Site Overlay

আমার ছোটবেলার পুজো

দেবযানী ভট্টাচার্য

আমরা যারা আটের দশকের শুরুতে বা সাতের দশকের এক্কেবারে শেষের দিকে জন্মেছি, আমাদের একটা নিখাদ এবং অন্যরকম খুশিয়াল ছোট্টবেলা ছিল। এই অন্যরকম পর্যন্ত পড়েই হা হা করে তেড়ে উঠবেন না, আমি একবারও অস্বীকার করছি না যে প্রত্যেক প্রজন্মেরই নিজস্ব আনন্দময় শৈশব ও কৈশোর থাকে। অতীতের ছিল, বর্তমানের আছে, ভবিষ্যতেরও থাকবে। আমার বক্তব্য হল আমরা আমাদের পূর্বজদের বাল্য কৈশোরের যাপনের সঙ্গে নিজেদের কাটানো সময়ের মিল খুঁজে পেয়েছি, অচেনা লাগেনি। কিন্তু, হাল আমলের শিশু কিশোরদের কাছে আমাদের একদা বড্ড জ্যান্ত ছোটবেলা অনেকটাই গল্পকথা বলে মনে হয়। ওরা চেনে না সেই ছোটবেলাটা। আমি নিশ্চিত আর দুয়েকটি প্রজন্মের পরে ওটা মিথের পর্যায়ে চলে যাবে। ফারাকটা বড় হয়ে দেখা দেওয়ার প্রভূত কারণের মধ্যে অন্তত তিনটি বলতেই পারি। বিশ্বায়ন,  তথ্যপ্রযুক্তি ও সংযোগকারী ব্যবস্থাক্ষেত্রে বিপ্লব এবং বৈদ্যুতিন যন্ত্রের সহজলভ্য হয়ে ওঠা। শিশুমনের স্বাভাবিক কল্পনার জগৎ সংকুচিত হচ্ছে নিয়ত। সব কিছুর ব্যাখ্যা স্রেফ কয়েকটি বাটন প্রেসের প্রতীক্ষায়। সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যাচ্ছে মুহূর্তে। এ মন্দ তা বলছি না, কিন্তু প্রশ্ন তৈরি হওয়া ও উত্তর খুঁজে পাওয়ার মধ্যেকার যে জার্নি, সেটার অভিজ্ঞতাটাও বড় পাওয়া তো বটেই। সেটা কিন্তু এরা মিস করে যাচ্ছে। যাক গে, বিতর্কিত কথাবার্তা বন্ধ করে আমি বরং আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োবুড়িদের অর্থাৎ আমাদের ছোটবেলার গল্প শোনাই কচিকাঁচাদের। দুর্গাপুজোর নানান গল্প। ওরাই স্থির করুক সে সময়টা কেমনতর ছিল। 

হ্যাঁ, তা যা বলছিলাম খোকাখুকুরা থুড়ি মিলেনিয়াম কিডস, বেশ বড়ো হয়ে যাওয়া অবধি সেই-ই মিষ্টি মিষ্টি ছোট্টবেলার আঙিনাতেই খেলাধূলা করে কেটেছিল আমাদের দিন। আমার কথার অর্থ বুঝতে একটু কি অসুবিধে হল? বুঝিয়ে দিই? আসলে আমরা আড়ে-বহরে বড়ো হয়েছি, ইশকুলে টকাটক ক্লাসে উঠেছি, কিন্তু বোধভাস্যি একটু কমের দিকেই ছিল। চালাক চতুর ছেলে মেয়ে হাতে গোনা মিলত গোটা অঞ্চলে। এই আর কী। তাই সেসময় যে যা বোঝাতো সোনামুখ করে বুঝে যেতাম। নিজেরাও যা আলাপ আলোচনা করতাম তা শুনে আজকালকার ঘোড়ায়ও হাসবে। সেটা কেমন তার ব্যাখ্যানে পরে আসছি, আগে বলে নি এই গল্পের “আমরা” টা কারা। এই “আমরা”-টা হল আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা। বাবুয়া, নোচন, মৌ, রূপা, টুম্পা, পাপাই, সুমি, রাজু, মামুন, বুবুন এবং আমি― এই এরা। এদের সকলের ছেলেবেলার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে থাকা নিজের ছোটবেলার গল্প বলব আমি। পুজো দেখার গল্প। পুজো কাটানোর গল্প।

পুজোর আগে আমার জ্বরে পড়াটা এককালে নিয়তি নির্বন্ধ ছিল। যতো দূর স্মরণে আসে অন্তত ইশকুলের বছরগুলোয় তো ফি বচ্ছর একই ঘটনা ঘটেছে। তবে কিনা আমি তো জীবনে সর্বক্ষেত্রেই সাতমারী পালোয়ান তাই সাত দশ দিনের বেশি আমাকে শুইয়ে রাখতে পারেনি কোন জ্বরের ঠাকুর্দা। গা মাথা যন্ত্রণা আর খেতে গেলে বমি ছাড়া ওই সাত দশদিনের যাপন তো আমার কাছে পাগলের গো-বধে আনন্দ লাভের মতো হুলিয়ে মজার ছিল। 

কেন!

পড়াশুনো ভোগে, বকাবকি বন্ধ, কেবল নকশি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা আর গল্পের বই বই আর বই-এ ডুবে যাওয়া। যতো বই আমি সম্বৎসর পেয়েছি বাবার থেকে, প্রাক্ পুজোকালীন জ্বর উপলক্ষে পেয়েছি তার তিনগুন। পুজো সংখ্যা ছাড়াও আরো বহু রকমের বই বাবা পড়িয়েছে আমায় সেইসময়। এপিকস্ চারটে, ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকগুলো, ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার লেখালেখির অনুবাদ, বিজ্ঞানভিত্তিক লেখাপত্র, কল্পবিজ্ঞানের গল্প, রম্যাণি বীক্ষ্য, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী, দেব সাহিত্য কুটিরের কমিকস্গুলো সব সব পড়েছি সোল্লাসে। 

একবার কেবল অলপ্পেয়ে টাইফয়েড আর মাম্পস্ হয়ে গেল একইসাথে। যুগলের একটিই প্রেমাস্পদ বনে গেলাম ফলে তারা এক্কেবারে পেড়ে ফেললো আমায় সেবার। বেশি প্রকোপের সময়টায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতাম চোখ বুজে, কতো কী যে উড়ুমধুড়ুম নাচানাচি করতো বন্ধ চোখের পাতায় সেসময়। একেবারে ছায়াছবি দেখতাম একের পর এক। ঝিম ধরা ভাব চারিয়ে যেতো গোটা শরীরে, সব শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কিচ্ছুটি বলতে পাচ্ছি না, ঠোঁট মজাসে ঘুমোচ্ছে, সব বকরবকর কেবল ভিতরে। সব দেখতে পাচ্ছি কিন্তু চেয়ে দেখার ছবিদের সাথে সে দৃশ্যের যেন বিস্তর ফারাক, আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, দেখেই চলেছি বেঁচে চলেছি তাদের সাথে, যাদের সাথে ভাব হয়েছে পাগল পাগল গন্ধের কালো অক্ষর গুলো মারফত। 

হেক্টর মরে যাচ্ছে মা! 

ভ্যাঁলজা পালাও পালাও! 

বাবা জেন এবার কোথায় থাকবে! 

আউদা আউদা, ওই দ্যাখো ফিলিয়াস ফগ! 

―এইসব বকে যেতাম সমানে। আরেকটা অদ্ভুত ভয় পেতাম। ভিক্টোরিয়া জাদুঘর এইসব দেখতে গিয়ে কার্জন পার্কে পাশাপাশি দাঁড়ানো দুটি বনমানুষ গোছের মূর্তি দেখেছিলাম ছোট্টবেলায়। জ্বর যতো বাড়তো আমি ততো দেখতে পেতাম ওই দুই জন আমার মাথার দুধারে দাঁড়িয়ে কেবলই অঙ্ক কষিয়ে চলেছে! সে সিঁড়ি ভাঙ্গা থেকে ক্যালকুলাস অবধি আমি কষে গেছি যতোবার ধুম জ্বর হয়েছে। একবার তো আইসোটোপের অঙ্কও কষেছি মনে পড়ছে। ছোটো মামা বলেছিল ভয় না পেতে, ওরাই নাকি ওই পার্কের কুখ্যাত শুয়োরের সাইজের ইঁদুরের ভয়ে ওই পেডেস্টালে চড়ে বসেছে নইলে নধরকান্তি নিয়ে সারাদিন চষে বেড়াতেই নাকি ওরা ভালবাসে। যতই বোঝাও, জ্বর বাড়লেই ভয় বাড়তো। কী যে অদ্ভুত অনুভূতি সেটা ওই হাই টেম্পারেচার যাদের হয়নি তারা বুঝে উঠতে পারবে না। 

