Site Overlay

অপ্রকাশিত

অভিযান ভট্টাচার্য্য

[প্রাক্ কথন: এই কাহিনী নিছকই কল্পনায় ভর করা গল্প ৷ ইতিহাস , রাজনীতি বা সমকালের সাথে কেউ সামান্যতম সাজুয্য খুঁজে পেলে, তা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার ৷]

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল অম্বরীশ ৷ কলিং বেলের নিরন্তর শব্দ যেন মাথায় হাতুড়ী পিটছে ৷ একটা বিখ্যাত কনফারেন্সে গবেষণাপত্র জমা দেবার শেষ সময় ছিল  সকাল ৬টা অব্দি | সারারাত প্রচন্ড পরিশ্রম করে ভোর নাগাদ গবেষণা পত্রটা অনলাইনে জমা দিয়ে যখন শুতে গেছিল ততক্ষণে প্রাত:ভ্রমণকারীর  দল ক্যাম্পাসের রাস্তায় বেরিযে পড়েছে ৷ বিছানায় বসেও অম্বরীশের ঘোর কাটেনি ৷ কোনো রকমে হাতড়ে মোবাইল ফোনটা নিয়ে সময় দেখল ৷ সকাল ৭টা ৷ এই সময়ে কে এরকম পাগলা ঘন্টির মতো বেল বাজাচ্ছে ? খিঁচিয়ে ওঠা মেজাজে আলসেমী জড়ানো পায়ে টাল খেতে খেতে দরজা খুলে তেড়ে একটা গালি দিতে যেই যাবে, সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক দমকা বাতাসের সাথে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে এল সুচরিতা |

সুঃ “রিজ়দা শুনেছ?”

ঘরে ঢুকে প্রচণ্ড হাঁফাতে হাঁফাতে বলল সুচরিতা, সুচরিতা মাহাত ৷ অম্বরীশকে ওর মতো জুনিয়ররা রীজ় বলেই ডাকে ৷ সুচরিতা কম্প্যুটার সায়েন্স এম. টেক. ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী ৷  বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডিস হোস্টেলে থাকে ৷ অম্বরীশের জন্য বরাদ্দ রিসার্চ স্কলার কোয়ার্টার্স থেকে একটু দুরেই ৷ পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে খুব পরিশ্রম করে পড়াশুনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী টপকেছে ৷  চলনে বলনে তার পাহাড়ী ঝোরার প্রাণঞ্চলতা ৷ একটা তীব্র উত্তেজনায় তার সমস্ত শরীর যেন কাঁপছে ৷ সুচরিতার এইরকম অকস্মাৎ, অকল্পনীয় ঝোড়ো উপস্থিতির ধাক্কায়  যাবতীয় আলসেমীর জাল ভেদ করে অম্বরীশের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ঘুম জড়ানো বিরক্তি,

অঃ “কী!”

সুঃ “বিভাস ঘোষ!”

অঃ “মানে?”

সুঃ “ফিরে এসেছেন!”

অঃ “এই শোন, কাল রাতভোর কাজ করে না আমার টোটাল সিস্টেম হ্যাং করে আছে ৷ সাতসকালে এই চ্যাংড়ামিটা জাস্ট নিতে পারছি না ৷ তার ওপর বিভাস ঘোষ নিয়ে! এখন যা তো ৷ আমি ঘুমবো ৷ "

সুঃ “ইয়ার্কি মারছি না রিজ় দা ৷সিরিয়াস ! তুমি কি কিছুই জানোনা?”

অঃ “What serious? সাতসকালে বিভাস ঘোষ অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে তোকে ঘুম থেকে তুলে আমার মাথা খেতে পাঠিয়েছে?”

সুঃ “ রিয়্যাল পাব্লিক বাংলা চ্যানেলটা খোলো ৷ সকাল থেকে ব্রেকিং নিউজ চলছে ৷ "

অঃ “ মানে? কিসের ব্রেকিং ? কি সব …”

অম্বরীশের কথা শেষ হবার আগেই সুচরিতা নিজেই টিভিটা চালিয়ে দিয়ে RP BANGLA মানে, রিয়্যাল পাব্লিক বাংলা চ্যানেলটা চালু করেছে ৷ সামনেই বিধানসভা নির্বাচন | তার কয়েকমাস আগেই চ্যানেলটা চালু হয়েছে ৷ চ্যানেলটা হিন্দি আর ইংরেজি ভাষায় কিছু বছর আগে সম্প্রচার শুরু করেছিল ৷ বাংলায় নতুন৷

এখন বিজ্ঞাপনের বিরতি চলছে ৷ অম্বরীশের ঘরে সুচরিতা যথেষ্ট  স্বচ্ছন্দ ৷ সে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে চা এর জল গরম করতে লেগে গেল ৷ সকাল থেকে টিভির খবরের উত্তেজনায় তারও চা খাওয়া হয় নি ৷ অম্বরীশের  আলস্য কাটাতেও চা টা খুব জরুরী ৷

অঃ “ কি ব্যাপার একটু খুলে বলবি? এরা তো বিজ্ঞাপনই দেখিয়ে যাচ্ছে ৷ ”

অধৈর্য হয়ে ওঠে অম্বরীশ ৷ আসলে বিভাস ঘোষ তো শুধু একটা নাম নয় ৷ তার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ, শ্রদ্ধা জড়িয়ে আছে এই মানুষটির সাথে ৷ তাদের জন্মের কিছু বছর আগে অশান্ত রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে মানুষটা হঠাত উধাও হয়ে যায় ৷ তারপর থেকে জনমতের চাপে পরবর্তী সরকারে যাঁরা যাঁরা ছিলেন সকলেই নিজের মতো করে একটা তদন্ত কমিশন বসিয়ে প্রমান করেছেন যে বিভাস ঘোষ মৃত ৷ কিন্তু অনেকেই তা বিশ্বাস করে নি ৷   তাদের সিদ্ধান্তের সমর্থনে অকাট্য প্রমাণ নাকি কোনো তদন্ত কমিশনই উপস্থিত করতে পারে নি ৷ এই নিয়ে অনেকে ব্যক্তিগত স্তরে অনুসন্ধান করেছেন ৷ এক একজন এক একটা তত্ত্ব খাড়া করেছেন ৷ সেসব নিয়ে বাজারে বইও বেরিয়েছে অনেক ৷ অম্বরীশ তার কৈশোর থেকেই এই নিয়ে পড়াগুনো করেছে ৷ শুধু অন্তর্ধান নয়, বিভাস বাবুর রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও সে যা পড়াশুনো করেছে, তাতে করে তাকে একজন অথোরিটি মনে করাটা অত্যুক্তি নয়। সুচরিতা অম্বরীশ সম্বন্ধে খুব একটা ভুল কিছু বলে নি ৷ আসলে বিভাস ঘোষের অন্তর্ধান রহস্য, নানা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এই সব নিয়ে মুচমুচে রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের মতো অনেক বই পড়তে পড়তে এক সময় অম্বরীশের মনে হয়, যে আদর্শ নিয়ে মানুষটা লোকচক্ষুর আড়ালে যাবার আগের দিন পর্যন্ত লড়ল, সেই আদর্শটা নিয়েই কারও মাথাব্যথা নেই ৷ বিভাস ঘোষ যেন ক্রাইম থ্রিলারের একজন হিরোতে পর্যবসিত হয়েছেন ৷  অথচ মানুষটা রাষ্ট্রনির্মানের যে চিন্তা ভাবনা করেছিল সেটা নিয়ে কেউই কথা বলে না ৷ তাই আজকাল বিভাস ঘোষের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে খুব পড়াশুনো করছে ৷ মানুষটাকে যেন আরও ভালো লাগছে ৷

সুচরিতার সাথে আলাপ হবার পর থেকে অম্বরীশও এটা নিয়ে আলোচনা করার একজন একনিষ্ঠ সহচরী পেয়ে গেছে ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নে এখনও “ গণতান্ত্রিক সংগ্রামী পার্টির” ছাত্র শাখার দাপট ৷ দীর্ঘদিন তাদেরই সরকার ছিল ৷ বিভাসবাবু নিরুদ্দেশ হবার কিছুদিন পরই তারা সরকারে আসে ৷ দীর্ঘ শাসনের পর গত নির্বাচনে বহুবছর পর সরকার পাল্টেছে | সরকারে এসেছে “ বঙ্গজনতা পার্টি” ৷ কিন্তু তা হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংগ্রামীদেরই কর্তৃত্ব রয়ে গেছে ৷ এরা আদর্শগত ভাবে বিভাস ঘোষকে বর্জন করার পক্ষে ৷ তাই ইচ্ছে থাকলেও অম্বরীশ খুব একটা এসব নিয়ে আলোচনা করার মতো মানুষ অন্ততঃ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পায় না ৷ আজকাল সাধারণ ছাত্রছাত্ৰীরাও কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ৷ এসব তাদের কাছে “অপ্রয়োজনীয়” আলোচনা  ৷ অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য স্মার্টফোনে হাজারো পসরা সাজানো আছে ৷ সুচরিতা এরই মধ্যে ব্যতিক্রম৷ সে যে জায়গা থেকে উঠে এসেছে সেখানকার মানুষ আজও বিভাস ঘোষকে দেবতা জ্ঞান করে। জনশ্রুতিতে শোনা যায়, তাঁকে নাকি অনেকে অনেক সময়েই দেখেছে – কখনও গভীর জঙ্গলে একপাল মনুষ্যরূপী ছায়ামূর্তির সাথে শুকনো শালপাতা মাড়িয়ে ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে; কখনওবা রুক্ষ মালভূমির গহীন অরণ্যে পর্বতের গুহায় মৃদু আলোকচ্ছটায় ৷ কিন্তু, অশরীরি আত্মাকে দেখার অভিজ্ঞতার গল্প যেমন হয়, সসেইরকমই এইসব সাক্ষাৎ যে কার সাথে আসলে , তা কেউ বলতে পারে না ৷ রুক্ষ মালভূমির জঙ্গলে – জনপদে বিভাস ঘোষ যেন এক জীবন্ত প্রেতাত্মার মতোই মানুষের মনে অদৃশ্য কুণ্ডলী পাকিয়ে অনন্ত এক অস্তিত্ব হয়ে রয়েছেন !

“ আমি কি জানিনা, ওই মানুষটাকে নিয়ে তোমার যা পড়াশুনো তাতে করে তুমি অনায়াসে একটা গোটা থিসিস নামিয়ে দিতে পার? তোমার কম্পুটার সায়েন্সে যত রগড়াচ্ছ, তার থেকে অনেক সহজ হতো সেটা ৷ “ প্রশংসার সুরেই বলল সুচরিতা |  সকালের এই হঠাত হুটোপাটার কারনটা ব্যাখ্যা করল,  “R P Bangla সকাল থেকে একটা exclusive ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে ৷ ওদের সাংবাদিক মহুয়া রায় নাকি দীর্ঘ ইনভেস্টিগেশন করে বেনাম বাবা কে খুঁজে পেয়েছে ৷ তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছে ৷ কিন্তু লোকেশনটা বলছে না ৷ বলছে যে এই বেনাম বাবাই আসলে বিভাস ঘোষ | মানে বাজারে রিসেন্ট চালু থিয়োরীটাই নাকি সঠিক ৷ সব থেকে বড় কথা, বেনাম বাবা সরাসরি আবেদন জানাচ্ছেন ‘সনাতন জাগৃতি দল’কে নির্বাচনে জেতাতে !”

 “ বলিস কি?” অম্বরীশ যেন আঁতকে  ওঠে ৷ বলে, “ দেখ, আমি আগেও তোকে বলেছি, আবারও বলছি, বেনাম বাবা থিওরী সবটা  ফ্ৰড  ৷ তাছাড়া যদি ধরেই নি যে উনি বিভাস ঘোষ, তাহলেও বলতে হয়, যে বিভাস ঘোষ এই সনাতন জাগৃতী মার্কা দলগুলোর সাথে আজীবন লড়াই ,  সে এদ্দিন বাদে প্রকট হয়ে বলছে তাদেরই জেতাতে? তার মানে এতদিন যা কিছু জানলাম পড়লাম সব মিথ্যে? What utter nonsense ? ”

“তোমার মনের ভাবটা আমি বুঝতে পারি রিজ়দা ৷ কিন্তু ভিত্তিওটাতে বার কয়েক ওনাকে ক্লোজ-আপ দেখিয়েছে ৷ “ দুকাপ চা অম্বরীশের আগোছালো টেবিলের একটা ফাঁকা জায়গায় রাখতে রাখতে বলল সুচরিতা | “বিশ্বাস কর রিজ়দা, হুবহু সেই লোক ! যেন দেওয়ালের ওই ফোটো ফ্রেম থেকে নেমে এসেছেন ৷ অবশ্য বয়সের ছাপ পড়েছে ৷ চুল দাড়িতে মুখটা ভর্তি ৷ দেখলেই মনে হবে একজন পরম সাধক ৷  RP Bangla চালু হবার কিছুদিনের মধ্যেই ওরা কিন্তু বেনাম বাবা নিয়ে একটা ফিচার করেছিল ৷ আমি তোমার মতো অতোটা না হলেও, এই  থিওরীটা নিয়ে একটু সন্দেহ করতাম ৷ তবে আজকে খবরটা দেখার পর থেকে …"

সুচরিতাকে থামিয়ে উত্তেজিত ভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অম্বরীশ ৷ কিন্তু, এমন সময টিভিতে বেজে উঠল চ্যানেলের সিগনেচার টিউন : “ আপনারা দেখছেন, RP Bangla | বাংলার খবর , সবার আগে৷”

বিজ্ঞাপনের বিরতির পর শুরু হল খবর | ঝাঁচকচকে স্টুডিও ফ্লোরের উপর থেকে ক্যামেরা প্যান হয়ে নেমে এল সোজা অম্লান বরুয়ার এর মুখের সামনে। অম্লান RP Bangla চ্যানেলের চিফ নিউজ এডিটর ৷ জন্মসূত্রে সে গৌহাটির ৷ কিন্তু র্দীঘদিন দিল্লীতেই সাংবাদিকতা করছে ৷ বিভিন্ন হিন্দি এবং ইংরেজী চ্যানেলে বেশ ঝানু একরোখা নাছোড়বান্দা “ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট” হিসেবে নাম করেছে ৷ শোনা যাচ্ছে ইদানিং নাকি  সনাতন জাগৃতির সর্বভারতীয় সভাপতি, দিল্লীর স্বনামধন্য ব্যবসায়ী , ওম ঝুনঝুনওয়ালার সাথে অম্লানের বিশেষ  ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ৷ RP BANGLA চ্যানেলেও মিঃ ঝুনঝুনওয়ালার  ভালো রকম শেয়ার আছে। R P BANGLA চালু হবার পর অম্লানকে বকলমে চ্যানেলের সর্বময় কর্তা  করে বাংলায় পাঠিয়েছেন স্বয়ং ঝুনঝুনওায়ালা সাহেব ৷ বলাই বাহুল্য, RP BANGLA চ্যানেলে অম্লানের একটাই এজেণ্ডা, আসন্ন  নির্বাচনের প্রাক্কালে ঝুনঝুনওয়ালা সাহেবের দলকে বাংলার জনমানসে  জায়গা তৈরী করতে সাহায্য করা৷ গণতান্ত্রিক সংগ্রামীদের মতো কড়া সংগঠনকেন্দ্রিক দলকে সরিয়ে বঙ্গজনতা  ক্ষমতা দখল করলেও, শাসকদল হিসেবে সাংগঠনিক বাঁধুনী তাদের বিশেষ একটা  তৈরী হয় নি ৷ এই সুযোগে সনাতন জাগৃতি বাংলা দখলে মরীয়া হয়ে উঠেছে ৷ এতদিনে প্রথমবার বাংলা দখলের সুযোগ এসেছে বলে তারা মনে করছে ৷ ফলে চেষ্টার কোন কসুর নেই – সোস্যাল মিডিয়াতে তাদের দাপট ছিলই, এবার টিভিতেও ৷ এই কাজে অম্লান মিঃ ঝুনঝুনওয়ালার বড় ভরসা৷ এখানে অবশ্য আরেকটা বিষয় আছে।

