Site Overlay

কেউ কথা রাখে নি

(প্রসঙ্গ: সুভাষ চন্দ্র বসুর মহানিষ্ক্রমণ ও সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট)

অভিযান ভট্টাচার্য্য

১৯৩৮ ৷ বারুদের স্তূপের শীর্ষে বসে ইয়ুরোপ তখন আরেক বিধ্বংসী যুদ্ধের আশঙ্কায় প্রহর গুনছে ৷ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সংঘাতে চারিদিকে বোমা আর বুলেটে উত্তপ্ত  ইয়ুরোপের রাজনৈতিক বাতাস ৷ উত্তর সাগর, আল্পস , সাইবেরিয়া থেকে ভেসে আসা হিমশীতল বাতাসেও সে উত্তাপ বুঝি ঠান্ডা হবার নয় ৷ ক্ষমতার লালসা আর ঐশ্বর্যের লোভে আধুনিক সভ্যতার তথাকথিত পীঠস্থান ইয়ুরোপের ভাগ্যবিধাতাদের  বিবেক শৃঙ্খলিত ; মনুষ্যত্ব  মুখ ঢেকেছে লজ্জায়! জার্মান জাতীয়তাবাদের গর্বে উন্মত্ত হিটলার তখন গোটা ইউরোপকে পদতলে এনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর৷ পশ্চিমে তাঁর সাথী মুসোলিনির ইটালী ৷ উত্তরে ও পূর্বে নতুন শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষারত স্টালিনের রাশিয়াও হিটলারের সঙ্গে মৈত্রীর কৌশল নিয়েছে ৷ হিটলারের নাৎসী বাহিনীর রণহুঙ্কারে ইয়ুরোপ তথা পৃথিবীর স্বঘোষিত অভিভাবক ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নিজের ঘরেই থরহরিকম্পের সঞ্চার হয়েছে। হিটলার তখন জার্মানীর পার্শ্ববর্তী একের পর এক রাষ্ট্রের ওপর দখল কায়েম করছেন আর বিশুদ্ধ জার্মান রক্তের শত্রু চিহ্নিত করে ইহুদীদের উপর শুরু করছেন দানবীয় অত্যাচার ৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অফ নেশনস তৈরী হয়েছে বটে, তবে সেখানে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাদের একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছে। লীগ অফ নেশনস যেন পর্যবসিত হয়েছে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী কায়েমী স্বার্থ রক্ষার মাধ্যম হিসাবে ৷ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে শান্তি স্থাপনের চেষ্টায়  সে ব্যর্থ তার একদেশদর্শী আচরণের জন্য। এমতাবস্থায় হিটলার দাবী তুললেন সাবেক চেকোশ্লভাকিয়ার “সুডেটেন” (Sudeten) – কে জার্মানীর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হলো, ওই অঞ্চলে মূলতঃ খাঁটি জার্মান রক্তের মানুষের বাস, তাই ওটি জার্মানীর ন্যায্য পাওনা ৷ যা উহ্য থাকল তা হল, ওটি সমর কৌশলের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কারণ চেকোশ্লোভাকিয়া সুডেটেন সীমান্তেই ব্যাপক রণসজ্জার আয়োজন করেছে জার্মানীকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। চেকোশ্লভাকিয়াকে সাহায্য করছে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এক সামরিক চুক্তির মাধ্যমে। একবার যদি সুডেটেনে  বিনা রক্তব্যায়ে অধিকার সুনিশ্চিত হয়, তা হিটলারের কাছে ইয়ুরোপের পশ্চিমে বিজয় অভিযানের দরজা খুলে যাওয়ার সামিল ৷ হিটলারের ভাব গতিক দেখে পোল্যান্ডও  প্রমাদ গুনছে ৷ চেকোশ্লভাকিয়া ও জার্মানী দুজনের সাথেই তার সীমান্ত | পোল্যান্ডেও কিছু কিছু অঞ্চল জার্মান  অধ্যুষিত | হিটলার কি তবে আজ নয় কাল সেটাও দাবী করবেন? পোল্যান্ডও সৈন্য সমাবেশ শুরু করল তার সীমান্তে ৷ যুদ্ধংদেহী হিটলারকে নিরস্ত করতে আসরে নামল ইংলন্ড ও ফ্রান্স | মিউনিখে শুরু হল বৈঠক | আপসকামীদের নেতৃত্বে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন ৷ উল্টোদিকে মুসোলিনিকে পাশে রেখে দর কষছেন হিটলার ৷ বৈঠকে তীব্র অচলাবস্থা ৷ অবশেষে চেম্বারলেনের বিশ্বাস জন্মালো সামান্য সুডেটেন টুকু দিয়ে দিলে যদি হিটলার খুশী হয়ে শান্ত হয় তাতে অসুবিধা কিসের ? চেকোশ্লভাকিয়ার আপত্তি গ্রাহ্য হল না। ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের সামরিক সাহায্য নিয়ে তাদের চলতে হয়। এসব আপত্তির মূল্যই বা কতটুকু ! চেকোশ্লভাকিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হল, হয় সে নিজের ক্ষমতায় হিটলারকে আটকাক , নয়তো ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কথামতো হিটলারের দাবী মোতাবেক অংশটুকু দিয়ে দিক৷ নিরুপায় চেকোশ্লভাকিয়ার সম্মতি ছাড়াই , স্বাক্ষরিত হল “মিউনিখ সমঝোতা ” (Munich Agreement) – চেকোশ্লভাকিয়ার সাবর্ভৌমত্বের বিনিময়ে আগ্রাসী হিটলারকে তোষণ করে শান্তি কিনবার চেষ্টা করলেন  চেম্বারলেন ৷ দুই সাম্রাজ্য্যবাদীর বোঝাপড়ায় বিনা যুদ্ধে মাটি হারালো চেকোশ্লভাকিয়া; দিতে হল ঔপনিবেশিক বেনিয়া শক্তির কাছে আত্মশক্তি সমর্পনের খেসারত ৷ সুডেটেনের সামরিক ঘাঁটির দখল নিল হিটলারের নাৎসী বাহিনী ৷ ওদিকে ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮, বিপুল অভিবাদন ও হর্ষধ্বনির মধ্যে মিউনিখ থেকে লণ্ডনে অবতরণ করলেন চেম্বারলেন ৷ চার্চিলের মতো জাত্যাভিমানী কিছু রাজনীতিবিদ বাদে লোকে বলাবলি করল – এই না হলে বৃটিশের ধুরন্ধর বুদ্ধি ! বৃটিশের দয়ায় থাকা দুর্বল একটা দেশের একটুকরো জমি ছিঁড়ে নিয়ে উন্মত্ত শ্বাপদ হিটলারের মুখের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে দিব্যি বশ করা গেছে ৷ আর হিটলার পশ্চিমমুখো আসছে না ৷ ইংল্যান্ডকে আবার একটা যুদ্ধ করতে হবে না। অবশেষে শান্তি | আবেগঘন কন্ঠে চেম্বারলেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে জানালেন তিনি সম্মানের সাথে শান্তি নিয়ে ফিরেছেন জার্মানী থেকে ৷ তিনি দাবী করলেন যে জীবনের মতো শান্তি তিনি নিশ্চিত করেছেন (“Peace of our time “) ৷ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট চেম্বারলেনকে তার-বার্তায় লিখলেন “গুড ম্যান”!

