছিল। তাই অন্যান্য বহিরাগত শাসকগোষ্ঠীর তুলনায় অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে গোটা ভারতব্যাপী আধিপত্য কায়েম করে ফেলেছিল। সোনার বাংলার লক্ষ্মীর ঝাঁপি যার তহবিলে, তার যদি দৃঢ়তা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং কর্তব্যের প্রতি একাগ্র নিষ্ঠা থাকে, তাহলে ইতিহাসের বুকে কত বড় বিস্ময় তৈরী করা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ ইংরেজদের ভারত-অধিকার। যে রাজপুরুষদের দরবারে একদিন তারা টুপি খুলে, জোড়া পায়ে সেলাম ঠুকে অধোবদনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত এই ভেবে যে কখন রাজা-বাদশা গোরাদের দয়া করে দুটো ব্যবসা করার অনুমতি দেবে, সেই রাজপুরুষদের সিংহাসন অচিরেই তাদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে গেল।
গৌড়াধিপ শশাঙ্ক বাংলার সম্পদের দ্বারপাল হয়ে অনন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন ভারতের অন্যান্য রাজপুরুষদের সাথে । তাঁর অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন কান্যকুব্জের হর্ষবর্ধন। কান্যকুব্জের দোসর হয়ে শশাঙ্ককে সাঁড়াশি আক্রমণ করলেন কামরূপের রাজা প্রভাকরবর্মন। ইতিমধ্যে ভারতে বৌদ্ধধর্মের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিপত্তির হাওয়া লেগে গেছে। কান্যকুব্জ এবং কামরূপের শাসকরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আজকের দিনে যেমন সাম্রাজ্যের জন্য বা অর্থনৈতিক লড়াইকে অনেক সময় ধর্মের রং মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। সেযুগেও বোধ হয় তার ব্যাতিক্রম ছিল না। শৈব শশাঙ্ক তাই সমসাময়িক বৌদ্ধ ভারতের ইতিহাস রচয়িতাদের কাছে বৌদ্ধ-বিরোধী দানব হিসাবে প্রচুর গালি শুনেছেন এবং নানা অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন। যদিও আধুনিক ঐতিহাসিকরা তথ্য-তালাশ করে সে সব দোষ অনেকটাই খণ্ডন করেছেন। শশাঙ্কের সময়ে বাংলা যে বৌদ্ধ দর্শন চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ছিল তার যথেষ্ট প্রমান আছে। তবে, শশাঙ্ককে যখন বিরোধী যুযুধান গোষ্ঠীর লোকজন গালি দিয়ে গেছেন, তখন এটুকু মানতেই হয় যে শশাঙ্কর সমর নৈপুণ্য বিরুদ্ধ শক্তির কাছে চিন্তার ছিল যে শুধু তাই নয়, তাঁর প্রহারও সহ্য করতে হয়েছিল তাদের। দুর্বল প্রতিপক্ষকে লোকে করুণা করে, গালি বোধহয় খুব একটা দেয় না!
যাইহোক, চারিপাশে প্রবল প্রতিপক্ষের সাথে ঘর করেও শশাঙ্ক এই বাংলা এবং বর্তমান উড়িষ্যার বেশ কিছুটা জুড়ে সেই সময়ের দক্ষিণ এশিয়ায় একটা বেশ শক্তিশালী শাসনতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার জীবনে অন্ধকার নেমে এল। সে অন্ধকার এতোই গাঢ় যে, ইতিহাস শশাঙ্কের হদিশ পেলেও, তাঁর পরবর্তী প্রায় একশ বছরের হদিস পায় না। ইতিহাস শুধু জানে যে সেই সময়ে বাংলা জুড়ে কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিলনা। ভারতবর্ষে তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসক গোষ্ঠী আপন আপন শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যাস্ত। বাংলায় তখন সবল অনায়াসে দুর্বলের গ্রাস কেড়ে নিয়ে বাংলা জুড়ে শুরু করেছে অরাজকতা। ইতিহাস তাকে বলে “মাৎস্যন্যায়”! কোন কোন সামন্ত রাজা কোথাও কোথাও ক্ষণিকের জন্য দখল কায়েম করলেও কেউ কোন সুস্থির সুশাসন দিতে পারছিলেন না। তাঁরা পরস্পরের সাথে কায়েমী স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন। আর কামধেনু বাংলার এই রাজনৈতিক শূণ্যতার সুযোগ বাকি ভারত নেবে না, তা কি হয়? অতএব বাংলা সহ্য করল কখনো বৎস বা দুর্ধর্ষ গুর্জর শাসকদের বীভৎস লুণ্ঠন। কখনো রাষ্ট্রকূট রাজাদের শক্তির আস্ফালন। কখনো দেখল তারই মাটিতে দুই বিদেশী শাসকের পরস্পরের লড়াই।