ঝুনঝুনওয়ালা সাহেব মোটা মাইনে দিয়েও এমন একজন সাংবাদিককে বাংলার বাজারে পাচ্ছিলেননা যে অম্লান বড়ুয়ার মত চোখ বুঁজে বাংলার যে কোন রাজনীতিবিদকে ক্যামেরার সামনে যেমন খুলী আপমান করতে পারে ৷ আসলে বাঙালী সাংবাদিকদের স্বাভাবিক সহবত বোধ দিয়ে কাজ হবে না ৷ প্রতিপক্ষকে তার মাটিতেই বুকঠুকে অপদস্থ করে জনমানসে নিজেদের বেশ একটা বাহুবলী চেহারা প্রতিষ্ঠা করতে সনাতন জাগৃতি মরীয়া ৷ ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এভাবেই তারা বিপুল সাফল্য পেয়েছে ৷ সেই চেনা অঙ্কেই ঝুনঝুনওয়ালা সাহেব ঘুঁটি সাজাচ্ছেন ৷ সংগ্রামী পার্টি-র শক্তিশালী সংগঠন এতদিন এই কাজে বাধা হয়েছিল ৷ এবার মোক্ষম সুযোগ | তাই কোন মনোমত উপস্থাপক না পেয়ে ঝুনঝুনওয়ালা  অম্লানকেই উপস্থাপনার গুরুদায়িত্ব নিতে বলেছেন ৷ অম্লান আসামের লোক এবং কর্মসূত্রে দিল্লীর হিন্দি ও ইংরেজী চ্যানেলে কাজ করলেও, স্কুল জীবন কাটিয়েছে বাংলায়৷ তাই বাংলা সে ভালোই বোঝে এবং বলতেও পারে ৷ অবশ্য বাংলা বলতে গিয়ে প্রচুর হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে। তাই বাংলাটা ঠিক যে বাংলার মতো শোনায় তা বলা যাবে না ৷ এতে অবিশ্যি ঝুনঝুনওয়ালা সাহেবের কোন আপত্তি নেই। বাংলায় হিন্দির  'বিস্তার' কম হওয়া নিয়ে সনাতন জাগৃতির  নিয়ন্তা সংগঠন রাষ্ট্র সেবা সংঘ বিশেষ ভাবে চিন্তিত | অতত্রব, অম্লানের হিন্দি নির্ভর বাংলায় ঝুনঝুনওয়ালা সাহেবের মাথা ব্যথা নেই ৷

 “ নামোষ্কার বংলা |” টিভির পর্দায় আধা বাংলায় চিৎকার করে ওঠে অম্লান, “ সোকাল থেকে যে সনসনিখেজ় খবর নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই খবর নিয়ে আবার একবার ফিরে এলাম আমি অম্লান ৷ সারাদিন আমরা এই খবরে চোখ রাখব , কেন কি এবার সময় এসেছে বাংলার রাজনীতিতে হিপোক্রিসি সেস করে দেবার ৷ আর সেটা করবে Real Public . Real Public -এর স্পেসাল অপারেশন খবর যদি কোবরেও ছুপে থাকে, তো সেটাকে বের করে আনবে৷
আমরাই এন্ডোর্স করেছিলাম কি বেনাম বাবা কোন imagination, কোন story নয় ৷ বেনাম বাবা is the real বিভাস ঘোষ ৷ Yes Bengal , তোমাদের প্রিয় সেই হারিয়ে যাওয়া লিডার | এতদিন ধরে বাংলা জানতে চেয়েছে তার পসন্দিদা লিডার কোথায় হারিযে গেল? আজ RP BANGLA জানাচ্ছে ৷ এতদিন বংলার সেন্টিমেন্ট নিয়ে বংলার সব রাজনৈতিক দল খিলওয়াড় করেছে ৷ কিন্তু আমরা দাবী করেছিলাম যে বিভাস বাবু গুম হয়ে যাওয়ার পরে তার সত্যিকারের বন্ধু যদি কেউ থেকে থাকে সেটা ছিল রাষ্ট্র সেবা সংঘের লিডাররা ৷ যখন সবাই বিভাসবাবুকে সেস করতে চেয়েছে , তখন বিভাসবাবু রাষ্ট্র নির্মাণের জন্যে সনাতন জাগৃতির help নিয়েছেন ৷ একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমীকে একের পর এক দেশদ্রোহী সরকার ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে ৷ কিন্তু এই অন্যায় বংলার বুকে আর নয় ৷ এবার সত্যের খোলাসা হবে ৷ বংলায় যারা এতদিন ছড়ি ঘুরাচ্ছিল তাদের জন্য চেতাবনী দিচ্ছি ৷ সুধরে যাও, নয়তো সুধরে দেব ৷”

 " দুদিন বাংলা চ্যানেলে অ্যাঙ্করিং করে কি ধমকাচ্ছে বটে ! কি অ্যারোগেন্স !” বেশ উত্তেজিত ভাবেই বলে উঠল সুচরিতা |

 “ পয়সা, পয়সা ৷ পেছনে পয়সাওলা খুঁটি থাকলে তোরও এরকম ধমক চমক হোতো ৷ চুপ করে বোস ৷ ভালো করে শুনতে দে ৷” অম্বরীশ সুচরিতার উত্তেজনা থামিযে টিভি তে সমস্ত মনোযোগ নিবেশ করল ৷

ওদিকে অম্লান বলে চলেছে,  “আসুন, আবার একবার দেখে নিন সেই ঐতিহাসিক বার্তালাপ ৷ যেখানে সরকার পৌঁছতে পারে নি , সেখানে পৌঁছে গেছি আমরা৷ আমাদের সাংবাদিক মহুয়া রায় রাতের অন্ধকারে যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে পুরুলিয়ার এক গোপন গুহায়, সেই ভিডিও আবার একবার ৷”

টিভির পর্দায় ভেসে উঠল মালভূমির পাহাড় ঘেরা অরণ্যের দৃশ্য ৷ নেপথ্যে শোনা যাচ্ছে মহয়া রায়ের কণ্ঠ :

মঃ “ বাঙালী, বিভাস ঘোষকে মনে পড়ে ? বাঙলার Fire brand লিডার কে কি বাঙালী ভুলে গেছে ? না ৷ ভুলতে পারে না ৷ বিভাস বাবুকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা অনেক হয়েছে ৷ কিন্তু বিভাস বাবু বারে বারে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আছেন আমাদের কাছেই৷ তিনি আছেন আধ্যাত্ম্যিক পুরুষ হিসেবে প্রকট হবার অপেক্ষায় ৷ বিভাস বাবু ছিলেন বাংলার ভগবান | আর ভগবান তখনই প্রকট হন যখন ভক্ত তাঁকে প্রানভরে ডাকে ৷ আমরাই বারে বারে বলেছি পরম পূজ্য বেনাম বাবাই আমাদের হারিয়ে যাওয়া বিভাস ঘোষ ৷ সেই বেনাম বাবা, যার কথা সবাই শুনেছে, শুধুই শুনেছে ৷ গোটা বাংলা অপেক্ষায় আছে এই দুঃসময় থেকে কবে বেনাম বাবা অধর্মের মাটি তে ধর্ম সংস্থাপন করতে প্রকট হবেন ৷ আমরাই  বাংলার সেই আর্তি বাবার কাছে পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি ৷”

এবার জঙ্গল মিলিয়ে গিয়ে টিভির পর্দায় ভেসে উঠল এক প্রায়ান্ধকার দৃশ্যপট ৷ স্ক্রিন জুড়ে মহুয়া রায়ের মুখ।

মঃ"বেনাম বাবাকে সমস্ত বাংলার হয়ে আমাদের প্রণাম ৷”

বিঃ “শুভমস্তু”!

উল্টোদিক থেকে উত্তর এল ৷ বিভাস ঘোষের মতোই যেন কন্ঠস্বর | ওনার কয়েকটা রেকর্ডেড ভাষন ইন্টারনেটে পাওয়া যায় ৷ সেখান থেকেই একটা আভাস পাওয়া যায় ওনার কন্ঠের ৷ কিন্তু বক্তাকে দেখা গেল না ৷

 “ কইরে ? বিভাস ঘোষ কই ?” গলায় একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল অম্বরীশ ৷

“ সবুর রাখো ৷ দেখাবেক একটু পরে ৷ " আশ্বস্ত করল সুচরিতা |

 আবার মহুয়ার কন্ঠ শোনা গেল,
 "বাবাই  যে আমাদের হারিয়ে যাওয়া নেতা বিভাস ঘোষ , সেটা বাংলার মানুষকে জানিয়ে দেবার সময় এসেছে ৷ বাঙালী জানতে চায় কেন বাবা আমাদের থেকে দূরে আছেন এতদিন ?” মহুয়ার পরের প্রশ্ন ৷

 “ বিশ্বাসে মিলায় বিভাস ৷ তর্কে বহুদুর ৷ বাংলার রাজনীতিতে অপরিপক্ক স্বার্থান্বেষীদের দাপট৷ সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ৷ ততদিন নিভৃতে প্রস্তুতি নিতে হবে।”

এবার পর্দায় ভেসে উঠল একটা মুখ ৷  আধো অন্ধকারে সাদা লম্বা দাড়ি আর গোঁফে ঢাকা একটা মুখ ৷ একেবারে একজন আধ্যাত্মিক পুরুষের মতো দেখতে ৷ নাকের নীচে থেকে মুখের প্রায় সবটাই ঢাকা | কিন্তু চোখটা একেবারে বিভাস ঘোষের মতোই ! সেই অবিকল উজ্জ্বল তেজোদীপ্ত চোখ ৷ মনে হয় বর্তমানে থেকেও ওই দৃষ্টি যেন কোন অনাগত ভবিষ্যতে নিবদ্ধ হয়ে আছে ৷

মঃ “ কিন্তু মানুষ বাবাকে প্রকাশ্যে পাবে কবে?”

বিঃ “ মহাকালের তাণ্ডব অচিরেই শেষ হবে ৷ তারপর কুজ্ঝটিকার মুক্তি |”

বেনাম বাবা বললেন ৷ অবশ্য আলো আঁধারিতে দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখের নড়াচড়া যে খুব একটা বোঝা গেল তা নয় ৷

মঃ “ বাংলার মানুষকে বাবা দুঃসময়ে কি বার্তা  দিতে চাইবেন?”

বিঃ “ যদি আমাকে বিশ্বাস কর, তাহলে সনাতনে আস্থা রাখ ৷ সনাতনই সামনে এগোনর পথ ৷”

মঃ “ আর বাংলার সরকারকে ... বিশেষতঃ মুখ্যমন্ত্রী কল্যানী দাশগুপ্ত, যিনি রাজনীতির হাতে খড়ি করেছিলেন বিভাস ঘোষ মানে আমাদের বাবার কাছে, তাঁর জন্যই বা কোন নির্দিষ্ট বার্তা থাকবে বাবার কাছ থেকে?”

বিঃ “ বিশ্বাসঘাতকদের বাংলার মানুষ ক্ষমা করবে না ৷ জয় অবশ্যম্ভাবী!”

আচমকাই ইন্টারভিউটা বন্ধ হয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেল আবার ৷ সুচরিতা অম্বরীশের দিকে তাকিয়ে দেখল বিস্ফারিত চোখে টান টান শিরদাঁড়ায় পলকহীনভাবে তখনও টিভির দিকে তাকিযে আছে সে৷ একচুমুক চাও মুখে তোলে নি ৷ অম্বরীশের কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিল সুচরিতা |

সুঃ “ কি গো? কি বুঝলে ?”

অঃ “ জানিনা ৷ কিন্তু কোথাও যেন একটা বড় গোলমাল হচ্ছে ৷”

সুঃ “ কি রকম?”

অঃ “ বুঝতে পারছি না ৷ কিন্তু কি যেন একটা ... আচ্ছা, তোদের পরিবারের সাথে তো জঙ্গল রক্ষা কমিটির কানেক্ট আছে ?”

সুঃ “ আছে তো ৷ আমার কাকাতো ওদের সব লীডারদের চেনে ৷ বিভাস ঘোষকে ওরা দেব্তার মতো মান্যি করে!”

অঃ “ জঙ্গলে থেকেও তারা বেনাম বাবার খোঁজ পেল না এতদিনে ৷ অথচ এরা পেয়ে গেল ? লোকটার এত বড় একটা আইডিওলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন হয়ে গেল ৷ দেশের কয়েকটা বিজ়নেস হাউজ়ের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আদ্যোপান্ত দিল্লী কালচারে চলা একটা দলকে লোকটা ওপেনলি এন্ডোর্স করছে, অথচ তোদের ওখানে কোন খবর নেই! ওখানে এখনও সে দেবতা! তোদের নেতারা এতোটা বোকা!”

কথাগুলো বলতে বলতে অম্বরীশের চোখের কোনটা চিক চিক করে উঠল ৷ সুচরিতার খুব খারাপ লাগছিল ৷ বুঝতে পারছে গোটা জিনিষটা অম্বরীশের খুব গূঢ় অনুভূতির কেন্দ্রে আঘাত করেছে ৷ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ৷ কিন্তু অম্বরীশ আবার বলে উঠল,  “ তাছাড়া কল্যানী দাশগুপ্তকে ওরকম একজন মানুষ এইভাবে অপমান করলেন? মহিলার না হয় হাজার দোষ আছে, কিন্তু উনিই তো ওকে ... যে থিয়োরী গুলো প্রোপাগান্ডা বলে এদ্দিন উড়িয়ে দিয়েছি সেগুলোকেই ... গোলমাল একটা আছে … কিন্তু কি?”

কথা গুলো বলতে বলতে অম্বরীশের দুহাত মাথার চুল গুলোকে আকর্ষণ করে মাথাটাকে ঝুঁকিয়ে দেয় হাঁটুর ওপর ৷ সুচরিতা উঠে পড়ে আসতে আসতে ৷ সে জানে, রিজ়দার এইরকম দৈহিক অভিব্যক্তির অর্থ হল, রিজ় প্রকাণ্ড এক চিন্তার সমুদ্রে আসতে আসতে নিজেকে তলিয়ে দিচ্ছে ৷ এই সমুদ্র মন্থন করে তুলে আনতে চাইছে তার গবেষক সত্বার অন্তর্নিহিত সত্যান্বেষীটিকে ৷

************

যা ঘটার তাই ঘটল৷ একটা ভিডিওতেই তোলপাড় হয়ে গেল শুধু রাজ্যই নয়, গোটা দেশ | Real Public তাদের ন্যাশনাল চ্যানেল গুলোতেও এটা নিয়ে স্টোরী করেছে ৷ সোস্যাল মিডিয়াতে সাক্ষাৎকারটা ভাইরাল হয়ে গেছে ৷ কমেন্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে চতুর্দিকে ৷ বিশেষতঃ সনাতন পার্টী এবং রাষ্ট্রীয় সেবকদের সমর্থকরা যুদ্ধং দেহী আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৷

রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরেও চাপ বাড়ছে এই বিষয়ে তাদের সরকারী বিবৃতি ও মতামত জানানোর ৷ সংগ্রামী  পার্টি থেকে ইতিমধ্যেই  তাদের মুখপাত্র সুনীল বিশ্বাস সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন ৷

সুনঃ “ দেখুন এই ভিডিওটির সত্যতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি ৷ আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার ৷ দেশে যখন বেকারত্ব, দারিদ্র, অনাহার, স্বাস্থ এইসব নিযে বতর্ক চলার দরকার তখন এই সব গল্প দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে ৷”

সাং: “ আপনি কি মনে করেন? এটা একটা ষড়যন্ত্র? কারণ বিভাস ঘোষকে তো আপনাদের সরকার মৃত ঘোষণা করেছিলেন , কিন্তু...”

সুনঃ “ দেখুন আমি কি মনে করি সেটা গুরুত্বপূর্ণ না ৷ আমরা সংগঠিত দল , বঙ্গজনতা পার্টীর মতো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না ৷ আমাদের দল অবশ্যই মনে করে যে এটা একটা গভীর চক্রান্ত ৷ সনাতনী আর বঙ্গজনতার মিলিত উদ্যোগ মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য ৷ আপনারা তো দেখছেন, আমরা সরকার থেকে চলে যাবার পরই বঙ্গজনতার প্রত্যক্ষ মদতে সনাতনীদের মতো বাংলার একটা প্রান্তিক শক্তি কিভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ৷ মানুষ সব দেখছেন৷ আগামী নির্বাচনে মানুষ সব বুঝিয়ে দেবেন ৷ আমরা এখনও বলছি, বিভাস ঘোষ মৃত ৷ এটাই সরকারীভাবে স্বীকৃত৷ এটাই সঠিক ৷ একজন মৃতব্যক্তিকে নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত  করা বন্ধ হোক ৷”

সাং : “আপনারা বলছেন এতে বঙ্গজনতা পার্টীর হাত আছে ৷ কিন্তু বেনাম বাবা তো কল্যানী দেবীকেও কঠোর সমালোচনা করেছেন ৷”

সুনঃ “ এই শুনুন ৷ আপনারা তো লেখা পড়া করে সাংবাদিক হয়েছেন ? এসব আজগুবি গপ্প নিয়ে কথা বলেন কি করে? প্রথমেই তো বললাম ভিডিও টার সত্যতা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে ৷ কল্যানী দেবীকে দুকথা শুনিয়ে আপনাদের বোকা বানাচ্ছে ৷ নইলে আপনারাইবা এরম বোকা বোকা প্রশ্ন করবেন কি করে? শুনুন, কল্যানী দেবীর চারিত্রিক সার্টিফিকেট -এর  জন্য এসব জাল ভিডিও -র দরকার নেই ৷ ওনার ব্যক্তিগত সততা নিয়ে আমরা আগেও প্রশ্ন তুলেছি, মানুষকে বলেছি, ভবিষ্যতেও বলব ৷”

সাং: “কিন্তু এতো নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে যে ভিত্তিও টা জাল? আপনারা কি RP BANGLA র বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবার কথা ভাবছেন? আসলে আপনাদের সরকারী সিলমোহর দেওয়া সিদ্ধান্তকেও তো ওরা চ্যালেঞ্জ করছে?”

