Site Overlay

কেয়ার গিভার

যোজনগন্ধা

মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতে এতো বছর পর এভাবে যে তাম্রপর্ণীকে আবিষ্কার করতে পারবে স্বপ্নেও ভাবেনি দত্তাত্রেয়! সিনিয়র সিটিজেন তকমার অধিকারিণী হয়েও তাম্রপর্ণী এখনো বেশ মোহময়ী। আকাশ-নীল সালোয়ার কামিজে, কায়দা করে কাটা চুলের বাহারে, কথার ফুলঝুরিতে চারপাশের লোকজনকে নিমেষে আত্মীয় বানিয়ে তোলার ক্ষমতার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে দত্তাত্রেয়। কিছুটা সন্দেহ যদিও ঘুরপাক খাচ্ছে মনের মধ্যে। চিনতে পারবে কি? বার্ধক্য এলেও লম্বা-চওড়া চেহারায়, কালার করা ঝাঁকড়া চুলে, চোখের বিদেশি সানগ্লাসে, পরিধানের কালো জিন্স আর লাল টি-শার্টে দত্তাত্রেয়র রংবাজি এখনো পুরো মাত্রায় বজায় রয়েছে। অবশ্য পরিচয় পাওয়ার পর বিদেশ ফেরত, ডলারওয়ালা, এক কালের পরিচিত, বর্তমান সিনিয়র সিটিজেনকে তাম্রপর্ণী স্বাভাবিক নস্টালজিয়ায় মুড়ে নেবে নাকি আদিখ্যেতায়, দ্বন্দ্ব চলছে তা নিয়েও।।

এক পাড়ায় বড়ো হলেও ভীষণ সিরিয়াস পড়ুয়া দত্তাত্রেয়, নিজের জগতে ডুবে থাকা দত্তাত্রেয়, জীবনের টার্গেট তৈরি করে ফেলা দত্তাত্রেয় কখনও খেয়াল করে দেখে নি বা নজরই করে নি বাড়িতে প্রায় দিন আসতে থাকা বোন দর্পণার বন্ধু তাম্রপর্ণীকে। একবার মুখোমুখি হয়েছিল দুজনে। যেবার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বেরনোর পর এক বাক্স মিষ্টি আর একটা দামী কলম উপহার দেওয়ার পাশাপাশি পাশের সবটুকু কৃতিত্ব দত্তাত্রেয়কেই দিয়েছিল তাম্রপর্ণী। হতবাক দত্তাত্রেয়কে পরে অবশ্য তার মা বলেছিল পিতৃহীন মেয়েটিকে তার সমস্ত নোটসের খাতা মা দান করেছিল একটু সুরাহা হওয়ার আশায়। মায়ের মুখরক্ষা করেছিল তাম্রপর্ণী। আর শেষ বারের সেই দেখা! আজও ছবিগুলো স্পষ্ট ভাসে দত্তাত্রেয়র চোখের সামনে! চাকরিতে সবেমাত্র প্রবেশ করেছে সেই বছর। তমোনাশের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলে মা নিজের হাতে তাম্রপর্ণীর জন্য আইবুড়ো ভাতের আয়োজন করে ছিল। তমোনাশ মায়ের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ছেলে। বিরাট ব‍্যবসা তাদের। মোটামুটি ফরসা, গোলগাল চেহারার, হি হি করে কথায় কথায় গড়িয়ে পড়ার, কথার পিঠে কথা বলার তীক্ষ্ণ ক্ষমতার মেয়েটির জন্য সেইদিন প্রথম দত্তাত্রেয়র বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে একটা ব‍্যথার জন্ম হয়েছিল। তাম্রপর্ণী যখন সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল, চুপিসারে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দত্তাত্রেয়র চারপাশে লাল, নীল, কালো, গেরুয়ার সংমিশ্রণে নানান দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছিল। কারুর চলে যাওয়া যে এতো রাজকীয় হতে পারে সত্যিই জানা ছিল না! শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাওয়া গল্পটাকে কবরে পাঠাতে দত্তাত্রেয়র আয়োজনের অন্ত ছিল না। কঠোর পরিশ্রমের পর যখন বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব এসেছিল, সানন্দে গ্রহণ করে ছিল। কর্তব্যের পরিসরে, সময়ের দাবীতে চাপা পড়ে থাকলেও নামটা গভীরে গেঁথে ছিল। তাম্রপর্ণী!!