যাক, আসলে কথায় ফিরি, যখন একটু কমত প্রকোপ, তখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কাশ আর আকাশ দেখতাম গরাদওয়ালা বড়ো জানলাটা দিয়ে বড়ো ঘরের খাটে শুয়ে শুয়ে। আমাদের জমি পেরোলেই ইঁট বিছানো একফালি রাস্তা আর ওধারটায় বাচ্চুমামাদের বাগান বাড়ী। হলুদ বনে বেজিরা সপরিবারে টহল দিতো, জিওল গাছের ডালে দাঁড়াশ ঘুম দিতো, কাশের বনে এই এত্তোটুকু টুকু পাখি ঘরকন্না করতো, গরুগুলো আলসে জাবর কাটত, রবিন ব্লু গোলা আকাশে পিড়িং পিড়িং ঘুড়ির ঝাঁক মাতালের মত চলত, জেট প্লেন টু শব্দটি না করে হুশহুশিয়ে চলে যেতো ইয়া লম্বা রাজহাঁসের রঙের লেজ পিছনে ফেলে, ফেলে রাখার কষ্টে আস্তে আস্তে নিজেদের নিঃশেষে গুলিয়ে মিশিয়ে নিত আকাশের সাথে সেই লেজটা, একটা ঘুঘু ডাকতো অচেনা মন খারাপ জড়ানো ডাক আর কত রকমের চেহারা নিয়ে মেঘেরা আসতো তার ইয়ত্তা নেই। 

সেই সময় একটা মজার খেলা খেলতাম একা একাই। মেঘেদের শরীরে অন্য অবয়ব খুঁজে ফেরার। কাকে পাইনি সেসময় আর কি পাইনি তাই বলো! টাইটানিক থেকে কুট্টুস, রবি ঠাকুর থেকে সের্গেই বুবকা, হাওয়াই মিঠাই থেকে তানজানিয়া সব দেখে ফেলতাম সামান্য আয়াসেই। এভাবেই কটা দিন কাটিয়ে ফেলতাম, একসময় পুজো দরজায় কড়া নাড়তো, সে আরেক আনন্দের উপাখ্যান।

বলছি, রোসো।

আমাদের কালে পঞ্চমীর দিনটিতে পুজোর ছুটি পড়ত। সেদিন ইস্কুলে ইউনিফর্ম না পরে গেলে বকা দিতেন না কেউ। গতবছরের পুজোর জামাটি পরে যাওয়ার ছাড় ছিল। বইপত্র না নিয়ে গেলেও দিদিমণিরা বকতেন না। প্রথম ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুট দিতাম ঘরের পানে। পেছনে গলা শোনা যেত, 

― ওরে আস্তে সুস্থে যা, পুজোয় আনন্দ করবি কিন্তু রোদ লাগাবি না বেশি, বাইরের খাবার খাবি না, ঠাণ্ডা লাগাবি না, স্কুল খুললেই কিন্তু পরীক্ষা, মনে থাকে যেন।… 

কম দিন তো নয়, সেইই ভাইফোঁটা অবধি ছুটি। তবে সত্যি বলতে কী মাস্টারমশায় দিদিমণিরা অহেতুক ভয় পেতেন। পুরো বইপত্রের পাট উঠে যেত তেমন কিছু নয়, একাদশীতেই বেলপাতার একবার আর খাতায় একশ সাত বার শ্রী শ্রী ঁদুর্গা সহায় লিখে দপ্তর সাজিয়ে বসতে হত। বাড়ির কাজ দিতেন যে এক ঝুড়ি, নির্দয় দিদিমণিরা। 

অবশ্য পঞ্চমীতে সেসব বাড়ির কাজের ভাবনা কোথায়! বইয়ের বাক্সে ছেত্রে পড়ে থাকত বাড়ির কাজের খাতা, মাথাব্যথা করার মোটে সময় থাকত না ওসব নিয়ে। তখন জামা কিনতে যেতে হবে, চুলের ক্লিপ–নখপালিশ–সোয়েটের টিপ কিনতে যেতে হবে –এইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। হ্যাঁ, পরি কাকুর দোকানে যে ছিট কাপড়ের বাহারি ফ্রক কিছু দিন আগে বানাতে দেওয়া হয়েছে সেটা আনা বা বাবার হাতে পুজো অগ্রিম অর্থ এসে পড়াতে আরেকটি রেডিমেড জামাও কখনও কেনা হত এই পঞ্চমীতেই। জামাকাপড়ের গল্প করব খানিক পরে, এখন পুজোর দিনগুলো আসুক আগে।

পাড়ায় তখন একটিই দুর্গাপুজো হতো। সাহা বাড়ীতে। কচিকাচা থেকে বুড়োবুড়ি সক্কলে সেখানেই ষষ্ঠী থেকে দশমী ইস্তক দিনভর। তো সেবার হল কী, ষষ্ঠীর বোধন পর্ব চলছে সেই বাড়ীরই সদর দরজার পাশের এক বেলগাছের নিচে, ঠাকুরমশায় পূজার্চনা করছেন আর কিছু আগে উল্লেখ করা সেই “আমরা” গোল হয়ে ঠেলাঠেলি করে চলেছি। তারি মধ্যে নোচন ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

― জানিস, এইটা কিসের পুজো? এইটা দুগ্‌গা নামাবার পুজো।

― মানে?

রূপার নাক মুখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা।

― মানে আবার কী? ওই দুগ্‌গা তো বেলগাছের ডালে চড়ে বসে থাকে। নামতেই চায় না। সকলের চোখের আড়ালে। স্রেফ ঠাকুরমশায় তাকে দেখতে পায়। অনেক সাধ্যিসাধনা করে তবে নামাতে হয়। এইটা খেতে দেব, ওইটা পরতে দেব, ছেলেমেয়েদেরও জামা-জুতো কিনে দেবো, ঠাকুরমশায় নানান লোভ দেখালে তবেই সে নামে।

― তুই কী করে জানলি? ঠাকুরমশায় বলেছে?

আমার সপাট প্রশ্ন।

― আমার মামা বলেছে। আমার মামা কলেজে পড়ে।

ব্যস। আর কোনও প্রশ্ন উঠতেই পারে না। কলেজে পড়ে!!

সবকটার চোখ আঁতিপাঁতি করে গাছটার ডালে ডালে খুঁজতে লাগলো লাল টুকটুকে শাড়ি পরা, বড় বড় চোখের নাকে নোলক এক সুন্দর মতো ছেলেমানুষ বউকে।…

এরপর সপ্তমী। 

নবপত্রিকা স্নান পর্ব সকালেই। আমাদের ভাষায় সেটা কলাবউয়ের চান। ঘুম ভাঙাটার কেবল অপেক্ষা। ছুট ছুট পুজো বাড়ী। সে বাড়ীর মেজো কত্তা ঘাড়ে ফেলে লালপেড়ে শাদা শাড়ি জড়ানো কলাগাছকে নিয়ে যেতেন সত্যভারতীর পুকুরে, পিছনে ঢাকি-কাঁসি, তার পিছনে আমরা। কলকল করে কতো রকমের আলাপ-আলোচনা।

― জানিস কলাবউ কে? গণেশের বউ।

― গণেশের মানুষ বউ নেই কেন? মানে ঠাকুর বউ।

― ধুর। কাত্তিকের অমন দারুণ সুন্দর চেহারা, তাতেও একটা বউ নেইকো, আর গণেশের অমন হুমদো চেহারায় যে বউ পেয়েছে এটাই অনেক। বুঝলি? হলই বা কলাগাছ, শাড়িটারি জড়িয়ে দিব্য দেখায়।

― হ্যাঁ, সেটা ঠিকই। কিন্তু বড্ড মোটা বরের বড্ড রোগাপটকা বউ। ঠিক যেনও মানায় না, বল? রথের মেলার বরবউগুলো বেশ, নয়? অমন যদি হতো…

― তোর তো ভারী আস্পদ্দা! ঠাকুর দেবতার মানামানি নিয়ে কথা বলিস! ঠাকুররা রেগে পাপ দিলে সোজা ফেল মেরে যাবি দেখিস।

― না না, ওই বলছিলাম আর কী…এম্নি এম্নি।

তারপর অষ্টমী। 

এইদিনটা আমার জন্য যাকে বলে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদের। কেন বল দেখি? সেই সাহাবাড়ীতে কুমারী পুজার প্রচলন ছিল যে। আমি বেশ কয়েক বছর কুমারী হয়েছিলাম উপযুক্ত বামুনের মেয়ে হিসেবে। সে যে কি বর্ণনাতীত অভিজ্ঞতা রে ভাই সেটা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে! সকলে খেলে বেড়াচ্ছে, হইহই করছে, আমি কেবল শাড়ীর পুঁটুলি হয়ে একটা আলপনা আঁকা জলচৌকির উপর থেবড়ে বসে আছি। সামনে পুরুত ঠাকুর গোল গোল চোখ করে কড়মড় মড়কড় মন্তর আওড়াচ্ছে আর ফুল ছিটোচ্ছে আমাকে তাক করে। কাঁসার থালায় কত খাবার থুড়ি থুড়ি প্রসাদ। ফল-পাকুড়, খই-মুড়কি, লুচি-সন্দেশ, নাড়ু-মালপোয়া আরও কতো কী সাজানো। আমারই সামনে, অথচ আমাকেই খেতে দেবে না। সকাল থেকে উপোসি। যাহোক পুজো মিটলে সকলের সে কী প্রণামের ধুম। ঢিপঢিপ করে আমার সামনে মাথা ঠুকছে পাড়ার বড়রা। মনে মনে ভাবছি, এখন তো নিজেদের মাথা ঠুকছ আর কালকেই ফের আমার মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দেবে একটু বেগড়বাই করলেই। 

কিছুই বুঝিনা বাপু! 