সুনঃ “আপনাদের একবার বলেছি, মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইতে পাশে থাকাই আমাদের একমাত্র এজেন্ডা ৷ মানুষ যাদের সাথে নেই তারা মৃত মানুষের পাঁচালী  ঘাঁটুক ৷ এখন আসুন ৷ আমার মিটিং আছে ৷ নমস্কার ৷”

বঙ্গজনতা পার্টী থেকে আপাতত: ভিডিওটি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে একটা বিবৃতি দেওয়া হয়েছে ৷ বলা হয়েছে যে পার্টী এই বিষয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে তারপর প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলন করবে ৷ তার আগে দলের পক্ষ থেকে কেউই বিবৃতি দেবেন না ৷ যদি  কেউ কিছু বলেন তবে সেটা যেন দলের স্বীকৃত বক্তব্য হিসেবে ধরা না হয় ৷ বাস্তবিকই বিষয়টা নিয়ে তারা বেশ চাপে আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে ৷

অন্যদিকে সনাতন পার্টীর রাজ্য সদর দপ্তরে সাজো সাজো রব ৷  স্বয়ং ওম ঝুনঝুনওয়ালা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দিল্লী থেকে উড়ে এসেছেন ৷ ষোড়শপচারে এলাহী আয়োজন করে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়েছে ৷ বিরাট হলঘরে ডায়াসের মাঝখানে সপার্ষদ বসে আছেন “ওমজী” ৷ দলের কর্মী সমর্থকরা এই নামেই ডাকে ঝুনঝুনওয়ালা সাহেবকে৷ বিশাল চেহারায় কেকের ওপর চেরীর মতোই টাকটা চককে করছে ৷ আজ যেন একটু বেশীই চকচকে লাগছে ৷ রাজনীতির কুস্তিতে বিপক্ষকে নক আউট করার তুরীয় আনন্দ ঠিকরে বেরোচ্ছে যেন ৷

“  বিভাস বাবু কে সাথ ভলেহি শুরু শুরু মে হামারি পার্টি সে বৈচারিক মতভেদে থী লেকিন উয়ো এক সচ্চে দেশ প্রেমী থে ৷” সাংবাদিকদের বলে চলেছেন ওমজী |

“ভারতকি পরম্পরা, সনাতন ধর্ম কি গরিমা উয়ো মানতে থে৷ ইসি লিয়ে যব কোই উনকে সাথ নেহি থে, যব সরকারেঁ উনকে যেয়সে বংগাল কে সুপুত কো এক শব বানানে মে জুটি হুই থি তব সির্ফ সনাতন জাগৃতি পার্টি হি উনকে লিয়ে আঁসু বহায়ি আউর উনকো উনকা সম্মান লউটানে কি ঠান লি থি৷ আজকা ভিডিও ইসিকা এক খুলাসা হ্যায়৷ হালাকি হামারি পার্টি নে অভিভি ইস ভিডিও কি সচ্চাই যাঁচ নেহি কি হ্যায়, লেকিন হাম বধাই দেতে হ্যায় RP BANGLA চ্যানেল কো৷ লম্বে অরসে সে ছুপি এক সত্য কো উনহোনে উজাগর করনে কি যো কোশিস আজ কিয়ে হ্যাঁয় , ইসসে আনে বালে দিনমে বহত আচ্ছে আচ্ছো কি পোল খুলনে বালি হ্যায় ৷”

“ তাহলে আপনারা বলছেন যে বিভাসবাবু জীবিত এবং বেনাম বাবাই তিনি? এটাই কি আপনাদের পার্টীর স্ট্যান্ড?" সাংবাদিক প্রশ্ন করে ৷

"আপনে দেখি হ্যায় ভিডিও ?” পাল্টা প্রশ্ন ওমজীর ৷ সাংবাদিক সম্মতি জানায় ৷ ওমজী সোৎসাহে বলে ওঠেন, “ তো শ্ৰীমান পার্টি ছোড়িয়ে, আপকি রায় ক্যায়া হ্যায় বতাইয়ে তো ৷”

কেউ কোন কথা বলে না ৷ মিটি মিটি হেসে ঘরের চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে আবার শুরু করেন ওমজী,
“ দেখো পার্টী তো কোই বহারী দুনিয়া সে হ্যায় নেহী ৷ পার্টী পাব্লিকসে বনি হ্যায়, পাব্লিককে লিয়ে হ্যায় ৷ হম গণতন্ত্র পে ভরোসা রখতে হ্যায় ৷ পার্টীকি স্ট্যান্ড পাব্লিক কি স্ট্যান্ডসে অলগ নেহি হো সক্তি | লেকিন ইয়ে হাম জরুর আশ্বস্ত করনা চাহেঙ্গে কি বংগালমে হামারী নয়ী সরকার বননে কে বাদ ইস বিষয় পর হাম পুরি ইমানদারী সে তহকীকাত শুরু করেঙ্গে আউর বিভাস বাবুকো ন্যায় দিলায়েঙ্গে৷”

সাং: “ বেনাম বাবাকে আপনারা কি কলকাতায় আনার কথা ভাবছেন?”

ওঃ “ দেখিয়ে একতো হমে ইয়হ পতা নহী হ্যায় কি ইস ভিডিও জিস কালখণ্ড মে রেকর্ড কিয়া গয়া হ্যায় উসকে বাদসে কিতনে দিন গুজ়র  চুকে হ্যাঁয় ? বাবাকি স্থিতি কয়া হ্যায় ? উপরসে উয়ো এক দিব্য পুরুষ হ্যায় ৷ জনতাকে সমক্ষ আনা ইয়া না আনা, ইয়ে সম্পূর্ণ রূপসে উনপে নির্ভর করতা হ্যায় ৷”

সাং: “ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বেনাম বাবা বিশ্বাসঘাতক বলেছেন ৷ এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?”

ওঃ “ইসপে হম কয়া টিপ্পনী দে ? সভিকো পতা হ্যায় কি কল্যানী দেবী নে বিভাস বাবু কো রাজনীতিমে কদম রাখনে কি এক সিঁড়িকে তরহা ইস্তেমাল কিয়া ৷ যব উনকি জ়রুরত পুরি হো গয়ী তো বাকীও কে জ্যায়সা কল্যানী দেবীভি মুহ মোড় লিয়ে ৷ উপরসে বিভাস বাবুনে যো সুনেহরা বাঙ্গালকি সপ্না দেখতে হুয়ে আপনি রাজনীতিক ভবিষ্যকা বলিদান দিয়া , উস বাঙ্গালকা  কেয়া হাল বানায়া উনহোনে ? স্থিতিতো অভি সংগ্রামী পার্টীকে জ়মানে সে ভি খরাব হ্যায় ৷ উপরসে সনাতন ধরমকো পুছনে বালা ভি কোই  নেহি ইঁহা | মুখ্যমন্ত্রীতো কিসি এক বর্গকি মনোরঞ্জন কে লিয়ে হি পুরা দম লাগা রহি হ্যায় ৷ ইয়ে বংগালকে সাথ, খাস তৌড়পে যো লোগ বাটওয়ারে কে সময় আপনি জান বাঁচাতে হুয়ে ইধর আকে বসে থে , উন লোগোঁকে সাথ বিশ্বাসঘাত নেহী হ্যায় তো আউর কয়া হ্যায় ৷ চলিয়ে, আজ কে লিয়ে বস ইতনাহি ৷ আগে সে য্যায়সে  য্যায়সে ঘটনা ঘটতি রহেগী, হামারে কারিয়কর্তা আপকো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে রহেঙ্গে৷ জয় বজরঙ্গবলী ৷”

**********

সচিবালয়ে একা নিজের চেম্বারে ফাইল দেখছেন মূখ্যমন্ত্রী কল্যানী দাশগুপ্ত৷ আজ সচিবালয়ে বেশ থমথমে পরিবেশ৷ ম্যাডামের মুড কেমন  থাকতে পারে তাই নিয়ে আমলা থেকে শুরু করে অধঃস্তন কর্মচারী সকলেই বেশ চাপে আছে ৷ দরজায় ঠক ঠক ঠক করে তিনবার শব্দ হল ৷

“এস আবিদ”, ফাইল থেকে মুখ না তুলেই  বললেন কল্যানী, হাতের ইশারায় বসতে বললেন৷ একমাত্র আবিদেরই এইভাবে দরজার টোকা দিয়ে ঘরে ঢোকার অনুমতি আছে ৷ আবিদের দরজায় টোকা মারার একটা নির্দিষ্ট চেনা ছন্দ আছে। আবিদ ওনার ব্যক্তিগত সহকারী ৷ কল্যানী দেবীর রাজনৈতিক জীবনের বহু দুঃসময়ে আবিদ নিরবে তাঁর পাশে থেকে কাজ করে গেছে নিঃশর্ত আনুগত্যে ৷ মুখ্যমন্ত্রী হবার পর বিশেষ ক্ষমতা বলে আবিদকে তিনি তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেছেন ৷
আবিদ চুপ করে বসে থাকে ৷ অপেক্ষায় থাকে, কখন কল্যানীদেবী ফাইল থেকে ফুরসত পাবেন ৷

“ বলো আবিদ | আমি শুনছি ৷” ফাইল দেখতে দেখতেই বলেন কল্যানী ৷

“কর্মীরা খুব অর্ধৈর্য হয়ে উঠছে ম্যাডাম ৷ আপনার নির্দেশ ছাড়া অন্যান্য নেতৃত্বও মুখ খুলতে পারছে না ৷ এদিকে বিরোধীরা তুলকালাম বাধিয়ে দিচ্ছে ৷ বিধানসভা খুললেই এটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ৷ সংবাদমাধ্যমেও নানা রকম ভাবে খবর পরিবেশন করা হচ্ছে ৷ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পরিস্থিতি খুব খারাপ দিকে এগোতে শুরু করেছে ৷ এমনকি ভেতরের খবর, যে কিছু কিছু নেতাও তাঁদের নিজস্ব লবিতে আপনার বিরুদ্ধে বেসুরো কথা বার্তা বলতে শুরু করেছে৷ আপনি যেহেতু কোন বিবৃতি দেননি, তাই সাধারণ কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও বিভ্রান্তি বাড়ছে ৷ আর বোধ হয় চুপ করে থাকাটা ঠিক হবে না ৷”

ফাইল থেকে চোখ তুলে চশমাটা টেবিলে খুলে রেখে কল্যাণী দাশগুপ্ত তাকালেন আবিদের দিকে ৷ স্থির দৃষ্টি৷ দেখে বুঝবার উপায় নেই মনের ভেতর কি চলছে ৷

কঃ “ তোমার কি মনে হয় আবিদ ?”

আঃ “ কি বিষয়ে ম্যাডাম?”

একটু ঘাবড়ে গিয়েই প্রতিপ্রশ্ন করে আবিদ |

কঃ “ এই ভিডিওটা ৷ বিভাসদার এই চেহারা ৷ বিভাসদার মুখ দিয়ে বেরোন কথা গুলো ৷ এই পুরো ব্যাপারটা ৷ বিশ্বাস কর তুমি ?”

আঃ “ না ম্যাডাম ৷”

দৃঢ়ভাবে উত্তর দেয় আবিদ | চোখদুটো বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপ করে থেকে বলে উঠলেন কল্যানী ৷

কঃ “ কেন?”

আঃ “ ম্যাডাম, নানাজান যেদিন বুঝেছিলেন মুসলিম ইউনিটি সেন্টারে উর্দুভাষী নেতারা বাংলাকে পিষে দেবার ষড়যন্ত্র করছে, সেদিন কিন্তু বিভাস বাবুর মতো তরুণ নেতাদের দেখেই ভরসা করে জাতীয়তা বাদী গণমঞ্চে ফিরে আসেন৷ শুনেছি আব্বুকে নানাজান বলতেন, ‘গোটা বাংলায় যদি সাচ্চা অসাম্প্রদায়িক কেউ থাকে, তো সেটা একমাত্র বিভাস৷ বিভাস একদিন বাংলার সব মানুষের কলিজার টুকরা হবে ৷’ জান থাকতে বিশ্বাস করতে পারব না , বিভাস ঘোষ এইসব কথা বলতে পারেন ৷ আর আপনাকে এই সব বলা ...  তবা!তবা !”

আবিদের ঠাকুর্দা একসময়ে ভারতের জাতীয়তাবাদী গণমঞ্চে যোগ দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ৷ পরবর্তীকালে যখন ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতে মুসলিমদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্নে বড়সড় বিভেদ শুরু হল তখন আরও অনেক মুসলিম  রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে সঙ্গে তিনিও মুসলিম ইউনিটি সেন্টারে যোগ দেন ৷ তখন মুসলিম ইউনিটি সেন্টার ভারতের মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একবগ্গা সম্প্রদায়িক স্বার্থ ভিত্তিক এজেন্ডা নিয়ে দেশ জুড়ে উথাল পাথাল শুরু করেছে ৷ জাতীয়তাবদী গণমঞ্চ আসলে বৃহত্তর হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায় এমনটাই সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছে ৷ অন্যদিকে আবার রাষ্ট্রীয় সেবা সংঘ গণমঞ্চকে মুসলিমদের নরম মনোভাব পোষণ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে কট্টর সনাতন ধর্মভিত্তিক ভারতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে৷ এই যুগপৎ চাপ, সেই সঙ্গে র্দীঘদিন ধরে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শাসন ক্ষমতা দখলের দরকষাকষি - সব মিলিয়ে গণমঞ্চের বৃদ্ধ নেতৃত্ব তখন দিশাহারা , ক্লান্ত | কিন্তু অচিরেই আবিদের ঠাকুর্দা সহ আরও কয়েকজনের সাথে মুসলিম ইউনিটির অবঙালী উর্দুভাষী নেতৃত্বের বিরোধ শুরু হয় ৷ আবিদের ঠার্কুদাদের সন্দেহ হয়, মুসলিমদের জন্য আলাদা শাসনব্যবস্থার আড়ালে আসলে বাংলার ওপর উর্দুভাষীদের একটা গোষ্ঠী আসলে ব্যবসায়িক আধিপত্য কায়েমের ছক কষছে | যখন বাংলার বিভাজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল, তখন তাঁরা কয়েকজন পুনরায় গণমঞ্চে যোগ দেন এবং এদেশেই থেকে যান ৷ যদিও তাতে মুসলিম ইউনিটির ধার ও ভার কমে নি ৷ সেই থেকে পারিবারিকভাবে ওনারা গণমঞ্চের সাথেই ছিলেন ৷ কিন্তু, কল্যানী দেবী যখন দলের তরুণ ব্রিগেডকে নিয়ে নতুন দল তৈরীর আহ্বান দিলেন, তখন আবিদ সেই শুরুর দিন থেকেই কল্যানী দেবীর অনুগত সৈনিক।

আবিদের কথাগুলো শুনে মৃদু হাসলেন কল্যানী ৷ বললেন, “ সবই তো বুঝলাম আবিদ ! তোমার নানাজানের political analysis -এর প্রশংসা বিভাসদার কাছে অনেক শুনেছি ৷  উর্দু আগ্রাসন নিয়ে তোমার নানাজান যে আশঙ্কা করেছিলেন, তাই তো সত্যি হল ! আবার যখন উনি গণমঞ্চ ছেড়ে মুসলিম ইউনিটি গেছিলেন তখন হয়তো ওনার রাজনীতি ভুল ছিল ৷ কিন্তু উনি ভয় পেয়েছিলেন যে গণমঞ্চের নেতৃত্ব সেবা সংঘকে স্বাধীন ভারতে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবে না ৷ সেটাও তো ঠিক ৷ যদি পারত, তাহলে হয়তো আজ এই মুহূর্তে আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতাম৷ বিভাসদাকে নিয়েও ওনার analysis অভ্রান্ত ৷ কিন্তু মানুষ এত কিছু বুঝবে না ৷ আসলে কি জান অবিদ, সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ে তালিয়ে ভাবে না ৷ আবেগ আর perception – এ চলে ৷ বিভাস দা কে নিয়ে কটা intellectual discussion শুনেছ এত বছরে? অথচ খোঁজ নিয়ে দেখ , সবার মধ্যে  একটা সেন্টিমেন্ট কাজ করছে ৷”

আঃ “ ঠিক ম্যাডাম ৷ সংগ্রামী পার্টি বিভাস ঘোষকে নিয়ে আলোচনার পরিবেশ যতই সঙ্কুচিত করেছে, পপুলার  সেন্টিমেন্ট ততই  গেঁড়ে বসেছে সমাজের মনে ৷ আর সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে সনাতন পার্টী ৷ পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে অন্য চ্যানেল গুলোও TRP ধরে রাখতে প্রাইম টাইমে এটা নিয়েই অনুষ্ঠান করতে বাধ্য হচ্ছে ৷”

কঃ “RP BANGLA সত্যিই তাহলে বাংলা খবরের জগতে এক ট্রেণ্ড সেটার হয়ে গেল !”
বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন কল্যানী ৷ আবিদ রেগে বলল,

আঃ “ খোদার গজব নামবে ওদের ওপর। জালিয়াতি করেছে ৷”

কঃ “ চুপ কর ৷ হাওয়ায় কথা বোলো না ৷ মিথ্যেটা প্রমাণ করতে পারবে ?”

