হাসান শরিফ
একটা বিশাল বড় খাটের এক ধারে আমি বসে আছি। আসলে খাটটি খুব বড় নয়, বরং আমিই বেশ ছোট সাইজের। ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। আমার ঠিক সামনে খাটের অধিকাংশটি জুড়ে একটি ক্যারাম বোর্ড। বোর্ডের চার ধারে চার জন মানুষ। তাদের মধ্যে আমাকে নিয়ে দুটি শিশু। আমার ডান পাশে আমার মামাতো ভাই গাবলু। সে ক্লাস ওয়ান-এ পড়ে, এই গ্রামেরই এক স্কুলে। তার প্রধান গুণ- সে মারাত্মক ভালো ‘গুলি’ খেলে। রংচঙে গুলি নিয়ে তাকে যেখানে সেখানে, উঠানে-আঙ্গিনায় পাড়ার ছেলেপুলেদের সাথে ধুলোয় উবু হয়ে বসে খেলতে দেখা যায়। এখন বেশ সকাল, গুলি খেলার পার্টনাররা ঘুমোচ্ছে, তাই গাবলু এখনও বাড়িতে। আমার উল্টোদিকে একটা চেয়ার টেনে বসেছে আমার ছোট মামা, এক্রামুল কবীর। মামা পড়াশুনোর পাঠ চুকিয়েছে বেশ কয়েকবছর আগেই, এখন শুধু চুটিয়ে ফুটবল খেলে। মামার ছোটখাটো চেহারা, কিন্তু ইয়া মোটা মোটা থাই। মামাকে দেখলেই আমার মারাদোনা মনে হয়। মামা খেলেও মারাদোনার মত। গ্রামে তো বটেই, গ্রামের বাইরের টিমও মামাকে খেলতে নিয়ে যায়। আমার বাঁ পাশে আমার আর এক মামা, ইনু মামা। এই মামা শুধু গান শোনে, আর সব ব্যাপারে অদরকারি মজার মন্তব্য করে। যেকোনো আড্ডাতে ইনুমামা না থাকলে জমে না।
ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান বাজছে, “টারজান, ও মাই টারজান”। ইনু মামা গুনগুন করতে করতে বোর্ডে স্ট্রাইকার বসাচ্ছে, হিট করবে। ছোট মামা বলল, “পাউডার দে দিন, গুঠি নড়তেস না।” ইনু মামা হাঁক ছাড়ল, “জিয়াউল, এ জিয়াউল!” কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না। পাউডারের কৌটোটা অবশ্য দেখাই যাচ্ছে। শো-কেসের ভিতরে পন্ডসের গোলাপি কৌটো। তার উপর চারটে পাপড়িওয়ালা গোলাপি ফুলের ছবি। আমরা কেউই উঠলাম না। কেউ না কেউ এখনি আসবে।
ইনু মামা জোরে হিট করল। রেড সমেত খান চারেক সাদা গুঠি পকেটে ঢুকে গেলো। গাবলু তালি দিল, “দারুণ, আব্বু!” গাবলু হিট করলেও চার-পাঁচটা গুঠি পড়ে। পরের বার আমার হিট, একটার বেশি গুঠি পড়লে আমিই খাট থেকে পড়ে যেতে পারি।
