অমৃতা পাল
দূর্গাপুজো হলো বাঙালির এক আবেগের নাম। হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে থাকা ভালোবাসার পরশ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ,মিলন,প্রেম আর অবশ্যই বাঙালীর পঞ্চব্যঞ্জনের সমাহার। এ পুজো শুধু মায়ের আরাধনা,পুজোর আচার ,নিয়ম,নিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না বরং সে সবকে ছাপিয়ে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক মহামিলনের উৎসব।
ছোটবেলায় পুজোর অনুভূতি ছিল অন্যরকম,সেই আনন্দময় স্মৃতির ঝাঁপি খুলে আজ অমূল্য মণিমুক্তো গুলো খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস করছি।
বাঙালীর দূর্গাপুজো শুরুই হয় ঊষালগ্নে বেতারে এক আবেগময় ঐশ্বরীয় কন্ঠস্বর শ্রবণের মাধ্যমে –
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর।
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা।
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা।
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি
অসীম-ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।”
আহা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের’এই শ্লোকোচ্চারণের সাথে সাথে সত্যি যেন মায়ের ধরণীতে আগমন বার্তা ঘোষিত হয়।মহালয়ার দিনে বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনার জন্য সকল বাঙালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে না হলেযে পুজোর সূচনাই হবে না ,শ্লোকের সাথে সাথে বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে অপূর্ব সব মায়ের আগমনী গান মনকে ভরিয়ে তোলে প্রতিবার।
ছোটবেলা আমার কেটেছে যৌথ পরিবারে, জেঠু ,কাকা ,দিদি ,দাদাদের সাথে । সে এক আলাদাই আনন্দ।মহালয়ার আগের দিন রাতে আমার ছোট জেঠু তার রেডিওতে কলকাতা ‘ক’ চ্যানেলটা সেট করে রাখতো যাতে ভোর ৪ টে তে রেডিও চালালেই শোনা যায় সেই অপূ্র্ব ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।রেডিওর আওয়াজ জোরে করে দেওয়া হতো যাতে আমরা যে যার ঘর থেকে শুনতে পাই। শুয়ে শুয়ে সেই মহালয়া শুনতে কি যে ভাল লাগতো ! তবে কিছুক্ষণ শোনার পরই অনেক সময় কখন যে ঘুমের দেশে চলে যেতাম ! যখন ঘুম ভাঙতো তখন অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে – “রূপং দেহি,জয়ং দেহি ,যশো দেহি দ্বিষো জহি”।তবে দূরদর্শনের মহালয়ার অনুষ্ঠান কখনো বাদ দিতাম না।খুব ভাল লাগতো।তখন তো আর এত চ্যানেল ছিল না , শুধু ডি ডি বাংলা ১ আর ২।
মহালয়ার পরই শুরু হয়ে যেত আমাদের দিন গোনা।,আর ৬ দিন, ৫ দিন, ৪ দিন ;
সুনীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ।
বাতাসে শিউলির সুবাস,ভোরের শিশিরের ছোঁয়া ঘাসের আগায় ,গাছের পাতায় ফুলের দলে,সব মিলিয়ে পুজোর গন্ধ চারিদকে মনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলতো আমাদের বাড়ীতে একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল ,এইসময় গাছ ফুলে ভরে থাকতো,আহা কি অপূ্র্ব সুবাস!আমরা খুব সকাল বেলা উঠে গাছ ঝাকিয়ে ফুল কুড়োতাম ,দু তিন সাঁজি ভরে যেত ।
আমাদের স্কুল ছুটি পড়তো পঞ্চমীর দিন থেকে ,শেষ কদিন স্কুলে বন্ধুদের সাথে পুজোর বাজার ,কার কটা জামা হলো ,কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখতে যাবে, বা কেউ বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে কিনা এইসব নিয়েই আলোচনা চলতো, পড়ায় আর মন আর বসতো না।আর একটা জিনিসের জন্য আমি আর ভাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম – ‘পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলা’ আর ‘শুকতারা’।হাতে পাওয়ার পর সে যে কি আনন্দ,কি সুন্দর এক গন্ধ ।সত্যি বড় মধুর স্মৃতি,আজ তা আবার লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে মনে এক আবেগময় প্রফুল্লতা সঞ্চারিত হচ্ছে।
