Site Overlay

ভাঙা মন্দিরের ঢিপি

অভিযান ভট্টাচার্য্য

সূর্যের তেজ নিভে আসার একটু আগে যখন সেখানে পৌঁছলাম, মন অদ্ভুত বিস্ময়ে যেন স্থবির হয়ে গেল ৷ ধবধবে সাদা কাশবনে ঢেকে আছে চরাচর | মনে হচ্ছে বাংলার পেলব মাটির বুকে নেমে এসেছে একখন্ড স্বর্গ ! যেন শরতের আকাশের মতোই মেঘ বাতাসে ভেসে ঢেউ খেলে খেলে ছুটে বেড়াচ্ছে কাশ বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে৷ শুভ্র শরীরে  পড়ন্ত সূর্যের কাঞ্চণবর্ণ মেখে সে যেন একটুকরো দেবলোক ৷ আর সেই দেবলোকের জঠরে সলাজে অবগুণ্ঠিতা এক ভগ্ন মন্দির | চারিপাশে ক্ষয়িষ্ণু মাটির ঢিপি | তারই মধ্যে জেগে আছে অতীতের কঙ্কাল নিয়ে ৷ শুধু স্থানে স্থানে স্খলিত মাংসের মতো পড়ে আছে কারুকাজ অজানা অতীতের সম্ভাব্য গৌরবগাথা হয়ে ৷ সম্ভাব্য – কারণ ইতিহাস এই মন্দিরের সন্ধান পায়নি ৷ পুনর্ণিমান হয়নি তার অতীত ৷ শুধু, তার সমস্ত গ্লানি নিয়েও , আমার মত খামখেয়ালি বাউন্ডুলের মনে অপার বিস্ময়  জাগিয়ে বড় কুন্ঠায় সে যেন চেয়ে আছে ৷ পুরোন আমলের গৃহস্থবাড়ীর অসংবৃতা অন্তঃপুরচারিনী অন্দরমহলে হঠাৎ কোন অচেনা পুরুষকে দেখলে যেমন কুণ্ঠিতা হয় – অনেকটা যেন সেই রকম ৷

“ ও কাকু, আমাদের লজেন কেনার পয়সা দেবে না? এইটাই তো তোমার সে মন্দির ৷”

গ্রামের যে ছেলের দল আমাকে এই দৃষ্টির আড়ালে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর জায়গায় পথ দেখিয়ে এনেছে, তাদেরই একজনের ডাকে সম্বিৎ ফিরল ৷  

এই মন্দিরের খবরটা আমাকে দিয়েছিল রমেন ৷ ও সপ্তগ্রামে কি একটা সরকারী কাজ করে ৷ কদিন আগে আমার বাড়ীতে এসেছিল ৷ বলল গত বর্ষায় দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে যে বন্যা হয়েছিল, তাতে ওদের দিকেও নদীনালা উপছে চারাদিক ভাসিয়ে দিয়েছিল ৷ জানমালের ক্ষয়ও হয়েছিল প্রচুর৷ মাসাধিককাল পরে যখন জল নেমে গেল, তখন হঠাতই একদিন একটা সরকারী সার্ভেয়র টীম নদীর ধার দিয়ে জরিপ করবার সময় দেখে নদীর পাশের একটা ঢিপির খানিকটা খসে পড়ে একটা মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ জেগে উঠেছে ৷ রমেন গ্র্যাজুয়েশন করেছিল অ্যান্থ্রোপলজি নিয়ে ৷ এসব নিয়ে ওর আগ্রহ এখনও আছে। যদিও রুটি রুজির জন্য কলম পেশা কেরাণীর কাজ করতে হয় ৷ ঘটনাটা শোনার পর রমেন গিয়েছিল ওখানে মন্দিরটা দেখতে ৷ সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছিল ৷ সঙ্গে থাকা অফিসের লোকজন অন্ধকারে বেশীক্ষণ ওখানে থাকা নিরাপদ মনে করে নি ৷ কয়েকজনের নাকি বেশ গা ছম ছম করছিল ৷ তাই রমেন ভালো করে দেখতে পারে নি ৷ যে টুকু দেখেছে তাতেই একটু আশ্চর্য হয়েছিল ৷ মন্দিরটা দেখে ওর স্পষ্ট মনে হয়েছিল এ যেন উড়িষ্যার কোন দেবদেউলের ধ্বংসস্তূপ ৷ কিন্তু সপ্তগ্রামের কাছে গণ্ডগ্রামে এরকম মন্দির ! কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে মহালয়ার দিন রমেন বাড়ী এসে আমাকে ঘটনাটা বলে ৷ ওর মনে হয়েছিল আমার মতন শিল্পীর জন্য জায়গাটা একটা অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ হতে পারে ৷ তখনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম এখানে আসবই | হঠাৎ জেগে ওঠা অতীত আবার হয়তো মিলিয়ে যাবে ৷ হয়তো চিরতরে ৷ আমাদের মতো ইতিহাসকে অবহেলা করা দেশে স্থায়ী ইতিহাসেরই যত্ন হয় না ৷ তাই এই মন্দিরও চিরতরে বিলীন হওয়া আশ্চর্য নয় ৷  রমেন ছুটিতে চলে গেছে দার্জিলিং পুজো শুরুর আগেই ৷ তাই দুর্গা ষষ্ঠীতে একাই বেরিয়ে পড়লাম ভাঙা মন্দিরের সন্ধানে ৷ এই গ্রামে এসে জানলাম জায়গাটার নামই হয়ে গেছে ‘ভাঙা মন্দিরের ঢিপি’ |