বারান্দা থেকে দাদুর ডাক শোনা গেলো, “জেয়াউল, এ…… জেয়াউল!” দাদু সকাল সাড়ে তিনটেতে ওঠে। বিশেষ কোন কাজে নয়। এমনিই। মা বলেছে, মামারা যখন ছোট ছিল দাদু সবাইকে ওই সময় পড়তে বসাত। ফজরের নামাজ পড়ে হাতে একটা বেত নিয়ে দাদু বারান্দায় খাটের উপরে বসত। নিচে মেঝেতে আমার মামা, খালামারা একটা মাদুরের উপর। দাদু ছাড়া সবাই ঢুলত,আর বেতের বাড়ি খেত।এখন কেউ পড়তে না বসলেও দাদু প্রতি রাতেই একই সময়ে উঠে যায়। উঠেই উঁচু গলায় প্রশ্ন করে, “কই, চা কই?” যেন ঘুম থেকে ওঠার আগেই চা বিছানার পাশে পাওয়ার কথা ছিল! আমরা পাশ ফিরে শুই। আমাদের পাশে সবার শেষে শুতে আসা নানিমা উঠে পড়ে। চারপাশ সেসময় এতই শান্ত থাকে যে, কয়েক মিনিট পরেই দাদুর চায়ে চুমুক দেওয়ার শব্দ শোনা যায়। নিস্তব্ধতা অবশ্য বেশিক্ষণ থাকেনা, কারণ তার পরেই দাদুর জিয়াউলদাকে ডাকা শুরু হয়ে যায়, “জিয়াউল, এ জিয়াউল!” জিয়াউলদা দাদুর হাজার ডাকেও ওঠেনা। দাদু “জিয়াউল” থেকে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে “এ জেয়াউল”-এ চলে আসে। তারপর বিড়ি ধরিয়ে হতোদ্যম হয়ে স্বগতোক্তি করে, “শোর কনেগার (শুয়োর কোথাকার)!” আমার ছ’বছরের বোন জড়ানো গলায় আমাকে প্রশ্ন করে, “দাদু ঘুমাচ্ছেনা কেন? এই দাদা, দাদু ঘুমাচ্ছেনা কেন?”
জিয়াউলদা আমার বড় খালামার ছেলে। বড় খালামা দাদুর কাছেই ওকে রেখে গেছে সেই কবে। কেন জানিনা; ওদের টাকা-পয়সা কম বলে? নাকি জিয়াউলদার পড়াশুনোর জন্য? জিয়াউলদাকে সব সময় গালাগালি করে বলে দাদুর উপর আমার মাঝে মাঝেই রাগ হয়। আমি অবশ্য এই মুহূর্তে ঘরের জানলা থেকে জিয়াউলদাকে দেখতে পাচ্ছি। বারান্দা থেকে তো আর বাড়ির পাশের গোয়ালটা দেখা যায় না, তাই দাদু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আমি পাচ্ছি। জিয়াউলদা গোয়ালে। খড় ডোবাচ্ছে মাটির বড় মালসায়। মামাদের গোয়ালে তিনটি গরু। একটি উৎসুক মুখে অপেক্ষা করছে জিয়াউলদার সামনে। বাকি দুটি ইতিমধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে অন্য দুটি গামলায়। ওদের চোয়াল নাড়ানো দেখে আমার বেশ ঘুমঘুম পায়। জিয়াউলদার মুখে নিমের দাঁতন, চোখ বিষণ্ণ। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কেউ মন খারাপ করে ঘুরলে একটুও ভালো লাগেনা।
ছোট মামা বলল, “ইন্দা, কি রে, নৌকোর কি হল?”
ইনু মামা বলল, “হব্যানি, কটায় বলবো বল দিন?”
গাবলু বলল, “দুপুরে খেয়েই যাবো?”
আমি বললাম, “জুলি বুবুরা তার মধ্যে আসবে?”