কল্যানী প্রশাসক সুলভ ঝাঁঝে কথা গুলো বলেন ৷ আবিদ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে । তার কাছে সত্যিই তো এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই! কল্যানী নির্দেশ দেবার ঢঙে বলে ওঠেন,
“ আজ রাতে আমার কাছ থেকে একটা স্টেটমেন্ট নিযে শুভ্রা বক্সীকে দিয়ে দিও ৷ বোলো ওর পাটী জেনারেল সেক্রেটারীর প্যাডে ওইটা যেন সমস্ত মিডিয়া হাউস গুলোকে  সার্কুলেট করে, পার্টির অফিসিয়াল সোস্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলেও যেন ওইটাই যায় ৷ পার্টীকর্মীরা যেন ওইটাই শেয়ার করে ৷ পার্টীকর্মীরা যেন এই ভিডিও ফিডিও তে ফোকাস না করে বেশী ৷ কোন প্রেস মিট করার দরকার নেই ৷ লেট দ্য অপোজিশন প্লে অন দেয়ার ওন ফিল্ড | আমি ইমিডিয়েটলি চিফ সেক্রেটারী কে একটা নোট দেব ৷ পুরো জঙ্গল মহল জুড়ে  "প্রান্তিক উৎসব" শুরু হবে ৷ সরকারী কর্মীরা প্রতিটা গ্রামপঞ্চায়েতে গিয়ে মানুষকে সরকারী প্রকল্প সম্বন্ধে জানাবেন ৷ তাঁদের অভাব অভিযোগ শুনবেন ৷ আগামী রবিবার থেকে টানা এক সপ্তাহ চলবে ৷ ম্যাক্সিমাম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ক্যাবিনেট ওখানেই থাকবে৷ আমিও থাকব ৷ ইমিডিয়েটলি টিভি চ্যানেলগুলোতে এই মর্মে সরকারী বিজ্ঞাপনের স্লট বুক করতে বলে দিচ্ছি তথ্য দপ্তরের সেক্রেটারীকে ৷ তুমি শুভ্রাকে বলো পার্টী যেন রাজ্য জুড়ে প্রতিটা ইউনিটে এইটা নিয়ে প্রচার শুরু করে ৷ শুভ্রা যেন নিজের দায়িত্বে জঙ্গল রক্ষা কমিটির সাথে পুরো ব্যাপারটা কোঅর্ডিনেট করে ৷ ওদের পাশে নিয়েই সমস্ত কাজ করতে হবে। জঙ্গলমহালে  পার্টির প্রতিটা ইউনিট যেন স্থানীয় লিডারদের মারফত প্রশাসনের সাথে কো অর্ডিনেট করে। কোন জায়গা থেকে কোন রকম বেয়াদপির খবর পেলে আমি কিন্তু বরদাস্ত করব না ৷”

এইটুকু বলে থামলেন কল্যানী ৷ আবিদের মুখের দুশ্চিন্তার মেঘ অনেকটা সরে গেছে ৷ সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কল্যানীর দিকে ৷ সমস্ত নির্দেশের পেছনে আসলে বিরোধীদের সর্বাত্মক আক্রমনের মুখ থেকে সরে এসে  পাল্টা প্রশাসনিক চালে বিপক্ষের ডিফেন্স ভেঙে দেবার একটা সুদুর প্রসারী ছক আছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না আবিদের৷ মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রায় গোটা প্রশাসন যদি গরীব মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে যায় , তাহলে মিডিয়া বাধ্য হবে এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ৷

কঃ “ আর কেউ যেন আমাকে ফোন করে বিরক্ত না করে ৷ হয়তো সারারাত আমি অফিসেই থাকব ৷ আমাকে একটু একা থাকতে দেয় যেন সবাই ৷”

শেষের কথা গুলোয় যেন একটু চাপা কষ্ট মিশে আছে মনে হল আবিদের ৷ ধীরে ধীরে বলল , " ঠিক আছে ম্যাডাম কোন চিন্তা করবেন না ৷ সব হয়ে যাবে ৷ আমি তাহলে আসি ৷”

“ শোন৷” আবিদ উঠতে যাওয়ার মুহূর্তে বললেন কল্যানী ৷ গলায় আবার প্রশাসকের ভাবলেশহীন কাঠিন্য ৷ “মহুয়া বলে মেয়েটাকে ক্লোজ করার চেষ্টা কর ৷ খুব সাবধানে ৷ অম্লান শুদ্ধু RP BANGLA র পুরো টিমটাই প্রাক্টিকালি সনাতন পার্টীর সেন্ট্রাল মেশিনারী আর সেন্ট্রাল মিনিস্ট্রির প্রোটেকশনে আছে ৷ কোন ক্যালাস কাজ হলেই কিন্তু এটা নিয়ে ওরা বিরাট হৈ চৈ করবে। সেন্টার থেকে গবর্মেন্ট লেভেলেও একটা কেওস তৈরী করতে পারে ৷ ভেরি কেয়ারফুল৷”

আঃ “ আপনি বলবার আগেই আমি আমার টীম দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম ম্যাডাম ৷  কিন্তু ভিডিও টা টেলিকাস্ট হবার আগের রাতেই মহয়াকে দিল্লীতে কোন একটা আ্যসাইমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৷ তবে শুনলাম রিসেন্টলি নাকি ওর সাথে চ্যানেলের একটা বড় ঝামেলা হয়েছে ৷”

কঃ “ হুম | ঠিক আছে ৷ মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে জুনিয়ার লেভেলে অনেকের সাথেই তো তোমার ব্যক্তিগত কানেক্ট আছে ৷ একদম গ্রাউন্ড লেভেলে যারা রিপোর্টিং করে সেরকম ছেলে মেয়েদের সাথে একটু কালচার করতে শুরু কর তোমার নেটওয়ার্ক দিয়ে ৷ প্রিটেন্ড টুবি ক্যাসুয়াল এন্ড বি সাইলেন্ট ইন ইওর এপ্রোচ |”

আবিদ চলে যাবার পর কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা হেলিয়ে ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন কল্যানী ৷ সাধারন একটা গরীব উদ্বাস্তু পরিবার থেকে মুখ্যমন্ত্রীত্বের এক অবিশ্বাস্য সফর শেষ করেও জীবন জুড়ে শুধুই একটা শূন্যতা| সংগ্রামী পার্টির মতো একটা সংঘবদ্ধ শক্তির দীর্ঘ শাসনের অবসান যে তাঁর মাধ্যমে হতে পারে এটা তাঁর অতি বড় সমর্থকও যেন বিশ্বাস করতে পারে না আজও ৷ কিন্তু এ যেন কাঁটার সিংহাসন ! দলের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই ৷ প্রশাসনে অনেকটাই সংগ্রামী পার্টির সংগঠন গুলোর দাপট৷ দলের একান্ত বিশ্বস্ত কিছু কর্মী আর সরকারের বিশ্বস্ত কয়েকজন আধিকারিকদের নিয়ে একটা টিম বানিয়ে সরকারটা চালাচ্ছেন ৷ এরই মধ্যে দলের বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিরোধীরা বিধানসভা তোলপাড় করেছে কয়েকবার ৷ নিজের দলের সংগঠন ঢিলেঢালা ৷ বিরোধীরা শতগুনে সংগঠিত | তবে ওনার মূল শক্তি রাজ্যের প্রান্তিক স্তরের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলিতে ওনার অসীম জনপ্রিয়তা | বিরোধী প্রচারের মধ্যেও সেই জনপ্রিয়তা অটুট আছে কিনা সেটা বাস্তবের মাটিতে যাচাই করার জন্যই প্রান্তিক উৎসবের চালটা উনি খেলেছেন ৷

কিন্তু সনাতন পার্টী একটা নতুন  বিপদ  হিসেবে দেখা দিয়েছে ৷ কয়েক বছর ধরে এদের আগ্রাসী আক্রমণে  অনেক রাজ্যেই বিরোধী পক্ষ ধরাশায়ী ৷  যখন থেকে কল্যানী দাশগুপ্ত প্রধান বিরোধী নেত্রী হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন তখন থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে যে সমস্ত রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছিল, তার মধ্যে একটা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রহনন ৷ বিশেষতঃ, নিরুদ্দিষ্ট বিভাস ঘোষের সাথে কল্যানীর সম্পর্ক নিয়ে নানারকম মুচমুচে কাহিনী হুইস্পারিং ক্যাম্পেনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হত ৷ কিন্তু আজ যেটা হল সেটা তাঁর কল্পনার অতীত ৷ এইভাবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে অপদস্থ করার চেষ্টা আগে হয় নি ৷ সংগ্রামী পার্টির এটাতে কোন হাত আছে বলে মনে হয় না ৷ যদিও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সুযোগ তারা ছাড়বে কেন? এটা সনাতন পার্টীর একটা অংশের কারসাজী হতে পারে ৷ কিন্তু, বিভাসদার এই বৃদ্ধ বয়সের সাক্ষাৎকার কি ভাবে সম্ভব? ওপরে যতই কঠিন আবরণ থাকুক, বেশ বুঝতে পারছেন, ভেতরে ভেতরে যেন আস্তে আস্তে কুঁকড়ে যাচ্ছেন৷ হৃদয়ের সবথেকে দুর্বল প্রকোষ্ঠে যেন একটা কার্পেট বোম্বিং হয়ে গেছে ৷

ভাবতে ভাবতে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসতে আসতে গিয়ে দাঁড়ালেন বিরাট কাঁচের জানলার সামনে ৷ শহরটা বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় এখান থেকে ৷ শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে থাকলে কল্যানী ৷ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে৷ জল ছবি হয়ে প্রায় পাঁচ দশক আগের ঘটনা গুলো যেন ভেসে বেড়াচ্ছে , অতীতের কুশীলবরা ছায়ামূর্তির মতো জীবন্ত হয়ে উঠছে !

**********

শহীদ মিনারের নীচে বিরাট জনসভা হচ্ছে ৷ দূরদূরান্ত থেকে মিটিং-এ নানা বর্নের ধর্মের মানুষ এসেছে ৷ মূলতঃ এসেছে নানান আদিবাসী সম্প্রদায়, নমশূদ্র এবং উদ্বাস্তুসংগঠন গুলোর থেকে ৷ সভাস্থল ঘিরে ভীড় করে রয়েছে পথচলতি মানুষ ৷ সভা আহ্বান করেছেন বিভাস ঘোষ | গণমঞ্চের নবীন প্রজন্মের সবথেকে সম্ভাবনাময় নেতা | স্বাধীনতার সাথে সাথে বাংলা বিভাজনের পর গণমঞ্চই  বিভক্ত  বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করেছিল গণমঞ্চ৷ গণমঞ্চের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ধীমান রায় যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন তাঁর মতন করে ভেঙে পড়া অর্থনীতি , বিরামহীন উদ্বাস্তুর চাপ এসব সামলিয়ে একটা উত্তরণের পথ খোঁজার | কিন্তু, কোথাও একটা বড় গলদ থেকে যাচ্ছে ৷ ক্রমশঃই বিক্ষোভ বাড়ছে ৷ রাজ্যে সম্পদ সৃষ্টি হলেও অর্থনৈতিক অসাম্য বেড়েই চলেছে ৷ মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগাতে প্রবল ভাবে নেমে পড়েছে সংগ্রামী পার্টী ৷ তারাই এখন প্রধান বিরোধী পক্ষ৷ ধীমান রায়েরও বয়স বাড়ছে ৷ ওদিকে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, দিশাহীন নেতৃত্ব এই সবের মধ্যে থেকে চরমপন্থী কিছু দল মাথা চাড়া দিচ্ছে ৷ প্রচুর মেধাবী ছাত্র সেই সমস্ত দলে যোগ দিয়ে  জায়গায় জায়গায় হিংসাত্মক কাজকর্ম শুরু করছে, কোথাও কোথাও নিরপরাধ মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদের হাতে পুলিশ খুন হচ্ছে। পুলিশের এনকাউন্ন্টারে মারা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র৷ চারিদিকে অরাজকতা আর অবিশ্বাস ৷ কিন্তু তারই মধ্যে ব্যতিক্রমী চরিত্র হয়ে উঠে এসেছে তরুণ বিভাস | এত অবিশ্বাসের মধ্যেও তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বে দলমত নির্বেশেষে মানুষের বিশ্বাসকে আকর্ষণ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার ব্যক্তিত্বে৷ ধীমান রায়ের অত্যান্ত স্নেহভাজন ছিল সে ৷ কিন্তু নীতিগত প্রশ্নে ক্রমেই দুরত্ব বাড়ছে ৷ বরং বাংলার নবীন প্রজন্মের কাছে তার সমর্থন উত্তরোত্তর বাড়ছে ৷ আর তার ব্যক্তিগত বিপুল জনভিত্তি তৈরী হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ৷ সে যেন গণমঞ্চের বিশাল সংগঠনের মধ্যে থেকেও পৃথক তার স্বতন্ত্র   উজ্জ্বল অস্তিত্বে৷ স্বাভাবিক ভাবেই দলের মধ্যে তার প্রচুর শত্রু। স্বয়ং ধীমান রায়ও ইদানিং বিরক্ত তার পার্টীলাইন অস্বীকার করে স্বাধীন মত প্রতিষ্ঠা করার  মনোভাবের জন্য ৷ ওদিকে বিরোধী দল গুলো বিভাসের মধ্যে অশনি সঙ্কেত দেখছে ৷ বিভাসের গ্রহণযোগ্যতা প্রান্তজন এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যে যে ভাবে বাড়ছে তাতে করে তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিভাস বুঝতে পারছে, রাজনীতির পেশাদারদের মঞ্চে সে ক্রমেই এক কমন এনিমি হয়ে যাচ্ছে ৷ একমাত্র ভরসা তার নবীন ব্রিগেড৷ দল তার মত অনুযায়ী চলতে চাইলে ভালো, অন্যথায় সে নিজের পথ একাই চলবে ৷

 “ আমার লাল মাটির বাবা সকল , বাংলার মায়েরা আমার, বাংলার ভায়েরা আমার, মনে রেখো, এই দেশের স্বাধীনতা ততদিন   সত্য হবে না যতদিন না আমার বাংলার মানুষ তার নিজের মাটির সম্পদ নিজের ভবিষ্যত গড়ে তোলার কাজে, এই বাংলা গড়ে তোলার কাজে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে ৷” মঞ্চ থেকে ভাষণ দিচ্ছে বিভাস ৷ তাকে ঘিরে রয়েছে তরুণ প্রজন্মের কর্মীরা৷ বিভাসের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী কল্যানী দাশগুপ্ত৷ ওদের পরিবার যখন উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতা চলে আসে, তখন কল্যানীর মা গর্ভবতী৷ ওর জন্ম এখানেই , টালিগঞ্জের এক বস্তিতে ৷  সর্বাঙ্গে দারিদ্রের থাবা, কিন্তু প্রচন্ড জেদী আর কর্মঠ ৷ স্কুলের একটা কোন অনুষ্ঠানে বিভাসের জহুরীর চোখে ও নজরে পড়ে যায় ৷ বিভাসের হাতেই কল্যানীর হাতেখড়ি রাজনীতির মঞ্চে ৷ তারপর নিজগুনে সে বিভাসের একান্ত বিশ্বাসভাজন কর্মী৷