তারপরের কাহিনী আরও দুঃখের। ওই সমস্ত প্রসাদ আমারই চোখের সামনে সব্বাইকে বিলি করা হয়ে গেল। আমি তখন বসেই আছি। এও কী সহ্য হয়! রূপার দিকে একটু ইসারা করতেই বলে উঠলো,

― এসবের দিকে একদম তাকাস না। তুই না এখন ঠাকুর। ঠাকুরে কক্ষনো খায় না। কেবল দ্যাখে।

বুড়ো আঙুলের নখটা খেতে খেতে ভাবলাম, সত্যি তো। আমি তো এখন ঠাকুরই, আর ঠাকুরে তো খায় নাই। খালি দ্যাখে।

চোখটা সিধে চলে গেলো দুগগার মুখে। বুকের মাঝে কিছু কথা উঠে এলো,

― মা গো, তোমার কষ্টটা আমি এতক্ষণে বেশ বুঝছি মা। এজন্যই তুমি নামতে গড়িমসি করো। ঠাকুর হওয়া তো ভারী দুঃখমতো ব্যাপার। ঠায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকো। মোটে কথা বলতে পারবে না, পলক ফেলবে লুকিয়ে, পেট কামড়ালেও হাসি হাসি মুখে থাকতে হবে, পুরুতকে দেখে ভয় পেলেও ছুটে পালানো যাবে না, সামনে রাশি রাশি খাবার অথচ সেগুলো খাওয়া চলবে না। 

এ কী বিকট যন্ত্রণা রে বাবা!

আনমনা হয়ে পড়েছিলাম খানিক। মার গলার স্বরে হুঁশ এলো।

― আহারে! মেয়েটা আমার সেই সকাল থেকে এইভাবে রয়েছে। গরমে, ভয়ে খিদেয় মুখটুকু শুকিয়ে গেছে গো! এবার ওকে নিয়ে যাই ঠাকুর মশায়?

ঠাকুর মশায় সম্মতি দিতে না দিতেই ঝাঁপিয়ে মায়ের কোলে। 

― বড্ড খিদে পেয়েছে মা। ওই মালপোয়াটা আমার কিন্তু। তুমি ওদের বলে দাও। আমি আর ঠাকুর নই তো এখন।

হাসির রোল পড়ে গেলো পুজো প্রাঙ্গণে। সব্বাই কত আদর করছে কোলে টেনে নিয়ে। আমি মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চুপিচুপি দুগ্‌গাকে বলে এলাম,

― তোমার তো মা আছে নিশ্চয়ই? বাপের বাড়ি আসো সকলে বলাবলি করে শুনেছি। এত পাড়া বেড়িয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ নেই আর। এক দৌড় দাও সেদিকে। মা-ই কেবল খেতে দেয়। নতুন জামা জুতো দেয়। আর কেউ দেয় না গো। পালাও শিগগির।

যতোই যেয়ো না যেয়ো না বলা হোক না কেন নবমী ঠিক চলেই যেত আর নিশি পেরিয়ে এসেই পড়ত দশমী। বিজয়া দশমী। 

এদিনের মূল আগ্রহ ছিল পেতলের বড় গামলা ভরা জলে মাতৃপ্রতিমার মুখ দেখা। ঠাকুর মশায় ওই জলেই দর্পণ রেখে দিতেন কি না, সকলে বলত দর্পণে বিসর্জন হয়ে গেল মায়ের। এইবারে মা না কি খুব কাঁদছেন। যেতে চাইছেন না। এ তো ভারী অবুঝ মেয়ে। প্রথমে আসবে না বলে জিদ ধরেছিল, এখন আবার যাব না বলে জিদ ধরেছে। আমাদেরও তো ইশকুল খুলে যাবে কালী পুজোর পর। তখন যাব না খেলে বেড়াব বললে কি শুনবে কেউ? নিয়ম মা, নিয়ম। সকলকে মানতে হয়। তুমি আবার এস। এত করে কাকে বোঝাচ্ছি কেন বোঝাচ্ছি নিজেরাই বুঝতাম না। কেবল বোঝাতাম। কান্না থামাতে চাইতাম। অমন দশ হাতের জ্বলজ্বলে রাজরাজেশ্বরী আমার ছোটমাসির মত শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে বলে গুমরে গুমরে কাঁদছে এটা কল্পনা করা বড় মন ভাঙা কষ্টের ঢেউ তুলত, গামলার জলে ভাসা করুণ ছবিটা ঘাই দিত বোকাসোকা বুকে। 

দিন বসত সূর্যের সঙ্গে পাটে। সন্ধে নামত নিজস্ব নিয়মে। ভাসানে যেত সাহাবাড়ির দুর্গা। উঁহু, একলা ছাড়তাম না। সঙ্গে যেতাম আমরা সকলেই। বড় মাঠের পাশে পুকুর। দশমীর নরম চাঁদের আলো মাঠ জুড়ে মেলে ধরত ফিনফিনে কুয়াশার মিহিন ওড়না। চেনা প্রকৃতি অচেনা হয়ে উঠত যেন ওই ম্লানমুখী সন্ধেয়। ভার ভার বুকে হ্যারিকেন লণ্ঠনের আলো উজিয়ে শেষবারের মত মায়ের মুখ দেখে নিতাম আমরা। এলোমেলো চুলে কপালে রাশি রাশি সিঁদুর মাখা আলুথালু মাতৃমূর্তি। জগৎপালিকা দেবীর শরীরে তখন নিতান্ত এক গেরস্তঘরের মনমরা যুবতীর ছাপ। বাপের ঘর ছেড়ে যেতে যার পা সরে না। জোড়হাত করে তাকিয়ে থাকতাম জলের দিকে। পাড়ার মামা কাকারা সাতপাক ঘুরিয়ে জলে আলতো করে চিৎ করে শুইয়ে দিতেন একচালার প্রতিমা। শান্তিজল ছেটাতো কোশে করে। ওরা উঠে এলেই মুখ ঘুরিয়ে নিত সবাই পুকুরের দিক থেকে। পেছনে ফেরা মানা। দেখা বারণ। পিছুটান পড়বে যে মায়ের!

একাদশীর সকালে মূল সমস্যাটা হতো বড়ভাইকে নিয়ে। ও কেবল বেলপাতা চিবুতো, নজর সরালেই। আমাদের ভাগের বেলপাতাগুলোও ওর পেটে যেতো। স্বভাবতই কানমলা খেত, পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করত আর আমাদের পুণ্যকর্মে ব্যাঘাত ঘটাত। পুণ্য এবং অবশ্যকরণীয় কর্মটি হল,― দশমীতে মণ্ডপে দর্পণে বিসর্জনের পর মায়ের ঘটের বেলপাতা নিয়ে এসে রাখতে হত পড়ার টেবিলে। যত্ন করে। পরদিন ভোরে সেটাতে দুর্গানাম লেখা আর সেটিকে পাশে রেখে খাতার পাতায় আরও একশ সাতবার লেখা, মোট একশ আটবার দুর্গা নাম লিখে তবেই পড়াশোনা শুরু হতো আমাদের। 

সব পাড়াতুতো বন্ধুরা ভাই বোন সঙ্গে নিয়ে সাহা বাড়ী থেকে বেলপাতা আনতাম, বড় ভক্তি করে গুছিয়ে রাখতাম নামে নামে একটা করে। কেন? বার্ষিক পরীক্ষার রক্তচক্ষু খুলে যাবে তো ইশকুল খুললেই! আশীর্ব্বাদ বড্ডরকম দরকার পড়বে ঠাকুরের। তাই একটু বিশেষ রকম আবেদন নিবেদনের রাস্তায় হাঁটা আর কী।

তা যে কথা বলছিলাম, একাদশীর সকালে খাতাপত্র খুলে মহোৎসাহে শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় লিখতাম। সেসব মিটলে তবে বাড়ী বাড়ী বিজয়া করার ছাড়পত্র মিলতো। বিজয়া করা ব্যাপারটি দারুণ আকর্ষণীয়, তাই এই নাম লেখা পর্বটি যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সারতে চাইতাম আমরা, বড়ভাইয়ের বিঘ্ন ঘটানোটা তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রাগিয়ে দিত। যাক গে, বচ্ছর গণ্ডার দিন, বকাঝকা করলেও, শেষে ভাইকে কোলে কাঁখে নিয়ে, বুঝিয়ে শান্ত করে বন্ধুবান্ধব মিলে দল বেঁধে বিজয়া করতে বেরতাম পাড়ায়। এটা একটা দারুণ মজার ব্যাপার ছিল। পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা ফাঁকা মণ্ডপে জড়ো হতাম, নেই হয়ে থাকা ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করতাম, তারপর দল বেঁধে সব বাড়ী বাড়ী হানা দিতাম। ফলে নিজের নিজের বাড়ীর বিজয়াটাও সারা হয়ে যেতো একইসঙ্গে। আসলে তো ছোট ছোট পেট, এতটুকুন এতটুকুন মানুষসব, এক-দুই বাড়ী খেলেই পেটটা গণেশের সাথে প্রতিযোগিতায় দাঁড়িয়ে যেতো, ফুলো পেট নিয়ে হাত থেকে গড়িয়ে পড়া ঘুগনির ঝোল চাটতে চাটতে পরবর্তী বাড়ীগুলোতে উপস্থিত হলে সে বাড়ীর খুড়ি জেঠিরা আর খাবার বেড়ে দিতেন না। খাবার বেঁধে দিতেন। নিমকি, গজা, বোঁদে, মিহিদানা, সীতাভোগ, নারকেল নাড়ু(চিনির-গুড়ের), ছাপা, ঘুগনি আরও কতো কী। 

― বাড়ী যেয়ে খেয়ো মণিরা, এইডা নিয়ে যেয়ে মারে দেবা, মা দেবানে পরে খাতি। বিকেলের দিক খাবা। কেমন?