আজ বিকেলে আমরা ইছামতীর চরে যাবো। আজ সপ্তমী। জুলিবুবু ছোটমামাকে বলে রেখেছে ওরা এলে তারপর যেন বেরনো হয়।
কলকাতা থেকে এই মাগুরুতি গ্রামে আসতে ভালোই সময় লাগবে। তার উপর জুলি বুবুরা আসবে গড়িয়াহাটের ডোভার লেন থেকে। আমরা তো গাইঘাটা থেকে এলাম গতকাল। আমাদেরই দু-আড়াই ঘণ্টা লাগল। প্রথমে বাসে হাবড়া। সেখান থেকে বাস বদলে খোলাপোতা। তারপর ভ্যানে করে মাগুরুতি। এই পুরো যাত্রাটাই আমার অবশ্য খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে ভ্যানে করে গ্রামে আসার সময়টা। গ্রামের রাস্তা একেবারেই ভাঙাচোরা। ভ্যানে ঝাঁকানি খেতে খেতে যেতে হয়। ভ্যান যখন কারো গোবর নিকোনো উঠানের পাশ দিয়ে যায়, দেখি বাড়ির পিছনে ঝকঝকে সবুজ কলাগাছের সারি। যেন এই মাত্র বৃষ্টি হয়েছে। কাঁদি-কাঁদি কলা ঝুলছে। উঠোনে মুরগি খেলছে, হাঁস ঘুরছে। বাড়ির আঙ্গিনায় সিমেন্ট বাধানো তুলসী মঞ্চ। আর ঘরের মাটির দেওয়ালে ঘুঁটে। ঘুঁটের উপর পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ। বাড়ির সামনে পাটকাঠির ডাই। ডাইয়ের উপর মাকড়শার জাল। মাকড়শার জালে জলের ফোঁটা।পাতা পড়ে পড়ে মাঠের মত মসৃণ সবুজ হয়ে যাওয়া পুকুরের এক কোণায় পাট পচছে। পচা পাটের গন্ধে ঝিমানো, বাঁশবনের ছায়ায় অন্ধকার ভাঙা ইটের রাস্তা। তিরতিরে হাওয়া দিচ্ছে। এদের মধ্যে দিয়ে আমাদের ভ্যান চলে। মামাবাড়ির দিকে। সেখানে সবাই আছে। সারা বছর যাদের দেখিনি, তারাও আছে। তাই ঝাঁকুনি খেলেও আমার ভালো লাগে। আমার তো মনে হয় আমি যেন পক্ষীরাজে চেপে যাচ্ছি।
ভ্যানের পথে দুটো পুজো মণ্ডপ পড়ে। সেখানে সকাল থেকেই বাচ্চাদের ভিড়, ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কোন বাচ্চা কাঁদছে, কেউ বেলুন নিয়ে লোফালুফি করছে। একজনের হাতের খেলনা বন্দুক আমাদের দিকে তাক করা। দুম করে শব্দ হল। বন্দুকের পিছনে বারুদের টিপওয়ালা লাল ফিতের একটা টুকরো ধোঁয়ার সাথে উড়ে গেলো। হো হো করে হেসে উঠল সে! আমিও হেসে ফেললাম।
বাসে আসার পথে কত মণ্ডপে কত রকম গান যে শুনলাম! হিন্দি-বাংলা ছবির গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব একটা শুনতে পাই নি। কোন মণ্ডপে আশা ভোসলে গাইছেন, “কথা হয়েছিল, তবু কথা হল না।” কোথাও কিশোর কুমার, “আমার পূজার ফুল”। এখন শুনছি রাহুল দেব বর্মণের “মনে পড়ে রুবি রায়”। বাড়িতে ক্যাসেট প্লেয়ারে শোনার থেকেও মণ্ডপে গান শুনতে যেন আরও বেশি ভালো লাগে। মণ্ডপ ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে আসার পরও সেই গান হলুদ ফুলে ছাওয়া সরষের ক্ষেত, আর সবুজ ধানের ক্ষেত পেরিয়ে, ফুরফুরে হাওয়ার মৃদু আবেশ নিয়ে কানে ঢুকে যায়। গান থামলে কানে আসে ঢাকে কাঠি পড়ার আওয়াজ। মিঠে চেনা তাল। সেই তালে পুরনো আর নতুন দুয়েরই গন্ধ মিশে আছে। এই আওয়াজ যেন দূর থেকে আরও বেশি ভালো লাগে।
মনে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব শুরু হয়ে গেলো পুজোর প্রথম দিনেই। আর মাত্র চার দিন পরেই পুজো শেষ হয়ে যাবে। ধুর!