বিভাস বলে চলে, “ বাংলার সম্পদের ভাগ তোমরা পাওনা ৷ কিছু বেনিয়াদের মদতে বাংলার সম্পদের লাভ চলে যাচ্ছে বাংলার বাইরে ৷ আগামী দিনে আরও বড় আঘাত আসছে ৷ ওরা একে একে তোমাদের জল - জঙ্গল - জমিন সব কেড়ে নিতে তৈরী হচ্ছে ৷ যারা ওপারের মাটি ছেড়ে এপারে এসেছে সেই বাঙালী ভাই বোনদের এই মাটির সম্পদের ওপর অধিকার কি কেউ নিশ্চিত করেছে? না ৷ তোমরা জানো আমি কাদের কথা বলছি ৷ কারা তোমাদের মাটিতে তোমাদেরই অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, কারা তাদের মদত দিচ্ছে ৷ তাই বলি তোমাদের জল -জঙ্গল -জমিনের দখল ছাড়বে না ৷ বাংলার মাটিকে আগলে রাখো – বিক্রি হতে দিও না ৷”

ভিড়ের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠল, “বাঙালীর জোশ / বিভাস ঘোষ ৷”

হঠাত বিকট একটা শব্দ হল ৷ মঞ্চের থেকে একটু দূরে পুলিশ পিকেট ছিল ৷ ঠিক তার সামনে একটা বোম পড়েছে ৷ মঞ্চের ওপরের লোকেরা কিছু বোঝার আগেই আবার পরপর দুটো বোম পড়ল৷ একটা পড়ল একদম মঞ্চের সামনে ৷ বোমার দমকে ছিটকে পড়ল কল্যানী ৷ ইতিমধ্যে পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করে দিয়েছে৷ জনতা ছত্রভঙ্গ ৷ তুমুল বিশৃঙ্খলা ৷ আধোঅচেতন অবস্থায় কল্যানী শুনতে পেল  কেউ একজন প্রাণপনে মাইকে চিৎকার করে জনতাকে শান্ত হতে বলছে, পুলিশকে সংযত হতে অনুরোধ করছে ৷ একটু পরে সব চুপচাপ ৷ কল্যানী আচ্ছন্ন অবস্থায় মাথাটা তুলে বিভাসদাকে খুঁজতে চেষ্টা করল ৷ ধোঁয়ার কুণ্ডলি  ভেদ করে দেখতে পেল বিভাসদাকে কলার ধরে পুলিশ প্রিজন ভ্যানে তুলছে ৷

পরদিন সকালে জামিন হল বিভাসের ৷  থানার বড়বাবু নিজেই এসে জানালেন যে জেল থেকে বেরিয়েই বিভাসকে ধীমান রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে। ওপরতলা থেকে নির্দেষ ৷ বড়বাবু নিজেই গাড়ী চালিয়ে পৌছে দেবেন বিধানসভায় ৷ মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী নেতা সকলেই নিজ নিজ চেম্বারে রয়েছেন ৷

“ কি ব্যাপার বিভাস ?  তুমি নাকি শেষ অব্দি ওই চরমপন্থী বখাটে ছোঁড়া গুলোর দলে ভিড়েছ? শাসক দলে থেকেও তোমার সভা থেকে পুলিশকে বোম মারতে প্ররোচনা দিয়েছ ? এটা কি তোমার মতিভ্রম না ঔদ্ধত্য?” চুরুটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে কথা গুলো বললেন ধীমান রায় ৷ বাংলার অবিসংবাদী মুখ্যমন্ত্রী ৷ টেবিলের উল্টো দিকে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিভাস ৷ টেবিলের একপাশে বসে আছেন সংগ্রামী পার্টির তথা বিধান সভায় বিরোধী বেঞ্চের নেতা যতীন বসু৷ ধীমান বাবু যতীনকে খুব স্নেহ করেন ৷ দুজনের রাজনীতি আলাদা হলেও নিবিড় পারিবারিক সম্পর্ক আছে। বিধান সভাতেও তাই বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ধীমান বাবুর থেকে একটু আধটু প্রশ্রয় আদায় করে নেন যতীন ৷ বিধানসভার অলিন্দে কান পাতলে ইদানিং কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে ধীমান রায় প্রচ্ছন্নভাবে যতীনকেই তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে তৈরী করে যেতে চাইছেন ; হলই বা বিরোধী দল | অবশ্য এক্ষেত্রে যতীনের পারিবারিক অভিজাত্য , পাশ্চাত্যের ডিগ্রি, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভাসমিতিতে নিয়মিত যোগদান এইসবই সহায়ক হয়েছে ৷ সংগ্রামী পার্টি শ্রমিক, কৃষক, দরিদ্র মানুষের প্রতিনিধিত্ব দাবী করে ৷ কিন্তু সেখানেও যতীন তাঁর অভিজাত্যের দ্যুতিতে রীতিমত জমিদার সুলভ একটা অবস্থান রেখেছেন ৷ উল্টোদিকে বিভাসের কোন রকম আভিজাত্যের সুযোগই নেই ৷

“ জঙ্গলের মানুষ এখনও বোমা বন্দুক চেনে না স্যার ৷ যদি মারতেই হতো ওরা তীর মারত ৷ লুকিয়ে নয়, সরাসরি | আমার মিটিং থেকে প্রশাসনকে আক্রমণ করতে বলা হয়েছে এই মিথ্যাটা কে বলল আপনাকে ?” দৃঢ়ভাবে বলে বিভাস ৷

ধীঃ “ বলবার কি আছে? Do you think my police force is fool? It is clear from the police report.”

বিঃ “ওটা মিটিং-এর ভিড়ে লুকিয়ে থাকা আপনার পোষা লুম্পেন দের কাজ ৷ মিটিং-এ যা হয়েছে, সেটা একটা ষড়যন্ত্র ৷”

ধীঃ “ ষড়যন্ত্র ! তোমার ধারনা আছে তুমি কি বলছ? Even যতীন পর্যন্ত ওর পার্টিকে civilized responsible opposition বানিয়ে ফেলেছে, and you are sounding like those extremist বখাটে ছোঁড়ার দল !”

ধীমান রায়কে সমর্থনের সুরে যতীন বলে ওঠেন, “ Exactly. দেখুন বিভাস, আমরা কিন্তু police force কে যথেষ্ট  sympathize করি ৷ Infact আমরা মনে করি, they are also victim of exploitation by the state. ওরাও রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণের স্বীকার !”

বিভাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যতীনের দিকে তাকিয়ে বলে, “ যতীন বাবু, চরমপন্থীদের মতো হঠকারী রাজনীতি আমি ঘৃণা করি !” এবার ধীমানের দিকে ফিরে বলে, “ কিন্তু স্যার এটাও বলি, আপনারা ভুলে যাবেন না, সো কলড বখাটে ছেলেগুলোও কিন্তু এই বাংলার সম্পদ, আপনার সন্তান | বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক স্কলার ওই বখাটেদের দলে নাম ভিড়িয়েছে ৷ এর জন্য দায়ী আপনাদের দুই দলের দিশাহীন রাজনীতি |”

ধীঃ “How dare you pass such an irresponsible comment! Partition আমার economy তছনছ করে দিয়েছে৷ সেখান থেকে we are surging to the top. তোমার কোন ধারণা আছে কত সম্পদ তৈরী হচ্ছে?”

বিঃ “ সম্পদ? হাহা | যে সম্পদে আমার মাটির মানুষের অধিকার নিশ্চিত নয় সে সম্পদে লাভ কি? মাটির দিকে তাকিয়ে দেখুন স্যার, আপনার সম্পদের নীচে অসাম্য বেড়েই চলেছে ৷”

বিভাসের কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে যতীন বলে ওঠেন, “Exactly. আমরাও তো তাই বলছি ৷ এইজন্যই সমস্ত labour force কে আমাদের এক করতে হবে। নেহাত স্যার সামনে আছেন তাই, নাহলে তো I would have offered you to join our party. হা হা হা ৷”

যতীনের হাল্কাচালের কথা গুলো বড়ই ঔদ্ধত্যের মতো শোনাল বিভাসের কানে ৷ বিশেষ করে ধীমান রায়ের সামনে এই ধরনের কথা বার্তা শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিলনা ৷ আড়চোখে দেখল ধীমান রায়ের মুখে একটা  তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ৷ মুখটা নিচু করে ধীরে ধীরে বিভাস বলল, “ ক্ষমা করবেন যতীন বাবু ৷ আপনি ভুল বুঝছেন ৷  আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী এক নয় ৷ আমি চাই আমার মাটিতে আমার মানুষের সম্পদ সৃষ্টির অধিকার ৷ শ্রম দেবার অধিকার আগে জন্মাক, তবে তো শ্রমিক ঐক্য !”

“আমার মানুষ, আমার মানুষ করে কি বলতে চান বলুন তো?” যতীন বিরক্ত হয়ে বলে ওঠেন ৷

বিভাস বলে,
“মাটির কাছাকাছি মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে বাস্তবের কঠিন মাটির গন্ধ মেখেই আমার সময় কেটে যায় ৷ আপনাদের রাজনীতির অভিজাত মহলে আমি ব্রাত্য হতে শুরু করেছি ৷ তাই হয়তো আমার কথা আপনাদের বুঝতে অসুবিধে হয়। অথচ প্রান্তজনের কাছে শুনে দেখবেন ৷ আমার কথা শুনে তাদের কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না৷”

ধীঃ “ ননসেন্স! শোন বিভাস আমি যেহেতু তোমাকে ভালোবাসি সো আই ওয়ান্ট টু গিভ ইউ এ লাস্ট চান্স টু কন্ট্রিবিউট টু আওয়ার মেনস্ট্রীম ডেভেলপমেন্ট ট্র্যাক ৷ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্টের জন্য আমি একটা টাস্ক ফোর্স করছি ৷ ইন্ড্রাস্টি যাতে আমাদের এখানে সহজে ক্যাপিট্যাল ইনভেস্ট করতে পারে সেটাই এরা নিশ্চিত করবে। I want you to head this . যতীনও থাকবে as head of labour coordination committee. He will ensure যাতে করে লেবার ফোর্স আর ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে একটা  সুসম্পর্ক থাকে ৷ The task force is scheduled to meet Ustam and Shah brothers on coming Monday. ওরা একটা স্পঞ্জ আয়রনের কারখানা খুলতে চায় ৷ তুমি ইমিডিয়েটলি বম্বে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু কর। আমার সেক্রেটারী তোমাকে ব্রিফিং করে দেবে ৷"

বিঃ “ আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন এইভাবে বাইরের লোকজন ডেকে এনে ব্যবসা খুলে বাঙালীর ভাগ্য ফিরবে? কমতো করলেন না ৷ কিন্তু তাকিয়ে একবার দেখেছেন বাংলায় চাকরী তৈরী করতে গিয়ে বাঙালীর হাহাকার কিন্তু কমাতে পারছেন না ! বাংলায় পুঁজি আনছেন, কিন্তু বাঙালীর পুঁজির খবর রেখেছেন? ছোট হোক বড় হোক ৷”

যতীন হাঁ হাঁ করে ওঠে, “ কি বলতে চান কি? বাংলায় আপনি কি একটা Neo Capitalist class তৈরী করতে চাইছেন ? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না!”

বিভাস বিদ্রূপের স্বরে বলে, “ যতীন বাবু, বাইরের পুঁজি এনে তার labour coordination-এ আপনার তো কোন আপত্তি দেখছি না ৷ বাঙালীর পুঁজির কথা বললেই আপনার class মনে পড়ে?”
বিভাস এবার ধীমান রায়কে বলে, “  যে বাঙালী সর্বস্ব হারিয়ে এপারে আসছে তাকে স্বনির্ভর করার দায় কি আপনার নেই ? তাদের ধরে ধরে বাইরের রাজ্যে রুক্ষ্ম জমিতে পাঠিয়ে সস্তার শ্রমিক তৈরী করা হচ্ছে ৷ আপনি পারেন না তাদেরকে এখানেই রেখে তার নিজের মাটিকে সাজিয়ে তোলার সুযোগ দিতে? এক একটা ফ্যাক্টরীর নামে জল-জঙ্গলের অধিকার হারাচ্ছে মাটির মানুষ গুলো ৷ আপনাদের চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতি শুধু তেলা মাথায় তেল দিচ্ছে৷ ওদিকে মাটি কিন্তু তেতে উঠছে ! সময় চলে যাচ্ছে স্যার | দিল্লীর দরবারে আপনার বিরাট ক্ষমতা ৷ দিল্লীকে বলুন ট্যাক্স রিফমেশন করতে ৷ রাজ্যের সম্পদের ওপর রাজ্যের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করুন স্যার ৷ যদি না পারেন বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করুন ৷ আপনিই বাঙালীর ভরসা৷”

ধীঃ “ শাট আপ | দিল্লী থেকে হাইকম্যান্ড অলরেডি তোমার এই সেপারেটিস্ট এ্যাটিটিউডের এগেনস্টে ওয়ার্ন করেছে৷ একটা জাতীয়তাবাদী দলে থেকে তুমি কোন সাহসে এসব প্রাদেশিক কথা বার্তা বল?”

বিঃ “নেশনালিসম মানে নেশনের একটা  অংশ থেকে সম্পদ তুলে নিযে অন্যের প্রফিট বাড়ানো হতে পারে না ৷ স্বাধীনতার পর বাংলা একটা বহুজাতিক রাষ্ট্রের অংশ হয়েছে স্যার এবং সেটা সমমর্যাদার ভিত্তিতে ৷ বাঙালীর অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ় করার উপায় এটা নয় স‍্যার ৷ আমি আপনারই ছাত্র৷ জানি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে আপনার বাধ্যবাধকতা ৷ কিন্তু আপনার শিক্ষা কে আমি কি করে ফেলে দেব স্যার? এসব একদিন আপনার থেকেই শেখা ৷ আমি বাস্তবে প্রয়োগের দিশা খুঁজছি মাত্র ৷”

মাথাটা নীচু করে টেবিলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন ধীমান রায় ৷ ধীরে ধীরে অস্ফুটে বললেন, “I am not left with much time to administer another anarchy with an uncertain hope to an unseen future! I am too tired. I have seen enough of anarchy.”

ঘরের মধ্যে সাময়িক নিরবতা নেমে এল ৷ গলা খাঁকারি দিয়ে নীরবতা ভাঙলেন যতীন,  “ দেখুন বিভাস , আপনার অনেক অবসার্ভেশনের সঙ্গেই আমাদের পার্টি একমত ৷ কিন্তু আমাদের আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝে এগোতে হবে ৷ বিশ্বব্যাপী পুঁজির আগ্রাসন চলছে ৷ তার বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক আন্তর্জাতিক ঐক্যের কথা মানুষকে বোঝানোর সময় এখন ৷ শুধু তাই নয় বাস্তুহারার সমস্যাও কিন্তু আমাদের আন্তর্জাতিক শোষন যন্ত্রের নিরিখেই বিশ্লেষণ করতে হবে ৷”

যতীনকে থামিয়ে দিয়েই বিদ্রূপের সুরে বলে ওঠে বিভাস, “ যতীনবাবু, বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে ৷ নইলে দাতা আর গ্রহীতার সম্পর্ক তৈরী হয়। দুর্বল গোষ্ঠীর মুখে ভ্রাতৃত্বের কথা মানায় না, সে পাড়ায় হোক, জাতীর স্তরে হোক বা আন্তর্জাতিক স্তরে ৷ আমার মানুষ হালে গরু জুততে হিমসিম খাচ্ছে, আর আপনি এরোপ্লেনের ভাষায় কথা বলছেন ! স্যার আমায় ভুল বুঝবেন না ৷” শেষের অংশটুকু বিভাস ধীমান রায়ের উদ্দেশ্যে বলল ৷

“ ভাষা সংযত করুন বিভাস ৷” মেজাজ হারালেন যতীন বোস |

বি: “ দেখুন যতীনদা আমি সহজ কথা সহজ ভাবে বুঝি সহজ ভাবে বলি ৷ স্যার বাইরে থেকে পুঁজি আনছেন ৷ সেখানে যে ধরনের কাজ তা আমার মানুষদের জন্য উপযুক্ত কিনা তা ভাবার দায় করো নেই ৷ সেখানে আমার মানুষের কাজ নিশ্চিত করার দায়ও করো নেই ৷ আপনি আপনার ‘আন্তর্জাতিক’ দায় মাথায় নিয়ে শ্রমিকদের তাতাবেন৷ মালিকের কোন দায় নেই এখানে থাকার | প্রথম সুযোগেই সে ফ্যাক্টরী গুটোবে  ৷ কিন্তু কাঁচামালের  যোগান সে নিয়ে যাবে আমার মাটি থেকেই ৷ তারপর মালিকের এলাকার ভাই বেরাদররা ফিনিশড প্রোডাক্ট বেচবে সেই আমার মানুষকেই ৷ বাইরের বেনিয়ায় ছেয়ে যাবে আমার মার্চি ৷ অথচ আমার বাস্তুহারারা অন্যত্র দাসবৃত্তি করবে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ৷ The future is written on the wall!”

