Site Overlay

চাঁদে কলঙ্ক নেই

দেবাঞ্জন দাস

কদিন আগে চন্দ্রযান যখন চাঁদে পাঠায় ইসরো, তখন একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়, কারণ ইসরো চেয়ারম্যান কে দেখা যায় মন্দিরে প্রার্থনা করছেন চন্দ্রযানের সাফল্য কামনা করে।

বিতর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক, কেন না বিজ্ঞান যেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে সেখানে পূজা পাঠ তো কুসংস্কার। এই নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে কি? আবার যারা এই বিতর্কে নাচ গান করছেন তারা অধিকাংশই প্রগতিশীল আর বেশিরভাগই স্বঘোষিত লিবারেল বা স্কচ কমিউনিস্ট। এরা রীতিমতো নীল আর্মস্ট্রং কে টেনে এনেছেন। আর পুরো বিষয়ে যেটা চেপে যাচ্ছেন সেটা হলো  নীল আর্মস্ট্রংয়ের সতীর্থ এডুইন অলড্রীনের কথা, যিনি চাঁদে গিয়ে ধর্মাচরণ করেছিলেন একদম ক্যাথলিক মতে যেটাকে কমিউন বলে। 

গোদা ইংরেজিতে: Commune is a Christian sacrament in which consecrated bread and wine are consumed as memorials of Christ’s death or as symbols for the realization of a spiritual union between Christ and communicant or as the body and blood of Christ.

২০শে জুলাই, ১৯৬৯-এ আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন  এপোলো-১১-এর চন্দ্র মডিউল থেকে বেরিয়ে আসার আগে, অলড্রিন একটি ছোট প্লাস্টিকের পাত্রে ওয়াইন এবং কিছু পাউরুটি আনেন। তিনি হিউস্টনের কাছে ওয়েবস্টার প্রেসবিটারিয়ান চার্চ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে এসেছিলেন। তারপর তা নিয়ে সোজা চাঁদে। সেই চার্চে তিনি একজন বিশিষ্ট বা এলডার ছিলেন। অলড্রিন প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের সাধারণ পরিষদ থেকে এই কমিউন  করার অনুমতি আগেই পেয়েছিলেন। তার বই ম্যাগনিফিসেন্ট ডেসোলেশনে তিনি সেই বার্তাটি শেয়ার করেছেন যেটি তিনি নাসাকে রেডিও করেছিলেন:  “I would like to request a few moments of silence … and to invite each person listening in, wherever and whomever they may be, to pause for a moment and contemplate the events of the past few hours, and to give thanks in his or her own way.” 