জুলি বুবুরা দুপুরের মধ্যে আসতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। জুলি বুবু আমার মেজ খালামার ছোট মেয়ে। মেজ খালামার বড় মেয়ের নাম টুটুল। দুই বোনই আসবে নিশ্চয়। দুই বোন দুরকম। একজন ডিমের শুধু সাদা অংশটা খায়, আর একজন শুধু কুসুম। একজন চুল লম্বা রাখে, আর একজন বয় কাট। একজন ইলিশ ভালো বাসে, আর একজনের ইলিশ দেখলে গা গোলায়! টুটুল বুবু আমার থেকে অনেক বড়। আমাকে পাত্তাই দেয়না। কিন্তু জুলি বুবু মিষ্টি করে কথা বলে আমার সঙ্গে। আমি যে বুবুর থেকে অনেক ছোট বুঝতেই দেয়না। সব ব্যাপারেই যেন আমার মতের অপেক্ষা করে। যেমন এই কথাটা যদি জুলি বুবুর সামনে হত, বুবু ঠিক আমাকে জিজ্ঞেস করতো, “বিকেলে গেলেই ভালো, সন্ধ্যে সন্ধ্যে, বল বিপুল?” বুবুকে দূর্গা ঠাকুরের মতই দেখতে। আমার তো তাই মনে হয়। তবে সবাই বলে বুবুর রঙ চাপা। তাতে কিছু অসুবিধে আছে মনে হয়। আমি ঠিক জানিনা। আমি জুলি বুবুর জন্য সকাল থেকেই অপেক্ষা করছি। বুবু এলে তবেই আমার মামাবাড়ির পুজো শুরু হয়েছে মনে হয়। সত্যদের দোকানের কটকটি বুবুর সাথে না খেলে অতটাও কি ভালো লাগে? ঠিক যেমন বুবু না শুনলে আমার প্যান্ডেলে গিয়ে ঢাক বাজাতেও ইচ্ছে করেনা।
আজ চরে যাবো মামাদের আর বুবুদের সঙ্গে। খুব হইচই হবে। আনন্দে আমার দৌড়তে ইচ্ছে করছে।
ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙল আজ, শুনলাম সেজো মামা কিছু একটা বলছে। মামার বাড়িতে এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়। প্রতিদিনই যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন অনেকে কথা বলছে শুনতে পাই। পাখির কিচিরমিচিরের মত। শুনতে কি ভালো লাগে! কে কথা বলছে সেটা বুঝতেও পারি। আজ যেমন সেজো মামা, সেজো মামিমা, নানিমা, আর মা কথা বলছিল। কিন্তু কি নিয়ে যে কথা হচ্ছে কিচ্ছু মাথায় ঢোকেনা। এই বাড়ির মাঝখানে একটা বড় আঙ্গিনা। তার এক দিকে রান্নাঘর, খাওয়ার জায়গা, একদিকে বাথরুম, আর বাকি দুদিকে থাকার ঘর গুলো। সবাই রান্নাঘরের পাশের দাওয়ায় বসে গল্প করছিল। আমার পঞ্চম মামা অর্থাৎ হুমায়ূন মামা সারাদিন রেডিও শোনে। মামা এখনও যথারীতি রেডিও কোলে নিয়ে রান্নাঘরের মেঝের উপরে পাতা একটি মাদুরের উপর বসে আছে। ভয়েস অফ আমেরিকা বা বি বি সি, কিছু একটা চলছে। নানিমা মেঝেতে বসে ব’টিতে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছে। মা’র মুখে ব্রাশ। সেজো মামা আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে মাকে কিছু বোঝাচ্ছে। আমাকে দেখে সেজো মামা বলল, “নদীর ধারে যাবি নাকি, বিপুল?” এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। আমার নদী দেখতে খুব ভালো লাগে।
নদীর পথে আসতে আসতে কত মানুষের সাথেই যে দেখা হল। সবার সাথেই সেজো মামা গল্প করছে। এত জনকে চেনে মামা! আমার খুব অবাক লাগে। আমি তো কাউকেই চিনিনা। আর দেখো, সবাই জিজ্ঞেস করছে আমার কথা, “এ নাদিরার ছেলে না? খোকা, কোন কেলাসে পড় তুমি?” আমি ইচ্ছেমত কাউকে চাচা বলছি, কাউকে মামা, কাউকে কাকু বলছি। নদীর ধারে এসে দেখা গেলো পাড়ে বাঁধা নৌকোর মাঝির সাথেও সেজো মামার ভাব আছে। সে বলল, “মোফাজ্জেল, তোর সাথে ওডা কেডা?”