যঃ “ আপনি বড় বেশী separatist দের মতো কথা বলছেন বিভাস ৷ আন্তর্জাতিক বাস্তবতা বুঝছেন না ৷ একটা কথা আপনাকে বলে রাখি ৷ আমি কিন্তু স্যার নই ৷ যদি কোনদিন সরকার বদলায়, আমরা কিন্তু কড়া হাতে এইসব প্রতিক্রিয়াশীল দূষিত চিন্তাকে সমাজ থেকে মুছে দেব ৷ এমনিতেও শাসকদলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও স্যারের পুলিশ আপনাকে কলার ধরে প্রিজন ভ্যানে তুলছে সেটা আজকে public কাগজের পাতায় দেখেছে ৷ কাগজগুলোও যে আপনার সম্বন্ধে খুব একটা ভালো কিছু লিখেছে তা নয় ৷ যতই আপনি ওই so called 'আমার মানুষ’ আর কিছু মার্কামারা ‘intellectual’ দের কাছে প্রিয় হোন না কেন,  আপনি যে political sphere - এ complete bankrupt হয়ে গেছেন, সেই বার্তা পৌঁছে গেছে ৷ ”

ধীমান রায় নিরাসক্ত গলায় বলে উঠলেন, “ এখনও বলছি বিভাস ৷ Take the opportunity. Come back to main stream activities. অন্যথায় তোমাকে এক্সপেল করে সিডিশনের চার্জ দিতে আমি বাধ্য হব ৷ আমার ওপর ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড চাপ আসছে ৷ I can’t help you anymore.”

যতীনের কথায় বিভাস যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ ধীমানের উদ্দেশ্য ধরা গলায় বলল, “ স্যার,  আমি বিচ্ছিন্নতাবাদের কথা বলছি না , একসাথে থাকার শর্ত পূরণের কথা বলছি ৷ যাই হোক, আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে ৷ আমি পার্টী থেকে রিজাইন করছি ৷ কষ্ট করে আর expell করবেন না ৷  তারপর আপনারা যা খুশী করুন ৷ শুধু আপনার শেখানো একটা কথা বলে যাই, ‘ আদর্শের মৃত্যু নেই' ৷”

কথা গুলো শেষ করেই কারো দিকে না তাকিয়ে হন হন করে বিধানসভা থেকে বেরিয়ে আসে বিভাস ৷

বিভাসের ইস্তফার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল ৷ কিন্তু বিভাসের খোঁজ কেউ পেল না ৷ কল্যানী আর তার সঙ্গী সাথীরা অনেক চেষ্টা করেও বিভাসকে পেল না ৷ পার্টী নেতৃত্বও এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামালো না ৷ বিভাস তো আর পার্টীর কেউ নয় !

সপ্তাহখানেক বাদে আনিসুর একদিন চোরের মতো রাতের অন্ধকারে কল্যানীর ঘরে ঢুকল ৷ আনিসুর বিভাসের স্কুলে পিওনের কাজ করে। বিভাসের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে তাকে বিশেষ কখনও দেখা যায় নি ৷ তবে শোনা যায় কোন কোন দিন গভীর রাতে আনিসুর কাদের যেন বিভাসের ঘরের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে ৷ আনিসুর জানাল, বিভাস কল্যানীর সাথে দেখা করতে চেয়েছে ৷ লোকচক্ষুর অন্তরালে আনিসুর কল্যানীকে নিযে গার্ডেনরিচ শিপইয়ার্ডের কাছে এক পরিত্যক্ত গোডাউনের পেছনে হাজির হল ৷ আলো আঁধারি ঘেরা একটা জায়গায় বিভাস দাঁড়িয়ে আছে !

“বিভাসদা !” উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে উঠল কল্যানী ৷

“ চুপ!” চাপা গলায় ধমক দিল বিভাস ৷ কল্যানী থতমত খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল | বিভাস তার হাত ধরে কাছে টেনে নিল। কল্যানী অভিমানে মুখ নামিয়ে রেখেছে ৷ বিভাস চুপি চুপি বলল, “ রাগ করিস না ৷ খুব গোপন কিছু কথা বলব ৷ শপথ নে জীবদ্দশায় কাউকে বলবি না ৷”

অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইল কল্যানী ৷ বলল,  “ তুমি নিশ্চিন্ত থাক বিভাসদা ৷ তোমার নির্দেশ আমার কাছে ঈশ্বরের বানী ৷”

বিঃ “ আমি চলে যাচ্ছি ৷”

কঃ “ কোথায়?”

অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে কল্যানী ৷

বিঃ “নিরুদ্দেশের পথে ৷ এর বেশী কিছু জানতে চাসনা ৷ শুধু এটুকু জেনে রাখ, যে আদর্শের সাধনা করছি ,  এই সিস্টেমে তা অসম্ভব৷ সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে ৷ ধরে নে শেকড় খুঁজতে মাটির তলাতেই ডুবে গেছি ৷“

কঃ “ নিরুদ্দেশ! কি সব বলছ ? তুমি কেন নিরুদ্দেশ হবে ? জানি তোমার অনেক শত্রু, কিন্তু একবার চেষ্টা করে দেখ না। চলো না বাংলার সব দলগুলোকে আহ্বান করে আমরা একটা মঞ্চ বানাই | আমি নিজে ডোর টু ডোর যাব ৷ সব দল থেকেই কিছুনা কিছু মানুষ আমাদের সাথে যোগ দেবে ৷ তুমিতো বাংলার স্বার্থে কথা বলছ ৷”

বিঃ “ এখনও সে সময় আসে নি ৷ সবাই যার যার মতো রঙীন চশমা পরে আছে ৷ মাটির রঙ কেউ দেখছে না ৷ আমি কি চেষ্টা করিনি ভাবছিস? চরমপন্থীরা আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতি বিপ্লবী আরও কি কি সব বলে প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছে ৷ এমনকি আমি সনাতন জাগৃতি , মুসলিম ইউনিটি ওদের সাথেও যোগাযোগ করেছি ৷”

কঃ “ ওদের সাথে ? কি বললে ওদের?”

বিঃ “ সনাতন জাগৃতিকে বললাম, ধর্ম নিয়ে আপনারা যা খুশী করুন ৷ কিন্তু আপনাদের ভাগ বাঁটোয়ারার  ফর্মূলায় যে লক্ষ লক্ষ বাঙালী বাস্তুহারা নিঃস্ব হয়ে এখানে এসেছে ৷ তারা তো সনাতন ধর্মের মানুষ ৷ আসুন, এই মাটিতে তারা যাতে মর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই লক্ষ্যে এক সাথে কাজ করি ৷ কিন্তু ওরা বলল ওরা সদ্যোজাত একটা দল | রাষ্ট্রীয় সেবা সমিতি এখন আন্তর্জাতিক সনাতন ভ্রাতৃত্ব নিয়ে ভাবছে, কারণ দেশ ভাগ করে সনাতন স্বার্থ আপাততঃ রক্ষা করা গেছে ৷ এই সময়ে এইরকম আঞ্চলিক চিন্তা ভাবনা রাষ্ট্রীয় সেবা সংঘ অনুমোদন করবে না ৷ আরও বলল, দেশ বিধর্মীশূন্য হলে এমনিতেই একদিন সনাতনীদের কোন অভাব হবে না ৷ ওরা সেই লক্ষ্যেই এগোতে চায় !”

কঃ “ কি অদ্ভুত যুক্তি ! আর মুসলিম ইউনিটি ? ওরা কি বলল?”

বিঃ “ ওদের বললাম , বাংলার বিপুল খেটে খাওয়া মানুষের বিরাট অংশই মুসলিম ৷ মাটির ওপর প্রচ্ছন্ন শোষণ শুরু হলে সবার আগে ওরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷ কিন্তু দেখলাম ওদেরও এসব নিয়ে ভাববার ফুরসত নেই ৷ এমনিতেই ভাগাভাগির ফলে ওদের মূল শক্তিটাই বিদেশী রাষ্ট্র হয়ে গেছে ৷ যেটুকু সংগঠন বেঁচে আছে তাদের একটাই লক্ষ্য, বিপুল সংখ্যায় বিধর্মী শরণার্থী এখানে আসার ফলে যদি দাঙ্গা বাঁধে তাহলে তারা যেন মুসলমানদের লড়তে সাহায্য করতে পারে ৷”

কিছুসময় দুজনেই নিরব থাকে ৷ তারপর আস্তে আস্তে কল্যানী বলে,  “ তোমার দুটি পায়ে পড়ি বিভাসদা ৷ আমাদের ছেড়ে কোথাও যেয়ো না ৷ তুমিই তো বল , বাংলার বুকে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত যেভাবে তরুণ মেধার অপচয় হয়েছে, খুন হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ৷ তুমিও যদি চলে যাও বাংলা তো অন্ধ হয়ে যাবে ৷”

বলতে বলতে কল্যানীর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল ৷ পরম স্নেহে কল্যানীর জল মুছিয়ে দিল বিভাস ৷ বলল,
“ মন শক্ত কর কল্যানী ৷ আগামী দিনে তোর অনেক দায়িত্ব ৷ তোদের ছেড়ে আমি কোথাও যাব না ৷ সবসময জানবি কোন না কোন ভাবে আমি তোর পাশেই আছি ৷ যা আজ হচ্ছে তা আমি বহু আগে দেখতে পেয়েছিলাম ৷ কিচ্ছু ভাবিস না৷ আমার দাবার ছক সব জায়গায় ছড়ানো আছে ৷ আমার ঘুঁটিরা ঠিক সময়ে চাল দেবে ৷ কিন্তু নেতৃত্ব তোকেই দিতে হবে ৷ যে ঘুঁটির যে কাজ সে ঠিক সময়ে তা করবে ৷”

“ নেতৃত্ব দেব , আমি?” অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কিশোরী কল্যানী ৷

 “ হ্যাঁ ৷ তবে সে সময় আসতে এখনও দেরী আছে ৷ সময় এলে ঠিকই বুঝতে পারবি। শোন, কতগুলো কথা বলে যাই ৷ আমার হাতে আর বেশী সময় নেই ৷ একটা জিনিস মনে রাখিস, প্রতিপক্ষ বিপুল বলশালী হলেও ভয় পাবিনা ৷ সবসময় জানবি শক্তির দম্ভে একটা না একটা সময় সে চরম একটা শিশুসুলভ ভুল করবে ৷ সেই মুহূর্তেই তাকে বশ করবি ৷ কিন্তু মানবিকতা হারাবিনা ৷ শত্রু হোক মিত্র হোক, জানবি সে তোর মাটিরই সন্তান ৷ এই মুহূর্ত থেকে গনমঞ্চের মূল ধারাতে মিশে যাবি সমস্ত নবীন সদস্যদের নিয়ে ৷ যেন ভুলেও মনে না হয় তোরা কোনদিন আমার অনুগামী ছিলি৷ স্যারের শরীর ভেঙে গেছে ৷ স্যার চোখ বুঁজলেই গণমঞ্চ ক্ষয়ে যেতে শুরু করবে ৷ আগামী দিনে সংগ্রামী পার্টির শাসনই ভবিতব্য | আর তখন থেকেই তোর কাজ শুরু | একটা সময়ে গনমঞ্চ থেকে তোকে বেরোতে হবে ৷ তারপর কি করতে হবে তা তুই নিজেই বুঝে যাবি ৷ আমি ততদিন পৃথিবীতে থাকব কি না জানিনা | তবে আমার ঘুঁটিরা থাকবে ৷ আর তুই যা করবি, সবসময় মনে রাখবি আমার জঙ্গল রক্ষা কমিটি, এছাড়াও বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে ছোট ছোট যে সংগঠনগুলো তৈরী করেছি, এদের সাথে সমন্বয় রেখেই তোকে কাজ করতে হবে। আজকের পর আমার সম্বন্ধে হয়তো অনেক কিছু শুনবি৷ ওসবে মন দিবি না ৷ লক্ষ্যে অবিচল থাকবি ৷ চললাম ৷ বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে ৷”

কথা শেষ করেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল বিভাস ! সেই শেষ দেখা কল্যানীর ৷ শেষ বেলায় পা জড়িয়ে প্রনাম করার সুযোগটাও সে পায়নি ৷ এই অক্ষেপ তার সারা জীবন থাকবে৷

এর দুদিন পর আলিপুর জেলের পেছনে খালপাড়ে একটা গুলিতে ঝাঁঝড়া মৃতদেহ পাওয়া যায় ৷ এমনকি মুখটাও বিকৃত হয়ে গেছে বুলেটের আঘাতে ৷ পুলিশ ক্লেম করে বডিটা বিভাস ঘোষের ৷ বডির থেকে একটু দুরে নাকি পায়ে গুলি বিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছিল আনিসুর ৷ সেই নাকি পুলিশকে জানিয়েছে যে রাতের অন্ধকারে চরমপন্থীদের একটা গ্রুপ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এই কাজ করেছে ৷ কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী এবং পুলিশের অনেকেই পুরো বয়ানে অনেক অসংগতি পায় ৷ অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে, দেহটা আদৌ বিভাস ঘোষের কি না। খবরটা শুনে কল্যানীর বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছিল ৷ আনিসুরের থেকে সত্য ঘটনা জানার জন্য সে যখন তার বাড়ি যায়, দেখে আনিসুর অসুস্থ অবস্থায় বর্ধমানে তার দেশের বাড়িতে চলে গেছে ৷ কিন্তু ওর বাড়ির লোক জানায় আনিসুর নাকি বাড়ীতে ফেরেই নি ৷ হঠাত যেন কর্পূরের মতো উবে গেল আনিসুর ৷
সরকার অবশ্য মৃত্যুর তত্ত্বে অনড় রইল৷ সেই সঙ্গে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত দমনমূলক ধরপাকড়, এনকাউন্টার শুরু হল ৷ চরমপন্থীদের কোমর কার্যত ভেঙে গেল ৷

এরপর সত্যিই মাঝে মাঝেই অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল ৷ তখন গণমঞ্চের শাসনের টালমাটাল অবস্থা ৷ ধীমান রায়ের মৃত্যু হয়েছে ৷ বিভাসের ভবিষ্যদ্বানী মিলে যাচ্ছে ৷ এমন সময় হঠাত গোটা কলকাতা একটা লিফলেট ছেয়ে গেল ৷ এক যোদ্ধার আবছা সাদাকালো ছবি ৷ আশপাশে কিছু মঙ্গোলীয় সৈনিকদের মুখ ৷ মঙ্গোলীয় মুখের ভিড়ে সৈনিকের মুখটা যেন বিভাসের মতোই লাগছে ৷ তলায় ক্যাপশন, ভিয়েতনামে বিভাস ৷

এর কিছুদিন পর গুজব রটল, পূর্ববঙ্গের লড়াইয়ের ময়দানে বিভাসকে গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে দেখা গেছে ৷ আরও একদশক পর , তখন ক্ষমতায় সংগ্ৰামী পার্টি, হঠাতই পশ্চিমের এক জঙ্গলের মাথায় একটা হেলিকপ্টার থেকে বিভাস ঘোষের ছবি দিয়ে কি সব ধাঁধা লেখা লিফলেট ছড়িয়ে দিয়ে কারা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে  গেল ৷ তার জেরে শুরু হয়ে গেল সংগ্ৰামী পার্টির সংগঠনের সাথে জঙ্গলের মানুষের লড়াই৷ চারিদিকে একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ গ্রাস করতে শুরু করল ৷

এরই মধ্যে অবশ্য কল্যানীর রাজনৈতিক অগ্রগতি শুরু হয়েছে ৷  গণমঞ্চে নেতৃত্বের সঙ্কটের সুযোগে সেই হয়ে উঠেছে যুব ব্রিগেডের মুখ ৷ গণমঞ্চ এখন বিরোধী আসনে ৷ অধিকাংশ নেতাই সংগ্রামীদের সাথে আপোশে চলছে ৷ তাই বিরোধী নেতৃত্ব হিসেবে সেই অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে ৷ একটা সময় নিজের দলেই বিরোধ শুরু হল তার ৷ বিভাসদার কথা গুলো যেন ছবির মতো মিলে যাচ্ছে ৷ একদিন বাড়িতে লেটার বক্সে একটা খাম পেল ৷ ভেতরে তারামায়ের ছবি ৷ পেছনে ইংরেজিতে টাইপ করা “ QUIT”!  এক সপ্তাহের মধ্যে সকলকে চমকে দিয়ে সে গণমঞ্চের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের দল তৈরী করল ৷ সঙ্গী করল তার কৈশোরের নবীন ব্রিগেডের সহকারীদের৷ গোড়াতেই তার প্রচেষ্টা শেষ করে দেবার জন্য অনেক প্রাণঘাতী আক্রমণ হয়েছে৷ সংগ্রামীদের তখন প্রবল প্রতিপত্তি৷ কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছে তার চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে  আশাতীত ভাবে কোন অচেনা বা চেনা মানুষ তাকে রক্ষাকবচ যুগিয়েছে ৷ অনেক সময় দেখেছে বিরোধী দলের একটা অচেনা মুখ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ৷  একটা সময়ে যখন সকলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে, তার দলের সাথীরাও দূরে যেতে শুরু করেছে ঠিক সেই সময় ফলে গেল বিভাসদার আমোঘ ভবিষ্যদ্বানী ৷ ক্ষমতার দম্ভেই হোক, আর যাই হোক, সংগ্রামীরা একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করল ৷  মানুষ স্বাভাবিক বিকল্প হিসাবে নির্বাচিত করল কল্যানীর দলকে ৷  দীর্ঘ লড়াই শেষে শূন্য থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্ৰী হয়েছে কল্যানী ৷ কৈশোর থেকে একা লড়াই করে আজ প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমানায় ৷ শুধু ছল ছল চোখ দুটো শহীদ মিনারের আনাচে কানাচে আজও খুঁজছে প্রিয় বিভাসদাকে ৷ প্ৰণামটা যে আজও করা হয় নি !

