Site Overlay

সিংহবাহিনী

অভিযান ভট্টাচার্য্য

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সেই সিঙ্গিপুরের পোড়ো জামিদার বাড়িতে এসে পৌঁছলাম | গঙ্গার ধারে নিতান্ত গণ্ডগ্রাম এলাকা৷ নেহাত সমীরণ সঙ্গে এসেছিল তাই কলকাতা থেকে এতদূর আসতে পারলাম ৷ সমীরণ আমার ছোটোবেলার বন্ধু ৷ এখানকার ব্লক অফিসে অনেকদিন কাজ করে ৷ শহরে এলে চুটিয়ে আড্ডা হয় ৷ মাস খানেক আগে এরকমই একটা আড্ডায় আমার সমস্যার কথাটা বলেছিলাম ৷ সমস্যা আর কিছুই নয় – পেশার ঝক্কি ৷ খবরের কাগজের জুনিয়র রিপোর্টার হবার অনেক জ্বালা ৷ এডিটরের মন মেজাজের থই পাওয়াই মুশকিল ৷ পুজোর মাস দুই আগে এডিটরের এবার খেয়াল চাপে, পুজোর আগে এক সপ্তাহ ধরে একটা স্পেশাল কলাম চলবে ৷ গাঁ গঞ্জ থেকে নানান ‘অন্যরকম’ পূজোর খবর জোগাড় করে এনে রসিয়ে ছাপতে হবে ৷ এখন, ঠিক কি রকম হলে যে ‘অন্যরকম’ হবে, সেটা তিনি খোলসা করেননি৷ প্রতিবেদন জমা পড়লে সেখান থেকে তিনি ছেঁকে নেবেন ৷ যাদেরটা ছাঁকনিতে ধরা পড়বে তাদের ইন্সেনটিভ পাক্কা ৷ যারা ধ্যাড়াবে, তাদের যে গলাধাক্কা হতে পারে সেটাও মুখে না বলে ভাবেসাবে ভালই বুঝিয়ে দিয়েছেন ৷ টিম বানিয়ে দিলেন ৷ সর্বনাশের মাথায় বাড়ি মেরে আমাকেও তাতে ঢোকালেন ৷ দিব্যি পেজ-থ্রি সেলিব্রিটিদের মুচমুচে খবর দিয়ে চাকরীটা ঠেকনা দিয়ে রেখেছি ৷ ওনার তা সইল না ৷ পূজোর আগে বর্ষার চোটে চারদিকে এমনিতেই  বাণবন্যের ভয় ৷ এর মধ্যে কোত্থেকে ঘুরে ঘুরে অন্যরকম পূজো খুঁজে বার করব ? দেবীর এবার ঘোটকে আগমন ৷ ফল ছত্রভঙ্গ | আর কার কি ভঙ্গ হবে জানিনা, আমার চাকরিটি যে সাঙ্গ হবে, তা বেশ বুঝতে পারছি ৷ সেটাই বলেছিলাম সমীরণকে ৷ ব্যাটা ঠিক মনে রেখেছে ৷ দু’ দিন আগে আমায় ফোন ৷ ওর ব্লক অফিসের মধ্যে সিঙ্গিপুর গ্রামে নাকি এক অদ্ভুত পুজো শুরু হচ্ছে এবার ৷ গঙ্গার ধরে পাঁচশ বছরের পুরোনো একটা জমিদার বাড়ী আছে ৷ ভুতুড়ে বাড়ি বলে এলাকায় বদনাম আছে বাড়ীটার | রাতবিরেতে নাকি ধুপধাপ আওয়াজ হয় ৷ প্রশাসনের কাছে অবশ্য খবর আছে যে আসলে ওই তথাকথিত ভুতুড়ে বাড়ি থেকে নাকি রাতের অন্ধকারে পুরোনো কাঠ, পাথর এইসব গঙ্গা দিয়ে পাচার হয় ৷ এক সপ্তাহ আগে এক ভোররাতে ভুতুড়ে বাড়ির দিক থেকে বিকট একটা শব্দ হয় ৷ দিনের আলো ফুটলে এলাকাবাসী গিয়ে দেখে, একটা প্রকান্ড দেওয়াল ভেঙে পড়েছে ৷ তার তলায় চাপা পড়েছে তিনজন ৷ সম্ভবতঃ এরা এসেছিল একটা দরজা খুলে নিয়ে যেতে ৷  লাগাতার বর্ষায় পাঁচশ বছরের দুর্বল গাঁথনি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল ৷ দেওয়াল ভেঙে পড়ে তিন পাচারকারীর জীবন্ত সমাধি হয়ে গেছে ৷ কিন্তু , সেটা বড় কথা নয় ৷ আসল বিষয়টা হল, ভাঙা দেওয়ালের পেছনে প্রকাশমানা হয়েছেন এক প্রাচীন দেবীমূর্তি – সিংহবাহিনী | এলাকাবাসী প্রাথমিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে প্রশাসনে খবর দেবার আগেই এক ছিঁচকে চোর মূর্তিটা হাপিস করতে গেছিল ৷ কিন্তু, মূর্তিটা নিয়ে পালাতে যেতেই কোত্থেকে একটা লোহার বিম মাথার ওপর পড়ে সেই চোর অজ্ঞান হয়ে যায় ৷ এলাকার মানুষের বিশ্বাস জন্মায়, সিংহবাহিনী অতীব জাগ্রত ৷ এতদিনে মায়ের পূজা পাবার ইচ্ছে হয়েছে , তাই তিনি প্রকাশমানা হয়েছেন ৷ অতএব, তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে ৷ এলাকার ক্লাব , পঞ্চায়েত, সব লেগে পড়ে এতদিনের জংলা জমিদারবাড়ীর একটা চাতাল পরিষ্কার করে ফেলেছে ৷ আলোর ব্যবস্থা হয়েছে ৷ একজন পুরোহিতও ঠিক হয়ে গেছে ৷ শুরু হয়ে গেছে পূজো অর্চনা | চারদিন ধরেই মৃন্ময়ী দুর্গার সামনে অধিষ্ঠাত্রী পাথরের সিংহবাহিনীরও পুজো হবে ৷ সমীরণ খবরটা আমাকে দিল ৷ সিংহবাহিনী আর কাকে কৃপা করবেন জানি না, তবে আমি তো মনে মনে জোড়া পাঁঠা প্রমিস করে ইউটিউব আর ফেসবুকে ভ্লগাররা এটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই পত্রপাঠ পৌঁছে গেলাম ধ্যারধ্যারে সিঙ্গিপুর | পেট বড় বালাই ৷

