Site Overlay

এক পলকের একটু দেখা

সুজয়া ধর

কবি শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিচারণা। হঠাৎ করেই আমার কাছে লেখার আবদার করে বসে এক বন্ধু। মহাবিপদ, এমন মানুষের সৃষ্টি নিয়ে কিছু বলার বা লেখার ধৃষ্টতা আমার নেই। অতঃপর কি করা যায়, বন্ধুর আবদার ফেলতে পারলাম না। মনে হল মানুষটাকে কয়েক মুহূর্ত চোখে দেখার অভিজ্ঞতা আজ সবার সাথে শেয়ার করি।

১২ই ডিসেম্বর,২০১২সাল বিকেল বেলা ; হঠাৎ করে হাতে একটা উপহার পেলাম ,”মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়” কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা একটি বই। উপহারপ্রেরকের নামটা নাই বা জানালাম। আমি খুব একটা কবিতা পড়ুয়া নই, তবে কবির নাম স্কুল জীবন থেকেই জানা।বই খুলতেই উপহারপ্রেরকের এক প্রস্থ লেখা “প্রচ্ছদ‌ কবিতাটির ভাবনা, তোমার মনে আসতে পারে বারংবার, অহর্নিশি, আজীবন-প্রস্তুত হও”। মনে মনে হেসে বই এর পাতা উলট-পালট করতেই চোখ দুটো একটা কবিতায় এসে আটকে গেল।

না

এর কোনো মানে নেই। একদিনের পর দুদিন, দুদিনের পর তিনদিন
কিন্তু তারপর কী?
একজনের পর দুজন, সুজনের পর দুর্জন
কিন্তু তারপর কী?
এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান

তুমি বলেছিলে ঘর হবে, ঘর হলো
তারপর কী?
তুমি বলেছিলে স্নেহ হবে, স্নেহ হলো
তারপর?
কতদূরে নিতে পারে স্নেহ? অন্ধকারও আমাকে সন্দেহ করে নি কখনো
বুকে বসে আছে তার এত বড়ো প্রতিস্পর্ধী কোনো!

না এর পর না, না এর পর না, না এর পর না
তারপর কী?
পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা
তারপর?

কবিতা পড়ে একটা কথা মনে হল যদি মানুষটাকে একবার দেখতে পেতাম, এমনভাবে কেউ ভাবতে পারে, মন ছুঁয়ে গেছিল। খুব মন থেকে চেয়েছিলাম নিশ্চয়ই,তাই সেই আশাও একদিন পূরণ হলো। ২০১৬-র নভেম্বর মাস, ততোদিনে আমি বেশ সংসারী; সুরিতের বন্ধু অনির্বাণদার বিয়ে, পাত্রী আমন কবি শঙ্খ ঘোষের বড় নাতনি। অনির্বাণদার সাথে আমাদের প্রতিদিনের যোগাযোগ, সেই সূত্র ধরেই বিয়ের দিন ২৬শে নভেম্বর সন্ধ্যাবেলায় বিয়ের আসরে হাজির হলাম। বেশ দূর থেকেই দেখলাম প্রায় ৮৫ বছরের সুদৃঢ় প্রশান্ত এক মানুষ কে। তিনি নিজেই এগিয়ে এসে কথা বলছেন সবার সাথে, অজান্তেই সবার অভিভাবক হয়ে উঠছেন। অনেক অতিথির ভীড়ের মধ্যেই দেখি উনি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন, এসে সুরিত কে বললেন, আপনার তো দৃষ্টিশক্তির সমস্যা , আপনি খুব সাবধানে চলাফেরা করবেন, এখানে অনেক জায়গা উচুঁ-নীচু আছে, পড়ে যেতে পারেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, উনি তো আমাদের পরিচয় জানেন না।নিজে থেকেই মাথা নত করলাম, মনে হল এক বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের মতই বিয়ের আসরের প্রায় ২০০০ অতিথিকেই নিজেই আপ্যায়ন করছেন।প্রায় ৪ ঘন্টা ওনাকে খুব কাছ থেকে দেখলাম, অনেক কিছু শিখলাম।

তারপর বিভিন্ন সময়ে আমন-অনির্বানদার মুখে অনেক কথা শুনেছি,সব গল্প গুছিয়ে লিখতেও পারব না।

শুনেছি , প্রতি রবিবার সল্টলেকে শঙ্খবাবুর বাড়িতে নবীন কবিদের সঙ্গে বৈঠকী আড্ডা হতো, সবার জন্য অবারিত দ্বার। সেই আসরে নতুন কবির দল তাঁদের লেখা পড়ে ওনাকে শোনাতেন, আলোচনা করতেন তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে। বিরক্ত না হয়ে প্রত্যেকের বক্তব্য শুনতেন,যাকে যতটুকু তথ্য দেওয়ার দিতেন।গল্প আর আমার দেখা মহীরুহ এই দুই এর কল্পনায় মনে হল এ যেন নবীন- প্রবীণের মেলবন্ধন সভা।

গত এক দু বছর ধরেই স্নায়ুরোগের কারণে কবি আর নিজে লিখতে পারছিলেননা, লেখার জন্য একজন নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু কবির স্মৃতিশক্তি প্রবল।শঙ্খবাবু বলতেন, ভদ্রলোক লিখতেন।এইভাবেই লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।ইতিমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এ দেশ টালমাটাল , প্রত্যেক পরিবারের অনেক কাছের মানুষকেই কেড়ে নিয়েছে।এর মধ্যেও কবি সবার সাথেই দেখা করার চেষ্টা করতেন। তেমনি এপ্রিলের মাঝামাঝিতে খবর পেলাম কবি করোনায় আক্রান্ত।২১শে এপ্রিল,২০২১ সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে সুরিতের মুঠোফোন চালু করতেই অনির্বাণদা র বার্তা, শঙ্খবাবু নেই। মনে হলো মিথ্যে কেন হয় না খবর গুলো, মৃত্যু বারবার কেন জিতে যায়।

নেই কেন? উনি তো আছেন আমাদের কাজের মধ্যেই। বটগাছ প্রানত্যাগ করে না, অজস্র ঝুড়ি চারিদিকে বিছিয়ে দেয়।প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেক ছাত্র সারা বিশ্বে ওনার কাজকে আদর্শ করে এগিয়ে যাবে। কবি সারাজীবন থাকবেন পথ চিনিয়ে দিতে। ওনার কলমের ধারে সত্যিকথা বলতে এবং প্রতিবাদ করতে শিখেছে সাধারণ মানুষ। আমার লেখার প্রথম সূত্র ধরেই বলি “মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়” কাব্যগ্ৰন্থের ভাবনাচিন্তার রূপকার কবি শঙ্খ ঘোষ কিন্তু বাস্তব জীবনে আক্ষরিক অর্থেই একজন প্রকৃত সামাজিক মানুষ।আজ সংসার ধর্ম করতে গিয়ে বারবার মাথায় এই লাইনকটাই ঘোরাফেরা করে।

 "হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
   সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
  এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
   সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।"

কি বাস্তব কঠিন সত্য, এমন সহজ করে শঙ্খবাবুই ভাবাতে পারেন সাধারণ মানুষ কে। বারবার মাথা নত করি। ভালো থাকুন কবি আমাদের সবার স্মৃতির মাঝে।

Facebook Comments