বৃটেন ও তার মিত্রদের আস্ফালন দেখে সেদিন বোধহয় দুইজন অন্তরালে মুচকি হেসেছিলেন ৷ একজন অন্তরীক্ষের বিধাতা পুরুষ ৷ আর অন্যজন?অন্যজন ইয়ুরোপ থেকে বহুদূরে পরাধীন ভারতবর্ষের জন-গন – মন – অধিনায়ক শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসু – ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তরুণ সভাপতি ৷

ভারতবর্ষ তখন সহস্র সমস্যায় জর্জরিত ; পরাধীনতার পাঁকে আনখশির নিমজ্জিত ৷ সহস্র সহস্র বছর ধরে সভ্যতার আলোকবর্তিকা বয়ে চলা জাতি দুহাত তুলে শূন্যের বুকে আশ্রয় খুঁজছে ৷ ভগত সিং , মাষ্টারদা সূর্য সেনের মৃত্যুর পর সশস্ত্র বিপ্লবীর দল দিশাহীন | গান্ধীর কতৃত্বাধীন কংগ্রেস বিপ্লববাদ থেকে বহুদূরে ধীরে ধীরে আপসকামী ক্লান্ত সংগঠন হয়ে উঠছে। পরাধীন জাতির মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষার ঢেউ যেন কংগ্রেসের স্থবির তীরে এসে আছাড়ি পিছাড়ি করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে বারেবারে ৷ দিশাহীন বিপ্লবীর দল কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে বলশেভিক  আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে কম্যুনিষ্ট পার্টিতে যোগ দিচ্ছে ৷ কিন্তু কম্যুনিষ্ট পার্টী নীতিগত ভাবে পুরোপুরি রাশিয়ার অঙ্গুলি হেলনে নির্ভরশীল ৷ বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের জায়গায় গুরুত্ব পেতে শুরু করল  আন্তর্জাতিকতাবাদ ৷ সহজভাবে বলতে গেলে, ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টীর কার্যপ্রণালী নির্ভর করবে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাসের ওপর৷ আলোচ্য সময়ে “পুঁজিবাদী” ইংল্যান্ড বা “ফ্যাসিস্ট” জার্মানী, কারো সাথেই প্রকাশ্যে বৈরীতা রাশিয়ার কাম্য ছিল না ৷ সে তখন সুযোগের অপেক্ষায় থেকে দেশের অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে – হয়তো ভবিষ্যতের আদর্শবাদী সংগ্রামের   জন্য, হয়তো বা নব্য কোন সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেবার জন্য ৷ যাইহোক, মোটের ওপর ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লব  গতি হারাল৷ কম্যুনিষ্টরা অনেক বেশী যুক্ত হয়ে পড়লেন কৃষক শ্রমিকদের সংগঠিত করে আর্থ-সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ৷ ওদিকে আবার ধূর্ত বৃটিশ শাসকের দল ভারতবর্ষকে তাদের বিভেদমূলক “divide and rule” নীতির এক সফল পরীক্ষাগার বানিয়ে ফেলেছে ৷ দেশবাসীর ক্ষোভ কে একমুখী করে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী আন্দোলনে ঝাঁপানোর কোন আয়োজন নেই, উল্টে শুরু হয়ে গেছে ঘন ঘন ভ্রাতৃঘাতী জাতিদাঙ্গা – সৌজন্যে  মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা৷

