Site Overlay

স্মৃতি রোমন্থন

সুজয়া ধর

সকাল প্রায় ১০ টা। ৫মিনিট হল ঘুম ভেঙেছে, এখনও বিছানা ছাড়িনি। আমি বরাবরই একটু ঘুম থেকে দেরিতে উঠি। মোবাইলটা কানের কাছে বাজছে। রাই কল করছে।আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বললাম আধ ঘন্টা বাদে করছি।রাই আমার খুড়তুতো বোন, আমাদের পরিবারে‌ এই প্রজন্মের সবচেয়ে ছোট, ও মা’র সাথে আমাদের দেশের বাড়ি জিয়াগঞ্জে থাকে।একটু বেশি আদরের।চা নিয়ে বসেই রাইকে কল করলাম। অপর প্রান্তে কল নিতেই কথার ঝড় বয়ে গেল। বুঝলাম না কে বড় আর কে ছোট।ওর কথার সারমর্ম আজ বিশ্বকর্মা পুজো, জিয়াগঞ্জের বাড়িতে এবার পুজো হবে না।ছোট্টুর একটা বাইক আছে, মিষ্টিমা তাই বহু বছর ধরে বিশ্বকর্মা পুজো করে।এবার এক মাসের ব্যবধানে কয়েক মাস হল ছোট্টু‌ আর বড়পিসি গত হয়েছেন।ওর মন খুব খারাপ। সাধারণত মন খারাপ হলে ও আমাকে কল করে।ওকে কিছুটা কথায় ভুলিয়ে ফোনটা ছাড়লাম। মনোনিবেশ করলাম চায়ে। হাতের মোবাইল জানান দিল আজ সেপ্টেম্বরের ১৮ , বিশ্বকর্মা পুজো। আমি প্রায় ১০ বছর যাবত প্রবাসী, গ্ৰেটার নয়ডায় থাকি। দিল্লি, গ্ৰেটার নয়ডাতে বিশ্বকর্মা পূজো, ঘুড়ি উড়ানো কিছুই টের পাই না।

ভো-কা-ট্টা আআআআ!!

ছোট্ট তাতানের পুজো শুরু হয় বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকেই। তুতুল, তাতান আপন ভাই বোন। তোতন খুড়তুতো ভাই।যদিও তাতানের কাছে দাদা আর ছোড়দা দুইই নিজের। তাতানের দেশের বাড়ি জিয়াগঞ্জ। সামান্য পূজো পার্বন সবেতেই সে তার বাবা মা দাদার সাথে জিয়াগঞ্জ যায়। বিশ্বকর্মা পুজোতেও তার অন্যথা হয় না ।তুতুল যা বলে তোতন তাতান দাদার সেই নির্দেশ পালন করে। জিয়াগঞ্জের বাড়িতে বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন থেকেই শুরু হতো তাদের কর্মযগ্গি। ঘুড়ি কেনা, সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া, সেই মাঞ্জা দেওয়া সুতো শুকানো, আর সব শেষে লাটাই-এ রোল করা। তবে সবটাই করতো দাদারা, তাতানের তাতেই আনন্দ, সে ভাবত অনেক বড়ো হয়ে গেছে। দাদাদের দলে জায়গা করে নিয়েছে।এই মাঞ্জা দেওয়া হতো ভাত আর ভাতের মাড় দিয়ে। দুপুরবেলা মা, ঠাকুমা, পিসিরা ঘুমিয়ে পড়লে এই কাজটি করা হতো। তাতানের কাজ ছিল সময় মতো দাদা আর ছোড়দাকে খবর দেওয়া, বড়রা কেউ বাড়ির পিছনের উঠোনে আসছে কি না। পরদিন তাতান উঠে পড়তো কাঁসর ঘন্টা সহযোগে ভোকাট্টার আওয়াজে।জিয়াগঞ্জে তাতানদের পাকা বাড়ি আর পাশাপাশি গোপাল, লক্ষী ওদের বেড়া। টালি দিয়ে ঘেরা বাড়িগুলোতে ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিল না। বেড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে বাইরের আকাশে ঘুড়ির আনাগোনা শুরু হয়েছে দেখতে পেলেই সবাই তাতানদের ছাদে যে যার ঘুড়ি নিয়ে একজোট হয়ে যেত।খাবার সময় টুকুকেও বড়ো দীর্ঘ লাগতো সবার। সে এক অদ্ভুত সময় ছিল,ছাদে ছাদে ভোকাট্টার আওয়াজ।একবার আমাদের এক খেলার সাথী বাপ্পাই দা কাঁচ দিয়ে মাঞ্জা করেছিলো। সেই মাঞ্জা সুতোয় পাশের বাড়ির ছাদের তিলক শেখর দাদের ঘুড়ি কেটে এতটাই অবাক হয়ে গেছিলাম যে নিজেদের ঘুড়ি কখন গোত্তা মেরে নারকেল গেছে আটকে গেছিলো খেয়াল করিনি। গোয়াল পাড়ার অমিত, মিতা , সুমি, সবাই মাঝে মাঝে চলে আসতো ঘুড়ির টানে।তারপর আসতে আসতে ভোকাট্টা সব। পরদিন সকাল বেলা তুতুল আর তাতান মা বাবার সাথেই মালদায় বাবার কর্মস্থলে ফিরে যেত। প্রতিবারের মতই এই ফেরার সময় তাতানের কান্না থামতো না। দাদা খুব বোঝাতো আর তো একটা মাস বোন, আমরা আবার আসবো মহালয়ার পর , ষষ্ঠীর দিন। তাতানের অপেক্ষা সেই দিন থেকে আবার শুরু হতো , কবে আবার ছোড়দা, বাপ্পাইদা, গোপাল, লক্ষী, সবার সাথে দেখা হবে।