আমি নদী দেখছিলাম। জল দেখে আমার ভয় করছিল। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নৌকোটা দুলছে। চোখ সরিয়ে নিলাম। নদীর পাড় ধরেই অনেক দূরে চোখ চলে যায়। পাড় ঘেঁষে অন্তত তিন-চারটে প্যান্ডেল আরও দেখতে পেলাম। বড় বড় কালো বক্সের সামনে খালি গায়ে কিছু বাচ্চা নাচছে। মামা মাঝি চাচার সাথে কিসব কথা বলছে। আমি বললাম, “মামা, আমি চলে যাবো?” মামা ঘাড় নাড়ল দূর থেকেই। আমি একটা পাটকাঠি কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
জুলি বুবু এসেই হইচই শুরু করেছে। ইতিমধ্যে চার-পাঁচবার “নৌকো আসছেনা কেন”, “নৌকো আসছেনা কেন” বলে ছোট মামাকে বকেছে। খালামারা সবাই যাবে। মামারাও যাবে। সব মিলিয়ে পনেরো কুড়ি জন তো হয়েই যাবে। নৌকো বলা হয়েছে ছোট। ইনু মামা আর একটা নৌকো জোগাড় করতে বেরিয়েছে।
আমাদের বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যেই হয়ে গেলো। আমাদের নৌকোতে তুলতে গিয়ে ছোট মামা দুবার পা পিছলে জলে পড়ল। মা বলল, “পুটু, আমরা বসছি তুই জামাটা বদলে আয়।” মামা হিরোর মত জামা খুলে ফেলে বলল, “চলো দিন, কিসু হবে না।” আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি রে, বল নিস নি?” আমি বললাম, “নিয়েছি তো। গাবলুর কাছে। ওই নৌকোয়।” নৌকো ছাড়ল। হুমায়ূন মামা বসেছে আমাদের নৌকোতে। মামার কোলে মামার প্রিয় রেডিও বাজছে এখনো। রেডিওতে বলছে, “আজ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধীকে…” জুলি বুবু বলল, “মামা, প্লিজ বন্ধ করো।” হুমায়ূন মামা সঙ্গে সঙ্গে রেডিও বন্ধ করে দিলো, যেন কেউ আপত্তি করছিল না বলেই খুব কষ্টের সঙ্গে শুনতে হচ্ছিল।
কাউকে কিছুই না বলে জিয়াউলদা চুপ করে নৌকোর এক কোণে বসে আছে। জিয়াউলদা আছে জানলেই নানা কাজের ফিরিস্তি জিয়াউলদাকে ধরে দেওয়া হবে, তাই হয়ত। জিয়াউলদা কি অল্প হাসছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
নৌকো দুলতে দুলতে এগোচ্ছে। নৌকোর একধারে বসে ছোটমামা পা ডুবিয়ে দিয়েছে নদীতে। মা মাঝে মাঝেই বলছে, “ঠিক করে বস, পুটু।” নৌকোর অন্যধারে বসে জুলি বুবু ডান হাত নাচের মত জলে ডোবাচ্ছে, ওঠাচ্ছে। আমার একটু ভয় ভয় লাগছে। আমি সাঁতার জানি না। ভাবছি আমি পড়ে গেলে কে বাঁচাবে। জুলি বুবু কি সাঁতার জানে? জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “বুবু, তুমি সাঁতার জানো?” বুবু ঠিক বুঝে গেছে, “তুই, ভয় পাচ্ছিস, না রে, বিপুল? ছোটমামা জানে সাঁতার। আমি জানি না।” আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, “ছোটমামা ক’জনকে বাঁচাবে!” শুনে সবাই খুব এক চোট হাসল।
নৌকো যখন ঠিক মাঝ নদীতে হঠাৎ দেখি নৌকো আর নড়ছেনা। সকালের মাঝি চাচা খুব গম্ভীর মুখে বলল, “আর যাবে না, নেমে পড়েন”। শুনেই আতঙ্কে আমার বুক জমে গেলো । যা ভাবছিলাম তাই কি সত্যি হল! কে বাঁচাবে আমায়! মা কোথায়!