এদিকে কংগ্রেসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভাজন তীব্রতর হচ্ছে। মহাত্মা গান্ধীর সর্বময় প্রভাবকে অস্বীকার করে জেগে উঠছে সমাজতন্ত্রে ও  বৃটিশের বিরুদ্ধে সরাসরি সর্বাত্মক আন্দোলনে বিশ্বাসী অপেক্ষাকৃত তরুণের দল। সাধারণভাবে তাদের গান্ধী বিরোধী বামপন্থী চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু গান্ধীর অনুগামীরা যেমন তাঁর নেতৃত্বের ছায়ায় সংঘবদ্ধ , বামপন্থী অংশের সেই রকম সংঘবদ্ধতা নেই। নেহেরু আদর্শগত ভাবে প্রথম থেকেই বামপন্থী অংশের প্রতি সহানুভুতিশীল , কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছে ততই যেন তিনি বামপন্থীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েও মধ্যপন্থা অবলম্বন করছেন ৷ গান্ধীর মতোই তিনিও সেই সময় বৃটিশের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের বিষয়ে সংশয়ে ৷ তিনিও গান্ধীর মতোই বৃটিশ সরকারের সাথে আলাপ আলোচনার পক্ষপাতী ৷ ঠিক এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হরিপুরায় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি মনোনীত হলেন শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসু – মিউনিখ সমঝোতার বেশ কয়েক মাস আগে; তখনও তিনি নেতাজী হন নি ৷

নেতাজী তখন বাস্তবিকই দেশনায়ক ৷ দেশবন্ধুর যোগ্যতম উত্তরাধিকার ৷ বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য ৷ ভারতবর্ষকে তিনি উপলব্ধি করেন তাঁর আত্মায় ৷ তিনি বিশ্বাস করেন ইসলামিক দেহের আধারে সনাতন ধর্মের আত্মাকে ধারণ করেই সূচিত হবে নূতন ভারতের অগ্রযাত্রা ৷ তাই ভারতের রাজনীতিতে বহমান সাম্প্রদায়িকতার বিষ তাঁকে কনামাত্র স্পর্শ করে নি ৷  তাঁর অতলস্পর্শী আধ্যাত্মিক অন্তর বিশ্বাস করে, বৃটিশের মহার্ঘ চাকরীকে অস্বীকার করে  দেশের শৃঙ্খল মোচনের  বিপদসঙ্কুল অনিশ্চয়তায় অবগাহন  আসলে অধ্যাত্ম সাধনার মহাযোগ | অন্যদিকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নির্মানের ক্ষেত্রে তিনি কঠোর বাস্তববাদী ৷ একদিকে তিনি বিশ্বাস করেন, ভারতের মুক্তির সংগ্রাম আসলে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রাম, কারণ “ভারতের একটি বানী আছে ” আর তা বিশ্বে অবাধে প্রবাহিত হবে তখনই , যখন ভারত তার হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করে নিজের স্বাধীন সত্ত্বায় বিশ্বের সাথে যোগ স্থাপন করতে পারবে ৷ অন্যদিকে তিনি বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতের মুক্তির সংগ্রামের রূপরেখা প্রস্তুত করা যাবে না ৷ বরং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে সুচারু রূপে ভারতের মুক্তির স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে এবং ভারতবাসীর মুক্তির সংগ্রামের সপক্ষে জনমত গঠন করতে হবে। ‘৩০ এর দশকে একাধিকবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন সুভাষ ৷ ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝেছেন যে ইয়ুরোপে যুদ্ধ শুরু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা এবং এবারের যুদ্ধ বৃটিশ সাম্রাজ্যের নিজের গড়েই ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে ৷ সুভাষ বুঝতে চেষ্টা করলেন কোন কোন দেশের সাথে বৃটেনের স্বার্থের সংঘাত ৷ ইউরোপে থাকাকালীন প্রচার করলেন ভারতের কথা, ভারতের ওপর বৃটিশের অত্যাচারের বর্ণনা , সেই উদ্দেশ্যে ভিয়েনা শহরে অবস্থানকালে রচনা করলেন “The Indian Struggle” I ভারতেও তিনি বারবার কংগ্রেসের সহ নেতৃত্বদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, দেশে অবিলম্বে সর্বাত্মক আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে ৷ অচিরেই বৃটেন তার ঘরেই আক্রান্ত হবে ৷ সেই সুযোগের পূর্ন সদ্ব্যবহার করে ভারতবাসীকেও প্রস্তুত হতে হবে অন্তিম আঘাত হানবার জন্য ৷ কিন্তু, সুভাষের এই আন্তর্জাতিক বীক্ষা থেকে যোজন দূরে রয়ে গেলেন  কংগ্রেসের জাতীয় স্তরের অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্ব ৷ তাঁরা বিশ্বাস করেন বৃটেনের রাজশক্তি শাশ্বত, অপরাজের ৷ দেশের মানুষের ক্ষুব্ধ অন্তরের তরঙ্গ বিক্ষোভকে  অস্বীকার করেই গান্ধী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিশ্বাস করলেন যে দেশ সর্বাত্মক আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত নয় ৷ বরং তাঁদের মত হল ক্রমাগত অনুনয় আলোচনার মাধ্যমে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্তরাত্মাকে জাগালে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস একটা একদিন না একদিন পাওয়া যাবে ৷ কংগ্রেস নিশ্চয়ই ক্ষমতা পাবে ৷ হয়তো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের সার্বভৌমত্ব থাকবে না। হয়তো থাকবে না বৈদেশিক নীতির স্বাধীনতা ৷ তাতে কী ? ক্ষমতা কিছুটা তো পাওয়া যাবে। 