সেটা ভালো লাগতো, আবার খারাপও। পরে খাওয়া যাবে এটা ভেবে ভালো লাগতো, কিন্তু মা কক্ষনো এতো খেতে দেবে না একসঙ্গে বাড়ী নিয়ে গেলে এটা মনে করে খারাপ লাগতো। পাড়ায় দু একটা পাজি কাকু তো থাকতই। তারা আমাদের বোঁচকা থেকে খানিক ছিনতাই করতই, উল্টে বেমক্কা ভয়ও দেখাত, 

― খুদ্দুর রাক্কসের দল, এইবেলা থাম। এই রেটে খেলে পেট ছাড়বে কিন্তু! লক্ষ্মী পুজোয় মুড়িমুড়কি, খিচুড়ি, লাবড়া, চিংড়ী দেওয়া লাল শাক, কই মাছ এগুলো খেতে পাবিনা। বুঝবি মজা!

ধাঁ করে মনে পড়ে যেতো সেইসব অমৃতের স্বাদ, রণে ভঙ্গ থুড়ি বিজয়া করা শেষ করে ফিরে আসতাম। ফেরার পথে কর গুনতাম কটা দিন বাকি আর লক্ষ্মী পুজোর।…

পুজোর দিনের গল্প শুরুর সময়ে বলেছিলাম পুজোর জামার গল্পও করব যথাসময়ে। এইবারে হবে সে গল্প। এক্কেবারে ছোটটি যখন তখন বিশেষ সমস্যা হত না, নতুন যা হোক কিছু পরিয়ে দিলেই দিল খুশ হয়ে যেত। মণ্ডপে যাওয়ার ছাড়পত্রই মূল আকাঙ্ক্ষিত বস্তু ছিল। কিন্তু যখন আরেকটু বড় হলাম, যাকে বলে কিশোরী, তখন কী হত? 

বলি শোন সে আখ্যান। 

পুজোর আগে আগে টিউশন পড়তে গিয়ে সকলেরই সমবেত ও চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক চিত্র ছিল। চিন্তার বিষয় হল পুজোয় যে কাটের যে ডিজাইনের জামাটা বিশেষ করে উঠেছে সেটা কিনে বা বানিয়ে দিতে রাজি করানো যাবে তো বাড়ির লোকজনকে?! 

কেন?

আরে আমরা তো আর তোমাদের মত নিজস্ব মতামত রাখবার কালে জন্মাইনি। সেই সত্যযুগের অত্যাচারিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত, নিষ্পেষিত, অকাতরে মারগুঁতো–সহ্য–করিত, কথায় কথায় ঝুঁটিনাড়া–খায়িত ইত্যাদি প্রভৃতি আর মনে পড়ছে না, সর্বহারা ছেলেপুলে সব। তখনও নিজের পছন্দ অপছন্দ জোরের সঙ্গে রাখার ও সেটা মানতে বড়দের বাধ্য করার যুগটা এসে পড়েনি আর কী। প্রভূত অনুনয় বিনয় করে কিংবা ক্লাসের সেরা পড়ুয়াটিও সেটি কিনছে ফলে ও জামা খারাপ হতেই পারে না এরম নানাবিধ উপায়ে মা বাবাকে বুঝ মানানোর চেষ্টাচরিত্র করে মন গলানোর কঠিন কাজটি সমাধা করতে হত। 

সেই হিসেবে আমার ক্লাসের মেয়েগুলোর কপাল অত্যন্ত পোড়া ছিল যা হোক। তারা যাকে নজির রেখে বাড়িতে কথা পাড়বে সে নিজেই একটা বিষম বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে বাস করত। পরিমল কাকুর দোকানে বানানো পায়ের গোছ ছুঁইছুঁই ঝুল, লালাপোষের মত গলা থেকে বুক অবধি নামা ঝালর আর কাশীর টোল খাওয়া ঘটির মত দুটি হাতা সম্বলিত এক আজব জামা তার জন্য নির্দ্ধারিত থাকত ফি বছর। অন্তত দশটি আংরেজ জমানে কা জেলরের অখণ্ড স্বর্গবাসের ফলশ্রুতিতে তাদের গুণপনা পুরে পুরে দুনিয়াকে সিধে রাখতেই ঈশ্বর তার মাতৃদেবীকে ধরাধামে অবতীর্ণ করেছিলেন খুবসম্ভব, কেবল দুনিয়া সংকুচিত হয়ে মেয়েটিকে বেষ্টন করে ধরেছিল এই যা ফারাক। টেইলর-মাষ্টার কাকুকে মায়ের আড়ালে হাতজোড় মিনতি বিনতি করেও কিচ্ছুটি করা যেত না ওই সামান্য এদিক সেদিক চারটি কুঁচি জুড়ে দেওয়া ছাড়া। হাল ফ্যাশনের কেনা জামা সে তো অধরা মাধুরী। একবার তেড়িয়া হয়ে ঝালরে তো হাতাটা ঢেকেই যায়, বোঝাই যায় না কেমন হাতা একটু ছোট ঝালর করলে হয় না বলাতে ঠিক ঠিক বলে মাতৃদেবী করলেন কী… নাহ, কমিয়ে দেননি ঝালরের ঝুল বরং বাড়িয়ে দিয়েছিলেন হাতার ঝুল। তাকে নাকি গেলাস হাতা বলে। সে যা খোলতাই হয়েছিল পুরো ব্যাপারটা অনির্বচনীয় অকথ্য দাঁড়িয়েছিল একেবারে!

পরবর্তীতে ভেবে দেখেছি নিয়মের এই বজ্র আঁটুনি ছিল আসলে মার্জিত ও সুস্থ রুচি তৈরির এক প্রচেষ্টা। একটা সময়ের পর থেকে দিব্য অল্প অল্প ঢিলে পড়ে এসব কঠিন নিয়মে, নজরদারিতে। বড়রা বুঝে ফেলেন ইতোমধ্যে একরকমের সুস্থ রুচি তৈরি হয়ে গেছে বাড়ির ছেলে বা মেয়েটির মধ্যে, এবারে কোনও প্রভোকেশনে পড়ে কখনও চাইলেও সে খুব বেশি ডিঙিয়ে যাবে না, যেতে পারবে না সেই অর্জিত ভাবধারা, অভ্যাসের অভ্যস্ততায়। 

এখন অবশ্য জমানাই স্বরাট। সে যাক গে। কালের যখন যেমন নিয়ম।

পুজোর দিনের গল্প হল। নতুন জামার গল্প হল। এইবারে ঠাকুর দেখার গল্প হোক? নবমীর দিন বেরোতাম ঠাকুর দেখতে।

আমাদের ছোটবেলা সে তো বুঝতেই পারছ কয়েকটি যুগ পার। তা সেকালে কালী পুজোয় বাংলা কাঁপানো বারাসাতে গোটা চারেক বড় দুর্গাপুজো হত। চারের মধ্যে একটার নাম ভুলে গেছি, দুইয়ে যুবক সঙ্ঘ এছাড়া গায়ে গায়ে ছিল শেঠ পুকুরের দুটি পুজো। একটা পার্কের ভেতরে আরেকটা পার্কের পাঁচিলের বাইরের পুকুরপাড়ে। 

পার্কের ভেতরে যেটা সেটা ডাকের সাজের ঠাকুর। হেব্বি দেখতে। পুরো থতিয়ে দেওয়া সৌন্দর্য। বিরাট চেহারা, শাদা বিরাট মুকুট, বিরাট মণি চোখ, গোল ঘেঁষে হলদেসোনা পানপাতা মুখ আর ইয়া লম্বা ত্রিশূল সোনালী রঙের। 

“সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রখ্যা চতুর্ভির্ভুজৈঃ

শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা ।

আমুক্তাঙ্গদ-হার-কঙ্কণ-রণৎ-কাঞ্চীক্বণন্নূপুরা

দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা ।।”

―এসব তো বহু বহু পরে জেনেছি। মস্তিষ্ক শব্দ অর্থ বুঝে দেবীকে চিনেছে অনেক পরে। সে সময়ে ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র সমস্ত অস্তিত্ব যেন চোখের ভেতর দিয়ে হাত পা এগিয়ে আঁকড়ে মাকড়ে ধরত :