**********

সোস্যাল মিডিয়া থেকে ভিডিওটার একটা কপি ডাউনলোড করে সারারাত ধরে ওটা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে অম্বরীশ ৷ সেটা কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করছে ৷ ভিডিওর বিষয়টা নিয়ে তার স্পেসালাইজেশন না থাকলেও কিছুটা জ্ঞান তার আছে ৷ ভিডিওর প্রতিটা দৃশ্য আলাদা আলাদা করে এনালিসিস করে তার বেশ কিছু খটকা লাগছে ৷ সব থেকে খটকা লাগছে যেটা নিয়ে সেটা হল , বেনাম বাবার মুখের কথা গুলো ওর মনে হচ্ছে আগে কোথাও শুনেছে ৷ কিন্তু কোথায়? নাকি এটা ওর একধরনের ভ্রম? তাছাড়া বাচনভঙ্গীটাও যেন চেনা চেনা লাগছে ৷ কিন্তু মিসিং লিঙ্ক গুলো ধরেও ধরা যাচ্ছে না ৷

এমন সময় ডোর বেল বাজল ৷ সুচরিতা এসেছে ৷

“ আরে ফোন বন্ধ রেখেছ কেন?” সুচরিতা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল ৷

“ কাল চার্জ দিতে ভুলে গেছিলাম ৷ কিন্তু …”

 “ আরে তোমাকে একটা বিরাট খবর দেওয়ার আছে ৷” অম্বরীশ কে মাঝপথে থামিয়ে দিল সুচরিতা |

সুঃ “ তুমি কি জানো দিন চারেক আগে মহুয়া রায় এসেছিল অনেক রাত্রে ? মনোজ স্যারের ল্যাবে ৷”

অঃ “ সেকি রে! মনোজ স্যারের ল্যাবে ? কে দেখল ?”

সুঃ “ আরে সংযুক্তার রুমটা তো স্যারের ল্যাবের লাগোয়া | সেদিন ও রাত জেগে আসাইনমেন্ট কম্প্লিট করছিল ৷ হঠাত চেঁচামেচি শুনে ওর সন্দেহ হয় ৷ টুকরো টুকরো কিছু কথা ও শুনতে পায় ৷ কিউরোসিটি হওয়াতে  স্যারের ল্যাবের সামনের করিডরে চলে আসে ৷ কাল ক্যান্টিনে ও আমাকে চুপি চুপি সব বলল ৷"

অঃ “ আঃ কি বলল সেটা বলবি তো !”

সুঃ “ আরে শোনই না ৷”

সুচরিতা যা বলল তা মোটামুটি এই রকম :

সংযুক্তা হঠাৎ একটা মহিলা কন্ঠ শুনতে পায় ৷

 “ হাও ডেয়ার দে ডু দিস? ওরা আমার থেকে কোন কনসেন্ট নেয়নি ৷”

মনোজ স্যারের গলা পাওয়া যায় এরপর৷ “দেখুন সেটা আপনাদের ইন্টারন্যাল ইস্যু ৷ I am just an academic explorer. For me this is just a fun outcome of my research based on some input যেটা তারা আমায় দিয়েছিল ৷ They paid me handsomely, so they have the outcome”.

এই সময়ে সংযুক্তা করিডরে বেরিয়ে আসে ৷ মহিলার গলা সপ্তমে ওঠে, “ আপনার কাছে এটা মজা হতে পারে স্যার ৷ কিন্তু আপনি জানেন না এর সুদুর প্রসারী এফেক্ট কি হতে চলেছে ৷ সব থেকে বড় কথা আমি কিভাবে ফাঁসব আপনি বুঝতে পারছেন ? চ্যানেল একটা সময়ে সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে আমার ওপরেই সব দায় চাপিয়ে দেবে ৷ উফ আমি ভাবতেও পারছি না! ওদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ না মেলানোর জন্য ওরা এই ভাবে আমাকে স্কেপ গোট করবে ৷”

“ তা আমি কি করতে পারি ম্যাডাম?”

“ আমার অরিজিনাল  ভিডিও স্যাম্পল গুলো আমাকে দিন ৷ ওটা সম্পূর্ন অন্য একটা  ফিচার৷ ওরা যদি সত্যিই এটা টেলিকাস্ট করে তাহলে আমি নিজে মিডিয়া হাউস গুলোতে এই অরিজিনাল স্যাম্পল গুলো ডিস্ট্রিবিউট করবো ৷ ওরা ভেবেছে কি? ওদের সব কিছু এক্সপোজ করে দেব ৷”

“ সরি ম্যাডাম ৷ মনে হয় ওই ফাইল গুলো ডেস্ট্রয় করে দেওয়া হয়েছে ৷ না হলেও আমি আপনাকে দিতে পারব না ৷”

 “  দাঁড়ান আমি ফোন করছি ৷ ভেবেছেটা কি?”

মহিলা কাউকে একটা ফোন করে ৷ মনোজ স্যার প্রায় আঁতকে ওঠে, “ আপনি করছেন টা কি? ওরা যদি জানে আমি disclose করেছি, তাহলে …”

মনোজ স্যারের কথা শেষ হবার আগেই মহিলার কথা শোনা যায় ৷ ফোনে কাউকে  বলছে ৷ ও প্রান্তের কথা গুলো স্বাভাবিক ভাবেই কিছু শোনা যায় না ৷

 “ হ্যালো ... This is Mahua …Yes …  হ্যাঁ হ্যাঁ … হ্যাঁ এটাই আমার ফোন করার টাইম …তোমার থেকে আমাকে ম্যানার্স শিখতে হবে? ব্লাডি বাগার … তোমার ঘুম ? এই শোন তোর ঘুম আমি জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেব স্কাউন্ড্রেল …No I will not cool down …কি হয়েছে ? … হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি …কি ভেবেছিলি? আমাকে ফাঁসাবি ? শুনে রাখ , তোদের সব ধরা পড়ে গেছে ৷…হ্যাঁ হ্যাঁ তুই করেই বলছি ৷ জানোয়ার … আরে শোন শোন আমিও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে লোক চড়াই ৷ তুই তো কলকাতায় দু দিনের যোগী ৷ জানিস আমি এখন কোথায়? আমি মনোজ স্যারের ল্যাবে …
কি রে? কথা বল ! শোন, বেনাম বাবা -র ওপর ফিচারটা শুট করার পর তোর আর ওমজীর মধ্যে কি কথা হয়েছিল আমি সব শুনেছি ৷ এই জন্যেই আমাকে দিল্লী পাঠানোর তাড়া এত? …
এই কাকে থ্রেট দিচ্ছিস? শুনে রাখ , চালাকি করে দিল্লী পাঠাচ্ছিস তো? আমি ওখানে ন্যাশনাল মিডিয়ায় সব ফাঁস করব।…
হ্যালো ৷ হ্যালো ৷ হ্যালো ৷
ধুস্সালা ৷”

ও প্রান্তে ফোন কেটে দিয়েছে ৷ মহিলা এবার মনোজ স্যারকে ঝাঁঝিয়ে বলল, “ শেষ বারের মতো বলছি দেবেন, না দেবেন না?”

মনোজ স্যার কাঁদোকাঁদো ভাবে বলে, “ বললাম তো ম্যাডাম পারব না ৷ পারব না ৷  বরং আমি বলব আপনি এটা নিয়ে আর এগোলে আপনারই বিপদ বাড়বে৷ আর আপনি এটা কি করলেন ? ফোন করলেন করুন ৷ বলেও দিলেন যে আমার কাছে এসেছেন ? এবার তো আমার জীবন সংশয় হবে ৷ আমার স্কলার গুলো বিপদে পড়বে ৷”

এরপর আরও একপ্রস্থ বাগবিতণ্ডা চলে ৷ হঠাত মহিলার কন্ঠে কোনা যায় , “রাস্কেল ৷ কাওয়ার্ড |”

একটা ধ্বস্তাধ্বস্তি হয় ৷ একটা চড় মারার মতো আওয়াজ হয়। মনোজ স্যার কঁকিয়ে ওঠেন ৷ মহিলা থমথমে মুখে মনোজস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে গটমট করে করিডর দিয়ে চলে যায় ৷ আড়াল থেকে সংযুক্তা দেখে মহিলা আর কেউ নয়; সাংবদিক মহুয়া রায়!
ঘটনাটা শুনে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল অম্বরীশের ৷ বলল,
অঃ “ মহুয়ার  ভিডিও স্যাম্পল , মনোজ স্যার … মানে …”

সুঃ “ মনোজ স্যার তো সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর ৷ ওখানে মহুয়া রায় ...”

হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল অম্বরীশের মাথায় ৷

অঃ “ আই অ্যাম ড্যাম সিত্তর ওই ল্যাবেই পুরো রহস্যের শেকড়টা রযেছে ৷”

সুঃ “ মানে?”

অঃ “ সব বলব ৷ আর কয়েকটা হিসেব মেলাতে হবে ৷ তার আগে বল ৷ তোর কাকার থেকে এই বিষয়ে তোদের ওখানকার কোন আপডেট পেলি ?”

সুঃ “ ও হ্যাঁ,  তোমাকে বলব বলে ঠিকই করেছিলাম ৷ দেখো ওইসব ভিডিও টিডিওর খবর সাধারণ গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছয়নি৷ আর জঙ্গল রক্ষা কমিটির নেতারা এসব খবর নিয়ে নাকি হাসাহাসি করছে ৷ কোন গুরুত্বই দিচ্ছেনা !”

অঃ “ গুড | দ্যাট গিভস মি কনফিডেন্স | আর একটা কথা ৷ ‘বিভাস ঘোষ – জরুরী কিছু ভাষণ’ এই নামে আমার কাছে একটা বই ছিল ৷ পাচ্ছি না কিছুতেই ৷ তুই একটু দেখবি বইপাড়ায় কোথাও ওটা জোগাড় করতে পারিস কিনা ? কেন জানি মনে হচ্ছে ওই বইটাতে ক্লু আছে ৷”

সুঃ “ ওটা তো তুমি কদিন আগে আমাকে পড়তে দিয়েছিলে ৷ ভুলে গেছ?”

অঃ “ রাইট ৷ শিগগির ফেরত দে ৷ আমার দরকার ৷”

মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যায় সুচরিতার ৷

সুঃ “ওটা কদিন আগে সোহম আমার থেকে নিয়ে গেছে ৷”

অঃ “ সোহমটা আবার কে? ইউনিভার্সিটির ছেলে পুলে বিভাস ঘোষকে নিয়ে ইস্টারেস্ট দেখাচ্ছে ? স্ট্রেঞ্জ!”

সুঃ “আরে সোহম আমাদের এম টেকের ই স্টুডেন্ট ৷ আমি বইটা মাঝে মাঝে ক্লাসে বের করে পড়তাম ৷  ও সেটা দেখেছিল ৷ কদিন আগে হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার থেকে একরকম জোর করেই বইটা কেড়ে নিয়ে গেল ৷ বলল একটু পরেই ফেরত দেবে ৷ কিন্তু তারপর থেকে ওকে আর দেখতেই পাচ্ছি না ৷”

অম্বরীশ উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ৷ সুচরিতা তার আগেই গোল গোল চোখ করে প্রায় আর্তনাদের সুরে বলে,  “রিজ়দা, সোহম তো মনোজ স্যারের কাছেই ওর মাস্টার্স থিসিস করছে ৷   Artificial intelligence দিয়ে সারাদিন ভিডিওতে কি সব কারিকুরি করে শুনেছি !"

অম্বরীশ টেবিলের ওপর জোরে একটা ঘুঁষি মারে ৷ প্রচন্ড উওেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বলে ,  “সবকটা ডট জুড়ব ৷ সুচরিতা আই ওয়ান্ট দ্যাট বুক ব্যাক নাও ৷ না পেলে কিন্তু তোর মাথা গুঁড়িয়ে দেব ৷ মানুষটাকে এইভাবে মেলাইন করতে ওদের এতটুকুও বাঁধলনা ! ওদের ‘ ফান আউটকাম ‘ এবার বের করছি !”

অম্বরীশের রুদ্র মূর্তি দেখে কাঁদো কাঁদো হয়ে সুচরিতা বলল, “ তুমি কিছু চিন্তা কোর না ৷ বই টা আমি যেভাবে পারি এনে দেব ৷ আর একটা কথা ছিল ৷ “

অঃ “ যা বলবি তাড়াতাড়ি বল , বলে ভাগ৷ আমার বই ফেরত দে ৷”

সুঃ “ আমার এক পরিচিত দাদা আছে ৷ পরিমলদা ৷ একটা ছোট মিডিয়া হাউসে ফ্রিল্যান্স হিসেবে জয়েন করেছে ৷ ওকে আমি তোমার গল্প অনেকবার করেছি ৷ কাল অনেক রাতে আমায় ফোন করেছিল ৷ তোমার সাথে দেখা করতে চায় ৷ দেখা করবে?”
অঃ করতে পারি সন্ধ্যার পরে ৷ কিন্তু একটাই কন্ডিশন৷ তুই আমাকে আধঘন্টার মধ্যে বইটা ফেরত দিবি ৷”

সুচরিতা ঝর্নার বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল ৷ ঘামে ভেজা শরীরে প্রচণ্ড হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এল প্রায় মিনিট কুড়ি পর৷ হাতে বইটা ৷ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,  “ কি অসভ্য ছেলে বটে ! একে তো বই ফেরত দেয়না ৷ তারপর শুনি কদিন আগেই হঠাত করে বাড়ি গেছে ছুটি নিয়ে ৷ আমারও গেল মেজাজ গরম হয়ে ৷ এটা কি ছুটি নেবার টাইম ৷ সুপারিন্টেডেন্ট ঘরে ছিল না ৷ সেই সুযোগে আমি সোজা বয়েজ হোস্টেলে ঢুকে সোহমের ঘরে চলে গেলাম ৷ দেখি সব অগোছাল ৷ মনে হয় তাড়াহুড়া করে জিনিস পত্তর ঠিক করে গুছিয়ে যেতে পারে নি ৷ দেখলাম ড্রয়ারে তালা দেওয়া নেই ৷ খুলতেই বইটা পেয়ে গেলাম ৷ কি ভাগ্য বল দেখি! আর অসভ্যটাকে পরিষ্কার বইটা দিলাম, দেখো জায়গায় জায়গায় কেমন ঢেঁরা দিয়ে আন্ডারলাইন করেছে !”

