Site Overlay

একাত্তরের স্মৃতি – ১: শংকরদা

বাসুদেব মণ্ডল

ঊনিশশো একাত্তরের সাতই মার্চ। এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে যে বিশেষ কারণে তা হল ঢাকার রমনা ময়দানের বিশাল জনসভায় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা তথা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইংরেজি বিভাগ) উঁচু শ্রেণির ছাত্র, থাকি জগন্নাথ হলের পূর্ব বাড়িতে। ( এই হল অর্থাৎ ছাত্রাবাস সম্পর্কে অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে) এখানে সংখ্যালঘু অর্থাৎ অমুসলিম ছাত্ররা আবাসিক হিসেবে থাকতেন ( এখনও সম্ভবত সেই ব্যবস্থাই আছে)। 

সাত তারিখের বিশাল ঐতিহাসিক ছাত্র-জনসভায় আমরা বন্ধুরা অনেকে ছিলাম। সভা শেষ হল তিনটে সাড়ে তিনটের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে হলে ফিরে এলাম (বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে রমনা ময়দান খুবই কাছে।) আমি উপলব্ধি করলাম এর পরে আর এক দিনও ঢাকায় থাকা ঠিক হবে না। যেসব বন্ধুদের সাথে দেখা হল তাদেরকেও বোঝাতে চাইলাম পরিস্থিতির অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক চরিত্র। তাদের স্থির বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বা ছাত্রাবাসের মধ্যে মিলিটারি প্রবেশ করবে না। আমি সেদিন সন্ধ্যায় বুড়ি গঙ্গার সদর ঘাট থেকে ষ্টিমারে চড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমাদের বাড়ি তখনকার খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বাগেরহাট সহর থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দুরে। পরের দিন সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বাড়ি পৌঁছলাম। 

আজকের স্মৃতিকথা আমাকে নিয়ে নয়। যার কথা বলছি তিনি শংকরদা, আমাদের থেকে এক বছরের সিনিয়র। যে কথা বলতে চলেছি তা শুনেছিলাম পরবর্তী কালে ঢাকায় গিয়ে বন্ধুদের কাছে। ( বন্ধুদের অনেককেই আর পাইনি কারণ বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। ) 

যারা হলে থেকে গিয়েছিল তাদের অনেকেই প্রাণ হারিয়েছিল পাকিস্তানীদের বুলেট আর বেওনেটে। অন্যান্য হলে যারা থেকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যেও অনেকে একই ভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন।

পঁচিশে রাত থেকে বর্বর পাক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর তাদের নির্মম আক্রমণ শুরু করে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ছিল তাদের বিশেষ আক্রোশ কারণ পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার এবং প্রাণকেন্দ্র ছিল এই শিক্ষাঙ্গন। পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল সীমাহীন, বর্নণাতীত; তাদের নরহত্যার ধরন ছিল তেমনই বর্বরোচিত। আমি এখানে শুধুমাত্র ঢাকা শহরের কথাই বলছি। সারাদিন ওরা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরস্ত্র মানুষকে ধরে ধরে হত্যা করত। ধৃত কিছু যুবকদের দিয়ে সেই সব মৃতদেহ বহন করে আনাত জগন্নাথ হলের মাঠে, যেখানে আগেই প্রায় পুকুর সমান গর্ত খুঁড়িয়ে রেখেছিল তারা, একই ভাবে ধরে আনা যুবকদের দিয়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে  মৃতদেহগুলি ওই গর্তে ফেলানো হত যুবকদের দিয়ে। তার পরে ওই যুবকদের গর্তের পাড়ে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে গর্তে ফেলে দেওয়া হত। 

শংকরদা ছিলেন সেই সকল হতভাগ্য যুবকদের একজন। তবে তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন আশ্চর্য রকম ভাবে। কোন একদিন তিনিও সেই যুবকদের একজন ছিলেন  যাদের দিয়ে পাকিরা মৃতদেহ বহন করিয়ে এনে হলের পুকুরের মত বড় সেই গর্তের মধ্যে ফেলাত। সেদিন সন্ধ্যায় মৃতদেহগুলি গর্তে ফেলে দেওয়ার পরে শংকরদা সহ সবাইকে গর্তের পাড়ে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে পেছন দিক থেকে ব্রাশ ফায়ার করে গর্তে ফেলে দেওয়া হয়।

শংকরদারও শরীর ভেদ করে গুলি বেরিয়ে যায় এবং তিনিও গর্তে পড়ে যান। কিন্ত ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান: গুলি তার হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুস ভেদ করে যায়নি, বরং পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।অচেতন হয়ে কতক্ষণ ছিলেন বলতে পারেননি।  যখন চেতন ফিরে আসে তখনও বুঝতে পারেননি রাত কত। রক্তক্ষরণ, ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় হয়তো চেতনা আর অচেতনের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন। তবুও বাঁচার স্বভাবিক অদম্য আকাঙ্খায় নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন মাঠের পাশে একটা পরিত্যক্ত টয়লেটের মধ্যে। ভাগ্যক্রমে ল্যাট্রিনের মধ্যের ট্যাপে জল পাওয়া গেল। সেই জল পান করে কিছুটা যেন চাঙ্গা হলেন। কী করে চাঙ্গা হবেন? দীর্ঘ রক্তক্ষরণ, অতি দীর্ঘ ক্ষণের অনাহার , তৃষ্ণা আর আতঙ্ক। সুদুর কল্পনায়ও ভাবতে পারেননি তিনি বেঁচে যাবেন, তিনি সত্যিই বেঁচে ! সামরিক বাহিনীর কোন নজরদারের চোখে যে পড়েননি সেওতো দুর্লভ ভাগ্যের ব্যাপার। 

ভোর হওয়ার আগেই ওখান থেকে কোনক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উদার অসাম্প্রদায়িক অধ্যাপকের কোয়ার্টারে গিয়ে তাঁর শরণাপন্ন হন। দরদী অধ্যাপক নিজের এবং পরিবারের ঝুঁকি নিয়েও শংকরদাকে তার কাছে রাখেন, গোপনে বিশ্বস্ত চিকিৎসক ডেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। 

শংকরদা সুস্থ হলে লুকিয়ে লুকিয়ে নিরাপদে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যান এবং পরে ভারতে চলে আসেন। আমরা কয়েকজন তার মুখ থেকেই এই কাহিনী শুনেছিলাম নবজাত বাংলাদেশে গিয়ে। সেই বিরাট পুকুরের মত গর্ত পরে বুজিয়ে ফেলা হয়। অনেক বছর পরে আর একবার ঢাকায় গিয়ে দেখেছিলাম সেখানে বিভিন্ন রকমের ফুলের এক মনোরম উদ্যান তৈরী করা হয়েছে। সৌন্দর্যও যে গভীর অব্যক্ত বেদনার উদ্রেক করতে পারে সেদিন হাজারো মানুষের গণ কবরের উপরে রচিত ওই সুন্দর পুষ্পোদ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছিলাম। শংকরদার সঙ্গে আর কোন দিন দেখা হয়নি; জানি না তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন। ( আমাদের সময়কার অনেকে এখনও ঢাকায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে আছেন, আবার অনেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। )

Facebook Comments