*******

শেষ বর্ষার কাদা বাঁচিয়ে শ্যাওলা মাখানো পেছল চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে আমি আর সমীরণ ঢুকে পড়লাম সেই প্রায় ভগ্নস্তূপের ভেতরে ৷ মনে হল এটাই হয়তো ছিল সিংহদ্বার ৷ বাড়ির ভেতরে একটা অংশে খিলেন তোলা চণ্ডীমন্ডপের মতো কিছুটা এখনও টিঁকে আছে ৷ সেখানেই চাতাল ঘিরে বাঁশ বাঁধা হয়েছে ৷ ওখানেই পুজোটা হবে ৷ চারিদিকে জঙ্গল সাফাই হচ্ছে ৷ ডাঁই করে রাখা আগাছার স্তূপ আর ইতিউতি ছড়ানো হেঁসো আর কাস্তে দেখে তা মালুম হচ্ছে ৷ কিন্তু আশপাশে কেউ নেই ৷ গ্রামবাংলার ঝিমধরা দুপুর | সবাই বোধহয় ঝিমুতে গেছে ৷ আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সমীরণ লোকজন ডাকতে গেল ৷ আমি একা একা ওই বিশাল ভগ্নস্তূপের এদিক ওদিক একটু দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম ৷ ভেজা বুনো গাছ আর পাঁচশ বছরের পুরোনো ভেজা ইঁটের গন্ধ মিলে মিশে যেন ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে ৷ শুরুতে একা একা একটু ভয় ভয় করছিল ৷ গন্ধের ঘোরে ভয়টা আস্তে আস্তে ভুলতে থাকলাম ৷ জায়গাটায় কি যেন একটা আছে ! গঙ্গার গা ঘেঁষে একটা ভাঙা অলিন্দ ৷ গঙ্গা যেন ওর গা ঘেঁষে বাঁক নিয়েছে ৷ আস্তে আস্তে অলিন্দের কিনারায় দাঁড়িয়ে নীচে গঙ্গার প্রবহমান ধারার দিকে তাকালাম ৷ এখন ভাঁটি চলছে ৷ স্রোত উল্টো বইছে ৷ স্রোত ! স্রোত ! মনে হচ্ছে  যেন ওই স্রোতের মধ্যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আমি আমারই অনুসদ্ধান করছি ৷ সব পাল্টে যাচ্ছে ৷ চারিপাশ, আমি , এই ধ্বংসস্তূপ, সব ! কত মানুষ চারিদিকে ৷ সব যেন সময়ের ভাঁটির স্রোত  থেকে উঠে আসছে একে একে আর ভিড় করছে আমার চারপাশে ৷ এইতো সেই বাড়ী ! কোথায় যেন দেখা ৷ কতদিনের চেনা ৷ ওইতো বারমহল , ওইতো অন্দরমহলের রাস্তা, ওইখানে আস্তাবল , ওই পাশে গেলেই তো সেরেস্তা ! চণ্ডীমন্ডপ ৷ ওই তো সিংহদরজা দিয়ে কে যেন আসছে ৷ সমীরণ ! না তো! খুব চেনা অন্য কেউ ৷ হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে ৷ নায়েব শম্ভুচরণ! হন্তদন্ত হয়ে ডাকতে ডাকতে আসছে, “ হুজুর! সর্বনাশ!”

