মানসী দে
সেদিন পোটলার সাথে রাস্তায় দেখা। আমাকে দেখেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো, আমি উপযাচক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, — কি হে ভায়া, আছো কেমন ? হন্ত দন্ত হয়ে যাচ্ছো কোথায় ?
পোটলা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো, — এই একটু এদিকে যাচ্ছি… আপনি কেমন আছেন ?
— চলে যাচ্ছে ভায়া… তা আজকাল করো কি ? মানে বলছিলাম কোনো কাজটাজ কিছু করো নাকি আগের মতোই…..
— আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পোটলা বললো, আমি এরিকসন কোম্পানিতে আছি…
— বলো কি হে ! সেতো কবেই লাটে উঠে গেছে !
— ওঃ তাই নাকি! তবে আমি অন্য কোম্পানিতে আছি….
— তা তোমার বৌ ফুলটুসি কি এখনো চাকরিটা করে ? কি যেনো একটা রিসেপশনিস্ট এর কাজ করতো না ?
— হ্যা করে বোধ হয়…
— সেকি ! বোধহয় মানে ? তুমি ঠিক জানো না ?
— কি করে জানবো বলুন ? ও তো আজকাল আমার সঙ্গে কথাবার্তাই বন্ধ করে দিয়েছে…
ফুলটুসি আমাদের পাড়ার মেয়ে। কতো বড় ঘরের মেয়ে, পড়াশোনায় ভালোই ছিলো, খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারতো। রবীন্দ্র সঙ্গীত যখন গাইতো মনে হোতো যেনো স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের সুর ভেসে আসছে। ওর বাবা ছিলো আমাদের পাড়ারই ডাক্তার।
পোটলাকে দেখে অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেলো। তখন আমি সদ্য কলেজ পাশ করেছি। আমার একটা পুরোনো সাইকেল ছিলো। সাইকেল চেপে টিউশন পড়াতে যেতাম । ফুলটুসি আমার ছাত্রী ছিলো। তখন ও ক্লাস টুয়েলভে পড়ে। ফেরার সময় দেখতাম ওদের বাড়ির সামনে পোটলা একটা ইয়ামাহা মোটর সাইকেল নিয়ে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছ। যখনই পড়াতে যেতাম তখনই দেখতাম।
একদিন পোটলাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, — ওহে পোটলা ভাই, তোমার কি আর কোনো কাজ নেই ? সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ পাও——-?
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2023/10/54153.jpg?resize=1024%2C773&ssl=1)
পোটলা আমার কথার কোনো উত্তর দেয়নি।
পোটলা আমাদের এলাকারই ছেলে, ওদের বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ।ওর বাবা হোম গার্ডে চাকরি করতো।
ফুলটুসি ওর অনেক স্বপ্নের কথা আমার সাথে শেয়ার করতো। বড় হয়ে ও একজন ভালো টিচার হতে চায়, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চায়, আরো অনেক কিছু ——-
একদিন সন্ধ্যার পর আমি কোচিং করিয়ে ফিরছিলাম। আমার একটা কোচিং সেন্টার ছিলো। সেখানে ব্যাচ করে পড়াতাম।
বড় রাস্তার শেষে একটা গলির মুখে যা দেখলাম তাতে আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। এ আমি কি দেখছি ? এ কি সত্যি নাকি মনের বিভ্রম ?
ফুলটুসি আর পোটলা কাছাকাছি ঘেঁষাঘেসি করে দাঁড়িয়ে গল্প করছে ! আমাকে দেখে ভুত দেখার মতো অবস্থা ফুলটুসির ! লজ্জায় ওড়নায় মুখ ঢেকে রাখলো। আমিও পাশ কাটিয়ে চলে এলাম, সারারাস্তা শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম যে এও সম্ভব ?
পরদিন ফুলটুসির বাড়ি থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হলো যে ফুলটুসি আর আমার কাছে পড়বে না… আমি এমনটাই আশা করছিলাম,এতে একপ্রকার আমার উপকারই হলো I
এর পর অনেকদিন কেটে গেছে…
সামনেই পুজো। আকাশে বাতাসে পুজোর গন্ধ I এই সময় আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেতাম অনেক অনেক দূরে, শিউলি ফুল কুড়ানোর জন্যI এমনই একদিন যাচ্ছি পথে পোটলার সাথে দেখাIআমি কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলাম,আমাকে দেখে পোটলা বীরের মতো এগিয়ে এসে হেসে বললো, — কি দাদা কেমন আছেন ?
— আমি বললাম, ভালো.. তারপর তোমার খবর কি ?