*********************************************************
বাঙালী জাতটা গোড়া থেকেই বোধ হয় এই রকম। পড়ে পড়ে হাজারো গ্লানি সহ্য করে। যেন কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। সে যেন লাঞ্ছনা সঞ্চয় করতেই পৃথিবীতে এসেছে। তারপর হঠাত একদিন কি যেন মনে করে সহস্র আগ্নেয়গিরির লাভার বিস্ফোরণের মতো জেগে উঠে চমকে দেয়। জন্ম হয় বাংলার নতুন যুগপুরুষদের। এতদিনের লাঞ্ছনা মাথা নীচু করে স্থান করে দেয় বাঙ্গালীর কীর্তীধ্বজার।
মাৎস্যন্যায়ের লাঞ্ছনাই সম্ভবতঃ জন্ম দিয়েছিল আজকের বাঙালী জাতিস্বত্তার। চূড়ান্ত অপমানে, লাঞ্ছনায় নিমজ্জিত, শাসক ভূস্বামীদের অভ্যন্তরীণ কলহে দীর্ণ বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের পুঞ্জীভূত যন্ত্রণা নিবারণের আশায় বরণ করে নিল প্রথম এক বাঙালী রাজশক্তিকে যার কাছে আগামীতে মাথা নোয়াবে ভারতের বিপুল অংশ। যে রাজশক্তি তার ব্যাপ্তি এবং চরিত্রে পৃথীবীর ইতিহাসে অনন্য। কেন অনন্য সে প্রশ্নে আসছি। তবে তার আগে এই রাজশক্তির অভিনব সূচনার ইতিহাসটা একবার স্মরণ করি। স্মরণ করি বাঙালীর ঐতিহাসিক “ওয়ার-হিরো”দের, বাঙলার সম্রাটদের।
*********************************************************************
উপযুক্ত জনকল্যাণকামী রাজশক্তির অভাবে দেশে যখন বিপর্যয় আসে, মানুষের সুস্থ জীবন-চর্চায় বিঘ্ন ঘটে, তখন কিন্তু সাধারণ মানুষ চুপ করে বসে থাকে না। মানুষ তার নিজের ক্ষমতায় সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। যেমন ’৭৬-এর মন্বন্তরের অভিঘাতে বাংলার বুকে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সন্ন্যাসী-ফকিরের দল; ব্রিটিশ নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে বুকচিতিয়ে লড়েছিল বাংলার কৃষক; এদেশের মাটির রস আর মানুষের ঘাম রক্ত শুষে বৃটেনের মুনাফা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এদেশেরই অরণ্যচারী আদিবাসীরা; দেশব্যাপী বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে সঞ্চিত বিপুল ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে, যেখানে স্থানীয় শাসকদের থেকেও মূলতঃ এদেশের কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, অনেকসময়ই কেন্দ্রীভূত শাসনের অভাবে বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ-বিক্ষোভ সমুদ্রতটে তটে আছড়ে পড়া তরঙ্গের মতোই হারিয়ে যায়, ভাঙ্গন ধরাতে পারে না। আবার অনেকসময় এই বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধের মধ্যে থেকেই জন্মলাভ করেন নতুন কোন নায়ক যাঁর প্রভাবে সূচিত হয় মহাকালের চরণচিহ্ন বুকে নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটি জাতির অগ্রযাত্রার। যেমন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ জন্ম দিয়েছিল জর্জ ওয়াশিংটনের।