বিশ্ব রাজনীতির হিল্লোল ভারত মহাসাগরের তীরে সকল নেতৃত্ব শুনেও শুনলেন না। একা কর্নময় থেকে অস্থির হয়ে উঠলেন সুভাষ| 

আবার, কংগ্রেসের হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সূচনা লগ্নেই  সুভাষের তরুণ মনে এসেছিল অতি বাস্তববাদী প্রশ্ন : ইংরেজকে আজ নয় কাল ভারত ছাড়তেই হবে ৷ কিন্তু তারপর ? দেশটা চলবে কিভাবে ? ইংরেজের ধ্বংস করে যাওয়া অর্থনীতির পুনুরুদ্ধার হবে কি ভাবে?  ইংরেজ যে বশংবদ আমলাতান্ত্রিক কাঠামো তৈরী করেছে, কিভাবে তার বদল সম্ভব? জাত পাতের বেড়াজালে আবদ্ধ ভারতীয় সমাজে কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে সকলের জন্য ন্যায় ? নানা জাতির নানা ভাষার স্বাধীন ভারতের ভাষানীতি কি হবে ? বিদেশনীতির মূল ভিত্তি কি হবে ? সব থেকে বড় প্রশ্ন – স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক অবকাঠামো কি হবে ? ধনতন্ত্র না সমাজতন্ত্র ?

সুভাষ দেখেছেন কংগ্রেসের এসব নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নীতি নেই ৷ কেউ বিশেষ ভাবতেও চাননা ৷ কিন্তু সুভাষ বিশ্বাস করেন দেশ স্বাধীন হওয়া সাধনার একটা প্রাথমিক ধাপ ৷ আসল সাধনা শুরু হবে তারপর ৷ দেশকে গড়ে তুলবার সাধনা! শৃঙ্খল মোচনের পর ভবিষ্যত কর্তব্য স্থির করতে কালক্ষেপ করার অর্থ , দেশের নিরন্ন নিপীড়িত মানুষের কান্নাকে দীর্ঘায়িত করা ৷ সময় নেই!