“ কি হয়েছে শম্ভুচরণ ?” শান্ত গলায় বললেন জমিদার রণেন্দ্রনারায়ণ রায় ৷

“ হারু ডাকাত সিংদরজায় চিঠি রেখে গেছে ৷ আজ রাতেই আসবে !”

“ হারু ! হরিপদ ? কতদিন দেখিনি তাকে ৷ বড় ভালো যোদ্ধা ছিল ৷ যেমন বল্লম, তেমনি অসিচালনা ৷ মুর্শিদাবাদ থেকে নবাব যখনই ফৌজ চেয়ে পাঠাতেন, হারু ঝলমলে বর্ম গায়ে লস্কর নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে কুচ করত ৷ প্রতিবার যাবার আগে আমার পা ছুঁয়ে বলত, ‘ অশিব্বাদ করেন বাবু – সিঙ্গিপুরের মান যেন রাখতে পারি !’ সত্যিই মান রেখেছিল ৷ তারপর সব কি যে হল!” একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামলেন রণেন্দ্রনারয়ণ৷ “ পলাশীর পর ওকে আর দেখিনি ৷ পরে শুনলাম নাম করা ডাকাত হয়েছে ৷ যাক, এতদিন পর  অন্ততঃ দেখাটা হবে ! তা কি চায় সে ?”

শম্ভুচরণ আরেকবার চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে বলল, “ আজ্ঞে বিশেষ করে তো কিছু লেখেনি ৷ শুধু বলেছে হারুডাকাতের সম্মানটা রাখতে ৷ দালানের চৌকাঠটুকু পার করে হুজুরের পদরেণু নিতে কেউ যেন তাকে বাধা না দেয়, হুজুর যেন সেটা দেখেন ৷ হুজুরের চৌকাঠ থেকে খালি হাতে সে ফিরবে না, এ বিশ্বাস তার আছে ৷”

বড় করুণ হাসি হাসলেন রণেন্দ্রনারায়ণ।

“কি আর দেব! একদিকে মন্বন্তর, আরেকদিকে কোম্পানী আর নবাবের সেনাদের জুলুম ! জমিদারী টেঁকানোই দায়! খাজনার দাবী মেটাতেই নিদ্রা ছুটেছে ৷ নিরন্ন প্রজাকে পীড়ন করে খাজনা আদায় সম্ভব নয় – একথা মুর্শিদাবাদে জানানোয় ভালোর চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশী ৷ যে কোনোদিন নবাবের সৈন্য আর কোম্পানীর লুঠেরার দল কাছারীতে হামলা করতে পারে ৷” একটু থেমে ধীরে ধীরে নিজের মনেই বলে উঠলেন, “ আমারই ভুল ৷ মসনদে যে আলিবর্দী নেই, সিরাজ নেই – ভুলে গেছিলাম ৷  এখন তো আর মুর্শিদাবাদে নবাব নেই, যে দুঃসময়ে খাজনা মকুব করে উল্টে রাজকোষ থেকে অর্থ ঢেলে চাষী আর কারিগরদের পাশে দাঁড়াবে, মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করবে ৷ মুর্শিদাবাদের মসনদে আছে হাত-পা-মাথা নাড়া পুতুল ৷ দড়িটা কলকেতায়, কোম্পানীর মাথাদের হাতে ৷”

খুব চিন্তিত ভাবে নায়েব শম্ভুচরণ বলল, “ কত্তাবাবু, কাছাড়ীর পেছনে পুরোনো তোষাখানায় কিছু রৌপ্যমূদ্রা আর কয়েকভরি সোনার গহনা আছে ৷ কোম্পানী যদি জুলুম করে তাহলে ওইটুকু দিয়েই তাদের তুষ্ট করে এযাত্রা রক্ষা পাবার জন্য রাখা আছে ৷ আর তো কিছুই নেই! হারু চিঠিতে যতই বিনয় দেখাক, বাড়ি ঘেরাও করে যে রুদ্রমূর্তি হবে না, তার নিশ্চয়তা কই? তার দাবী মেটাতে তখন তো ঐ তোষাখানাই সম্বল ৷ তাহলে কোম্পানীর লোককে সামলাবো কি করে ?”

রণেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর ভাবে চিন্তামগ্ন হলেন ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ আপাততঃ ওদের জন্য ভোজের একটা আয়োজন না করলে জমিদারীর সম্মান থাকে না ৷ কতজন যে সঙ্গে আসছে কিছু বলে নি ৷ তবু ভাঁড়ারে  যা আছে, তাই দিয়েই যথাসাধ্য আয়োজনের চেষ্টা কর ৷ হারুকে নিয়ে আমি ভাবিনা ৷ তবে, এই মম্বন্তরের সময় ওর দলের লোকেদের ওপর ওর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমি জানিনা | লেঠেলরা যে কজন আছে তাদের বল অন্দরমহলের দরজায় আর নাটমন্দিরে যেন পাহারায় থাকে ৷ ভবিতব্য যা আছে তা খন্ডানোর কোনো উপায় নেই। আর হ্যাঁ, অপরাহ্নের পর অন্তঃপুরের নারীরা যেন অন্দর মহলের বাইরে না বেরোয় ৷”

রনেন্দ্রনারায়ণের নির্দেশ মত জমিদারবাড়ীতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল ৷ ধীরে ধীরে অন্ধকার নামল ৷ সশঙ্কচিত্তে সবাই অপেক্ষা করতে লাগল ৷ লেঠেল সর্দার মনসুর আলি সিংদরজার ওপরের নহবৎখানার কুঠুরী থেকে নজরদারী চালাচ্ছিল ৷ রাত্রি প্রথম প্রহর শেষ ৷ কেউ কোথ্থাও নেই ! হঠাৎ মনসুর চিৎকার করে উঠল “হুঁশিয়ার ! হুঁশিয়ার!” ভেতরে লেঠেলের দল সতর্ক হয়ে যে যার জায়গায় দাঁড়াল ৷ রণেন্দ্রনারায়ণ ঋজু হয়ে সিংদরজার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেন ৷ মনসুর নেমে এল ৷ রণেন্দ্রনারায়ণ আজ্ঞা দিলেন ৷ মনসুর সিংহদ্বার খুলে দিল ৷ আগন্তুক মনসুরের পুরোনো বন্ধুও বটে ৷

দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকায় বিশাল বপু পুরুষ ৷ কপালে রক্ত তিলক ৷ কোমরে তরবারি ৷ হাতে বল্লম | কাঁধে বন্দুক ৷ কোমরে ছোরা ৷ হারু ডাকাত! সাথে কতজন আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ৷ ডাকাত দলের সঙ্গে বিশেষ মশালের আলো নেই ৷ হয়তো রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আসতে চেয়েছে ৷ সিংহদ্বারের মশালের আলোয় হারুকেই শুধু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ৷ তার পেছনে সারি সারি ছায়ার মতন কিছু শরীর ৷

হারুর দুচোখে জল ৷ হাঁটু মুড়ে বসে চৌকাঠে চুম্বন করল ৷ রনেন্দ্রনারায়ণ মনসুর কে বললেন হারুকে ভিতরে নিয়ে আসতে ৷ ভিতরে প্রবেশ  করেই হারু রণেন্দ্রনারায়ণের পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল ৷

“ আহা হা করিস কি? ওঠ ওঠ ৷ কেমন আছিস ? একবারও আমাদের কথা মনে পড়ল না এতো দিনে ?” হারুকে দুহাতে মাটি থেকে তুলতে তুলতে বললেন রণেন্দ্রনারায়ণ ৷