ছেলের দলকে প্রতিশ্রুতি মতন কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিলাম ৷ ওরা মহা উল্লাসে কাশবন দাপিয়ে চলে গেল ৷ দূরে কোন মন্ডপ থেকে ঢাকের বদ্যি শোনা যাচ্ছে ৷ অদূরে নদী বয়ে চলেছে কলকল শব্দে ৷ হাওয়ায় দোলা কাশবন যেন ফিসফিস করে কি এক কথা বলে চলেছে অনর্গল ৷

একটা জুৎসই সমান কিন্তু একটু উঁচু জমি দেখে ক্যানভাসটা খাড়া করলাম ৷ খুব দ্রুত কাজ সারতে হবে ৷ অন্ধকার হতে বেশী দেরী নেই ৷ অন্ততঃ স্কেচটা সারতে হবে ৷

ক্যানভাসটা দাঁড় করিয়ে, কি মনে হল, ঢিপি বেয়ে উঠে মন্দিরের ভগ্নাবশেষের খুব কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলাম ৷ সত্যিই অদ্ভুত ! যেন কোনার্কের মন্দিরের খুব ছোট একটা সংস্করণ | রমেন ঠিকই বলেছিল ৷ মাটি সরিয়ে দেওয়ালের কাজগুলো দেখার চেষ্টা করলাম ৷ মন্দিরের আদল উড়িষ্যার হলেও কাজগুলো যেন বাংলার টেরাকোটার মতন ৷ সেকালের জীবনচর্যা ফুটে উঠেছে ৷ কিছু কিছু জায়গায় ফুটে উঠেছে শৃঙ্গারের চিত্রও | উৎকলের মন্দিরে যা হামেশাই দেখা যায় ৷ অনেকটা এলাকা জুড়েই মন্দিরের খণ্ডাংশ একটু আধটু জেগে আছে ৷ পুরো মন্দিরটা হয়তো অনেকটা এলাকা জুড়েই ছিল ৷ ঢিপিটা পাড় করে মন্দিরের অন্যাপাশটা কিছু দেখা যায় কিনা সেই চেষ্টায় এগোলাম ৷ হঠাৎ পায়ের কাছে একটা পাথর কোথা থেকে জানি খসে পড়ল ৷ মাটি সরালাম ৷ সেই একই ৷ শৃঙ্গারের দৃশ্য উৎকীর্ণ করা আছে ৷

“ চিত্রকর ? মন্দিরের চিত্র আঁকবে?”