ঐতিহাসিক ভাবে এই বাংলার মানুষ হীনবল নয়। মাৎস্যন্যায়ের সময় বহুক্ষেত্রেই আঞ্চলিক রাজশক্তি হয়তো বহিঃশত্রুর কাছে আত্মসমর্পন করেছিল, কিন্তু আঞ্চলিক সমর নায়কদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ থেমে থাকে নি। অনেক সময় সৈনিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই হয়তো স্থানীয় রাজশক্তি পশ্চাদপসরণ করেছিল। এই সঙ্ঘর্ষ-উত্তাল সময়েই উত্থান হয় এক বাঙালী সমর নায়কের। ইতিহাসে তাঁর নাম গোপাল। গৌড় বঙ্গের কোন এক সামন্ত রাজার অধীনে একজন সেনাপতি ছিলেন তিনি। চারিদিকে যখন স্থানীয় শাসকদের ক্ষুদ্র স্বার্থের সংঘাতে বাংলার সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, সেই সময় গোপাল তাঁর সমর নৈপূণ্যে বাংলার সম্মান রক্ষা করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সমস্ত স্থানীয় শাসক এক সময় বুঝলেন, পারস্পরিক কলহ তাঁদের আরও হীনবল করবে, দেবে আরও আরও পরাজয়ের গ্লানি। সাধারণ মানুষ ও সৈনিকেরা বুঝতে পারল, গোপালের মতো একজন কুশলী সমর নায়ক যতোই তাদের প্রিয় হোন, যতই তিনি অভ্যন্তরীণ ও বহির্শত্রুকে পর্যুদস্ত করুন, সাধারণ মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগান, গৌড়-বঙ্গের বাহুবলের সম্মান রাখুন – সমস্ত বাংলার ভূমির অধিকার যদি তাঁর হাতে সঁপে দেওয়া না যায়, তবে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব হবে না। হয়তো পরস্থিতি এবং জনমতের চাপেই বাংলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সামন্ত রাজারা সম্মিলিত ভাবে গোপালের নেতৃত্বকে স্বীকার করে। এইভাবেই আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগে বাংলার গণদেবতার আশীর্বাদে এক নতুন শাসনতন্ত্রের সূচনা হয় – সূচনা হয় পাল সাম্রাজ্যের। পাল রাজপুরুষদের সামরিক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতায় ভারতের বিপুলাংশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠে এই বাংলার মাটি।
তিন’শ বছরের মুঘল শাসন, দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন ইত্যাদি নিয়ে আমাদের ইতিহাসের পাতায় আলোচনার শেষ নেই। কিন্তু বাংলার ও বাঙ্গালীর এই নিজস্ব সাম্রাজ্যের খোঁজ আমরা রেখেছি কতটুকু? আগেই বলেছি এই পাল শাসন কিন্তু ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে সাম্রাজ্য স্থাপনের এক অনন্য নজির। অনন্যতা শুধুই তার গণতান্ত্রিক সূচনার জন্য নয়। পাল রাজবংশের ইতিহাস অনন্য নানা কারণে।
পাল রাজবংশ তার অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পেরেছিল একনাগাড়ে প্রায় সুদীর্ঘ চার’শ বছর। কোন একটি রাজবংশের এত বিরামহীন সুদীর্ঘ অস্তিত্ব ভারত তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। বাঙ্গালীর জন্য তা কম গৌরবের নয়। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে সর্বদাই যে এই সাম্রাজ্য তার আধিপত্য সমান ভাবে বজায় রাখতে পেরেছিল, তা নয়। ব্যাপ্তির শিখর থেকে পদস্খলন হয়েছে একাধিকবার। একাধিকবার এইবংশের শাসকরা দাঁড়িয়েছিলেন অবলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু, রূপকথার ফিনিক্স পাখীর মতো ধ্বংসের তীর থেকে আবার হৃতগৌরব ফিরিয়ে এনে শাসনের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছেন বংশের কোন এক রাজপুরুষ। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙ্গালীর স্তুতি করে বলেছিলেন, “মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি, / বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টিকা পরি।” বাঙ্গালী পাল রাজারা যেন বাংলার এই চরিত্রকেই ধারণ করে অমৃতের টিকা মাথায় নিয়ে বারে বারে নবজীবন লাভ করেছেন। এরকম শাসনতন্ত্রও পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য।