“ পাপ , পাপ গো কত্তাবাবু ৷ সব পাপের ফল ৷ সারা বিশ্বচরাচর পাপে ভরে গেছে ৷” কাঁদতে কাঁদতে বলে চলল হারু, “ সেই যে শেষবার এখান থেকে লস্কর নিয়ে কুচ করে গেলাম মুর্শিদাবাদ , সেখান থেকে আমাদের পাটনায় এত্তেলা দিল৷ জানকীরামের কেল্লায় ৷ ওখানে নাকি ফৌজ লাগবে ৷ দিল্লীর বাদশা নাকি মুর্শিদাবাদ আসছে ফৌজ নিয়ে ৷ পাটনা যেতে যেতে খবর পেলাম নবাব পলাশীতে হেরে গেছে ৷ মীরজাফর গদ্দারি করেছে ৷ আমি দল নিয়ে ছুটলাম মুর্শিদাবাদ | এসে দেখি সব শেষ ! নবাবকে মেরে মীরজাফর নবাব হয়েছে ৷ মনে ভাবলুম, এতে আর আমাদের কি ৷ নবাবীতে এরকম খুনোখুনি তো লেগেই থাকে ৷ আমরা যুদ্ধ করি ৷ নতুন নবাবের হয়ে যুদ্ধ করব এবার ৷ কিন্তু, দেখলাম এতদিনের জানা শোনা ব্যবস্থা সব পাল্টে যাচ্ছে ৷ গোরা সাহেবের ফন্দী ফিকিরে চলছে নবাব ৷ ঝোপের আড়াল থেকে দেখলাম হাতী, উট , গরুর গাড়ী, বজরা করে তাল তাল সোনা আর মোহর চলে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ৷ মনে ভাবলুম সে সব নিচ্ছে দিল্লীর বাদশা | পরে শুনলুম ওসব নাকি নেবে বিলেতের রাজা রানীরা আর গোরা কোম্পানী৷ দেখলাম, সব্বোনেশে বিপদ | নবাবের সেনা হয়ে থাকা মানে গোরা পল্টনের হুকুমের চাকর হয়ে থাকা | আমার মতো অনেকেই তখন বনে বাঁদারে পালিয়ে ডাকাতি শুরু করল ৷ কিন্তু বিশ্বাস করেন কত্তা , সেই জমিদার বাড়ীতেই ডাকাতি করেছি  যারা  এই গোরা পল্টনের সাথে সাঁট করেছে ৷ ধর্মত নীরিহ মানুষকে ক্ষতি করিনি ৷”

“ তবে ভুল জায়গায় ডাকাতি করতে এসেছিস ৷” বেশ রাগত স্বরে বললেন রণেন্দ্র, “ অন্য জমিদারদের মতো গদ্দারী সিঙ্গিপুর করে নি৷ আর তাই আজ জমিদারী চালাতে পদে পদে হেনস্থা হতে হচ্ছে কোম্পানীর ফেউদের কাছে ৷”

“ ছি ছি হুজুর! বিশ্বাস করুন ডাকাতি করতে আমি আপনার থানে আসিনি৷”

“ তবে?”

“ এসেছি ভিক্ষা চাইতে ৷”

“ ভিক্ষা!”

“ হ্যাঁ, ভিক্ষা ৷ দরিদ্রনারায়ণের জন্য ৷”

“ কী হেঁয়ালি করছিস !?”

“ হেঁয়ালি নয় হুজুর ৷ একবারটি দয়া করে বাইরে এসে আমার সঙ্গের মানুষ গুলোর পানে চেয়ে দেখুন !”

মনসুর আর কয়েকজন লেঠেল পরিবেষ্টিত হয়ে বাড়ীর বাইরে এলেন রণেন্দ্রনারায়ণ ও শম্ভুচরণ ৷ মশালের আলোয় কাছ থেকে এবার মানুষগুলোকে দেখা যাচ্ছে ৷ হারু ডাকাতের সাকরেদরা দু’পাশে সরে দাঁড়াতেই আঁতকে উঠলেন রণেন্দ্রনারায়ণ ৷ জীবন্ত কতগুলো কঙ্কাল যেন কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ অতিকষ্টে দাঁড়িয়ে আছে ৷ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে হারু ডাকাতের দিকে তাকালেন রণেন্দ্র৷