কে যেন পেছন থেকে বলল ফিসফিসে গলায় ৷ চমকে পেছন ঘুরে দেখি এক শীর্ণ চেহারার খর্বকায় মানুষ দাঁড়িয়ে হাসছে ৷ একমুখ চুলদাড়ি ৷ বয়েস অনুমান করতে পারলাম না ৷ পরনে ময়লা একটা কাপড় ৷ দেহের পেশীগুলো দড়ির মতন জড়িয়ে আছে ৷ বোঝা যায়, এককালে সবল দেহ ছিল ৷

আমি কিছুটা অবজ্ঞার সুরেই বললাম, “ ইচ্ছে তো সেরকমই আছে ৷” লোকটা হিস্ হিস্ শব্দ করে হেসে উঠল ৷ তারপর হঠাৎ থেমে কিসফিসিয়ে বলল, “ আর এই মন্দিরের মধ্যে যুগ যুগ গুমরে  মরছে যে কান্না! বাইরের এই জরাজীর্ণ দেহের ছবি এঁকে গর্ভগৃহের অন্দরের চাপা কান্নার কথা কইতে পারবে? যে কথা বলার জন্য সে আবার জেগে উঠেছ সে কথা শোনার, সেকথা শোনানোর জন্য কেউ নেই!”

ভাবলাম, এতো আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল ! কি জানি কি ধান্দায় ঘুরছে ৷ অচেনা অজ গাঁয়ে কোনো ঝামেলায় না ফেলে ৷ আবার দুর্ব্যবহার করে তাড়ালেও বিপদ | কযেকমুহূর্ত সাত পাঁচ ভেবে কুড়িয়ে নেওয়া পাথর খন্ডটা ব্যাগে পুরে আবার ক্যানভাসের কাছে ফিরে এলাম | লোকটাও এলো | পোষাকে যেমন অর্দ্ধনগ্ন তাতে করে কোন অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা ওই লোকটার পক্ষে সম্ভব নয় ৷ আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম ওর কোন দলবল আছে কি না ৷ কেউ নেই ৷ মনে হয় নিছক ভবঘুরে ৷ চাটিয়ে লাভ নেই ৷ একটু পরে দুটো টাকা দিয়ে বিদায় করব ৷ ততক্ষণ ওর সাথে মজা করে একটু বকবক করতে করতে ছবিটা শুরু করি ৷ দিনের আলো দ্রুত কমছে ৷

স্কেচ শুরু করলাম ৷ লোকটাকে কৌতুকের সুরে বললাম “কে কেঁদেছিল গো ? তুমি কাঁদতে শুনেছিলে?”

“ এই মন্দিরের জন্ম কবে জান চিত্রকর ?”

“ নাঃ | বলো দেখি, শুনি ৷” ক্যানভাস থেকে মুখ না তুলেই বললাম। ফ্রিতে গল্প শুনতে শুনতে ছবি আঁকতে মন্দ লাগবে না ৷

“ আকবর বাদশাকে চেন?”

“ সামনা সামনি দেখা হয় নি ৷ তবে নাম শুনেছি ৷” ছদ্ম গাম্ভীর্যে মজা করেই বললাম ৷

“ এ মন্দির তৈরী আকবর বাদশার আমলে ৷”

মনে মনে ভাবলাম, “ লোকটা দেখতে এরকম হলে কি হবে, গল্প ফাঁদতে বেশ ভালোই জানে ৷” মুখে বললাম, “ তাই নাকি? আকবর বাদশা বাংলা মুলুকে এসে মন্দির বানিয়েছিল?”

“ নাঃ, বাংলা মুলুকে তখন আকবর বাদশার নজর পড়েছে সবে ৷ আমাদের সুলতান তো তখন সুলেমান খান ৷ গৌড়ে তখন আফগানদের শেষ অবস্থা ৷”

লোকটাকে দেখে যে রকম ভাবছিলাম তাতো নয়! বেশ জ্ঞানগম্যি আছে দেখছি ৷ একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “ তাহলে? কে বানাল?”

লোকটা আকাশ পথে দৃষ্টি  মেলে বসে রইল কিছু মুহূর্ত৷ যেন কি খুঁজছে আলোকবর্ষ দূরে! চোখের কোনটা যেন চিকচিক করছে ৷ “ গ-জ-প-তি!” কেটে কেটে বলল সে ৷

“ গজপতি? সে কে ?”