তরুণ সুভাষ উত্তর খুঁজতে খুঁজতে তাকালেন বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার দিকে ৷ সেখানে তখন বলশেভিকদের নেতৃত্বে চলছে বিপুল কর্মোদ্যম মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৷ সমাজতন্ত্রের আদর্শকে সামনে রেখে সেখানে দেশের সর্বস্তরে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ৷ রাষ্ট্রের অধীনে যন্ত্রনির্ভর ভারী শিল্পের বিপুল আয়োজন৷ কৃষি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে যন্ত্রের বিপুল ব্যবহারে অভূতপূর্ব উৎপাদন ও উপার্জন বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে রাশিয়ায় ৷ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার পরামর্শে সুভাষ উপলব্ধি করলেন, যন্ত্র নির্ভর বৃহৎ শিল্প নির্মাণ ছাড়া শুধু চরকা ও চিরায়ত গ্রামীন উৎপাদন পদ্ধতিতে নির্ভর করলে হয়তো কিছুদিনের জন্য গ্রামের উপার্জন নিশ্চিত হবে, কিন্তু অচিরেই স্বাধীন ভারতকে পুনরায় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াতে হবে। দাক্ষিণাত্যে তাকিয়ে চমকিত হয়ে সুভাষ দেখছেন, এম. বিশ্বেশ্বরাইয়ার প্রযুক্তি-প্রতিভার বলে কিভাবে হায়াদ্রাবাদের ঊষরমাটিতে জল সিঞ্চন হচ্ছে, পুনাতে জলাধার নির্মিত হচ্ছে, পরিকল্পিত নতুন মহীশূর শহর তৈরী হচ্ছে ৷বুঝলেন, গান্ধীর অর্থনৈতিক চিন্তা বাস্তবের মাটিতে ক্ষণভঙ্গুর ৷ গান্ধীর দর্শনের সরাসরি বিরোধীতা করেই তিনি প্রচার করতে শুরু করলেন যন্ত্রনির্ভর আধুনিক ভারতের স্বপ্ন ৷ তিনি গ্রামীন ভারতকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন এই বলে যে, আধুনিক ভারতের বুকে সনাতন গ্রামীন ভারত তথা কৃষক – শ্রমিককে রক্ষা করতে হলেও যন্ত্রনির্ভরতা প্রয়োজন | এটাই সময়ের দাবী ৷ সেই সঙ্গে তিনি আরও উপলব্ধি করেছেন যে ভারতের সম্পদ শোষণের জন্য ইংরেজের যে বিরাট আয়োজন, তার এক প্রধান শরিক হল একশ্রেণীর দেশীয় পুঁজিপতি ৷ ইংরেজ চলে গেলেও এই পুঁজিপতির দল প্রচ্ছন্নভাবে ইংরেজদের শোষণযন্ত্র হয়ে কাজ করে যাবে ৷ এদের ষড়যন্ত্রে দুখিনী ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার বাধাপ্রাপ্ত হবে – নিরন্নের হাহাকার স্বাধীন ভারতেও ঘুচবে না ৷ তাই সমাজতন্ত্রই পথ! কিন্তু তা যেন মানুষের স্বাধীন সত্ত্বার দাবীকে অস্বীকার করে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনে পর্যবসিত না হয়! সুভাষের স্বপ্নে ধরা দিল এক নতুন জনকল্যানকামী ভারত যেখানে রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষের আধ্যাত্মিক সত্বাকে স্বীকৃতি দিয়ে তার বেঁচে থাকার চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিয়ে এমন এক সমসুযোগের পরিবেশ তৈরী করবে, যাতে করে প্রতিটি নাগরিক তার নিজের প্রতিভা বলে সম্পূর্ণরপে প্রস্ফুটিত হতে পারে এবং নিজ নিজ সৃজনশীলতায় দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করে ৷ দেশে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পে জনগনের দ্বারা স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিত হবে ৷ তবে ভারীশিল্প ও সুবৃহৎ অর্থনৈতিক পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি নিয়ন্ত্রিত হবে রাষ্ট্রের দ্বারা – ব্যক্তিগত পুঁজি নয়। সুভাষ প্রকাশ্যেই তাঁর সমাজতান্ত্রিক যন্ত্রনির্ভর ভারতের স্বপ্নের কথা প্রচার করলেন ৷ যন্ত্রনির্ভরতার কথা শুনে ক্ষুব্ধ হলেন গান্ধী অনুরাগীরা , আর সমাজতন্ত্রে অশনিসংকেত দেখলেন দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণী !
এ সবই ঘটে গেছে সুভাষ সভাপতি নির্বাচিত হবার আগে ৷ হয়তো অনেকে ভেবেছিল, প্রেসিডেন্টের আসনে আসীন সুভাষ দল পরিচালনার গুরুভারে গান্ধীর ছায়াতেই মিশে যাবেন ৷ কিন্তু, যে আদর্শ অধ্যাত্ম সাধনার সাথে একাত্ম হয়ে গেছে, তাকে কি অত সহজে ভোলানো যায়? 
১৯৩৮ -এর ফেব্রুয়ারীতে সভাপতি নির্বাচিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুভাষ প্রস্তুত হতে বললেন সর্বাত্মক বিপ্লবের জন্য ৷ বিপুল সাড়া জাগল দেশব্যাপী বামপন্থী তরুণদের মধ্যে ৷ কিন্তু তীব্র বিরোধীতা এল গান্ধীর পক্ষ থেকে ৷ নেহেরুও অস্বীকার করতে চাইলেন আন্তর্জাতিক পরিস্হিতির বাস্তবতা | পাশাপাশি সুভাষ , ড. মেঘনাদ সাহা, বিশ্বেশ্বরাইয়া ও আরও অনেককে নিয়ে সূচনা করলেন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন | আর মেঘনাদ সাহার পরামর্শে তার নেতৃত্ব তুলে দিলেন নেহেরুর হাতে ৷ দেশীয় পুঁজিপতির দল ও ইংরেজ শাসক বুঝল, সুভাষ সুপরিকল্পিত ভাবে এগিয়ে চলেছেন শোষনমুক্ত স্বাধীন ভারতের বাস্তবায়ণের লক্ষ্যে ৷ থামাতে না পারলে বিপদ!
কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধী অনুগামীরা তীব্রতর অবস্থান নিতে শুরু করলেন সভাপতি সুভাষের বিরুদ্ধে৷ এই পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসের অন্তিম লগ্নে খবর এল বৃটেন মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে শান্তি সুনিশ্চিত করেছে। কিন্তু সুভাষ বুঝেছেন এ শান্তি আসলে ঝড়ের পূর্বে দমবন্ধ করা নিশ্চল প্রকৃতি ! এ শান্তি আসলে শ্মশানের দূত ! ঘা মেরে জাগানোর চেষ্টা করলেন কংগ্রেসের ক্লান্ত নেতৃত্বকে ৷ কিন্তু, নেহেরু সহ অন্যান্যরা বৃটিশের বাহ্বাস্ফোটেই মেতে রইলেন ৷ বৃটিশ কি কখনও ভুল করতে পারে ! তাঁরা বিশ্বাসই করলেন না যুদ্ধের সম্ভাবনার বাস্তবতা | বৃটিশের সাথে আলোচনা ও অনুনয় চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই নেহেরু-গান্ধী দৃঢ় মত ব্যক্ত করলেন।