হঠাৎ করেই সুরিতের গলার আওয়াজ, ওর ঘর থেকে সজোরে বলে আর এক কাপ চা দেবে। আমার সম্বিত ফিরে আসে, বলি দিচ্ছি। বাইরে এসে সুরিত বলে কখন থেকে চা চাইছি।আমি সুরিতকে চা আর সঙ্গে বাটার পাউরুটি দিয়ে এলাম। এই করতে করতেই ঘরের টুকিটাকি কাজ করছি। রিঙ্কি এসে ঝাড়ু মোছা, বাসন মেজে গেল। ও যেতেই রান্নার দিদি ঢুকলো। ওকে সব বুঝিয়ে কি কি রান্না হবে বলে এক কাপ দুধ আর ডিম সেদ্ধ নিয়ে বসলাম ডাইনিং টেবিলে।বাজে প্রায় সাড়ে বারোটা।সবই করছি, কিন্তু থেকে থেকে আজ বারবার তাতানের কথাই মনে পড়ছে।

ছোট্ট তাতানের মালদায় ফিরে এসেই পরদিন সকাল থেকেই স্কুলে যাওয়ার তোড়জোড়। একদিন স্কুল কামাই হয়েছে। বিশ্বকর্মা পূজোর পরদিন স্কুল খুলে যেত। তাতান মালদায় বার্লো স্কুলে পড়তো। সকাল বেলাই লিম্পা আর তাতান কৃষ্ণ কাকুর রিক্সা করে স্কুলে যেত। লিম্পা তাতানের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। সরকারি আবাসনে পাশাপাশি থাকে, আফসার কাকুর মেয়ে। সব কথা সে লিম্পাকে বলে, জিয়াগঞ্জের গল্পও করে। আবার এক মাস পরেই তো যাবে জিয়াগঞ্জে। আর বিশ্বকর্মা পূজো থেকে ফেরার সময় প্রতিবার তাতানের ঠাকুমা ওদের কাছে আসতেন।তাতান বেশ ছোট থেকেই ঠাকুমার কাছে পৌরাণিক গল্প শুনতে ভালবাসে। ছোট্ট তাতানের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার তার ঠাকুমা।এই করেই দেখতে দেখতে একমাস কেটে মহালয়া এসে যেত।স্কুলে যাওয়ার জন্য সকালে ওঠাটা তাতানের কাছে জলভাত। ছুটির দিনেও তার অন্যথা হয় না। এই একমাস কয়েক দিন তাতান আর লিম্পার কাজই ছিল প্রতিদিন স্কুল যাবার আগে ঠাকুমার জন্য শিউলি ফুল তুলে আনা।লিম্পার ঠাকুমা ছিল না।ও তাতানের ঠাকুমাকেই নিজের মনে করতো। মহালয়ার দিন ও সক্কাল সক্কাল দুজনে প্রতিযোগিতা করে অনেক ফুল তুলতো ঠাকুমার জন্য। লিম্পা প্রতিবারই মহালয়ার দিন ঠাকুমার কাছে মহালয়ার গল্প শোনার বায়না জুড়তো, আর অগত্যা ঠাকুমা তাঁর দুই নাতনি কে নাটক করে চোখ বিস্ফারিত করে প্রতিবছর একই মহিষাসুরমর্দিনীর গল্প শোনাতেন।