কঠোর পরিশ্রমের ফলে সাফল্য অর্জন করার পর দত্তাত্রেয়র দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে ছিল প্রতি বছর ভাইফোঁটার সময় দর্পণার বাড়িতে এসে তিন রাত্রি কাটিয়ে যাওয়া। তাও প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল দর্পণার মৃত্যুতে আর ফোঁটাও পাওয়া হয় না। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যু আর একমাত্র ছেলের অন্য শহরে স্থায়ী বসবাস, নতুন করে একাকীত্ব তৈরি করায় দত্তাত্রেয়র দেশে ফিরে আসা আর বাবার তৈরি করে যাওয়া বাড়িতে থাকা আজ প্রায় মাস চারেক ধরে।তুতো ভাইবোনেরা ডলারের অভিপ্রায়ে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশার চেষ্টা করতেই স্বাভাবিক গাম্ভীর্যের মোড়কে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে দত্তাত্রেয়। ফলে প্রিয়জনের সান্নিধ্য দুর্লভ হওয়ায় মানসিক ভাবে একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় দত্তাত্রেয়। সেই সময়েই একদিন হঠাৎ করে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে। “বান্ধব” নামের সংস্থাটি কলকাতা শহরের সিনিয়র সিটিজেনদের কেয়ার গিভার সাপ্লাই করে। সোজা কথায় অর্থের বিনিময়ে সঙ্গদান। তবে কর্ণধার বছর চল্লিশের জীমূত বছরভর নানা ধরনের কর্মশালার আয়োজন করে এই একাকী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাড়ির বাইরে বের করে আনে জেনে তাদের মেল করেছিল দত্তাত্রেয়। এবারের মন্দারমণির প্ল্যানের বিস্তারিত তথ্য ই-মেল মারফত পেয়েই দত্তাত্রেয় চলে এসেছে। উদ্দেশ্য, সংস্থাটির আন্তরিকতা বা কেজো সম্পর্ক যাচাই করা যাতে কেয়ার গিভার নেওয়ার ব‍্যাপারটাতে মনস্থির করা যায়। তখন কে জানত এই স্বচ্ছ জলরাশি, শরতের নীলাকাশ, সুদীর্ঘ বালুকাবেলা, কেয়াবনের ঝোপের মধ্যে আবিষ্কার করে বসবে তাম্রপর্ণীকে!!