“সৌম্যাসৌম্যতরাশেষসৌম্যেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী ।

পরা পরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী ।।” 

বুকের ধকধক একটু কমলে ত্রিশূল বেয়ে নজরে আসত অসুরের বুক। ঘ্যাঁচ করে ঢোকেনি ধারালো ডগা, কেবল ছুঁয়েছে। এই এক কর গর্ত। রক্ত ছিটকে এসেছে গর্তের চারপাশে।

কষ্ট হত। মুখটায় রাগ জেদ তেজের সঙ্গে সঙ্গেই যন্ত্রণাও ছোপানো মনে হত। অনেকটা হেড স্যর বেদম পিটালে বেয়াড়া ত্যাড়া ছাত্রের যে মুখাবয়ব হয়, তাই ফুটে উঠত যেন মহিষাসুরের চেহারায়। 

চোখে সব ছিল, মা পেটালে আমার অভিমানটুকু অবধি কিন্তু এতটুকু ঘৃণা দেখিনি। বরং “কী দুগ্গি দেখলাম চাচা!” রকমে, ঠাকুর দেখে আমার সমূলে অবাকেরই যেন তিরতিরে ছায়া দেখতাম অসুরের দৃষ্টিতে। নিউরো ট্রান্সমিশন বা ফ্রয়েডীয় নানান অক্ষরজোট এসবের পক্কতা থেকে অজস্র হাত দূরের সে অনুভব। 

ঘেঁটি ছাড়াতে পায়ের কাছে হাত পা ছুঁড়ে ঝটকা মারতে মারতেই কখন যেন শ্রান্তিতে বসে পড়েছে। বিশাল দবদবাওয়ালা ওই ভদ্রমহিলার কথাগুলো শুনতে শুরু করেছে অসুরটা, যত শুনছে, চোখে জড়াচ্ছে বিস্ময়। 

“ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি

        যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্‌ ।

অমন্তবো মাং ত উপক্ষিয়ন্তি

        শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ।।”

বাড়ি ফিরে পাড়ায় যে বাড়িতে আমায় কুমারী পুজো করত, সেই বাড়ি চলে যেতাম এক ছুটে। অসুরের গায়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে আসতাম। বুকের ক্ষতে আঙুল রাখতাম। বিড়বিড় করতাম, ওঁকে ভাল করে দাও ঠাকুর! 

এই পার্কের অসুরটার বসবার কায়দা এমনই ছিল যে খাঁড়া ধরা হাতটা ছাড়া মুখ আর বুকই বেশি দেখা যেত। পুরো চেহারা দেখা যেত পার্কের বাইরের পুকুরপাড়ের অসুরের। সেখানে দুর্গা প্রায় ক্যালেন্ডারের রাধা রকমের কেবল তির্যক চাহনিতে কিছুটা দুগ্গা দুগ্গা লাগত। এঁকেবেঁকে দাঁড়িয়ে আছেন। শাড়িটাও মাটির। কেষ্টনগরের ঠাকুর। অমন রোগা ল্যাকপ্যাকে ললিতলবঙ্গলতা আমার পোষাতো না। এটা হয়তো নিজের সঙ্গে সাযুজ্য না পাওয়ার জন্যই অবচেতনের প্রত্যাখ্যান। 

কেবল অসুরের জন্য যেতাম। পুরো দেখা যেত। বিরাট শরীর নিয়ে হাঁটু মুড়ে বুক উঁচিয়ে লড়ে যাচ্ছে। চোখে মুখে লড়কে লেঙ্গে হাবভাব। কার্ভগুলো চূড়ান্ত আকর্ষক। যেমন বুক তেমন থাই। হাতের পেশি দেখলে ছানাবড়া হয়ে যায় চোখ। 

কী ফিগার রে ভাই! 

তখনও ফিজিক শব্দ চেনা হয়নি। 

একবার কালো আর পিত্তি সবুজ মিশেলে অসুর হয়েছিল। আমার পাশেই দুটি তিড়িংবিড়িং এর মন্তব্য কানে এসেছিল। থরথর গলায় :

― বোডি দ্যাখ, বোডি! উফ্!!

কেমন লাগছে শুনতে আমাদের সেকালের গল্প? ভাল তো?

এবারে যে দুটি গল্প বলব তোমাদের তা পরোক্ষে আমার ছোটবেলার পুজোর সঙ্গে সম্পর্কিত বটেই, জীবনকে চেনার, জীবনের ওঠাপড়ার প্রথম প্রত্যক্ষ পাঠ হিসেবেও চিরকাল মনে থাকবে। নিঃস্বার্থ মানবিকতা ও নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ কেমন ভাবে পাশাপাশি থেকে যায় আমাদের চিরচেনা সমাজে সে শিক্ষাও দিয়েছিল এই দুটি অভিজ্ঞতা।

সাল উনিশশো বিরানব্বই। মাস সেপ্টেম্বর। দিন মহালয়ার দুদিন আগে। সময় রাতের বেলা।

গান শুনতে ভালোবাসতাম খুব। একটা বিরাট রেডিও ছিল। সেটা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে আসছিল। পুজোর ঠিক আগে বাবা সিদ্ধান্ত নিলো এইবছর মহালয়ার আগেই আমাদের একটা টু–ইন–ওয়ান কেনা হবে। সেইমতো মধুমামার দোকান থেকে ফিলিপস-এর একটা ট্রানজিস্টার আর খানকয়েক আমার এবং বাবামায়ের পছন্দসই  ক্যাসেট কেনা হলো। মধুমামা আমাদের ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে শোনালো হেমন্ত মুখার্জ্জীর গলায় “অয়ি ভুবনমনোমোহিনী”। পুজো তো আমায় চুল থেকে নখ মুড়ে ফেললো মহালয়ার দিন দুয়েক আগের সেই সন্ধেতেই। সব বগলদাবা করে মোগলাই পরোটা কিনে নাচতে নাচতে বাড়ী ফিরলাম। 

রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে। বাবা মুখ ধুচ্ছিল কলতলায়। আমি নব্যলব্ধ বস্তুটি নিয়ে খুটখাট করছি, মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। বাবার মুখ ধোওয়ার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। বার দুয়েক কাশলো। তারপর বাবা মা-কে ডাকলো একবার। এক্কেবারে অন্যরকম স্বরে। মা পিছনের বারান্দার দিকে গেলো। তীক্ষ্ণ চীৎকার করে উঠলো। ছুটে গিয়ে দেখি বাবা কলতলায় কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে কলের মাথায় ভর দিয়ে, ঠোঁটের কষ্ বেয়ে গলগলিয়ে নামছে রক্ত। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জী রক্তে টাটকা ভিজে উঠছে বুকের মাঝখানটায়। 

কয়েক মুহূর্ত মা আমি দুজনেই কেমন একটা হয়ে গেলাম। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়েই বাবাকে ধরে নিয়ে ঘরে এলাম। শুইয়ে দিলাম বিছানায়। আবার কাশি। মা ছুটে গিয়ে একটা মগ নিয়ে এসে ধরলো বাবার মুখে। মগ ভরে গেলো রক্তে। পরপর তিনবার এমন হলো। কেমন একটা ঝিমিয়ে পড়লো বাবা। দুহাতে বাবাকে আঁকড়ে মা আমার দিকে ফিরলো। চোখ মুখ পাল্টে গেছিলো মায়ের। বরফ ঠাণ্ডা গলা শুনতে পেলাম, 

― কেঁদো না মণি, ডাক্তার ডাকতে হবে। এক্ষুনি মামাবাড়ী গিয়ে খবর দাও। 

কী যেন ছিল গলাটায়। অসহায় ভয় আতঙ্ক সরে গিয়ে লড়াইয়ের জোর পেলাম। রাত সাড়ে এগারোটার সময় অন্ধকারে তিন তিনটে বাঁশ ঝাড় ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে দৌড়োলাম দিদার কাছে, মামাদের কাছে। মামাবাড়ীতে তখন রাতের খাওয়া চলছে। সদর দরজায় আমার লাগাতার ধাক্কা আর সাথে বাজপড়া চেহারাটা দেখেই সবাই আন্দাজ করে নিলো অঘটন কিছু ঘটেছে। শক্ত করে আমায় ধরলো সেজমামা। বিকৃত গলায় বলার চেষ্টা করলাম সবটা। কিন্তু শুনতে পেলাম বলছি, 

― বাবা রক্তে ভেসে যাচ্ছে দিদা, আমার বাবা মরে যাচ্ছে। 

তারপর একটা যুদ্ধ লড়ল আমার মা, মামারা, বাবার বন্ধুরা আর লড়ল পাড়ায় নতুন আসা একটি পরিবারের দুটি মেয়ে যাদের সাথে আমাদের এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই সময়। বেবীদি আর পিঙ্কি। ওদের বাবা ছিল না, আমার বাবাকে বাবাই বলে ডাকতো দুই বোন।