*********************************************************************
বাংলাব্যাপী সামন্তরাজা ও ভূস্বামীদের আনুগত্য এবং সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পাথেয় করে গোপাল গৌড়কে কেন্দ্র করে এক এক দৃঢ় সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। সব থেকে বড় কথা হ’ল, মাত্র প্রায় এক শতাব্দী আগে শশাঙ্কের সময় যে ধর্মীয় সঙ্ঘাতের আবহ ছিল এবং দীর্ঘ মাৎস্যন্যায়ের সময় যে সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ সমাজে সর্বব্যাপী ক্ষত তৈরি করেছিল, গোপাল তা মুছে দিয়ে এক সর্বমত সহিষ্ণু, কল্যাণকামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হলেন। সহিষ্ণু শাসন কাঠামোর যে মূলসুরটি গোপাল বেঁধে দিয়েছিলেন, তাঁর পরবর্তী শাসকরা কমবেশি সকলেই সেটি মেনে চলেছিলেন। শাসকের সহিষ্ণুতার সাথে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শক্তি যে কতটা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই বাঙ্গালী শাসনতন্ত্র। সম্ভবতঃ শাসক সহিষ্ণু হলে প্রজারাও শাসকের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, আর সেটাই শাসন কাঠামোকে অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা দেয়। যদি মনে হয় যে আজ বাংলার বুকে ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের তুলনায় সহনশীলতা অনেক বেশী, তবে বলা যেতেই পারে যে এই সহনশীল সংস্কৃতির সূচনা গোপালের সময় থেকে।
গোপালের মৃত্যুর পর দুই প্রজন্ম ধরে বাংলার বিজয়লক্ষ্মী অটুট থাকে। গোপালের পুত্র ধর্মপাল সমগ্র উত্তরাপথে আধিপত্য বিস্তার করেন। পালেরা সমস্ত অঞ্চল যে নিজেরা সরাসরি শাসন করতেন তা নয়। বরং বহুক্ষেত্রে তাঁরা অনুগত রাজশক্তির মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন বজায় রেখেছিলেন। যে কান্যকুব্জের দখল রাখতে শশাঙ্ক ব্যর্থ হয়েছিলেন, মাত্র এক শতাব্দীকাল পরে সেখানেই ধর্মপাল অনুগত শাসক চক্রায়ুধকে অধিষ্ঠিত করে বাংলার শাসন সুনিশ্চিত করেন। ধর্মপালের পর দেবপাল সাম্রাজ্যের পরিধি আরও বাড়িয়ে নিয়ে যান। আধুনিক উড়িষ্যার বিপুলাংশ তো বটেই, পশ্চিমে আরব সাগরের তীরবর্তী গোকর্ণ থেকে উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতসীমান্তে কম্বোজ উপজাতিদের উপরেও বাংলার আধিপত্য নিশ্চিত হয়। বাংলার রণসাজে হাতি, পদাতিক এবং নৌবাহিনী বহির্শত্রুর ত্রাস হয়ে উঠলেও, সম্ভবতঃ ভৌগলিক কারণেই অশ্বারোহী বাহিনীর তেমন প্রচলন ছিল না। কম্বোজ উপজাতিদের উপর প্রভুত্ব অর্জন করে তাদের সাথে দেবপাল বাংলার এক নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং তাদের মাধ্যমেই দুর্ধর্ষ অশ্ববাহিনী যুক্ত করেন তাঁর সৈন্যদলে । দেবপাল পশ্চিমে হুনদেরও চিরতরে বিতাড়িত করেন।
একথা অনস্বীকার্য যে পাল সম্রাটরা শুধু যে বাহুবলে তাঁদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা নয়। তাঁদের বৌদ্ধিক ঐশ্বর্য, সহনশীল জনমুখী শাসন প্রণালীর জন্য ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল শ্রদ্ধায় বাংলার আনুগত্য স্বীকার করেছিল। গুপ্তদের বিলুপ্তির পর আবার ভারতবর্ষের এক বিপুল অংশ একটি রাজবংশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে এই পাল সম্রাটদের মাধ্যমে। ভারতের ভরকেন্দ্র আবার স্থানান্তরিত হয় পূর্বে – বাংলা হয়ে ওঠে তার কেন্দ্র স্থল। তবে, পালেরা শুধু যে বাংলাকেই সমৃদ্ধ করেছিলেন তা নয়। তাঁরা পাটলিপুত্রের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনেন। বারানসী সহ দোয়াবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সমৃদ্ধি ফিরে আসে।