হোটেলের সাজানো বাগানে বসে নৈঃশব্দ্য উপভোগ করছে দুজনে। একটু আগেই নিজের জীবনের ঝাঁপি উপুড় করে ছিল তাম্রপর্ণী নির্দ্বিধায়। জীমূত পরিচয় পর্বের সময় দত্তাত্রেয়র নাম বলতেই বহুদিন আগের সেই প্রাণচঞ্চল কিশোরীর মতোই ছুটে এসে ছিল তাম্রপর্ণী দত্তাত্রেয়র সামনে। তার স্বাভাবিক ব‍্যবহারে, আন্তরিকতার উষ্ণতায় দত্তাত্রেয়র মনের সমস্ত বাধা দূর হয়ে গেছিল। সারাদিন হোটেলের কমিউনিটি হলে “বান্ধব”-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত ডিবেট, নাচ, গান, জম্পেশ খাওয়া দাওয়ার মাঝে আর কথাই হয় নি দুজনের। রাতের পরিবেশ দেখার জন্য দত্তাত্রেয়কে রুম থেকে ডেকে এনে ছিল তাম্রপর্ণী। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সে এই সংস্থার “নন্ মেডিকেল কেয়ার গিভার” তথা “কালচারাল প্রোগ্রামার”-এর দায়িত্ব পালন করছে। তমোনাশের মৃত্যুর পর একমাত্র মেয়েকে একা হাতে মানুষ করেছে। রূপাঞ্জনা একজন আর্কিটেক্ট। একটি বহুতল প্রস্তুতকারী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বর্তমানে ব‍্যাঙ্গালোরে রয়েছে। একাকীত্ব যাতে গ্রাস না করতে পারে তাই জন্য তাম্রপর্ণী এই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি, নানা রকমের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, একদল কমবয়সী ছেলেমেয়েকে নেতৃত্ব দেওয়া- এসবের মধ্যে ভালোই কাটছে তার সময়। তবে কিছুদিন আগে একবার হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বলেই এবার একজন কেয়ার গিভার রাখার কথা ভাবছে। মেয়েও সায় দিয়েছে। দত্তাত্রেয় মনে মনে ভাবতে থাকে কতখানি আত্মসম্মানবোধ থাকলে সন্তানের উন্নতির পথে বাধা হয়ে না দাঁড়িয়ে, একাকীত্বকে বরণ না করেও এভাবে পথ চলা যায়! ষাট পার হতেই সব কেমন যেন বদলে যায়। ডিগ্রি, রূপ, যৌবন, ব‍্যাঙ্ক ব‍্যালেন্স, বাড়ি, গাড়ি, গয়না, স্ট্যাটাস সবকিছুই কেমন যেন মূল‍্যহীন। মুখ‍্য হয়েছে এখন সান্নিধ্য। জীবনের কাছে চাওয়া হয় স্বাভাবিকত্ব। উত্তেজনা নয়, মন চাইছে এমন কাউকে যাকে ছোঁয়া যায়, যার চোখের দিকে তাকালে শান্তি পাওয়া যায়, যার সঙ্গে ঝগড়া করে মনের আরাম হয়, যার সান্নিধ্যকে আশ্রয় বলে মনে হয়। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়তে সচকিত হয় দত্তাত্রেয়। পাশে তাকিয়ে দেখে মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে তার ডান হাত দিয়ে অসঙ্কোচে দত্তাত্রেয়র বাম হাতকে জড়িয়ে রেখেছে তাম্রপর্ণী। হার্ট বিট মিস্ করার বয়স চলে গেলেও একটা আকুলতা যেন পরম যত্নে ঘিরে ধরল!!

“বান্ধব”- এর থেকেই যে কেয়ার গিভার নেবে বলে মনে মনে ঠিক করে ফেরার বাসে উঠে বসে দত্তাত্রেয়। এদের অনুষ্ঠানে তাম্রপর্ণীর সঙ্গে দেখা হবে ভেবেও মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি জেগে ওঠে। বৃদ্ধাবাসে থাকা তার না-পসন্দ। অন‍্যের কথায় ওঠাবসা করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। নিজের বাড়িতে থাকা হলো, সঙ্গীও পাওয়া গেল আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতাও হলো না। এদের কাজের ধারাটি বেশ পছন্দ হয়েছে দত্তাত্রেয়র। কর্ণধার জীমূত সংস্থা নিয়েই চব্বিশ ঘন্টা ব‍্যস্ত। এই যে মন্দারমণির সমুদ্র সৈকত লাগোয়া ভালো হোটেলে প্রত‍্যেকের জন্য আলাদা রুমের ব‍্যবস্থা, রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী মেনু রাখা, সবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য খেয়াল রাখাই শুধু নয়, ঘড়ি ধরে যার যা ওষুধের প্রয়োজন সেকথা মনে করিয়ে দেওয়ার মধ্যে বয়স্কদের প্রতি মমত্ববোধও কোথায় যেন ফুটে উঠেছে। তবে শরতের সোনালী আভা মুছে দিয়ে মহালয়ার সন্ধ্যায় জীমূতের কাছ থেকে আসা ফোনকল রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল দত্তাত্রেয়কে। বাজার সেরে ফেরার পথে অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে গেছিল তাম্রপর্ণী। সিটি স্ক্যান বলছে মাথায় কয়েকটি ছোট ছোট রক্তের দলা জমাট বেঁধে আছে। হসপিটালের ছোট্ট কেবিনে বসে তাম্রপর্ণীর হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে মনে মনে নতুন করে একটা সিদ্ধান্ত নেয় দত্তাত্রেয়।।

ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে নিঃশব্দে দত্তাত্রেয় ঘরে চলে যেতেই হালকা হাসির রেখা তাম্রপর্ণীর ঠোঁটের কোণে খেলে যায়। আজ মহাষষ্ঠী। ভাগ‍্যিস এমন অকাল বর্ষণ মন্দারমণিতে হয় নি। নাহলে বেড়ানোর আনন্দ একেবারে মাটি হয়ে যেত। দত্তাত্রেয়র প্রস্তাব তাম্রপর্ণীর মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। সকাল থেকেই ভাবছে কথাগুলো। দত্তাত্রেয়র ইচ্ছে দুজনের বাড়ি দুটো বিক্রি করে দিয়ে একটা বড়ো মাপের ফ্ল্যাট কিনে জমিয়ে ফ্ল্যাট-মেট হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে দুজনে। দুজনেই তাদের ছেলেমেয়েদের টাকার একটা অংশ দিয়ে বাকিটা ব‍্যাঙ্ক এবং বিভিন্ন ফান্ডে রেখে সেই সুদে পায়ের উপর পা দিয়ে আরাম করে থাকবে। কোন বাইরের কেয়ার গিভারের তত্ত্বাবধানে আলাদা আলাদা ভাবে থাকা নয়, বরং এক ছাদের নিচে একে অপরের কেয়ার গিভার হয়েই থাকতে চায় দত্তাত্রেয়। ভয় যে একটা তার মনেও জন্মেছে সেটা এই পরিকল্পনা শুনেই স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তাম্রপর্ণী। সোজা কথায় দত্তাত্রেয় বলেছে, “আমাদের জীবনে কোনকিছুই আর আগের মতো নেই পর্ণী। আছে শুধু স্মৃতি। সেসব পুরনো, মরচে ধরা স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা কি খুব গর্বের? একজন কেয়ার গিভার তোমাকে যত্ন দেবে, প্রয়োজনীয় জিনিস এনে দেবে, ওষুধ-পথ‍্য-ডাক্তারের ব‍্যবস্থা করে দেবে, সঙ্গ দেবে, আমাদের স্মৃতিচারণ মন দিয়ে শুনবে বা শোনার অভিনয় করবে কিন্তু কোনটাই তাকে স্পর্শ করবে না। কেয়ার গিভার একজন প্রফেশনাল। টাকার বিনিময়ে সার্ভিস দেওয়া রোবট মাত্র। তার প্রাণ আছে কিন্তু উচ্ছ্বাস নেই, ভরপুর কর্তব্যজ্ঞান আছে কিন্তু আন্তরিকতা নেই, এটাই কি কাম‍্য পর্ণী? কেয়ার গিভাররা যন্ত্রের মতো। সেখানে কোনো নিঃস্বার্থ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। বরং আমরা একসাথে ফ্ল্যাটে থাকলে কোনরকমের দুশ্চিন্তা নেই। চব্বিশ ঘন্টা জল, আলো, সিকিউরিটি সার্ভিস, সিসিটিভির মনিটরিং, চোর-ডাকাতের ভয় নেই, একেবারে এই বয়সের জন্য আদর্শ থাকার জায়গা। কাজের লোক আর রান্নার লোক রেখে দিলেই আমাদের মসৃণ অবসর যাপন। আর তাছাড়া, কুক হিসেবে বলো বা কেয়ার গিভার হিসেবেই বলো, আমি যে খুব একটা খারাপ নই তা এই তিনদিনের অক্লান্ত সেবাযত্ন থেকে আশাকরি তুমি বুঝতে পেরেছ? তাড়াহুড়ো কিছু নেই পর্ণী। ধীরে সুস্থে ভেবে উত্তর দিও।” কি যে উত্তর দেবে তাম্রপর্ণী! জীবনে এমন শব্দ তার কল্পনাতেও কখনো উঁকি দেয় নি! “ফ্ল্যাট-মেট”!!