“ এদের জন্যই ভিক্ষা চাই হুজুর !” কাতরকন্ঠে বলল হারু ৷

“ কারা এরা ?” জিজ্ঞাসা করলেন রণেন্দ্র৷

“ মন্বন্তরে মরার অপেক্ষায় থাকা মানুষ ! এরা নসিপুরের প্রজা ৷ নসিপুরের নতুন জমিদারের জুলুমে এদের সব গেছে ৷ যারা পালাতে চেয়েছিল, তারা খুন হয়েছে ৷ কাল নসিপুরের জমিদারের ধড় মুন্ড আলাদা করে প্রাসাদ জ্বালিয়ে দিয়েছি ৷ কোম্পানী আর নবাব আমার নামে হুলিয়া বের করেছে ৷  নসিপুরের যে কয়ঘর প্রজা বেঁচে ছিল তাদের নিয়ে পালিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আসতে আসতে সিঙ্গিপুরের জঙ্গলে এসে পৌঁছালাম ৷ হুজুরের আশ্রয় নিতে মন কাঁদল | দৈব বড়  বিচিত্র ৷ এতদিন এইপথ যে কেন ভুলেছিলাম ! পলাশীর পর আমার মনিবের খবর নিতে আমি আসি নি ধরা পড়ে যাবার ভয়ে ! সেই পাপেই আজ আমি নরাধম ৷ তবু দরিদ্র নারায়ণের সেবায় শুনেছি স্বর্গলাভ হয় ৷ হুজুর যদি নসিপুরের এই প্রজাগুলোর মুখে দুটি অন্নের ব্যবস্থা করেন, তবে কয়েকটা প্রাণ বাঁচলেও বাঁচতে পারে ৷ সিঙ্গিপুরের প্রজারা এই মন্বন্তরেও খেয়ে পড়ে আছে আপনার কল্যাণে ৷ নসিপুরের এই কটা প্রজাকে বাঁচান হুজুর ৷”

কান্নায় ভেঙে পড়ল হারু৷

রণেন্দ্রনারায়ণ হারুর মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করলেন ৷

“যোদ্ধার চোখে এই জল মানায় না ৷ কাঁদিস না ৷ একদিন এই অন্ধকার কাটবে ৷ তার আগে আঁধার মানিক হয়ে এই ভাবেই আলো জ্বালবার চেষ্টা করতে হবে হারু ৷ জমিদারি আমার আর কতদিন থাকবে জানিনা | তবে যে কদিন আছি, যে কদিন জমিদারি আছে, যে কদিন সিঙ্গিপুরের মানুষ একবেলা করে হলেও খেতে পাবে, সেই কদিন এদের সাথেই অন্নভাগ করে খাবে ৷ ভেতরে ভোজের আয়োজন হয়েছে ৷ এদের নিয়ে যা ৷”

সহর্ষ উল্লাসে ক্ষুধার্তের দল জমিদারের নামে জয়ধ্বনি করল ৷ হারু সকলকে নীরব থাকতে বলে সাবধান করল ৷ কোম্পানীর খোঁচড় সর্বত্র৷ জমিদারকে প্রণাম করে বলল, “ আপনি সাক্ষাৎ মহাদেব ৷ তাই অন্নপূর্ণা আপনাকে এই দুঃসময়েও ছেড়ে জাননি৷ এবার আমায় যেতে হবে ৷ তবে যাবার আগে অধমের আরেকটি অনুরোধ আছে ৷”

“ বল!”

হারু পাশের বটগাছের তলা থেকে একটা কষ্টিপাথরের সিংহবাহিনী মূর্তি দুহাতে তুলে নিয়ে এল ৷

“নসিপুরের আগুন যখন দেবালয় ছুঁলো , দেখলাম আরেক মহা পাপ করেছি ৷ জ্বলন্ত দেবালয়ের অন্দরে সিংহবাহিনী রুষ্ট চোখে আমায় বুঝি ভস্ম করতে চান ৷ দেবীর চরণ ছুঁয়ে বেদী থেকে তুলে এনেছি ৷ আপনি সাক্ষাৎ মহাদেব ৷ যদি দেবীকে আপনার মন্ডপে প্রতিষ্ঠা করেন , তবে বুঝি আমার কিছুটা প্রায়শ্চিত্তির হয়!”

“ তাই হবে ৷ শম্ভুচরণ, মাতৃমূর্তি অন্দর মহলে আমার বিশ্রামঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা কর ৷ শোধন করে মাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা হবে ৷”

মনসুর মূর্তিটা হারুর কাছ থেকে নিয়ে ভেতরে গেল ৷ হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে মশাল হাতে এক ঘোড়সওয়ার তড়িৎ গতিতে এসে দাঁড়াল |

“ কি হয়েছে রঘু ?” শঙ্কিত ভাবে জিজ্ঞাসা করল হারু ৷

“ সর্দার ! বিপদ ! টিলার ওপর থেকে জঙ্গলের দিকে নজর রাখছিলাম ৷ হঠাৎ দেখি সারি সারি মশালের আলো | তারপর ভালো করে চোখ ঠাউরে দেখি কোম্পানীর নিশান ! ছোটো একটা ফৌজ এদিকেই আসছে !”