অন্যদের মুখে কিন্তু আতঙ্কের চিহ্ন নেই। সবাই হাসছে, যেন খুব মজার কিছু হয়েছে। ছোটমামা বলল, “বিপুল, লাফাবি নাকি?” আমি আবার তাকিয়ে দেখলাম চারপাশ। মাঝ নদীতে নৌকো দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি সাঁতার জানি না জেনেও মামা আমায় লাফিয়ে পড়তে বলছে! আমার সামনেই মামা নৌকো থেকে লাফ দিলো। আর কি আশ্চর্য! দেখি মামা মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ম্যাজিক! মামা বলল, “আয়, ভয় নেই, ডাঙা আছে।” আমি ভেবেছিলাম চরা মানে একটা দ্বীপ, সে দ্বীপ যে অল্প জলের নীচেও থাকতে পারে এটা বুঝিনি। আমি বললাম, “মামা চরা কতটা আছে এদিকে, আমি সাইডে পড়ে গেলে?” সবাই আবার হেসে উঠল।
অন্য নৌকো থেকে গাবলুও নেমে পড়েছে ফুটবল হাতে। নেমেই দমাস করে লাথি কষালো বলে। আমি নেমে পড়লাম। খালামাদের আর আমার মাকে কেমন ছোট মনে হচ্ছে দেখতে। সবাই এমন চিৎকার করে কথা বলছে, হাসছে, জলের উপর বাচ্চা মেয়েদের মত দৌড়াচ্ছে! বল ধরতে না পারার ছুতোয় আমি আর গাবলু সুযোগ পেলেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। সব থেকে বেশি পড়ছে জিয়াউলদা। পড়ছে আর তারস্বরে হাসছে। হুমায়ূন মামা প্যান্ট হাঁটুর উপর গুটিয়ে, রেডিও কাঁধের উপর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা হাসি হাসি। রেডিও আবার চালু হয়েছে।
সূর্য ডুবছে। অদ্ভুত লাল আলোতে দুলছে নদী। সেই জলে দাঁড়িয়ে লাল আলো মুখে মেখে জুলি বুবু হাসতে হাসতে আঁজলা ভরে জল তুলছে, ফেলছে, মাঝে মাঝে ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার গায়ে, ছোট মামার গায়ে। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে আজ আর একটুও সন্দেহ নেই যে জুলি বুবুই দূর্গা ঠাকুর। সে জন্যই বুবুর সাথে বছরে একবারই আমার দেখা হয়। পুজোর ক’টা দিন।
একটু দূরে বাঁধা দুটি নৌকো। নৌকোতে হাঁটু মুড়ে বসে এক মাঝি বিড়ি টানছে। পাড়ের এক প্যান্ডেলে ধুনুচি নিয়ে পাগলের মত নাচছে কয়েকটি ছেলে মেয়ে। ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি যেন। ঢাক বাজছে । কি অসম্ভব ভালো লাগছে ঢাকের শব্দ! আকাশ জুড়ে আজ রূপকথার মত লাল-নীল রঙের খেলা।
আমি জলে হাত রেখে চোখ বুজে বললাম, ঠাকুর, সপ্তমী যেন অন্তত আর এক দিন থাকে।
Facebook Comments