এইসময়টা বাংলার জন্য ছিল এক সুবর্ণযুগ। গৌড়ীয় শিল্প ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে। আবার ভারত ব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে এই সময় বহির্ভারতের সংস্কৃতির সাথেও বাংলার নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। উত্তরভারতীয় প্রভাবে বাংলায় মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম বোধহয় এই সময় থেকেই। এই সময়েই বাঙালী জাতিস্বত্বা তার ভাষা নিয়ে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে।
দেবপালের পর পাল সাম্রাজ্য তার গৌরব হারাতে থাকে। গুর্জর দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ক্রমশঃ পাল রাজবংশের আয়তন কমতে থাকে। একসময় গৌড় থেকেও তাঁরা বিতাড়িত হন। কিন্তু আগেই বলেছি, রূপকথার ফিনিক্স পাখীর মতো পাল রাজবংশ বারে বারে ফিরে এসেছে। হয়তো তার অতীত গরিমা ফিরে আসে নি, কিন্তু তার অস্তিত্ব বিস্মৃতির অতল থেকে পুনরায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে ।
দেবপালের পর প্রথম বিগ্রহপালের সময় থেকেই সাম্রাজ্যের ক্ষয় শুরু হয়। তাঁর পরবর্তী চতুর্থ রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপাল গৌড়ের অধিকার হারান, যে গৌড় থেকে একদিন গোপাল জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র প্রথম মহীপাল সম্ভবতঃ লোকচক্ষুর অন্তরালে রাজ্যাভিষিক্ত হন কোন অরণ্যে। ইতিহাস সাক্ষী, বাঙালী বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে লড়াই ছাড়ে নি। রাজ্যহীন রাজ্যাভিষেকের মর্যাদা মহীপাল রেখেছিলেন। মহীপাল গৌড় ও সমতট তো বটেই, কলিঙ্গ বিজয় করে মগধ ছাড়িয়ে বারাণসী পর্যন্ত তাঁর পিতৃপুরুষের অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন। বারাণসীকে সুসজ্জিত করে গড়ে তোলেন। চোল, চেদী, কলচুরী রাজবংশ দাক্ষিণাত্য থেকে একাধিক আক্রমণ করে বাংলায়। মহীপাল তা প্রতিহত করেন।
কিন্তু এই সময় ভারতের পশ্চিম দ্বারে আবার বিদেশী আক্রমণের ভ্রূকুটি দেখা দেয়। হুণ দের থেকে ভারত দীর্ঘদিন নিষ্কৃতি পেয়েছিল। কিন্তু, এবার দেখা দিল তুর্ক-আফগানী দুর্ধর্ষ লুটেরা গজনীর সুলতান মাহমুদ। দেবপাল হিন্দুকুষের প্রান্ত পর্যন্ত যে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা তখন অতীত। উত্তরাপথের বিচ্ছিন্ন শাসকের দল নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত। একসময় বাংলার অভিভাকত্বে থাকা উত্তরাপথ তখন অভিভাবকহীন। এশিয়ার পশ্চিমপ্রান্তে আরবের মরুভূমিতে তখন নতুন সভ্যতার বিজয়নির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে ইউরোপের সাথে এশিয়ার প্রভুত্ব-প্রতিষ্ঠার দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম – ধর্মযুদ্ধের নামে।
মাহমুদ ভারতের পশ্চিমে যখন রক্তস্নান করছেন, তখন শেষ মুহূর্তে কাশ্মীরসহ উত্তরাপথের বাকী রাজারা মহীপালের স্মরণাপন্ন হয়ে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অনুরোধ করেন। কিন্তু মহীপাল সে ডাকে সাড়া দেননি। যদি দিতেন হয়তো ভারতের ইতিহাস অন্যরকম হত। তবে কেউ কেউ বলেন দীর্ঘ যুদ্ধের পর পিতৃরাজ্য উদ্ধারকরে বৃদ্ধ মহীপাল তখন ধর্মাশোকের মতোই বৈরাগ্যময় হয়ে বারানসীকে সজ্জিত করতেই ব্যাস্ত ছিলেন। কেউ বলেন মহীপাল উত্তরাপথের বাকী শাসকদের থেকে অতীতে খুব একটা