বারোটা দিন যমের সাথে লড়াই। প্রথমে বারাসাত তারপর কোলকাতা। এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল মানুষটাকে আঁকড়ে ছুটে বেড়ানো। অ্যাম্বুলেন্স ওষুধ ইঞ্জেকসন হাসপাতালের এর কড়া গন্ধে পুজোর নরম গন্ধ ধুয়েমুছে গেলো কখন ঠাহরই হলো না। আতঙ্কের থাবা গ্রাস করে নিয়েছিল আমায়। আসলে আমি তার আগে বাবাকে এমন অসুস্থ হতে দেখিনিতো কক্ষনো। আমার বাবা আমার সুপারম্যান, আমার সব শক্তির আকর, সব ক্ষমতার উৎস, আমার বটগাছ। সেই বাবা একটা সাদা বিছানায় নাকে মুখে মাস্ক নল নিয়ে শুয়ে আছে, চোখ দুটো ঘোলাটে, আধবোজা, কেবল থেকে থেকে কাশছে আর রক্ত উঠে আসছে, আমায় ডাকছে না, মায়ের পিছনে লাগছে না, গান শোনাচ্ছে না, বাঁশি বাজাচ্ছে না এই দৃশ্য আমায় মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলল। পুজোর সকালে সব্বাই বাবার হাত ধরে মণ্ডপে যাচ্ছে আর আমাকে ঘরে রেখে মা যাচ্ছে হাসপাতালে। জানলার পাশে বসে কেটে যাচ্ছে সকাল দুপুর রাত। দিদা সেজমা নমা খাওয়ানোর চেষ্টা করলেই হুড়মুড়িয়ে উঠে আসছে বমি। লোকজন ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাইছে টিবিই হলো নাকি মদটদের-ও অবদান আছে। আমি যন্ত্রের মতো আউড়ে যাচ্ছি,

― এটা অন্য একটা অসুখ। ডাক্তারবাবু বলেছেন ফুসফুসের ধারণ ক্ষমতা হ্রাসে উঠে আসছে রক্ত। আপনাদের ভাবনাগুলো সঠিক নয় একেবারেই। ডাক্তার বাবু এ. জি. ঘোষাল সম্পর্কে আমার মায়ের মামাতো ভাই। তিনিই দেখেছেন। মামা বলেছেন আমার বাবা খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে বাড়ী আসবে। আসবেই। 

লোকগুলো চলে যেতেই তীব্র চীৎকার করতাম রাগে ক্ষোভে আর প্রচণ্ড বমি পেতো আমার। আসলে অদ্ভুত এক রোগ জন্মাচ্ছিল আমার ভিতরে ভিতরে। তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যে উপরি পাওনা রূপে এইধরনের মানসিক যন্ত্রণা ও তুমুল আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি হলেই হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ ভীষণ বমি পাওয়া। এ অসুখটা আজও রয়ে গেছে।

যাক, গল্পে ফিরি।

একাদশীর বিকেলে ফিরে এলো বাবা। মা, তরুণকাকু, বেবীদি আর সেজমামা ফিরিয়ে নিয়ে এলো আমার আস্থা ভরসা বিশ্বাস আবেগ জোর আমার সমস্ত কিছু― আমার ছোট্ট পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অংশ― বাবাকে। জানলা দিয়ে দেখলাম রোগামতো বাবা মায়ের হাত ধরে ঘরে আসছে। কী জানি কী কারণে বাবার সামনে আসতে পারলাম না। ভিতরের ঘরে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। গলা বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। আবেগে মুচড়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব। বাবা বড় ঘরে ঢুকেই বলে উঠলো, 

― আমার মণি কই? কতোদিন এই তোমাদের জন্যে আমার মেয়েটা আমার কাছে থাকতে পারল না। খুব বাজে লোকজন তোমরা। নিশ্চয় বড্ড রেগে গেছে। এবার কী হবে বল তো? আবার লক্ষ্মীপুজোও তো এসে পড়লো বোধ হয়। তা আমার মেয়েটা বাজারে যাবে না না কি আমার সাথে? ঠাকুর কিনতে হবে, খড়িমাটি কিনতে হবে, ফল মিষ্টি মালা কতো কিছু। আমার মেয়ের মতো আলপনা দিতে কেউ কিন্তু পারোনা তোমরা। 

ও মণি, কোথায় গেলি মা?

আর থাকা যায়! ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাবার বুকে। ঝরঝর করে চোখের জল ভিজিয়ে দিল, ধুইয়ে দিল আমাদের। আলো অনেক অনেক আলো যেন ঘিরে ধরল আমাদের নতুন করে। তরুণ কাকু কী এক খেয়ালে চালালো টু ইন ওয়ান টা। আবারও বেজে উঠলো হেমন্ত মুখার্জ্জীর কণ্ঠে,

“অয়ি ভুবনমনোমোহিনী…”

এক নম্বর তো শুনলে। এইবারে দুই নম্বর গল্প।

একটা বয়স পর্যন্ত বারাসাতের দুর্গা ঠাকুর দেখার থেকেও বেশি আগ্রহ আমার ছিল লরী স্ট্যান্ডের বিশ্বকর্মা ঠাকুর দেখায়। আকাশ থাকতো যে, একটা গোটা শরতের আকাশ থাকতো প্যান্ডেলের মধ্যে আর অনেক অনেক ঘুড়ি উড়তো সে আকাশে, বিশ্বকর্মার পিছন দিকটা জুড়ে থাকতো আকাশটা। কী যে সুন্দর লাগতো কী বলবো! 

সেবার, উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল সেটা, ওই বিশ্বকর্মা পুজোর দিনকতক আগে থেকেই বাবার সাথে সড় করে রেখেছিলাম লরী স্ট্যান্ডের ঠাকুর দেখবো, মদনমোহনের মিল্কোস খাবো, শ্রীগুরু থেকে মিঠুন চেক গাউন ব্লাউজ কিনবো। মা যতোই বকুক, শুনবোনা কেমন? বাবাতো দারুন রাজী। আমি কেবল দিন গুনতে লাগলাম কবে আসবে সে পুজো। 

সে সময় ইশকুলের বেতনের দিন বলে কিছু ছিল না, পরের মাসের মাঝামাঝিও আগের মাসের বেতন হতো। তা তেমনই হলো সেই সেপ্টেম্বর মাসেও। বেতনের দিনটা ছিল বেস্পতিবার। বারটা মনে আছে বিশেষ করেই কেননা ওইদিন একটা টাকার কয়েন বাবার খুব দরকার ছিল বেতন পেতে আর মা কোথাও কয়েন না পেয়ে লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকেই বের করে দিয়েছিলো টাকাটা। উপায়ান্তর ছিল না, কিন্তু মায়ের মন খচখচ করছিলো। বারকয়েক বলেছিল বেশ মনে পড়ে যে লক্ষ্মীবারে ঝাঁপি থেকে দিলাম কয়েনটা, ঠিক করলাম কি…

দুপুরে বেলা মা তখন পুজোয় বসেছে, ঘটে পুত্তলি আঁকছে, আমি মাঝের ঘরের মেঝেতে রান্নাবাটি সাজিয়ে পুতুল খাওয়াচ্ছি। সদরে কে যেন হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো। বাবা নাকি! কী মজা! বেতনের দিন বাবা ফিরলে হাতে স্পেশাল কিছুতো থাকতই। করুণাময়ী-য় ছানার পায়েস বা ফেরিনি-র কিসমিস দেওয়া পাউরুটি আর জলভরা কিম্বা বৈশাখী-র রসগোল্লা অথবা বিবেকানন্দ স্টোরসের ডাবল বাইট কেক। 

সেই উচ্ছাসে বাইরের বারান্দায় এসে দেখি বাবা নয়, পাড়ার বিক্রম কাকু। আমাকে প্রায় ধাক্কা মেরেই গীতাদি গীতাদি ডাকতে ডাকতে সিধে ঠাকুরঘরে চলে গেলো। আমিও গেলাম পিছু পিছু। শুনছি মাকে বলছে, শিগগির চলো দাদার ইশকুলে, দাদার বড়ো বিপদ, তোমাকে খুব দরকার। স্যরেরা ডাকছেন।

মা শুধু হাঁক দিয়ে উল্টোদিকের পাড়াতুতো কাকিমাকে বাড়ীর খেয়াল রাখতে বলে আমার হাত ধরে বেরিয়ে এলো। 

তিনজনে প্রায় ছুটে বাবার ইশকুলে গিয়ে দেখি বাবা বসে আছে হেড স্যরের ঘরে। দুই হাতের পাতায় মুখ ঢাকা। ঝুঁকে পড়েছে শরীরটা টেবিলের উপর। আমার বাবাকে একমাত্র বড়ো জেঠুর মৃত শরীরের সামনে ছাড়া অতো ঝুঁকে দাঁড়াতে বা বসতে আমি এর আগে কক্ষনো দেখিনি। কতো লোক সে ঘরময়। কেউ কেউ চেনা জেঠু কাকু ইশকুলের, কাউকে কাউকে আবার চিনিই না। গুজগুজ ফিসফিস করছে সবাই। মা কাছে গিয়ে পিঠে হাতটা রাখতেই বাবা মুখ তুলে চাইলো, দৃষ্টিহীন সে চাওয়া। মা খুব আস্তে আস্তে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বাবা কে বললো, 