অম্বরীশ সুচরিতার মাথায় একটা স্নেহের চাঁটি মেরে বসতে বলে একগ্লাস জল এগিয়ে দিল ৷ বইটা হাতে নিয়ে দু একটা পাতা উল্টোতে উল্টোতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ৷ সুচরিতা কে বলল, “ পরিমলকে সন্ধেবেলায় নয়, বিকেলেই আসতে বল ৷ বেশ কড়া পাকের চা খাওয়াব ৷”

*********

বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই পরিমলকে নিয়ে হাজির হল সুচরিতা | লক্ষ্য করল, অম্বরীশকে বেশ ফ্রেশ লাগছে ৷  কয়েক ঘন্টা আগে তার মুখে যে ক্লান্তির ছাপ ছিল, সেটা যেন উধাও হয়ে গেছে ৷
তিনজনে একটা টি টেবলের পাশে বসল৷ অম্বরীশ খোশ মেজাজে চা বানিয়ে সবাইকে কাপে ঢেলে দিল ৷ টেবলের মাঝখানে তার ল্যাপটপটা রাখা ৷ চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে অম্বরীশ  পরিমলের উদ্দেশ্যে বলল,  “ বল পরিমল , আমার সাথে দেখা করতে চাইছিলে কেন?”

 “ আসলে RP BANGLA তে ওই ভিডিওটা ফ্ল্যাশ হবার দিন রাত্রে আমাদের মতো বেশ অনেক কজন ফ্রি-ল্যান্স রিপোর্টারের কাছেই ওপর মহলের কিছু সোর্স থেকে রিকোয়েস্ট আসে এই ব্যাপারটার সত্যতা নিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন করার জন্য ৷ সুচরিতার কাছে শুনেছিলাম বিভাস ঘোষের বিষয়ে আপনি একজন অথোরিটি | আজকে তো আপনার এখানে আসতে আসতে সুচরিতার থেকে শুনলাম আপনি নাকি রহস্যটা প্রায় ক্র্যাক করে ফেলেছেন! যদি একটু কিছু বলেন ৷ বুঝতেই পারছেন ৷ একটা যুৎসই স্টোরি বানাতে পারলে ...”

সবাইকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে  হেসে ওঠে অম্বরীশ ৷  হাসি থামলে বলে, “ দেখ ভাই ,  সরি কিছু মনে কোর না , তুমি করে বলছি ৷ দেখ আমি নিজেও চাই সত্য উদ্ঘাটিত হোক ৷ একটা বড় অপরাধ হয়েছে ৷ এটা আমি নিশ্চিত বলতে পারি ৷ অপরাধের পদ্ধতি সম্বন্ধেও আমি নিশ্চিত ৷ কিন্তু হাতে গরম প্ৰমাণ দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে ৷ তবে কোথায় খুঁজলে প্রমাণ পাওয়া যাবে এবং রাঘব বোয়াল না হলেও চুনোপুঁটি অপরাধীকে বামাল সমেত ধরা যেতে পারে, সে বিষয়ে একটা ধারণা দিতে পারি ৷ আসল অপরাধ এবং অপরাধীকে খোঁজার দায়িত্ব কিন্তু তোমার আর তোমার ওই ওপর তলার ৷ আমি বিজ্ঞানী হিসেবে শুধু কার্য আর কারণের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরী করতে পারি ৷”

প : “ মনে হচ্ছে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছুই ক্লিয়ার হবে ৷ আপনি প্লিজ বলুন। আই এসিওর ইউ টু টেক দিস ফরোয়ার্ড। আমার যথাসাধ্য করব। আপনি প্লিজ বলুন ভিডিওটা কি সত্যি না ফেক, সেটা বোঝা গেছে ?”

অঃ “ হুঁঃ, শুধু ফেক নয় ৷ ইট ইস ডিপেস্ট পসিবল ফেক | পুরোটাই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারসাজী | তবে এত ভালো প্রায় নিখুঁত কাজ পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয় করতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই ৷ এই রকম নক্কারজনক এপ্লিকেশন না হলে আমি এর সাথে যুক্ত সবাইকার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে রাখতাম।“
প: “ একটু বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ !”

অম্বরীশ বিভাস ঘোষের একটা পুরোন রেকর্ডেড ভাষণ্ চালায় ইন্টারনেট থেকে। বিভাস ঘোষের দু-একটা ভাষণ ইন্টারনেটে তার অনুগামীরা বিভিন্ন আরকাইভে আপলোড করে রেখেছে ৷ তারপর বেনাম বাবার ভিডিওটা চালায়৷ কিছুটা শোনানোর পর বলে, “ লক্ষ্য করে দেখেছ? দুটো কথারই টোন পিচ একই রকম ৷ শুধু শব্দ গুলো আলাদা ?”

সুচরিতা , পরিমল দুজনেই ঘাড় নেড়ে বিস্ময়ের সাথে সম্মতি জানাল৷ অম্বরীশ বলে চলে, “ এখানেই আমার প্রথম সন্দেহ হয় ৷ আসলে পুরোন রেকর্ড থেকে বিভাস ঘোষের কন্ঠস্বরের একটা গাণিতিক মডেল তৈরী করে সেখানে নতুন শব্দ বসিয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফ্টওয়্যার দিয়ে কৃত্রিম ভাবে কথা গুলো বানানো হয়েছে ৷ কিন্তু যারা এটা বানিয়েছে তারা একটা ফাঁক রেখে গেছে ৷  মানুষটার বৃদ্ধ বয়েসে কন্ঠের যে পরিবর্তন হবার কথা সফ্টওয়্যারে ততটা ইন্টেলিজেন্স তারা দিতে পারে নি ৷ ফলে বৃদ্ধের মুখে যুবকের স্বর এসে গেছে ৷ অবশ্য খুঁটিয়ে কালচার না করলে  সচরাচর নজর নাও হতে পারে ৷ “

পরিমল খসখস করে কিছু নোটস নেয় ৷ অম্বরীশ বলে চলে,  “ এবার ভিডিওটাতে আসা যাক ৷ তার আগে এই ছবিটা দেখ ৷ “
বইখুলে বিভাস ঘোষের একটা পুরোন সাদা কালো ছবি দেখায় অম্বরীশ ৷ তারপর আবার বেনাম বাবার ভিডিওটা পজ় করে বেনাম বাবার মুখটা দেখায় ৷

অঃ “দুটো মুখের চাউনির মধ্যে একটা মিল দেখতে পাচ্ছ ? আসলে এই বইয়ের ছবিটাকে ডিজিটাইজ় করে আটিফিসিয়ালি রঙীন করা হয় ৷ তারপর , সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ছবিটাতে বয়সের ছাপ ফেলা হয় ৷ তারপর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ওই কৃত্রিম ভয়েস সিকুয়েন্স অনুযায়ী ছবির ঠোঁট আর মুখের নানা রকম পরিবর্তন করে একটা ভিডিও বানানো হয় যাতে করে মনে হয় বৃদ্ধ বিভাস ঘোষ কোথাও বসে বসে কথা গুলো বলছেন ৷ তবে ঠোঁটের মুভমেন্টটা খুব একটা স্মুদ হয় নি ৷ সেটা ঢাকবার জন্য পুরো ভিডিও তে একটা ডার্ক এক্সপোজার দেওয়া হয় ৷ সেটাকে জাস্টিফাই করতে গুহার গল্পটা ফাঁদা হয় ৷

পঃ “ কিন্তু মহুয়া রায়ের অংশগুলো?”

অঃ “ ওটাতো খুব সহজ৷ মহুয়া রায়ের অন্য কোন একটা প্রোগ্রাম থেকে কিছু সিলেকটিভ জায়গা গুলো কেটে কেটে বেনাম বাবার কৃত্রিম ভিডিওটার  সাথে মেশানো হয়েছে ৷ দুজনের কথা যদি মন দিয়ে শোনা যায় তাহলে দেখবে নয়েজ লেভেলের একটু তারতম্য আছে ৷ অনেকটা চেষ্টা করেছে মেক আপ দেবার ৷ পুরোটা পারে নি ৷ আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করবে, মহুয়া রায়ের প্রশ্ন গুলো কিন্তু তাইরেক্ট না ৷ যেন ভাববাচ্যে ৷ কারণ আসলে ওগুলো অন্য কোন context থেকে নেওয়া ৷”

পরিমল আবারও খসখস করে একগাদা নোট নিতে লাগল ৷

 সুচরিতা জিজ্ঞেস করল, “ আর বেনাম বাবার মুখে বসানো কথা গুলোর সোর্স কি?”

অম্বরীশ সুচরিতার ফেরত দেওয়া বইটা দেখিয়ে বলল,  “ এটা কিন্তু তোর ধরে ফেলা উচিত ছিল ৷ মন দিয়ে পড়িস নি ৷”

একটা পাতা টেবিলের ওপর মেলে ধরে ৷ সোহম এই পাতাটাতেই অনেক আন্ডারলাইন করেছে ৷ পরিমলকে উদ্দেশ্য করে অম্বরীশ বলল,  “ এতক্ষন যা যা দেখলে সে গুলো প্রযুক্তির বিস্ময়কর কারিকুরী ৷ এবার আসি আসল অপরাধের প্রসঙ্গে ৷ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি আশির্বাদ বা অভিশাপ হয় তার প্রয়োগের ওপর৷ জান পরিমল, একজন মানুষের চরিত্র হননের সবথেকে বুদ্ধিমান পদ্ধতি হল, মানুষটার বলে যাওয়া অনেকগুলো কথার থেকে সিলেক্টিভলি কিছু কিছু অংশ তুলে নিয়ে সেগুলো জুড়ে মানুষটার সম্বন্ধে তার চরিত্রের পুরো উল্টো রকমের একটা ধারনা  জনমানসে তৈরী করে দেওয়া ৷ অনেকটা ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’-র মতন ব্যাপার ৷ বইতে আন্ডারলাইন করা বাক্যাংশ গুলো দেখ | এগুলোই ভিডিওতে পরপর শুনতে পাবে ৷ এই বক্তৃতাটায় বিভাস বাংলার অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে বিকল্প অর্থনীতির রূপরেখা সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছেন ৷
এই জায়গাটা দেখ| ওনার সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘বিশ্বাসে মিলায় বিভাস ৷ তর্কে বহুদুর ৷’ তারপর দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘ রাজনীতিতে অপরিপক্ক স্বার্থান্বেষীদের দাপট৷ সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ৷ ততদিন নিভৃতে প্রস্তুতি নিতে হবে।‘ অথচ এই দুটো কথাকে জুড়ে মহুয়ার প্রথম প্রশ্নের উত্তর বানানো হয়েছে ৷ তারপর এই জায়গাটায় আবারও কর্মীদের মনোবল অটুট রাখার জন্য বলেছেন ‘মহাকালের তাণ্ডব অচিরেই শেষ হবে ৷ তারপর কুজ্ঝটিকার মুক্তি |’ এইটা দিয়ে মহুয়ার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সাজানো হয়েছে ৷ এবার এই জায়গাটা দেখ | মানুষের স্বার্থে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন বোঝাতে গিয়ে প্রাচীন কাল থেকে ভারতের নিজস্ব বিকেন্দ্রীকৃত অর্থনৈতিক প্রথার সনাতন ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে বলেছেন,  ‘যদি আমাকে বিশ্বাস কর, তাহলে সনাতনে আস্থা রাখ ৷ সনাতনই সামনে এগোনর পথ ৷’ উনি কিন্তু কোথাও সনাতন পার্টীকে সমর্থন করতে বলেননি৷ অথচ এখানে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে মানুষ ভাববে সনাতন পার্টিকে ভোট দিতে বলা হয়েছে ৷ আরও দেখ, শেষের দিকে তিনি বাংলার অভ্যন্তরীণ যে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি শোষণে মদত দিচ্ছে তাদের চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, ‘বিশ্বাসঘাতকদের বাংলার মানুষ ক্ষমা করবে না ৷ জয় অবশ্যম্ভাবী!’  অথচ ভিডিওটা শুনলে মনে হবে যেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্বাস ঘাতক বলা হয়েছে ৷”

এই পর্যন্ত বলে থামল অম্বরীশ ৷ সুচরিতার অভিব্যক্তিতে একরাশ নীরব প্রশংসা ঝরে পড়ছে ৷ পরিমল দুহাতে তালি দিয়ে একটা স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিতে দিতে বলল, “ অসাম! ব্রিলিয়ান্ট ! আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব ৷ কিন্তু কাজটা করল কে? কোন ধারনা আছে ?”

এরপর, সুচরিতা পরিমলকে মনোজ স্যারের সাথে মহুয়া রায়ের কথোপকথনের ঘটনাটা বলে ৷ সবশুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিমল ৷ ধীরে ধীরে বলে, “ এবার সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ! একটা কথা আমি এতক্ষণ আপনাদের জানাইনি৷ অসমর্থিত সূত্রে আমাদের কাছে একটা খবর এসেছে , দিল্লীর একটা রিসর্টে কাল মহুয়াকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ৷ মিডিয়ায় খবরটা চেপে দেওয়া হয়েছে ৷ শুনছি দিল্লী পুলিশ এটাকে সুইসাইড বলেছে ৷ কিন্তু আমাদের সোর্স বলছে ঠান্ডা মাথার খুন | “

কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল সুচরিতা আর অম্বরীশ ৷ পরিমল উঠে পড়ল ৷বলল, “ এবার আমায় যেতে হবে ৷ রাতেই একটা রিপোর্ট পাঠাতে হবে ওপর মহলে ৷ তবে বন্ধু হিসেবে একটা সাজেশন দিচ্ছি ৷ আই থিঙ্ক ইউ বোথ মে বি ভালনারেবল টু সাম এটাক৷ টু বি সেফ, আপনারা প্লিজ কিছুদিন আউট অব স্টেশন হয়ে যান ৷”

একটু থেমে বলল, “ প্রযুক্তির বিষয় আমি কিছুই বুঝি না ৷ তবে এই পুরো জিনিসটা আপনার থেকে শোনার পর ভবিষ্যতের একটা ভয়ংকর আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠছে ৷ আধুনিক সভ্যতায়   মানুষ মানুষের থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে ততই যন্ত্রকে আঁকড়ে ধরছে৷ জানেন, আমার মনে হয় এর পেছনে একটা গভীর অবচেতন দর্শন কাজ করছে ৷ একজন অতি দরিদ্র নিরক্ষর মানুষও অবচেতন মনে বিশ্বাস করে যে , ‘  মেশিন ডাস নট চিট!’ মানুষই মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করে। কিন্তু, যেদিন মানুষ দেখবে, যন্ত্রও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে, ঠকাতে পারে, মানুষ যাবেটা কোথায় বলুনতো ?”

পরিমলের কথা শুনে ঘরে একটা নিরবতা নেমে আসে ৷ বড় খাঁটি কথা বলেছে পরিমল ৷ নিরবতা ভেঙে বিদায় নিল সে,  “ আচ্ছা চলি ৷ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের ৷ নমস্কার ৷”

***********

সুচরিতা দের বাড়ীর থেকে একটু দূরে একটা ছোট টিলার মাথায় বসে বসে দূরের পাহাড়ের সারির ওপর রৌদ্র মেঘের আলোছায়ার খেলা দেখছে অম্বরীশ ৷ হঠাত দূর থেকে সুচরিতার আওয়াজ পেল ৷ দৌড়তে দৌড়তে এদিকেই আসছে ৷ “রিজ়দা, পরিমলদা ফোন করেছিল ৷  স্টেট সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট মনোজ স্যারের ল্যাব সিজ় করেছে ৷ ওদিকে R P BANGLA নাকি ওদের সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে ভিডিওটা তুলে নিয়েছে ৷  পরিমলদা তোমার পারমিশন চাইছে ৷ তোমাকে হাইলাইট করে পুরো ইনভেস্টিগেশনের একটা স্টোরি করতে চায় ৷  কি দারুন ব্যাপার বল !” হাঁফাতে হাঁফাতে বলল সুচরিতা |

অম্বরীশ নিরাসক্ত ভাবে বলে ওঠে, “ধুর ৷ মানা করে দে আমার নাম জড়াতে ৷ আমি তো যা কিছু করেছি আমার অন্তরের সত্যের দেবতা কে কালিমামুক্ত করার তাগিদে ৷ দেবতাকে কালিমা  ঘুচিয়ে স্বমহিমায়  আবার প্রতিষ্ঠিত করেছি ৷ আর আমার কিছু চাইনা৷”

অম্বরীশের কথা শুনে একটা সরল হাসি সুচরিতার গাল বেয়ে পলাশ রাঙা জঙ্গলে যেন ছড়িয়ে গেল ৷ কোন এক গাছের অদৃশ্য আড়াল থেকে বেজে উঠল কোকিলের কুহুতান বসন্তের বন্দনায় !

***** শেষ ****

Facebook Comments