“ সর্বনাশ!” আশঙ্কায় বলে উঠলেন রণেন্দ্র৷

“ চিন্তা করবেন না হুজুর ৷ আপনি নরনারায়ণের সেবা করুন ৷ অসুর নিধনের জন্য হারু আছে ৷ ভাইসব, বল জয় চামুন্ডা ৷” গর্জন করে উঠল হারু ৷ “জয় চামুন্ডা” বলে হুঙ্কার দিল তার বাহিনী |

তারপর যেন নরকের কোন নাট্যপালা অভিনীত হতে থাকল  সিঙ্গিপুরের জমিদার বাড়ীতে ৷ সিংদরজার বাইরে তুমুল আওয়াজ ৷ অস্ত্রের ঝন ঝন ৷ আহত আর মৃত্যুপথযাত্রীর আর্তনাদ | গগন বিদারী হ্রেষাধ্বনি ৷ মনসুর কয়েকজন সঙ্গী, তীর-ধনুক আর গাদা বন্দুক নিয়ে নহবত খানায় চড়ে জমিদার বাড়িটাকে যেন একটা দুর্গ বানিয়ে ফেলল ৷  অন্যদিকে খাবার দেখে হামলে পড়েছে একদল জীবন্ত কঙ্কাল ৷ পাতে বসে খাবার তর সয় নি ৷ কেউকেউ দীর্ঘদিন বাদে খাবার পেটে পড়ায় ভেদবমি শুরু করেছে ৷ বাকীদের সেদিকে খেয়াল  নেই ৷ হয়তো তাদের মাড়িয়েই দৌড়াচ্ছে এক হাঁড়ির থেকে অন্য হাঁড়িতে ৷ অন্তঃপুরে মহিলারা আতঙ্কে কান্নাকাটি শুরু করেছে। যেন একটা ঘূর্ণিপাকের ঘোর লেগেছে ৷ হঠাৎ কানে এল চিৎকার  “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু”!  মনসুরের দেহটা উঠনে পড়ে নিথর হয়ে গেল ৷ শিবের বদ্ধজটা থেকে মুক্ত গঙ্গার মতো রক্তের  ধারা ফিনকি দিয়ে ছুটছে তার বিদীর্ণ বুক থেকে ৷ ডুকরে উঠল শম্ভুচরণ | রণেন্দ্র যেন পক্ষাঘাতে আবিষ্ট ৷ কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না ৷

এইভাবে কতক্ষণ কাটল কে জানে ! হঠাৎ দরজার বাইরে চিৎকার হল “জয় চামুণ্ডা!”, “জয় জমিদার রণেন্দ্রনারায়ণের জয় ৷”

দরজায় কেউ আঘাত করল ৷  হারুর কন্ঠ ভেসে এল , “ হুজুর দরজা খুলুন |”

শম্ভুচরণ দরজা খুলে দিল ৷ রক্তাক্ত শরীরে টলতে টলতে ঢুকল হারু ৷ মাথায়, কাঁধে বীভৎস ক্ষত তার ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ৷ বাইরে জড়াজড়ি করে নিথর হয়ে শুয়ে আছে বাংলার ডাকাত, সাগর পাড়ের গোরা সৈন্য, নবাবের আফগানী সেনা ৷

“ ওরা পালিয়েছে হুজুর ৷ মনসুর মিঞা না থাকলে কি হোতো জানিনা | ওদের গোরা সর্দার আমায় ঘিরে নিয়ে গুলি চালাতে গেছিল ৷ ভাবতে পারে নি নহবৎ খানায় ওদের যম বসে আছে ৷  মনসুর মিঞা ওদের সর্দারকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে ৷    যে ফিরিঙ্গির বাচ্চা ওকে গুলি মেরেছে তার মুন্ডু আলাদা করে দিয়েছি ৷ কিন্তু … !” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রণক্লান্ত হারু ৷ জমিদার রণেন্দ্রনারায়নের ঘোর এখনও কাটেনি ৷  স্বপ্নাবিষ্টের মতো হারুর মাথায় হাত রাখলেন ৷ উফ্! কত রক্ত !

“ওরা চলে গেছে ৷ কিন্তু আবার আসবে ৷ আজ রাতেই আপনি সকলকে নিয়ে পালান হুজুর ৷  আমারও যাবার সময় হয়ে গেছে ৷ চোখে বড় অন্ধকার ৷ আর সময় নেই! পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেলাম আপনার চৌকাঠে ৷ সবই সিংহবাহিনীর আশিব্বাদ |”

চোখের সামনে সব ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে ৷ হারু কই ! চারিদিকে সব ভেঙ্গেচুরে দুমড়ে যাচ্ছে সময়ের ঘায়ে ৷ নদীতে উজান বইছে ! স্রোত আবার ছুটছে মোহনার দিকে ৷ কে যেন আবার বলছে, “ সবই সিংহবাহিনীর কৃপা !”