“ উড়িয়া ব্রাহ্মণ ৷ এই এলাকার জমিদারী পেয়েছিল কয়দিনের জন্য ৷”

“ বাবা! আকবর বাদশা থেকে আফগানী সুলতান হয়ে শেষে উড়িয়া জমিদার !” এবার আর হাসি চাপতে পারলাম না ৷ “ গল্পতো ভালোই বানাতে পারো দেখছি ৷”

“ গল্প নয়, গল্প নয়, গল্প নয়!” ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় অস্বাভাবিক চিৎকার করে উঠল লোকটা ৷ তার ভেজা ফ্যাকাসে চোখের ওপর পড়ন্ত সূর্যের আলো ঠিকরে উঠছে আগুনের গোলার মতন ৷

“আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে ৷ সব সত্যি ৷ তুমি বলে যাও ৷” ভয়ে ভয়েই বললাম ৷ পাগলকে ক্ষেপিয়ে কি লাভ!

“ বলবই তো ৷ কাউকে তো বলতেই হবে ৷ নইলে যে …” নিজের মনেই শান্ত হয়ে বিড় বিড় করল সে ৷ আমিও কথা না বাড়িয়ে ছবি আঁকায় মন দিলাম ৷

“ মুকুন্দদেব কে চেনো?”

“ মুকুন্দ? নাতো ? কে সে?”

“ উৎকলের রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব ৷”

লোকটাতো জানে অনেক কিছু! বললাম, “ শোনা শোনা লাগছে বটে ৷ একটু খোলসা করে বল দিকিনি ৷”

মুকুন্দদেবের নাম শুনিনি বুঝে লোকটা হয়তো একটু আশাহত হয়েছে ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে গেল ৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ আকবর বাদশার সাথে মুকুন্দ দেব সাঁট করেছিল ৷ সন্ধি করে আকবরের জো-হুজুরী মেনে আগ্রায় খাজনা পাঠিয়ে উৎকল শাসন করত ৷ তারপর একদিন মোগল বাহিনীর ভরসায় হুহু করে দণ্ডভুক্তি দিয়ে বাংলায় ঢুকল উৎকলের সেনা ৷ সব দখল করে নিল ৷ এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, এই গ্রাম, এই নদী, ওই দূরে সাতগাঁও বন্দর, সব, সব দখল হয়ে গেল ৷

যেটা দখল করল, সেখানেই নিজের স্বদেশী একজনকে জমিদার করে বসিয়ে দিল ৷ এখানে বসালো গজপতিকে ৷”

এইটুকু বলে লোকটা থামল ৷ তবে লোকটার গল্প বলার কায়দা বেশ ভালো ৷ ক্যানভাস থেকে মুখ না তুলেই বললাম, “ তার পর ? গজপতি জমিদার হয়ে মন্দিরটা বানাল, তাইতো?”

“ কোনো রাজা, জমিদার কি কিছু বানায় চিত্রকর ? বানায় অভাগা কারুশিল্পীর দল৷ রাত নেই, দিন নেই, শুধু মরা পাথর খুঁড়ে জীবন সঞ্চার করা ৷ শরীর ভেঙে যায়, ফুসফুস ক্ষয়ে যায়, যৌবন বয়ে যায় – কে তার খবর রাখে বল? নাম হয় রাজা-বাদশা – জমিদারের ৷ তবে হ্যাঁ, গজপতিই হুকুম করেছিল এখানে মন্দির গড়ার ৷ উৎকল থেকে পাথর এনে উৎকলেরই নকশায় মন্দির বানানোর জন্য নদীর ধারে জায়গা ঠিক হল, যাতে সহজে পাথর এনে মন্দির বানানো যায় ৷ তবে এ মন্দিরে বিগ্রহ হবে চামুণ্ডার ৷ দণ্ডভুক্তির নানা জায়গা থেকে শীল্পিরা এল ৷ মল্ল রাজার দেশ থেকেও এল ৷ মন্দিরের কাজ শুরুর আগে কামরূপ থেকে একদল ব্রাহ্মণ আনিয়ে এইখানে গজপতি নিজে যজ্ঞ করল ৷”

মনে মনে ভাবলাম এ লোক কি জাতিস্মর! একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে যাচ্ছে, যেন চোখের সামনে সব ঘটতে দেখছে ৷