মহালয়া শেষ হলেই তাতানের আর তর সইতো না, কবে ষষ্ঠী আসবে। তাতানের স্কুলের পাশ দিয়েই মহানন্দা নদী বয়ে গেছে। টিফিনের সময় প্রায়ই সে নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকে, নৌকা দেখতে তাতানের খুব ভালো লাগে।রোজ সে ভাবে ষষ্ঠীর দিন এলেই নৌকা চড়ে জিয়াগঞ্জে যাবে।ভোর বেলা ট্রেনে চেপে আজিমগঞ্জে নেমে পাল তোলা নৌকা চেপে কখনো বাবা মা, আবার কখনো দাদার হাত ধরে জিয়াগঞ্জের বাড়িতে যাওয়া,দু বছর বয়স থেকে এটাই তাতান জানে। মাকে সে খুব বিরক্ত করে, এখান  থেকেই নৌকায় চেপে জিয়াগঞ্জে চলে যাবে।তার ছোট মাথায় কিছুতেই ঢোকে না মহানন্দা আর গঙ্গা আলাদা নদী। ছোট্ট তাতান ষষ্ঠীর ভোর হতেই দাদার হাত ধরে নতুন জামা পড়ে আবাসনের প্যান্ডেলে দূর্গা ঠাকুরের শেষ প্রস্তুতি দেখতে যেত।এর মধ্যেই মায়ের ডাক, তুতুল বোনকে নিয়ে ঘরে আয়, আমরা বেরবো তো। এরপর চারদিন বাড়ি ভর্তি লোক,কেউ শাসন করতো না যা ইচ্ছে তাই সে করতো।সব থেকে বেশি আনন্দ দাদা আর ছোড়দার সাথে বন্দুকের ক্যাপ ফাটানো আর দিনে অন্তত দশ বার পাড়ার শিব মন্দিরে এক ছুটে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। মা দূর্গার বিসর্জনের পর এই মজাটা দ্বিগুণ হতো,নাড়ু নিমকি গজার লোভে পাড়ায় সব বাড়িতেই বিজয়া করা। বিজয়া শেষ হলেই ছোট্ট তাতান বুঝতো তাকেও সবাইকে ছেড়ে আবার ফিরে যেতে হবে মালদায়। তাতানের মনে একটাই প্রশ্ন পুজোটা কেন সারা বছর ধরে হয়না?

আমার মনে আজও ভাবায় বছরে‌ দু চারবার পূজোটা হয়না কেন? বাবা বহুদিন হলো দূর্গা নবমীতে মারা গেছেন। আমি  মা , দাদা, ছোড়দা, ভাই সবাইকে ছেড়ে গ্ৰেটার নয়ডার টেবিলে বসে অলস দুপুরে আনমনা হয়ে ভাবছি বহুবছর পাল তোলা নৌকায় চেপে জিয়াগঞ্জের বাড়ি যাই না।এখন অবশ্য পাল তোলা নৌকাই চলে না। জিয়াগঞ্জের বাড়িতে এখন তাতান বলে ডাকার কেউ নেই, ঠাকুর বিসর্জনের মতো জ্যেঠু, ঠাকুমা,বাবা, মেজ, আন্টি, ছোট্টু, বড়পিসি সবাই একে একে চলে গেছে। মা দূর্গা বছর বছর তাতানের কাছে ফিরে আসত, কিন্তু আমার জীবনে এরা আর কোনদিন ফিরে আসবে না।ছোড়দা , বাপ্পাইদা কেউ আর জিয়াগঞ্জের বাড়িতে থাকে না, নতুন বাড়ি করে সব  বহরমপুর কলকাতা চলে গেছে। কেউ না গেলেও এবছর পূজোতে ছোট্ট তাতান বাবা, মা, দাদার হাত ধরে স্মৃতির পাল তোলা নৌকা চেপে জিয়াগঞ্জে যাবে।

কাছের মানুষদের আমি ধন্যবাদ দিই না, দেখা হলে রাইকে অনেক আদর করে দেব।রাই এর হাত ধরেই, আজ বহু বছর বাদে তাতান  আমার কাছে ফিরে এসেছে।

সবটুকু হয়তো মুছে যায়নি। মুছে যায় না। কোনদিনও মুছে যাবে না।

Facebook Comments