আমাদের পাড়ার পুজোতে পঞ্চমীর দিন ঠাকুর আসতো। সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার,মন্ডপে মা এসে যাওয়া মানেই পুজো শুরু, লেখাপড়ায় আর মন বসতো না ।বিকেলবেলা হলেই আমরা পাড়ার ছেলে মেয়েরা সব মন্ডপের কাছে উপস্থিত। হাতে সবার বন্দুক আর ক্যাপের প্যাকেট প্রথমের দিকে ছিল টিপ ক্যাপ;একটা করে বন্দুকে রাখো আর ফাটাও কিন্তু পরের দিকে রোল ক্যাপ আসার পর আরও মজা । একটা রোল ভরো আর চললো ঠাই ঠাই ঠাই ঠাই! উফফ,এখনকার প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা এইসব নির্ভেজাল আনন্দ থেকে যেন অনেকটাই বঞ্ছিত।
পুজোর দিনগুলোতে সকাল বিকেল মন্ডপে হৈচৈ,আড্ডা,খেলা সবকিছু নিয়ে খুব মজা করতাম,নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বরাবরই আমার ভাললাগতো।সন্ধ্যেবেলায় একদিন পরিবারের সকলের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া আর একদিন স্কুলের বন্ধুদের সাথে ,একসাথে রোল,ফুচকা,ঘুঘনি খাওয়া,সত্যি সেসব বড় মধুর স্মৃতি।অনেকসময় আমরা পুজোর সময় কলকাতা না থেকে বাইরেও বেড়াতে যেতাম ,দার্জিলিং এর ম্যাল এ বেশ বড় দূর্গা পুজো হয়,ওখানে মায়ের মুখের আদল পাহাড়ী মেয়েদের মুখের আদলের মতো দেখে বেশ অদ্ভুত লেগেছিল কিন্তু তারপর ভাবলাম মা দূর্গা তো হিমালয়েরই কন্যা।
তিন দিন হৈ হৈ করে কাটানোর পর দশমীর দিন মনটা একটু হলেও খারাপ তো হতোই। দশমীর দিন সকালবলায় আমাদের বাড়ীর কিছু নিয়ম ছিল যেগুলো বড় ছোট সকলকেই পালন করতে হতো।ঠাকুর ঘরে গিয়ে বেলপাতার উপর ‘শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়’ লিখতে হতো, দোয়াতে রাখা খাগের কলম দুধ জলে ডুবিয়ে,একটা পাত্রে টাকা পয়সা সোনা রূপো রাখা থাকতো তা ছুঁয়ে দেখতে হতো ,দুটো পুঁটি মাছ রাখা থাকতো ঢাকা দেওয়া পাত্রে,ঢাকা সরিয়ে মাছ দেখে তারপর দূর্গার ঘটে ফুল দিয়ে নমস্কার করতে হতো। বিকেলবেলা মায়ের বরণ শেষ হওয়ার পর আমাদের প্রস্তুতি শুরু হতো বিসর্জনের শোভাযাত্রার,পাড়ার সব মোয়ে বউরা লাল পাড় সাদা শাড়ী পড়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে যেত। একবার আমি ভারতমাতা সেজেছিলাম আর আমার ভাইরা রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ,যীশুখ্রীষ্ট ।শোভাযাত্রার প্রতিযোগিতায় আমরা অনেকবার প্রথম স্থান দখল করতাম আর সেই আনন্দে পাড়ায় জমিয়ে ভোজ পর্ব হতো লুচি,আলুরদম,ফ্রায়েডরাইস আর চিকেন দিয়ে।সেইসব নিখাদ আনন্দের দিনগুলো কখনো ভোলার নয় ,মনের পাতায় উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।এরপর বিজয়া দশমী করতে সকল আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবশীদের বাড়ী গিয়ে মিষ্টি ,গজা ,নিমকি,তিলের ও নারকেলের নাড়ু ,ঘুঘনি খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।পুজো শেষে মনটা একটু খারাপ হতো বৈকি আবার এক বছরের অপেক্ষা তবে আমাদের মধ্যমগ্রাম বারাসত অঞ্চলে শ্যামা পুজো হতো আরও জাঁকজমক করে যা এখনো বিদ্যমান,তাই সেই ভেবে মনটা আবার খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।ছোটবেলার পুজোর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে সেইসব একান্ত ভাললাগার দিনগুলো লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমিও যেন আবার সেই সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম।
নিজের তোলা পুজোর কিছু ছবিও দিলাম ।
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1416.jpeg?resize=1024%2C681&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1417.jpeg?resize=984%2C1024&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1432.jpeg?resize=717%2C960&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1429.jpeg?resize=960%2C713&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1426.jpeg?resize=960%2C640&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1433.jpeg?resize=720%2C960&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1419.jpeg?resize=768%2C1024&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/IMG_1423.jpeg?resize=960%2C637&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/image_6483441.jpg?resize=1024%2C768&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/image_6483441-1.jpg?resize=960%2C540&ssl=1)
Facebook Comments