লোকটা বলে চলল, “ তারপর একদিন স্বয়ং মুকুন্দদেব এলেন ৷ তিনি এসেছিলেন ত্রিবেনীতে জগন্নাথের ঘাট বাঁধানো কেমন হয়েছে তা দেখতে ৷ সাতগাঁ যাওয়ার পথে এখানে এলেন ৷ মন্দির ততদিনে অনেকটা হয়ে গেছে ৷ গজপতির আব্দারে সাড়া দিয়ে মুকুন্দদেব উৎকল ফিরে গিয়ে  একদল সেবাদাসী পাঠিয়ে দিলেন ৷ ওরই মধ্যে ছিল রম্ভা ৷ কর্নাট থেকে উৎকলে এসেছিল ৷ উৎকল থেকে এল গৌড়ে ৷”

বাবা! একে তো ল্যাঙট পড়া চেহারা, তাতেও গল্পে একেবারে নায়িকার আমদানী! মনে মনে হেসে উঠলাম ৷ লোকটা আবার বলতে শুরু করল, “ রম্ভা বড় মিষ্টি  ছিল গো চিত্রকর . বড় ভালো ৷ দিনরাত এক করে তখন পাথর খুদছে সবাই ৷ আর মাত্র কয়েকদিন পরেই দেবীবরণের তিথি ৷ তার মধ্যেই রম্ভার সাথে প্রথমে চোখে তারপর মনে মনে মিল হল ৷”

“ মনের মিল হল! কার গো?” সকৌতুকে শুধোলাম ৷

লোকটা উঠে দাঁড়াল | চারপাশ প্রায়ান্ধকার ৷ লোকটা আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে, জ্বলতে থাকা দুটো চোখে আমার দৃষ্টিপথে এনে মর্মভেদী দৃষ্টি হেনে বলল, “ আমার!”

মগজে কে যেন জোরে একটা ঘুঁষি মারল মনে হল ৷ ব্যাটা বলে কি? যা ভেবেছিলাম তাই ৷ এতো দেখি বদ্ধ পাগল ! ভয়ে ভয়ে বললাম, “ তো – তো – তো – তোমার ?”

“গজপতি বড় কামুক ৷ সবাই জানত। মন্দিরে দেব সেবার নামে বহু নারীকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সে … সবাই জানত ৷ কিন্তু, ও রাজার প্রিয়পাত্র৷ পূজার্চনায় যেমন, যুদ্ধেও ছিল তেমন নিপুণ ৷ কেউ তাই গজপতির কামুকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস পেত না ৷  গজপতির অঙ্কশায়িনী হতে বাধ্য হওয়া কামিনীরাও নয়!

রম্ভাকে কথা দিয়েছিলাম, অধিবাসের আগেই ওকে নিয়ে পালিয়ে যাব কামরূপের দিকে ৷ ওকে মন্দিরের অভ্যন্তরে ধর্মের নামে লালসার শিকার হতে দেব না ৷”

পাগলের কথা শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে ৷ অন্ধকারও হয়ে এসেছে ৷ টর্চটা জ্বেলে আঁকার সরঞ্জাম গোছাতে লাগলাম দ্রুত ৷ পাগলের খপ্পর থেকে পালাতে হবে ৷