সদ্ভাব পাননি। অতীত অভিজ্ঞতা তাঁকে নিজরাজ্য সুরক্ষিত রাখাকেই অগ্রাধিকার দিতে শিখিয়েছিল কারণ, ভারতের পশ্চিমাংশের আক্রমণে বাংলার নিরাপত্তা বারে বারে বিঘ্নিত হয়েছে, বাংলা লুণ্ঠিত হয়েছে। মহীপালের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে উত্তরাপথ বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে নি। কিছু বছর আগে যে পালবংশ অবলুপ্তির পথে চলে গেছিল, সেই বংশেরই মহীপালের সামরিক গুরুত্ব তখন এতটাই ছিল ভারতের রাজনীতিতে। এ এক অদ্ভুত উত্থান। তবে ভারতে ইসলাম শাসনের দ্বার সেদিনই উন্মুক্ত হয়ে যায়।
মহীপালের পর নয়পাল সিংহাসনে আসীন হন। এই সময়েই বাংলার গর্ব অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বৈদগ্ধে বৌদ্ধদর্শন বাংলা থেকে ছড়িয়ে পড়ে তিব্বত ও অন্যত্র। তীব্বতীয় বৌদ্ধ উপাসনাগৃহে আজও দীপঙ্কর পূজিত হন।
নয়পালের সময় থেকে পাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। নয়পাল গৌড় রক্ষায় সমর্থ হলেও বাকী সাম্রাজ্য হারাতে হয়। নয়পালের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের সময় থেকেই সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ। বারেন্দ্রভূমির অধিকার নেন কৈবর্ত রাজা দিব্য। ব্রাহ্মন্যবাদী শ্রেনী বিভাগ পাল রাজাদের সময় বাংলায় ছিল না তার প্রমান বোধ হয়, বর্তমানে প্রান্তিক হিসেবে যে জনজাতিকে মনে করা হয়, সেই কৈবর্তদের দ্বারা শাসন ক্ষমতা দখল করা।
কিন্তু আবার পাল রাজবংশ তার হৃত গৌরব ফিরে পায় রামপালের শাসনে। রামপাল উৎকল, মগধ পুনরাধিকার করেন। কামরূপ বিজয় করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। সেই সঙ্গে কৈবর্ত রাজ ভীমকে পরাজিত করে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করেন। এইভাবেই বারে বারে মহাকালের বুকে হারিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসেন পাল রাজারা।
রামপালের পর ধীরে ধীরে বাংলায় সেন বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মন্যবাদী সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ দাক্ষিণাত্য থেকে এসে পালেদের অধীনেই সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকেই সম্ভবতঃ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগে অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না পাল শাসন। সেনদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েও পাল রাজারা একেবারে বিলুপ্ত হন নি। রামপালের কনিষ্ঠপুত্র মদনপাল প্রাচীন মগধের পূর্বাংশ ও উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে এক ক্ষুদ্র রাজত্বে পর্যবসিত হয়েছিল। মদনপালের পর গোবিন্দপালের সময় পাল বংশ চিরতরে অবলুপ্ত হয় । তবে সে অবলুপ্তিও বড় গর্বের।
*********************************************************************
মহীপালের সময় থেকে যে তুর্ক-আফগানী আক্রমণ শুরু হয়েছিল, তা ক্রমেই পূর্বের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল দুর্দম বেগে। দোয়াব, কাণ্যকুব্জ পেরিয়ে তা এগিয়ে আসছিল বাংলার দিকে। গৌড়ের অধিকার তখন ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনবংশের শাসকদের হাতে। পাল সাম্রাজ্যের শেষ প্রদীপের নিভন্ত শিখার মতো তখন মগধের পূর্বে উদ্দন্ডপুর (ওদন্তপুরী – বর্তমানে বিহার শরিফের অন্তর্গত), নালন্দা, বিক্রমশীলা ইত্যাদি কয়েকটি ক্ষুদ্র নগর নিয়ে পিতৃপুরুষের সাম্রাজ্যের অবশেষ আঁকড়ে ছিলেন গোবিন্দপাল। এই উদ্দন্ডপুর, বিক্রমশীলা তো তাঁরই পূর্বপুরুষের কীর্তি! নালন্দার সমৃদ্ধি তো তাঁরই পূর্বপুরুষের হাতে।
