মৌমিতা তালুকদার
ছোটবেলার পুজোর কথা উঠলেই প্রথমেই মনে পড়ে যায় মহালয়ার দিনটার কথা। চিরকালের নিশাচরী আমি সূর্যের সঙ্গে ঐ একটি মাত্র ভোরেই দেখা করতাম। ভোরবেলায় রেডিওতে “মহালয়া” শোনার জন্য (যতই গালভরা নাম মহিষাসুরমর্দিনী হোক না কেন প্রচলিত অর্থে মহালয়াই বলা হতো) ঐ একটা দিন ভোর ৩:৪৫ মিনিটে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। যদিও ততক্ষণে মাতৃদেবীর ঘর পরিষ্কার করা হয়ে গেছে এবং ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে ধূপ-দীপ জ্বলে উঠেছে। আকাশবাণীতে তিনবার শঙ্খধ্বনি হতেই বাবা মা আমি আর ভাই একেবারে প্রস্তর খন্ডে পরিণত মানে মন দিয়ে মহালয়া শোনা হচ্ছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমোঘ কন্ঠস্বর “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল” শুধু নয়, মনোবীণার তন্ত্রীতে ঝঙ্কার দিত দুটি শব্দ “দেবীপক্ষের সূচনা”!! তাঁর গম্ভীর কন্ঠে চন্ডীপাঠ শুরু হতেই মায়ের চোখ ছলছল। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় রেডিও বন্ধ হতেই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়তাম মায়ের সঙ্গে আর পাড়ার প্যান্ডেলের কাজ কতদূর হয়েছে মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করতাম দুজনে। ঐ একটা দিন ভোরের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে তুলতে মহালয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারপর?অপেক্ষা। অপেক্ষা মহাপঞ্চমীর। পুজোয় যেসব রঙিন পোশাক পরিধান করা হবে তার মধ্যে থেকে একটি বেছে নিয়ে সেদিন অঙ্গে ধারণ করে স্কুলে যেতাম। ঐ দিনটায় আক্ষরিক অর্থেই স্কুলে যেন ফুলের জলসা, প্রজাপতির মেলা বসে যেত। সবার চোখে মুখে পূজাবকাশের আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। আবার কিছুটা মন খারাপ ঘিরে ধরত। দীর্ঘ একটি মাসের অদর্শন বন্ধুদের সঙ্গে!
মহাপঞ্চমীর দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রথমেই দেখে নিতাম হরিহরপুর ইউনাইটেড ক্লাবের মাতৃ প্রতিমা। তারপর একটু ঘুর পথে এসে শান্তি চ্যাটার্জীর পাড়ার পুজো। ওদের বিশেষত্ব ছিল দেবী দুর্গার ডান দিকে কার্তিক ও সরস্বতী এবং বাঁদিকে থাকে লক্ষ্মী ও গণেশ। মানে উল্টো ভাবে মূর্তি পূজা হয়। পাড়ায় প্রবেশ করে প্রথমেই চোখ চলে যেত নবপল্লী বয়েজ স্কুলের মাঠের কিশোর সঙ্ঘ পরিচালিত পুজো প্যান্ডেলে। হ্যাঁ ওটাই আমার পাড়া। আড়ে বহরে বা ভারে কোনদিক থেকেই সুনাম অর্জন করে নি এই পুজো কখনও, তবুও আমার ছোটবেলা জুড়ে রয়েছে এই পুজোর স্মৃতি। সপরিবারে মা দুর্গা এসে পড়েছে কিন্তু শাড়ি, ধুতি আর বাহন ছাড়া কারুর মুখ দেখা যাচ্ছে না! কাগজ দিয়ে মুখগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। ষষ্ঠীর সন্ধ্যার আগে সেসব দেখার কোনো সুযোগ নেই। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় সাজগোজ করে পুজো প্যান্ডেলে উপস্থিত হয়ে মেয়েদের পুরো দলের অঘোষিত নেত্রী প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ত চেয়ার দখলের লড়াইয়ে। প্যান্ডেলের পেছনে তখন জোর কদমে চলছে বেলগাছ তলায় ষষ্ঠী পুজো। আর মায়ের সামনে চলছে ছেলেদের দল আর মেয়েদের দলের আলাদা আলাদা করে আড্ডা। চলছে গানের লড়াই। চলছে কুইজ প্রতিযোগিতা। আর চলছে সূক্ষ্ম এক প্রতিযোগিতা। ছেলেদের মধ্যে থেকে কেউ যদি একবার কোনো কারণে উঠে যেত তাহলে আর রক্ষা নেই। মেয়েদের নেত্রীর ইশারায় বয়সে ছোট মেয়েরা টুক করে গিয়ে সেই চেয়ার নিয়ে এসে বসে পড়ত। নেত্রী যে কে ছিল আশা করি বলে দিতে হবে না! তবে আফসোস একটাই। পুজোয় প্রেমটা কোনদিন হলো না। ছোটরা দিদি বলতে অজ্ঞান আর সমবয়সীরা নেত্রীটিকে ভয়ই পেত।