“ কিন্তু সেদিন কি হল জানো চিত্রকর ?” পাগল বকেই চলেছে, “ মন্দিরের কাজ তখন শেষ বললেই চলে ৷ গর্ভগৃহর কাজ সম্পূর্ণ ৷ দেবী প্রতিমাও অধিষ্ঠিত হয়েছেন৷ আগামী রাত্রে দেবীকে বরণ করা হবে ৷ রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হয়ে গেছে ৷ আমি তখনও একখণ্ড পাথরে এক নারী মূর্তি খোদাই করে চলেছি ৷ শেষ কাজ ৷ মন্দিরের পেছনের দেওয়ালের একটা জায়গা ফাঁকা ছিল৷ মূর্তির অবয়ব ক্রমেই যেন রম্ভার মতন হয়ে আসছে ৷ একটু একটু করে সে গড়ে উঠছে, আর ভাবছি কাল যখন রম্ভা দেখবে কী খুশীই না হবে! এমন সময় একটা গোঙানীর আওয়াজ শুনতে পেলাম ৷ মনে হল মন্দিরের ভেতর থেকেই আসছে। ওপরে তাকিয়ে দেখি, ঠিক যেখানে আমার এই পাথরটা বসানোর কথা, সেইখানকার ছিদ্র দিয়ে মৃদুর আলোর রেখা আসছে ৷ ওটা গর্ভগৃহের পাশের একটা ঘরের পেছনের দেওয়াল ৷ সন্তর্পনে দেওয়ালের খাঁজ বেয়ে উঠে চোখ রাখলাম সেই ছিদ্রে| দেখলাম, আমার রম্ভাকে পিছমোড়া করে বেঁধে নারকীয় সম্ভোগ করছে পিশাচ গজপতি ৷ রম্ভার শরীর রক্তে ভেসে গেছে, তবু ছাড়েনি ওই নারীমাংস লোলুপ ব্রাহ্মণবেশী নরপিশাচ !”

গুঙ্গিয়ে কেঁদে উঠল লোকটা ৷ আমি স্থানুবৎ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি ৷ সব অন্ধকার! ভরসা বলতে আমার হাতের টর্চ লাইট টুকু ৷ গলা শুকিয়ে গেছে ৷ কষ্ট করে বললাম, “ আচ্ছা ৷ কেঁদো না ৷ আমি যাই তাহলে ৷”

“ শেষটুকু জানবেনা চিত্রকর?” ধরা গলায় বলল লোকটা ৷

কি আর করি ৷ বললাম, “ শুনছি বল ৷ একটু তাড়াতাড়ি ৷ বাড়ী ফিরতে হবে ৷”

“ অক্ষম পৌরুষে মাথা খুটতে লাগলাম পাথরের গায়ে ৷ হায়রে দেবালয়, হায়রে দেবতা, হায়রে নিয়তি – কার জন্য এত শ্রম! এতো ব্যয় ! এতো অপচয়! এক নরপিশাচের লালসা নিবৃত্তির জন্য ? ধিক আমার পুরুষ্টু এই দুই বাহুকে ৷ পাথর ছেঁচে প্রাণ আনতে পারে, কিন্তু প্রিয়াকে বাঁচাতে পারে না দ্বারপ্রান্তে প্রহরীর ভল্লর ভয়ে ! রম্ভা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল ৷ ওর দেহটা টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল প্রহরীর দল | গোপনে পেছন পেছন গিয়ে দেখলাম, আমার প্রেমকে ওরা সমাধি দিয়ে দিল মন্দিরেরই পাশের জঙ্গলে ৷ প্রতিশোধের আগুন নিয়ে ফিরে এলাম | সূর্য উঠবার আগে পর্যন্ত দুবাহুতে বিশ্বকর্মার বল নিয়ে পাথরের বুকে মুহূর্তে ফুটিয়ে তুললাম অসহায়া রম্ভার ওপর গজপতির পাশবিক শৃঙ্গারের দৃশ্য ৷ সেই সঙ্গে প্রতিশোধের পরিকল্পনা ফুটিয়ে তুললাম নিজের সশস্ত্র মারণোদ্যত প্রতিচ্ছবি গজপতির পেছনে স্থাপন করে ৷ কেউ জানুক, না জানুক – পাথর জানবে আমার কথা, জানাবে পৃথিবীকে ৷

ভোর হবার আগেই পাথর দিয়ে পেছনের দেওয়ালের ছিদ্র বন্ধ করে দিলাম ৷

রাত্রে যখন দেবীর বরণ শুরু হোলো, বিশাল এক ছেনী আর হাতুড়ি নিয়ে উপস্থিত হলাম মন্দিরে ৷ প্রহরীদের বল্লাম মায়ের চরণে একবার ওগুলো ঠেকাবো ৷ কেউ সন্দেহ করল না ৷ সুযোগ বুঝে সহস্র সিংহের বল নিয়ে ভীড়ের মধ্য থেকে এক উল্লম্ফনে গজপতির পেছন দিকে ব্রহ্মতালুতে ছেনীর ফলা বসিয়ে হাতুড়ির ঘায়ে দ্বিখন্ডিত করেই পরম আক্রোশে ধাইলাম দেবীমূর্তির দিকে ৷ চারিদিকে আর্ত চিৎকারের মধ্যেই দুটো বল্লমের ফলা ফুঁড়ে দিল আমার দুটো ফুসফুস ৷ হাতের হাতুড়ী ছিটকে গিয়ে পড়ল মূর্তির কটিদেশে ৷ দেবী দ্বিখন্ডিত হলেন ৷”