দত্তাত্রেয়র প্রস্তাব ঈষৎ আকর্ষণীয় এবং অ্যাডভেঞ্চারাস্ হলেও তাম্রপর্ণীর মনের মধ্যে একটা কিন্তু ভাব জেগে রয়েছে। দর্পণার সঙ্গে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জড়িয়ে ছিল তাম্রপর্ণী। বন্ধু হয়ে যতটা সে করেছে আপন সহোদর হয়েও দত্তাত্রেয় কণামাত্র করতে সক্ষম হয় নি দর্পণার জন্য। দর্পণার চলে যাওয়া ভুলতেই যে তাম্রপর্ণীকে “বান্ধব”-এর অংশ হতে হয়েছে একথা শুনেই কি দত্তাত্রেয় প্রতিদান দিতে চাইছে? তাম্রপর্ণীকে সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে মানসিক শান্তি পেতে চাইছে? কফির খালি কাপ নিয়ে ফিরতে গিয়ে আনমনা তাম্রপর্ণীর মুখের উপর দত্তাত্রেয়র অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছুঁয়ে যায়। আলতো হেসে বলে, “এতো ভাবনার কিছু নেই। ডাস্টবিনে ফেলে দাও আমার প্রপোজাল।” ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই তাম্রপর্ণী দত্তাত্রেয়র হাতটা চেপে ধরে। বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখেই নিচু স্বর বাজে, “এটা বিদেশ নয়। সমাজে বাস করতে গেলে অনেক কিছু এখানে ভেবে চলতে হয়। আমার স্বামী নেই। তোমারও স্ত্রী নেই। বেসিক‍্যালি আমরা দুজনেই যে যার জীবনে একেবারে একলা। আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা নিতেই পারি। কিন্তু দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়েছ বলেই তোমার কাছে যেটা সহজ আমার কাছে সেটাই ভীষণ কঠিন। দুজন সিনিয়র সিটিজেন ফ্ল্যাট-মেট হয়ে থাকলে কমপ্লেক্সের বাকি লোকেদের মধ্যে যে গুঞ্জন, ঠোঁট টেপা হাসির জন্ম দেবে সেটা মেনে নিয়ে পাশাপাশি পথ চলা কি সত্যিই সম্ভব হবে?” কথা শেষ হতেই এক ঝটকায় তাম্রপর্ণীকে দাঁড় করায় দত্তাত্রেয়। গাঢ় স্বরে বলে, “এই দুশ্চিন্তার একটাই সহজ সমাধান রয়েছে আমার কাছে। বিয়ে করবে আমাকে? আগামী অঘ্রাণে?” একেবারে অপ্রত্যাশিত অথচ অনাড়ম্বর সমাধানের কথায় তাম্রপর্ণী অতি পরিচিত মানুষটার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে। ছলনা নয়, নির্ভেজাল সত্যি ধরা দিয়েছে সেখানে। স্থির দৃষ্টি মেলে দিয়ে ছোট্ট জবাব ভাসে, “হ‍্যাঁ”। কখন যে বর্ষণ শেষে রামধনু ফুটে উঠেছে কে জানে! বোধনের মন্ত্রও শোনা যাচ্ছে। তাম্রপর্ণীর চোখেমুখে যেন সাত রঙের সমাহার। আর দত্তাত্রেয়র বুকের বাঁদিকে আচম্বিতে আড়বাঁশি বেজে উঠল।

Facebook Comments