এরপর তিনি চাঁদে উপাদানগুলি খেয়েছিলেন এবং পান করেছিলেন। পরে এই গোটা অনুষ্ঠানটি ১৯৭০ সালের গাইডপোস্ট ম্যাগাজিনের একটি অনুলিপিতে অলড্রিনের একটি নিবন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে: “আমাদের চার্চ আমাকে যে পাত্র দিয়েছিল তাতে আমি ওয়াইন ঢেলে দিয়েছিলাম। চাঁদের এক-ষষ্ঠ মাধ্যাকর্ষণে ওয়াইন ধীরে ধীরে কুঁচকে যায় এবং সুন্দরভাবে পাশের দিকে উঠে যায় কাপের। এটা ভাবতে আকর্ষণীয় ছিল যে চাঁদে যে প্রথম তরলটি ঢেলে দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে খাওয়া প্রথম খাবারটি ছিল যোগাযোগের উপাদান।” অর্থাৎ হার্জের ‘চাঁদে টিনটিন’ কমিকসে যেমন দেখেছি ক্যাপ্টেন হ্যাডক মহাকাশে মদ্যপান করছেন- অনেকটা সেইটাই করেন অলড্রিন, একদম চাঁদের মাটিতে বসে। তিনি এরপর  গসপেল অফ জনের একটি অংশও পড়েছিলেন। এই পুরো সময়টা নীল আর্মস্ট্রং যিনি  একজন দেবতাতে বিশ্বাস করেন বা deist  সম্মানের সাথে পাশে উপস্থিত ছিলেন। পুরো বিষয়টি গোপন ছিলো এবং অনেক পরেই প্রকাশিত হয়েছিল। অলড্রিন মূলত রেডিওর মাধ্যমে বিশ্বের সাথে ঘটনাটি প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে নাসার আগুনখেকো নাস্তিক ম্যাডালিন মারে ও’হেয়ারের দায়ের করা একটি মামলা করেন, যার ফলে অনুষ্ঠানটি কখনও সম্প্রচার করা হয়নি। ম্যাডেলিন আমেরিকান নাস্তিকদের  সংগঠন American Atheist-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং স্ব-শিরোনাম “আমেরিকাতে সবচেয়ে ঘৃণ্য মহিলা” ছিলেন। সেই সময়ে নাসা-সহ বহু সংস্থার বিরুদ্ধে ধর্মাচরণ বিষয়ক মামলা করেছিলেন। সফলভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  পাবলিক স্কুলে বাধ্যতামূলক স্কুল প্রার্থনা এবং বাইবেল পাঠ নিয়ে মামলা করে জিতেছিলেন। অলড্রিন অবশ্য শেষ ব্যক্তি নন, অ্যাপোলো ৮-র মহাকাশচারীরা চাঁদের কক্ষপথে জেনেসিস থেকে সৃষ্টির বিবরণ পড়ার পরে, ও’হেয়ার ডিউটির সময় নাসার মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে, মহাকাশে বা “চাঁদের চারপাশে” ধর্ম অনুশীলন করার উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে এটি গির্জা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সাংবিধানিক বিচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে। নিজের বই  ‘ম্যাগনিফিসেন্ট ডেসোলেশন’এ, অলড্রিন ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে মহাকাশচারী ডেজ স্লেটন, যিনি অ্যাপোলো-১১ ফ্লাইট ক্রু অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন, তাকে তার চন্দ্রের বিবৃতিতে সুর দিতে বলেছিলেন। “এগিয়ে যান এবং যোগাযোগ করুন, তবে আপনার মন্তব্যগুলি আরও সাধারণ রাখুন,” তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন।  পরবর্তীকালে অলড্রিন লিখেছেন যে চন্দ্রাভিযান সফলতার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোতাঁর উদ্দেশ্য ছিল। তবুও, পরে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি আরও অন্তর্ভুক্ত হতে পারতেন: “সম্ভবত, যদি আমাকে এটি আবার করতে হয়, আমি কমিউনিয়ন উদযাপন করতে পছন্দ করব না। যদিও এটি আমার জন্য একটি গভীর অর্থপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিল, এটি ছিল একটি খ্রিস্টান ধর্মানুষ্ঠান, এবং আমরা সমস্ত মানবজাতির নামে চাঁদে এসেছি – তারা খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলিম, অ্যানিমিস্ট, অজ্ঞেয়বাদী বা নাস্তিক হোক।” নাসার বিরুদ্ধে ও’হেয়ারের মামলাটি শেষ পর্যন্ত তামাদি হয়ে গেলেও, কিন্তু এটি নাটকীয়ভাবে অ্যাপোলো-১১ অবতরণের সুর পরিবর্তন করে। অলড্রিন মূলত চাঁদে আরও অনেক অগ্রগামী ক্রিস্টোফার কলম্বাস-শৈলীর অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য করেছিলেন। সেটা কখনই হওয়ার কথা ছিল না।

কিন্তু ওয়েবস্টার প্রেসবিটেরিয়ান চার্চে – অনেক নভোচারীর আধ্যাত্মিক আবাস – অলড্রিনের কমিউনিয়ন সার্ভিস এখনও প্রতি জুলাই পালিত হয়, যা লুনার কমিউনিয়ন সানডে নামে পরিচিত। সেখানকার যাজক হেলেন ডিলিওন পরে  বলেছিলেন যে তারা কীভাবে চাঁদে অলড্রিনের টেপটি পুনরায় চালান, যা তিনি পৃথিবীতে তার ফেরার যাত্রায় উদ্ধৃত করেছিলেন “…what is man that thou art mindful of him”। গির্জাটি এখনও সেই পাত্রটি সংরক্ষিত রেখেছে যা অলড্রিন তার সাথে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ওয়েবস্টার প্রেসবিটারিয়ান চার্চের একজন ভূতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবিদ জুডি অলটন একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন। যুক্তি দিয়েছিলেন যে যোগাযোগ ভবিষ্যতের মানব মহাকাশ ভ্রমণের একটি অপরিহার্য অংশ হতে পারে। তিনি দাবি করেন যে অলড্রিনের যোগাযোগের মতো আচারগুলি ” মানবতার বন্ধন শক্তিশালী করে”।