কংগ্রেসের নেতৃত্বের সাথে তার নিজের সভাপতিরই দূরত্ব বাড়তে থাকল ৷ এ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি ৷ দেখতে দেখতে এসে গেল মার্চ ১৯৩৯ | আবার কংগ্রেসের অধিবেশন হরিপুরায়৷ কে মনোনীত হবেন সভাপতি ? না, এবার আর মনোনয়ন নয় ৷ এতদিনের প্রচলিত পন্থার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এবার সরাসরি নির্বাচন | গান্ধীজী সমর্থিত পট্টভি সীতারামাইয়াকে ভোটে পরাজিত করে পুনরায় সভাপতি সুভাষ | বামপন্থীদের, বিশেষতঃ বাংলা ও পাঞ্জাব থেকে বিপুল সমর্থন এসেছে সুভাষের জন্য। কিন্তু, সভাপতি হয়েও সুভাষ ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয়ে গেলেন ৷ সুভাষ দেখলেন বামপন্থীরা উৎসাহী, সংখ্যায় বেশী , কিন্তু সংঘবদ্ধ নয়। অন্যদিকে গান্ধী অনুগামীরা গান্ধীর নেতৃত্বে সুসংগঠিত | গান্ধী পন্থীদের সাহায্য ব্যতীত সভাপতির দপ্তর চালানো আসম্ভব হয়ে পড়ছে। সুভাষ হয়ে গেলেন “president without an office”! এভাবে দেশকে আন্দোলনের জন্য গড়ে তোলা অসম্ভব ৷ সুভাষ বুঝলেন, এভাবে চললে অসংখ্য তরুণ ও বামপন্থীদের আশাভঙ্গ হবে, তাদের সমর্থনের মর্যাদা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে ৷

১৯৩৯ এর এপ্রিল মাসে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন সুভাষ ৷ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী শক্তিগুলিকে সংঘবদ্ধ করার জন্য কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই এক নতুন সংগঠন তৈরী করলেন – ফরোয়ার্ড ব্লক ৷ ফরোয়ার্ড ব্লক নীতিগত ভাবে স্থির করল , ভারতের সার্বিক অবনতির মূল কারণ বৃটিশ শাসন৷ তাই সর্বাগ্রে বৃটিশ শাসনের অপসারণ প্রয়োজন৷ ফরোয়ার্ড ব্লকের আশু কর্তব্য হল আন্তর্জাতিক পরিস্হিতির সম্বন্ধে দেশকে অবহিত করা এবং সবাত্মক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য দেশকে প্রস্তুত রাখা যাতে করে ইয়ুরোপে বৃটেন আক্রান্ত হলেই ভারতবর্ষে তীব্র আন্দোলনে রাজশক্তিকে টলিয়ে দেওয়া যায়। দেশব্যাপী বিপুল সমর্থন পেল ফরোয়ার্ড ব্লক ৷

১লা সেপ্টেম্বর , ১৯৩৯ ! মিউনিখ সমঝোতার ঠিক ১১ মাস অতিক্রান্ত | ফরোয়ার্ড ব্লকের সভা চলছে মাদ্রাজের সমূদ্র উপকূলে ৷ লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতকে সম্বোধন করছেন সুভাষ | এমন সময় দলের একজন একটা সান্ধ্য পত্রিকা এগিয়ে দিল সুভাষের দিকে ৷ হিটলার পোল্যান্ড আক্রমন করেছেন ! চুরমার হয়েগেল বৃটেনের বৈদেশিক নীতির দম্ভ | মূহুর্তে সুভাষ পরিবর্তন করলেন বক্তব্যের অভিমূখ ৷ ডাক দিলেন সর্বাত্মক সংগ্রামের ৷ দিকে দিকে শুরু হল ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতৃত্বে আইন অমান্য ৷ অচিরেই জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স | শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ৷ ভারতবাসী দেখল এতদিন সুভাষ যা বলে এসেছেন, যা বিশ্বাস করতে বলেছেন, তাই সত্য হল ! সমর্থনের জোয়ারে ফরোয়ার্ড ব্লক বৃটিশ শাসকের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলল ৷ সুভাষ কংগ্রেসের নেতৃত্বকে কাতর আহ্বান জানালেন এবার অন্ততঃ আন্দোলনে যোগ দিতে ৷ গান্ধী অনড় ৷ নেহেরু নিজেকে ফ্যাসীবাদ বিরোধী প্রমাণ করতে উদগ্রীব | ভারতের বুকে ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদ তখন তিনি তুল্যমূল্যতায় আনতে রাজী নন৷ তিনি অভিমত ব্যক্ত করলেন যুদ্ধকালে ইংরেজের বিরুদ্ধে যাওয়া মানে প্রকারান্তরে হিটলারকে সমর্থন করা ৷ গোটা বিশ্ব কংগ্রেসকে ফ্যাসীবাদের সমর্থক ভাববে ৷ সে বড় গ্লানির বিষয় !