কে ! হারু? ফিরে এল? না ৷ সমীরনের পাশে খালি গায়ে পইতে ধরে কে যেন দাঁড়িয়ে ! একেবারে হারুর মতোই যেন মুখের আদল৷ কিন্তু না , এতো হারু নয় ৷ আমিওতো রণেন্দ্রনারায়ণ নই ! একটা বাজারী কাগজের বেতনভুক চাকুরে রনজয় সরকার !

“আজ্ঞে, কি জানবার আছে বলুন | অতো বড়ো কাগজ থেকে এসেছেন ৷ এতো বড় সৌভাগ্যের কথা ৷” লোকটি বলল ৷

আমি অস্ফুটে বললাম , “ আর আমার জানার কিছুই নেই ! শুধু আপনার পরিচয়টা ?”

সমীরণ বলল, “ আরে উনিই তো এইখানে পুজোটা করবেন ৷”

“ আর বলবেন না ৷ আমি তো করি নসিপুরের একটা কেলাবের পুজো ৷ কিন্তু সিঙ্গিপুরে এবার সিংহবাহিনীর পুজো শুরু হবে ৷ এই গাঁয়ে সবইতো ডোম আর মুসলমানের বাস। পুজোর আয়োজনও ওরাই করেছে ৷ পুজুরী বাউন এ তল্লাটে নেই ৷ তো প্রধান সাহেব আমাকে পাকড়ে এখানে পাঠিয়ে দিলেন ৷ সবই সিংহবাহিনীর কৃপা ৷” লোকটির কথা শুনে চমকে উঠলাম ৷ মুখে বললাম, “বাহ্ চমৎকার !”

“ তোর কি হয়েছে বলত? হঠাৎ করে কিরকম অদ্ভুত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তোকে ৷ একটু আগে তো এমন ছিলি না ৷” সমীরণ আমার গায়ে একটা টোকা মেরে বলল ৷

“ কিছু হয় নি তো ৷ চল বাড়ী যাই ৷ আসি পুরুত মশাই ৷” নমস্কার জানিয়ে দরজার দিকে এগোনো শুরু করলাম ৷

“ বাবু , একটু দাঁড়ানতো ৷” পুরুত মশাই ডেকে উঠলেন ৷ “ একবার একটু আমার দিকে তাকাবেন বাবু?”

পুরুতের কথা শুনে ঘুরে তাকালাম ৷ ভদ্রলোক ভালো করে কি যেন দেখলেন আমার মুখের দিকে ৷ তারপর একটু অপেক্ষা করতে অনুরোধ করে ছুটে গেলেন মন্ডপে, যেখানে সিংহবাহিনী আছেন ৷ সিংহবাহিনীর পেছন থেকে ভাঙা তক্তা মতন কি একটা নিয়ে এলেন ৷ সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, “ এটা আবার কি?”

“ একটা পুরোনো তেল রঙের ছবি, বাবু ৷ যে ইঁটের পাঁজাতে সিংহবাহিনী কে পাওয়া গেছে ৷ সেইখানেই ইঁটের খাঁজে এইটে আমি খুঁজে পেয়েছি ৷”

“ কিসের ছবি দেখি ?” সমীরণ আগ্রহ ভরে এগিয়ে গেল ৷

“ জমিদার বাড়ীর কোনো রাজপুরুষের মনে হয় ৷ নষ্ট হয়ে গেছে অনেকটাই ৷ খবরের কাগজের বাবু কে দেখা ইস্তক মনে হচ্ছিল বাবুর মতো কাকে যেন আগে দেখেছি ৷ তারপর এই ছবিটার কথা মনে হল ৷ একটু দেখুন তো বাবু চোখ দুটো যেন অনেকটা আমাদের খবরের কাগজের বাবুর মতন না?”

সমীরণ ফ্রেমটার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে ৷ আমি সিংহবাহিনীর কাছে মনে মনে বিদায় নিচ্ছি ৷  সূর্য মৃদু হচ্ছে ৷ ছাতিম গন্ধ বিলাচ্ছে ৷ মৃদু মন্দ আলো-অন্ধকারে প্রদীপের শান্ত শিখার প্রতিচ্ছায়া সিংহবাহিনীর কৃষ্ণকালো কপোলে টলটল করছে দুই বিন্দু অশ্রুর  মতো ৷

Facebook Comments