বখতিয়ার খিলজি যখন দুর্মদ গতিতে বাংলার দিকে অগ্রসর হতে হতে মগধের প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন, তখন বাংলার দ্বারপ্রান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সেই গোবিন্দপাল। একা! পশ্চিমে তখন বাংলার বিস্তীর্ণভূমি, কিন্তু তা শত্রুর হাতে। সেন রাজারা কোন পাল বংশীয়কে সাহায্য করবে না। যে বিস্তীর্ণ ভূখন্ড থেকে একসময় তাঁর পুর্বপুরুষ গোটা ভারতে বিজয়ধ্বজা উড়িয়েছেন, যে ভূখণ্ডের সামরিক বাহিনীর পদধ্বনি শুনে একদিন গোটা ভারত সম্ভ্রমে মাথা নত করেছে, যে ভূখণ্ডকে তাঁর পূর্বপুরুষ সমৃদ্ধ করেছেন, আজ সেই ভূমিরই রক্ষার দায় গোবিন্দপালের। অথচ যাকে রক্ষা করবেন সেই ভূমির থেকে কোন সাহায্যের আশা করা বাতুলতা। কি অদ্ভুত! বাংলাকে রক্ষা করার পিতৃপুরুষের শপথ মাথায় নিয়ে গোবিন্দপাল ব্রতী হলেন এক অসম যুদ্ধে। চণ্ডাশোকের আক্রমণ থেকে কলিঙ্গকে রক্ষা করতে যেমন সমস্ত কলিঙ্গবাসী অস্ত্র ধরে জন্মভূমির সম্মান রক্ষা করতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, সেই রকম স্বভূমির সম্মান রক্ষায় সমস্ত বৌদ্ধভিক্ষু অস্ত্রধারণ করে সমবেত হলেন উদ্দন্ডপুরে । নগরীর মধ্যে পাহাড়ের মাথায় দুর্গের মতো অবস্থিত উদ্দন্ডপুরের সঙ্ঘারাম। উত্তরাপথের কোন রাজা এগিয়ে এল না সাহায্যের জন্য। যে সঙ্ঘারাম বিদ্যার্জনের পবিত্রভূমি, সেখানেই শুরু হল তীব্র অসম সংঘর্ষ । সসৈন্যে যুদ্ধরত গোবিন্দপাল নিহত হলেন বখতিয়ার খিলজির সেনা বাহিনীর হাতে। নিভে গেল পাল গৌরবের শেষ প্রদীপ। শেষ হয়ে গেল বাঙালী জাতির অভিভাবকদের চারশ’ বছরের অধ্যায়। যদি ইতিহাস দাবী করে যে মাহমূদকে প্রতিহত করার জন্য উত্তরাপথের রাজাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে মহীপাল ভুল করেছিলেন, তবে বলতে হয় যে, গোবিন্দপাল নিজের জীবন দিয়ে পূর্বপুরুষের সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছিলেন।
*********************************************************************
শুরু করেছিলাম বাংলার সমরিক ঐতিহ্যের উৎস অনুসন্ধান করে। খুঁজতে চেয়েছিলাম বাংলার “ওয়ার হিরো”দের, বাঙ্গালী সম্রাটদের। তাই শিবাজী বা রাণাপ্রতাপে বিহ্বল বাঙ্গালীমনকে তার নিজের সাম্রাজ্য, সমর-ঐতিহ্য স্মরণ করাতেই এই প্রচেষ্টা। দক্ষিণভারত আজও চোল, চালুক্য, বিজয়নগরের শাসকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, সেই অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান জাতিস্বত্বার প্রেরণা সঞ্চয় করে। বাঙ্গালী তার একান্ত নিজের সাম্রাজ্য গৌরবে সিঞ্চিত হতে পারে না?
*********************************************************************
যে রচনাগুলি থেকে এই লেখার বিষয়বস্তু সংগৃহীত হয়েছে :
বাঙ্গালার ইতিহাস (১ম খণ্ড), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
ধর্মপাল (উপন্যাস), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
গৌড় রাজমালা, রমাপ্রসাদ চন্দ।
তুমি সন্ধ্যার মেঘ (উপন্যাস), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আত্মচরিত, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধীয় ভারত, বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
প্রাঞ্জল। তথ্যপূর্ণ। সুখপাঠ্য।
ধন্যবাদ দেবযানী ৷
বেশ ভালো লাগলো ……
Nice article Abhijan .
খুব ভালো হয়েছে অভিযান