কিন্তু, যুদ্ধের পরিস্থিতি দ্রুত ইংল্যান্ডের এবং মিত্রশক্তির পক্ষে জটিল হতে শুরু করল। ইউরোপের সমস্ত রণাঙ্গনে মিত্রশক্তি পরাভূত হতে থাকল ৷ ১৯৪০ এর মে – জুন মাসে ফ্রান্স আত্মসমর্পন করল। কয়েকমাস পর জার্মানীর বোমারু বিমানের আঘাতে লন্ডন তছনছ হয়ে গেল। সুভাষ গান্ধীজীর কাছে আবার আবেদন জানালেন ৷ কিন্তু, গান্ধীজী অনড় ৷ তিনি জানিয়ে দিলেন , বৃটেনের ধ্বংসের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার দাবী জানালে ভারতের মর্যাদাহানী ঘটাবে ৷ বরং দুঃসময়ে বৃটেনের পাশে থাকলে যুদ্ধোত্তরকালে অবশ্যই বৃটেন ভারতের দাবী মানবে ৷ সেই মর্মে আশ্বাসও পাওয়া গেছে ৷ কিন্তু সুভাষের সন্দেহ, দাবী মানার অর্থ যদি ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস হয় তাহলে তো বিদেশনীতির জন্য ভারত বৃটেনের ওপর নির্ভরশীল থাকবে ! যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বৃটেনের পরাক্রম ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য ৷ বিশ্বের রাজনৈতিক বিন্যাসে হয়তো নতুন সমীকরণ আসবে ৷ এমতাবস্থায় বৃটেন নির্ভর বিদেশনীতি কি ভারতের স্বার্থ নিশ্চিত করবে ? তাছাড়াও, যে যুদ্ধে ভারতের কোন স্বার্থ নেই সেখানে অযথা ভারতকে জড়ানো হবে কেন? কেনইবা ভারতের সন্তানরা এমন এক যুদ্ধের জন্য বৃটেনের সেনাবাহিনীর হয়ে রক্ত ঝরাবে ? 

সুভাষের কথা হয়তো গান্ধীজীর অন্তরাত্মাকে বিচলিত করে তুলেছিল ৷ সুভাষকে তিনি নিজের মতো পথ বেছে নিতে বলেছিলেন ৷ বলেছিলেন সুভাষ সফল হলে সবার আগে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাবেন গান্ধীজী নিজে ৷ অচিরেই গান্ধীজী কংগ্রেসের সমস্ত পদ থেকে অব্যাহতি নেন , কারণ ভারতবর্ষের যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন ও তাতে কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন সমর্থন – এই দুটিই ছিল তাঁর অহিংস আদর্শের পরিপন্থী। 

এদিকে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতৃস্থানীয়দের উপর নেমে এল বৃটিশ সরকারের দমননীতি | একে একে নেতা কর্মীরা গ্রেপ্তার হলেন ৷ ইংরেজ বুঝল ফরোয়ার্ড ব্লককে সামলাতে না পারলে সমূহ বিপদ | সুভাষ বুঝলেন তাঁর গ্রেপ্তারীও সময়ের অপেক্ষা৷ শেষ চেষ্টা করলেন একবার সমস্ত সংগঠনগুলিকে একজোট করে সর্বাত্মক আন্দোলন ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ৷ নেহেরু আবারও জানালেন, তিনি হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বৃটেনের বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়াতে চান , অন্যথায় তাঁর আশঙ্কা যে তাঁর বামপন্থী ফ্যাসীবাদ বিরোধী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে ৷  

সুভাষ স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে সমস্ত ছুতমার্গতা সরিয়ে রেখে দ্বারস্থ হলেন জিন্নার ৷ বল্লেন পাকিস্তানের দাবী তুলে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল না করে, তাঁর সমস্ত শক্তি বৃটিশের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করতে ৷ কিন্তু অনড় জিন্না জানালেন তিনি সর্বোতভাবে বৃটিশের সাথে সুসম্পর্কে আগ্রহী, কারণ বৃটিশের সাহায্যেই তাঁকে পাকিস্তান অর্জন করতে হবে ৷ সুভাষ জানালেন , যদি একত্রে আন্দোলন করে দেশের অখণ্ড স্বাধীনতা অর্জনে জিন্না সাহায্য করেন, তাহলে জিন্নাকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেও সুভাষ তৈরী ৷ কিন্তু, সুভাষের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জানিয়েও জিন্না কংগ্রেস সম্বন্ধে পূর্ণ অনাস্থা জ্ঞাপন করে সুভাষের সমস্ত প্রস্তাবেই অস্বীকৃত হলেন।