― কী হয়েছে আমায় বলো? কতো বড়ো বিপদ ঘটেছে? এইতো আমি এসে গিয়েছি। ওই দ্যাখো মণিও এসেছে। আমরা দুজন মিলে পারব না উদ্ধার হতে এমন বিপদ আছে না কি? খুব পারব। এদিকে ফের, বল আমায়।

বাবা ডুকরে উঠলো। বাবা কাঁদছে! আমার বাবা এইভাবে ভেঙেচুরে কাঁদছে! যে মানুষটা আছেই আমার কান্না থামাতে সেই আজ এতো কাঁদছে! আমার ছোট্ট জগতে যেন বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়ে গেল। অজানা আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেলাম। অজান্তেই পিছিয়ে আসতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, রতন কাকু, বাবার এক সহকর্মী ধরে ফেললেন। একজন স্যর বিষয়টা বলতে যেতেই মা শান্তভাবে তাকে থামালেন। 

― ওকে বলতে দিন। আমি ওর মুখ থেকেই শুনতে চাইছি।

খানিক পরে বাবা আস্তে আস্তে বললো সবটা। ব্যাঙ্ক থেকে গোটা ইশকুলের সবার বেতন বোনাস আরও কী একটা বড়ো অঙ্কের টাকা নিয়ে ফিরছিল আজ।  সাইকেলেই। সামনের হ্যান্ডেলে ঝোলানো ছিল টাকার ব্যাগ। আচমকা চাকায় জড়িয়ে যায় কাতার দড়ি। টাল সামলে কোনক্রমে নামতেই একটি ছেলে পিছনে দিকে থেকে এগিয়ে আসে। 

― কাকু, দড়ি জড়িয়েছে তো চাকায়। ওই ডাবওয়ালার থেকে কাটারিটা নিয়ে আসি? 

বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই সে ডাবওয়ালার দিকে যায়। বাবাও কি মতিভ্রমে সে দিকেই তাকিয়ে থাকে। খুবই সামান্য সময় কিন্তু তারই মধ্যে হ্যান্ডেল থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে ছুট দেয় একজন। ধর ধর গেল গেল করতে করতেই সে এক বাইকের পিছনে উঠে পালিয়ে যায়। এরই মাঝে সেই ছেলেটিও কপ্পুরের মতো উবে যায়। বাবা ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। অসুস্থ বোধ করে। লোকজন একটু সুস্থ করে তারপর চেনা এক রিক্সাকাকু ইশকুলে নিয়ে এসেছে বাবাকে।…

এরপর শুরু হয় আরেক নাটক। ঘটনার বিশ্বাস যোগ্যতা নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইশকুলেরই কেউ কেউ। এতটুকু আহত হয়নি, চোট আঘাতের চিহ্নমাত্র নেই, ঘটনা সাজানো নয় তো? টাকাগুলো নিজেই মেরে গপ্প ফাঁদছে নাতো? ইশকুল থেকে একটা দিনকয়েকের সময় দেওয়া হয় বাবাকে টাকাটা ফেরত দেওয়ার নচেৎ থানাপুলিশ করবেন তারা। বাবা লজ্জায় ঘেন্নায় পাথর হয়ে যায়। এতো বড়ো ধাক্কায়, অসম্মানে, গ্লানিতে জাস্ট বোবা হয়ে যায় আমার বাবা। মা বুঝতে পারে এর উপর থানা পুলিশের হুজ্জোত হলে বাবাকে বাঁচানো যাবে না। ইশকুলে যায়। দুই বয়োজ্যেষ্ঠ মাষ্টারমশায়কে কথা দিয়ে আসে, 

― কাল আপনারা টাকা পেয়ে যাবেন। কিন্তু আপনারা কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে এই হীনতা ওঁর দ্বারা সম্ভব? ঈশ্বর থাকলে প্রমাণ একদিন হবেই যে উনি নির্দোষ। সেইদিন…

সন্ধেবেলায় সেজোমামার সঙ্গে বেরিয়ে যায় মা। যাবতীয় গহনা বিক্রি করে টাকার জোগাড় করে। দিয়েও আসে পরের দিন। চারিদিকে তখন পুজো পুজো রব। কত কত আলো। কেবল আমাদের বাড়ীতে শুধু কালোরা আস্তানা গেড়েছে সর্বময় হয়ে। চূড়ান্ত অর্থসঙ্কট, মা জনে জনে জবাবদিহি করে করে হাক্লান্ত আর বাবাতো বোবাই হয়ে গেছে। কারোর সাথে কথা বলে না, মেশে না, চুপ করে থম খেয়ে বসে থাকে আর কেবল বিড়বিড় করে আমি চোর? আমি চোর! …

সেও এক সেপ্টেম্বর মাস। সেও এক পুজোর সময়। আমি উঠোনে বাগানে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে বেড়াই একলা। শিউলি স্থলপদ্ম ভর্তি বাগান। কিন্তু আনন্দ মুঠো গলে কিভাবে যেন হারিয়ে গেছে কে জানে কোথায়।

ষষ্ঠীর দিন সকাল। স্কুলের বাচ্চাদের গাড়িচালক ওয়াহাব কাকু আর তার বোন আঙুর পিসি এলো। হাতে আমার জন্য একটা ফ্রক, চুলের ফিতে আর লাল ভেলভেটের জুতো। পুজোর নতুন সাজ! প্রায় একইসঙ্গে ঢুকলো তাঁদের মা। “অভাবের মা”। আসলে ওয়াহাব কাকুর মা কিন্তু আমি উচ্চারণ করতে পারতাম না ছোটবেলায়, সকলে ওঁকে ডাকত ওয়াহাবের মা আর আমি শুনে শুনে বলতাম অভাবের মা। তাঁরই হাতে আলতা সিঁদুর। মা বারান্দায় বসে বাবাকে জল মুড়ি খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। তিনজনে দাওয়ায় উঠে এলো। মায়ের হাতে আলতা সিন্দুর দিয়ে অভাবের মা বলে উঠলেন, 

― খুকী, তুমি এয়োতী মানুষ। আমার বড়ো খোকার ইস্তিরি। তা তোমারে শাড়ী দেওয়ার ক্ষ্যামতা তো আমার নেইকো, কিন্তু এই আলতা সিন্দুরডা এনিচি, এইডে আঝ পরো, পরতি হয় ঝে। আর নাতিনডারে ঝামা ঝুতো পরায়ে দাও, আঙ্গুর দুটো প্যাণ্ডেল ঘুরোয় নে আসুক, পুজো পরবের দিন আজ, মেয়েডা ঘরে বসি মুক আন্ধার করি থাকলে আল্লাহ্ আমায় মাপ করবে না! কী ঝানো খুকী, আমি মোসলমানের বিটি, মোসলমানের বিবি। কিন্তু আঝ ঝদি আল্লাহ্ এইসেও আমায় কয় আমার বড়ো খোকা টাকা নেচে, আমি বিশ্বেস ঝাবোনানে। 

মা মূর্তির মতো বসে রইল জিনিসগুলো হাতে নিয়ে। আঙ্গুর পিসি বাবার পায়ের কাছটিতে বসে কেবল অস্ফুটে বিড়বিড় করছিল, ও দাদা কতা কও আর ওয়াহাব কাকু বাবার পাশে বসে হাত দুটো ধরে বলে চলছিল, 

― ও বড়ো ভাই, তুমি এমন পারা হইয়ে আর থেকোনিগো। তুমি জানোনা এই ঘটনায় তোমার প্রতি যে অবিচার হইয়েচে আমরা সব্বাই তার প্রতিবাদ করি চলিচি। কেউ মানিনিকো আমরা। ঝে লোক নিজের ঘরি চালের জোগাড় না করি অন্যেরে চাল কিনি দেয়, বই কিনি দেয় অগুন্তিরে, ঝে লোক ছাত্তর ভত্তির জন্যি এক নয়া পয়সা বাড়তি নেয় না, দিতি এলি ঠেঙ্গোয়ে বাইরে করে, সে লোক টাকা নেছে! কেউ মানছে নাগো। কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে সবাই, সামনে আসতি পারছে না তোমাদের। বিচের এর হবে বড়ো ভাই। ন্যায্য বিচেরই হবে। শুনতি পাচ্চো তুমি? …

বিচার হয়েছিল। আরও কিছু মানুষ ঠকানোর পর সেই দলটি ধরা পড়ে। তাদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় বাবার কেসটাও তাদেরই অবদান। আমার বাবাও আস্তে আস্তে সেরে উঠলো শুভানুধ্যায়ীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। 

সব ঠিক হয়েই গেল একটা সময় ধীরে ধীরে। কিন্তু আমাদের জীবনের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো, সেই অপমান, অবমাননা, আর্তি, যন্ত্রণা, মুখোশের আড়ালের তথাকথিত ভদ্রলোকেদের আসল কুৎসিত চেহারা, সমাজ নামক ক্লীব অস্তিত্বের বাগাড়ম্বর আমরা কি কখনো ভুলে যেতে পারব? পারবো ভুলে যেতে আমায় মা শিউলি কুড়িয়ে ঠাকুরবাড়ী দিয়ে আসতে দেয়নি এই ভয়ে যে যদি চোরের মেয়ে বলে! আমার আর মায়ের স্থলপদ্ম হাতে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাওয়া হয়নি সেই একই লোকের অদ্ভুত ঘিনঘিনে দৃষ্টি আর ততোধিক অশালীন প্রশ্নবাণের আতঙ্কে! ডাকপাখি যেমন দাঁড়াশের কবল থেকে নিজের ছানাপাখিদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে এক অসম যুদ্ধে ডানার আড়াল দিয়ে, আমার মা একলা দিনের পর দিন বাবাকে আর আমাকে সেইভাবে আগলেছে আর নিজে দগ্ধে দগ্ধে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে এটা আমি ভুলে যেতে পারি? পারা সম্ভব আদৌ?