এসব তো গেলো একটি দিক- প্রশ্ন এখানে থেকেই যায় যে এই রকম ধর্মাচরণ কতটা যুক্তিযুক্ত। শুধু তাই নয় এসব বিরোধিতাও কত টা মানা যায়? সমাজে যা চলে তা কি সবসময় ঠিক? সমাজস্বীকৃত প্রথা মানেই যে ভালো হতে হবে তার কোনো মানে নেই। সেই অনুযায়ীতো বিধবা বিবাহ বা সতীদাহ প্রথা ঠিক। বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে ৯০% মানুষ ভোট দিয়েছিলেন।আবার একই সাথে নবজাগরণ বা রেনেসাঁস মাত্রেই যে সমস্ত অচলায়তনকে ভেঙে ফেলতে হবে এমন কোনো দিব্যি দেওয়া আছে কি? যে আচার বা রীতি আশা জাগায়, ইতিবাচকতার দিকে ইঙ্গিত করে তাকে ফেলে দিই করে? রোজ সকালে তুলসি মঞ্চে জল আর সন্ধেতে শাঁখ বাজানো তো মহাঔষধীকে স্বরণ করা। আর নবান্ন তো শষ্যকে ঘরে তোলা- এসব কোনো কর্মের শুভারম্ভ মাত্র। সেই ভাবে দেখলে তো অলড্রিনের কমিউন বা ইসরো বিজ্ঞানীদের গণেশ বন্দনা একই বিষয়। তাই বলে কি ধর্মের দোহাই দিয়ে সতীদাহ বা মেয়েরা গান গাইলে নলি কেটে দেওয়া কখনই সমর্থন যোগ্য নয়। রাজ্যের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যিনি স্বঘোষীত নাস্তিক তিনি তো ১৯৭২ সালে প্রচারে বেরিয়ে বলেছিলেন – সুযোগ পেলে গৃহস্থ বাড়ীতে লক্ষীপুজো বন্ধ করে দেবো। এটা যেমন খারাপ তেমনই খারাপ নবরাত্রির দোহাই দিয়ে বাঙালির পাত থেকে মাছ কেড়ে নেওয়া। আসলে বিষয়টা যে যেমন খুশি সাজায়। তাই হিন্দু ধর্মতে নতুন ডালপালা গজিয়ে হিন্দুত্ব হয় আর লজ্জাগৌড়ী বা কামসুত্রের দেশে আজ যে কোনোরকম নুন্যতম যৌনতাকেও অপসংস্কৃতি আখ্যা দেয় এক শ্রেনী। এত কিছুর পর কি করে বলি পুজো দিয়ে কোনোভাবে বিজ্ঞানকে কলঙ্কিত করেছে ইসরো। লড়াইটা অবিশ্বাসকে কতটা প্রশ্রয় দেওয়া যায় সেটার। ভণ্ডামির প্রতিযোগিতা যদি হয় তাহলে সেটারও। আসলে দেখা যাবে যারা ইসরো বিজ্ঞানীদের নিয়ে হাসাহাসি করছেন তাদেরও ঘরের কোনায় কোনও না কোনও  আরাধনা হতেই থাকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  তো সেই কবে বলেছেন…

এরা সবাই তো বিশ্বাসীর দল

সবাই বিশ্বাসী, বিশ্বাসী, বিশ্বাসী…

এক একবার ভাঙা গলায় বলতে ইচ্ছে করে

অবিশ্বাসীর দল জাগো

দুনিয়ার সর্বহারা অবিশ্বাসীরা এক হও!

Facebook Comments