ষষ্ঠীর সন্ধেটা পাড়ায় কাটিয়ে রাত নটায় বাবা মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম বারাসাতের পূজা পরিক্রমায়। বাবা দুটি ভাগে ভাগ করে নিত বারাসাতের ঠাকুরগুলোকে। এক ভাগ দেখা হবে ষষ্ঠীতে আরেক ভাগ দেখা হবে সপ্তমীতে। কল্যাণকৃৎ সঙ্ঘ, বিবেক সঙ্ঘ, যুবক সঙ্ঘ, শেঠপুকুর, বারাসাত সার্বজনীন, চারের পল্লী, আটের পল্লী প্রভৃতি দর্শন করতাম সবাই মিলে পায়ে হেঁটে। অলি গলি, গলির মধ্যে গলি, তস্য গলি দিয়ে বাবা নিয়ে যেত। আর মজা হতো বাবার নির্দেশ মতো কতগুলো ঠাকুর দেখলাম সেটা গুণে রাখতে হতো। কিন্তু এই পরীক্ষায় আমি বরাবরই ডাহা ফেল আর ভাই পাশ। চার/পাঁচটা ঠাকুর গোণার পর হাঁ করে প্রতিমার সৌন্দর্য দর্শন করতে গিয়ে ভুল করতাম সংখ্যা গুণতে। সপ্তমীর সন্ধ্যাতেও এক ব্যাপার। তবে একটা লোভনীয় ব্যাপার ছিল বাড়ি ফেরার পথে করুনাময়ীর মোগলাই। ঐটি ছাড়া পুজো অসম্পূর্ণ!!
অষ্টমীর সকালে সবাই যখন অঞ্জলী দেওয়ার জন্য তোড়জোড় করছে আমরা সপরিবারে তোড়জোড় করছি বিরাটি যাওয়ার। আমার মাসির বাড়ি। অঞ্জলী শেষ হলেই কচুরি তরকারি খেয়ে সোজা ট্রেনে চেপে বিরাটি। সারা সন্ধ্যায় বিরাটির ঠাকুর দেখা হত সবাই মিলে। তবে হ্যাঁ বিরাটির ঠাকুর যে বারাসাতের ঠাকুরের কাছে কিছুই নয় সেটা নিয়ে বেশ গর্ব ছিল। নবমীর সকালে মাসিরা আর আমরা মিলে চলে আসতাম মধ্যমগ্রামে। মামার বাড়িতে। দাদু দিদা রয়েছে, মামা মামিরা রয়েছে। দুপুরে হুটোপুটি করে বিকেল হলেই মেজো মাসির কাছে বসতে হত সাজগোজ করার জন্য। মাসি খুব সুন্দর করে আমাকে আর মাসতুতো বোনকে সাজিয়ে দিত। নবমীর সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখার পর্ব শেষ হলেই প্রায় রাত নটায় দেবদাস পল্লীর পুজোর প্রধান আকর্ষণ ধুনুচি নৃত্য দেখার জন্য প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে পড়তাম সকলে। দশমীর দুপুরে মাংস ভাত খাওয়ার পর মা মাসিদের হুকুমে আমি আর বোন ছুটতাম ওখানকার প্যান্ডেলে মাতৃ প্রতিমা বরণের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। পুরো নাহা বাড়ি থেকে সাতজন মহিলা আসবেন। আমরা দুই বোন তাদের প্রতিভূ। যথাসময়ে হাতে বরণের থালা নিয়ে তাদের আগমন ঘটলেও আমাদের ছুটি নেই। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো থালা ধরে। তাদের সাহায্য করতে হত বরণের সময়। এবং বরণ শেষে সব ঠাকুরকে প্রণাম করতে হত আমাদের। এইখানেই ছিল গন্ডগোল! বোন সবাইকেই ভক্তিভরে প্রণাম করলেও আমি কায়দা করে অসুর মশাইকে বাদ দিয়ে দিতাম। “হু হু বাবা তুমি তো মোটেই ভালো মানুষ না! ক্যালানি দিতে এসে ক্যালানি খেয়েছ! বেশ হয়েছে! তোমাকে আবার প্রণাম কিসের!” প্রতি বছর অসুরবাবাজী প্রণামের তালিকা থেকে বাদ পড়তেন। রাতে বিসর্জন দেখতে যাওয়া ছিল বেশ উন্মাদনার। এইখানে একটু আবেগ প্রবণ হয়ে পড়তাম। জলে প্রতিমা ডুবে গেলেই মন খারাপ হয়ে যেত। মনে মনে বলতাম, “আবার এসো মা!” ফিরে এসে বাড়িতে গুরুজনদের প্রণাম করে মিষ্টি মুখের চল ছিল। পরের দিন আবার বারাসাতে ফিরে আসতাম। মা লক্ষ্মীর আগমনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে যে!!
Facebook Comments