অতঃপর সুভাষ দ্বারস্থ হলেন হিন্দু মহাসভার নেতা, অতীতের বিপ্লবী সাভারকরের ৷ বোঝালেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির গুরুত্ব ৷ বোঝালেন, এই ঈশ্বরদত্ত সুযোগের ব্যবহার করে বৃটিশ শাসনের অপসারণে সর্বাত্মক চেষ্টা না করতে পারলে ইতিহাস ক্ষমা করবেনা ৷ কিন্তু সাভারকর তাঁর বিপ্লবী সত্ত্বাকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছেন ৷ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তিনি নিরুৎসাহী৷ তিনি জানিয়ে দিলেন, তিনি চান বৃটিশের সৈন্যদলে আরও বেশী করে হিন্দুরা অংশগ্রহন করে অস্ত্রশিক্ষা করুক, যাতে করে আগামী দিনে মুসলিম লীগের সাথে সরাসরি সংগ্রামে হিন্দু মহাসভার যোদ্ধার অভাব না হয়।

কেউ কথা রাখল না সুভাষের ৷ অতত্রব পথ একটাই – বাইরের থেকে শক্তি সঞ্চয় করে সশস্ত্র আক্ৰমণ ৷ সুভাষ গ্রেপ্তার হলেন ৷ অসুস্থতার কারণে এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দী রইলেন ৷ তারপর একদিন ১৯৪১ -এর শীতের রাত্রে সবার অলক্ষ্যে দুর্বার বৃটিশ শক্তিকে ফাঁকি দিয়ে অদৃশ্য হলেন সুভাষ | কেউ জানল না কোথায় দেশনায়ক ! 

বহুপরে দেশনায়কের বানী শোনা গেল বার্লিনে , তারপর টোকিওয় , সিঙ্গাপুরে ৷ বাংলার দামাল সুভাষ তখন নেতাজী !সিঙ্গাপুরের পতনে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন নেহরু সহ গান্ধীর অনুগামী কংগ্রেসীরা | ততদিনে গান্ধীর সম্বিৎ ফিরেছে ৷ সুভাষ তবে ঠিকই অনুমান করেছিল ! একমাত্র সুভাষই ক্ষুরধার দূরদৃষ্টিতে বুঝেছিল আসন্ন যুদ্ধে বৃটিশের ভিত টলে যাবে ৷ প্রমাণ হবে, বৃটেন অপরাজেয় নয় ৷ বোধ হয় বড় ভুল হয়ে গেল ! আজ যদি সুভাষ ঘরে থাকত! কংগ্রেসের নেতারা আতঙ্কিত হয়ে ভাবলেন , যদি ইংল্যান্ড তার নিজের ঘর সামলাতে গিয়ে ভারতকে জাপানী আগ্রাসনের মুখে অসহায় করে ছেড়ে দেয় তখন কি হবে? ১৯৪২ -এর এলাহাবাদ অধিবেশনে গান্ধীজী বার্তা পাঠিয়ে জানালেন যে তিনি বিশ্বাস করেন, বৃটেন ভারতকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ৷ জাপানের সাথে ভারতের কোন শত্রুতা নেই। ইংরেজের বৈরীতার ভার ভারত কেন বহন করবে ? ইংরেজ ভারত ছাড়ুক | ভারতবাসী স্বাধীন ভাবে তার ভবিষ্যত নীতি নির্ধারণ করবে ৷নেহেরু যদিও ‘ইংল্যান্ড ভারতকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম ‘ জাতীয় কড়া কথা সরাসরি কংগ্রেসের সরকারী বক্তব্যে রাখতে চাইলেননা, কিন্তু তিনিও সরাসরি দাবী জানালেন স্বাধীনতার – ” এখুনি , এই মুহূর্তে ” !

১৯৪২ – এ সর্বাত্মক ” ভারত ছাড়ো ” আন্দোলনের ডাক দিলেন গান্ধীজী | এবার বৃটিশের রোষ পডল কংগ্রেসের নেতৃত্বের ওপর৷ গান্ধীজী সহ প্রথম সারির নেতারা গ্রেপ্তার হলেন ৷ গান্ধীজী বললেন ” করেঙ্গে , ইয়া মরেঙ্গে”৷

এর পরের ইতিহাস সবারই জানা৷ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হল ” Two dominions are born” ! বাংলা ও পাঞ্জাবের বুক বিদীর্ণ করে জন্ম নিল ভারত ও পাকিস্তান ৷ আর সুভাষ ! মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার সন্ধানে সে রয়ে গেল নিরন্তর নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়ে। কেউ তার কথা না রাখুক, তাকে তো কথা রাখতেই হবে – যে কথা সে দিয়েছে তার অন্তরের ঈশ্বরকে !

******************************************

ঋণ স্বীকার :

১) The Indian Struggle (1920-10942) by Netaji Subhash Chandra Bose, published by Tandra Chakraborty, Natyachinta Foundation, Second edition, 2005.

২) সুভাষচন্দ্র ও ন্যাশনাল প্ল্যানিং, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, জয়শ্রী প্রকাশন৷

৩) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস, প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী ও সিদ্ধার্থ গুহ রায়, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স |

Facebook Comments