“ তারপর ?” সম্মোহিতের মতো বললাম আমি |

“তারপর আমাকেও শুইয়ে দিল রম্ভার পাশে ৷ কিছুদিন বাদে চরাচরব্যাপী ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আকাশ ঢেকে এই পথেই সুলেমান কাররানীর নিশান হাতে গৌড় থেকে উৎকল আক্রমণে চলল কালাপাহাড় ৷ আকবর বাদশা তখন মেবারের সাথে যুদ্ধ করতে গেছে সেই পশ্চিমে বালির দেশে ৷ কালাপাহাড়ের ঘায়ে উৎকল রাজার লোক লস্কর গৌড় ছেড়ে উৎকলের দিকে পালাতে লাগল ৷ স্থানীয়রা মন্দিরকে  আগেই অভিশপ্ত মনে করে জনশূণ্য করেছিল ৷ অবশিষ্ট যা ছিল, চূর্ণ হল উৎকলের দিকে ধাবমান কালাপাহাড়ের ক্রোধের আগুনে ! ”

নিজেকে আমার যেন রক্তশূন্য মনে হচ্ছে ৷ আর যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই ৷

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ বিশ্বাস করছ না চিত্রকর, তাই না ? একবার ওই পাথরটা বের করবে, যেটা তোমার ঝোলায় ঢোকালে ৷ আর একবার দেখ৷” কন্ঠস্বরে যেন বড় অনুনয় ৷ সম্মোহিতের মতো ব্যাগ থেকে পাথরটা বের করলাম ৷ মাটিটা পরিষ্কার করে টর্চের আলো ফেললাম ৷ সত্যিই তো ! এতটা খেয়াল করি নি ব্যাগে ঢোকানোর সময়৷ নারীর দেহভঙ্গীমায় কি যন্ত্রণাময় আকুতি ! শৃঙ্গারের কিছুমাত্র আনন্দ সেখানে নেই ৷ শৃঙ্গাররত পুরুষের মুখে ক্রূড় হাসি ৷ মাথার পিছনে উড্ডীয়মান দীর্ঘ শিখা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার ব্রাহ্মণ পরিচয় ৷ তার ঠিক পেছনে উদ্যত কৃপাণ হাতে এক খর্বকায় পুরুষ ৷ চোখে হিংসা ৷ পুরুষ্টু গোঁফ, আর অবিন্যস্ত দাড়ির রেখা স্পষ্ট৷

“ কে ?  কার অবয়ব ?” আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম ৷ এযে পরিষ্কার ওই পাগলের প্রতিচ্ছবি !

“আজ আমি মুক্ত ৷ ফিরে গিয়ে তোমাদের পৃথিবীকে আমার যন্ত্রণার কথা বলবে তো চিত্রকর ?”

আমার মুখ থেকে একটা অবর্ণনীয় অপ্রাকৃত চিৎকার বেরিয়ে এল ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই ৷ যেন কখনও কেউ ছিলই না !

[লেখকের কথা : আকবরের সমর্থনে মুকুন্দদেবের গৌড় আক্রমণ, সপ্তগ্রাম বন্দর অধিকার ও ত্রিবেনীর ঘাট সংস্কার করে জগন্নাথ দেবকে স্থাপনা করা – এ সবই ঐতিহাসিক সত্য ৷ রাজপুতনায় শিশোদিয়া রাজাদের দমনে আকবর ব্যস্ত থাকার সুবাদে কালাপাহাড়ের উৎকল আক্রমণ এবং মন্দির ধ্বংসও ঐতিহাসিক সত্য | এইটুকু বাদে এই গল্পের বাকী সবই নিছক গল্পই ৷ ]

Facebook Comments