ইশ! দ্যাখো দেখি, গল্পে গল্পে কেমন মন খারাপ করে দিলাম তোমাদের। নাহ, এ ঠিক নয় মোটেই। সকল কালো আলো হোক। সকলের মনের অন্ধকার ঘুচে যাক। আনন্দময়ীর আখ্যানে আনন্দ ফিরুক ফের। আমার ছোটবেলার গল্পের শেষ হোক একটি মজার গল্প দিয়েই। পড়ে ফেল দেখি সক্কলে।―

আজ দশমী। এবার আমাদের পাড়ার থিম ছিল লাইভ ঠাকুর। মোড়ের মিষ্টির দোকানের ময়রা হয়েছিলো গণেশ, বলিউডের স্বপ্নে বিভোর ঋত্বিক হয়েছিলো কার্ত্তিক, পাড়ার হার্টথ্রব চিনির বোন মিনি হয়েছিলো সরস্বতী, আর শিবেকাকার মিষ্টিমুখী ভালোমানুষ মেয়ে ধেলি হয়েছিলো লক্ষী ঠাকরুন। সক্কলের প্রিয় সবিতা বৌদি স্বয়ং দুর্গা আর জিম করা ভীম নামে খ্যাত মহেশ মুদী অসুর। 

লটারিতেই ঠিক হল সব, নইলে তো অন্যদের চটিতং হওয়ার সম্যক সম্ভাবনা। বাহনেরা অবিশ্যি সব পুতুলই ছিল কেবল আমি ছাড়া। আমি কে? ন্যালা, ভালো নাম নলিনীকান্ত। আমি সিংহ সেজেছি। সেই ষষ্ঠী ইস্তক আমার পিঠে বৌদি আর মহেশদার পেটে আমি এই পোজে দাঁড়িয়ে আছি। সকাল সাতটা থেকে দুপুর একটা আর বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা অবধি ডিউটি।

ষষ্ঠী বেশ কাটল। কারা যেনও এসে ফিতে টিতে কাটলে, আমাদের সুখ্যাত করলে, বেশ কেউকেটা লাগছিলো নিজেকে। লাগসই একটা হুঙ্কার দিয়ে খুশিটা জাহির করতে গেলুম, মহেশদা কটমটিয়ে তাকিয়ে থামিয়ে দিলে। 

গোল বাঁধলও সপ্তমীতে। সকালের পুজোর পর প্যান্ডেল ফাঁকা, এক বিচ্ছু এলো ঠাম্মার সাথে। ঠাম্মাটি চক্ষু বুজে প্রণামরতা, সে সটান আমাদের সামনে উঠে এলো। 

– অসুর খুব বদমাশ, না ঠাম্মা?

– হ্যাঁ খোকন।

– তাই ওকে ধরে ধরে মারে মা দুগগা, না ঠাম্মা?

– হ্যাঁ খোকন।

– আমিও মারি।

(কিছু বুঝে ওঠবার আগেই সপাট চড় মহেশ দার গালে! দাদা তো রেগে কাঁই। দাঁত কিড়মিড়িয়ে মুঠো পাকিয়ে এক্কেবারে আসুরিক রাগ! খোকন ভেবলে সিধে ঠাম্মার পিছনে।)

– অসুর খুব রাগী গো ঠাম্মা!

– হ্যাঁ খোকন।

– তেড়েফুঁড়ে উঠলে, পুরো আমায় অঙ্ক করাতে বসা বাবার মতো লাগলো!

– হ্যাঁ খোকন, অ্যাঁ!!! 

(বোজা চোখ নিমেষে রসগোল্লা।)

অষ্টমীর অঞ্জলি। ঠাকুর মশায় মন্তর আওড়াচ্ছেন, “জেনেগান” রিপিট করছে আর বৌদির থুড়ি দুগগার পা টিপ করে ফুল ছুড়ছে। কিন্তু তারা তো আর অভিনব ব্রিন্দা নয়, ফলতঃ একমুঠো বেলপাতা সোজা আমার নাকে মুখে। বিপজ্জনক সুড়সুড়ি। প্রচুর প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে বিরাট এক হ্যাঁচ্চওওওও!!! জেনেগান ছিটিয়ে ছত্রখান। পিঠের উপর বৌদি কোনোরকমে টাল সামলালো। ময়রা নিমু হাসতে গিয়ে ভুঁড়ি থুড়ি ধুতির ভুঁড়ি ফাঁসালো, ধেলির চোখ কপালে, ঋত্বিক নিজের ধনুকে নিজের নাকেই খোঁচা খেয়ে টেয়ে অস্থির, অনলি মিনি বীণা হস্তেন স্টেডিলি সংহিতা। এ মেয়ের হবে, হবেই। ওদিকে উদ্যোক্তারা গণ হাঁচি হেঁচে চলেছেন, ভাবটা এমন যেনও ওনারাই হেঁচেছেন সিঙ্গিটা নয়। জনতার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া আর কি। একে কি বলে বলুন তো? হাঁচি চুরি নাকি ড্যামেজ কন্ট্রোল? 

নবমীর সন্ধ্যে। ধেলি মঞ্চে ওঠার সময় ফিক করে হেসে বলে উঠলো,

– সিংহে তোমায় বেশ মানিয়েছে ন্যালাদা।

পোজ নিলাম কিন্তু হাসিটা চোখে আঠা হয়ে রইলো। 

প্যান্ডেলের সামনে তখন ঢাক বাজানো, ধুনুচি নাচানো, মোমবাতি জ্বালানো প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা ভিতরে দাঁড়িয়ে। হটাত দেখি খেঁকুরে টাইপ জনাচারেক জটলা করছে। কেসটা কী? মুখ ঘুরিয়ে বৌদিকে ইশারা করতে যাবো, চোখ পড়লো ধেলির উপর। অজানা কী এক ভয়ে কাঁটা মেয়েটা থরথর কাঁপছে! ফিসফিসিয়ে বললও,

– ওদের আমি চিনি। কাকার বন্ধু। খুব খারাপ। আমায় প্রায়ই কোথায় একটা নিয়ে যাবে বলে। 

যা বোঝার বুঝে গেলাম আমরা। বৌদি ইঙ্গিতে বোঝালো করণীয় যা যা। বেয়াড়া কিছু করলেই অ্যাকশান। 

আচমকা লোডশেডিং! 

ধেলির চিৎকার! 

আন্দাজেই ঝাঁপালাম। ধাই ধপ ধপ মলুম রে গেলুম রে হরেকরকমবা আওয়াজ। লোকজন ছুটে এলো। আলো জ্বললও। 

সে কী অনির্বচনীয় দৃশ্য! 

দুর্গা মুণ্ডু ঝাঁকাচ্ছে একটার, গণেশ আরেকটাকে নিজের ধুতি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে, এক সিড়িঙ্গেকে চেপে মাটিতে শুইয়ে রেখেছে কার্ত্তিক আর তাকে উদ্দাম পেটাচ্ছে সরস্বতী, মহেশদার বাহুবেষ্টিত পালের গোদাটার মুখের জিওগ্রাফি বদলাচ্ছি আমি। এককোণে দাঁড়িয়ে থরহরি কম্পমান ধেলি।

তারপর কী হল?

নটে গাছ মুড়োতে হেল্প করলো পুলিশ। চ্যাংদোলা করে নিয়ে গ্যালো পাজিগুলোকে ধেলির সেই খারাপ কাকা সমেত। প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে। পাড়ার লোকেরা আমাদের বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা করল। 

আজ দশমী। আজ পাব পুরস্কার। আজ আমরা সত্যি লাইভ ঠাকুর। 

শেষ বারের মতো পোজ নিয়ে দাঁড়াতে যাব, হঠাৎ―

– হি হি হি হি।

– অ্যাই মিনি, হাসছিস কেন?

– আমার তো সেট হয়ে গেছে, তোমারটাও সেরে ফ্যালো।

– মানে?

– ন্যাকা! ধেলি দি গো।

– যাহ্‌ বোকা।

ইশ!

সামনে তাকিয়ে দেখি ধেলির লজ্জারুণ মুখচ্ছবি আর তার ঠিক পিছনে দুর্গা বৌদি আর ভালো অসুরদার অবয়বে স্নেহের প্রোজ্জ্বল উদ্ভাস। 

মনে হল বেলুনে চড়ছি!

বলেই ফেললুম,

– আমি রাজি।

মিনি ঋত্বিক নিমু সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো―

– হুর্‌রে!!!

Facebook Comments