— বিন্দাস দাদা – ফুলটুসিকে বিয়ে করলাম গেলো মাসে
— তাই নাকি ? তা ওর বাড়ির লোক মেনে নিলো ?
— দূর.. তাই মেনে নেয় নাকি ?
— কেনো? মেনে নেবেনা কেনো ?
— ওঃ দাদা, আপনি কিছুই বোঝেন না Iএই আমি হলাম ক্লাস সেভেন ফেল।লোককে বলি নন গ্রাজুয়েট। ফুলটুসির মতো মেয়েদের ধাপ্পা দিয়ে কিভাবে খাপে আনতে হয় সে বিষয়ে আমার পিএইচডি করা আছে।
আমি খুব কৌতূহলী হয়ে বললাম, — কিরকম কিরকম !
একটু বুঝিয়ে বলো ভায়া,আমার তো মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে সব ।
— সেতো যাবারই কথা দাদা !
তাহলে শুনুন , বড়োলোকের সুন্দরী মেয়েরা সাধারণতঃ একটু সাদা সিধে বোকা ধরণের হয়.. ওদেরকে স্বপ্ন দেখাতে হবে ও স্বপ্ন বিক্রি করতে হবে I প্রথমেই আমি ধর্মতলায় গিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড প্যান্ট জামা কিনে ফেললাম, ফুটপাত থেকে সস্তা বড় ডায়ালের ঘড়ি আর কমদামি সানগ্লাসI বন্ধুর গ্যারেজ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানান ধরণের মোটর সাইকেল ধার নিয়ে আসতাম, যেগুলো লোকে সারাই করতে দিতো; বিনিময়ে গ্যারেজ এর কিছু কাজ করে দিতামI দু চারটে চালবাজি ইংরেজি কথা শিখে নিলাম, কথায় কথায় hi, hello, I love you, I miss you ইত্যাদি আরো অনেক কিছুI
— ওরে বাবা, তুমি তো ভাই মহাপুরুষ ! একটু পায়ের ধুলো দাও..
— হে হে দাদা, লজ্জা দেবেন না.. সবই উপরওয়ালার আশীর্বাদ !! তাছাড়া আমি তো আপনাকে কিছুই বলিনি, সবে তো শুরু——–পিকচার আভি বাকি হ্যায় !
— আরো আছে নাকি !!
— আছে আছে দাদা… আরো আছে… তারপর এই ধরুন ওকে বল্লাম যে ওর বাবা মা মানে আমার বাবা মা… ও হলো আমার জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা… ওর জন্য আমি জীবন দিতে পারি… তাছাড়া ওর পা টিপে দিতাম.. হাত টিপে দিতাম… কপালে সুড়সুড়ি দিয়ে দিতাম… আরো অনেক কিছু.. সেসব আমি আপনাকে বলতে পারবো না দাদা…
— এর জন্য তোমাকে অনেক খাটতে হয়েছে বলো ?
— নিশ্চয়ই… এসব শিল্প রপ্ত করা এতো সোজা নয়… এর আগেও আমি এগারো জনকে পটিয়ে জালে তুলেছি… এই কাজে আমার যথেষ্ট হাত যশ আছে দাদা…
— তা ভায়া, তোমার থেকে তো অনেক কিছুই শেখার আছে, তা তোমার চাকরির কথা কি বলেছো ?
— নির্জ্জস গুলগাপ্পা !! আমি কিভাবে চাকরি পাবো ? যেখানে আপনার মতো রাঘব বোয়ালরা সাঁতার কাটছে, সেখানে আমি ??
— তা ও এসব গুল বিশ্বাস করলো ?
— কেনো করবে না ? করালেই করবে… বিশ্বাস করাতে জানতে হবে… শুনুন, মেয়েদের কোনো বিষয়েই রাগ করবেন না, সবকিছুতেই হ্যা বলবেন .. ফুচকাতেও হ্যা, আবার তেলে ভাজাতেও হ্যা… ওদের ঘটে বাস্তব বুদ্ধি নেই.. থাকলে কি আর আমার মতো লুচ্চার পাত্তা পায় ?
— আমার তো ভিরমি খাবার অবস্থা ভায়া.. আর কতো দেখবো আর শুনবো ?
— আরো অনেক বাকি আছে দাদা.. অন্য একদিন বলবো.. পারলে একটা বইও লিখতে পারেন..
এরপর অনেক গুলো বছর কেটে গেছে… আমি এখন খুবই ব্যস্ত থাকি… কিন্তু পুরোনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে… এতদিন পর পোটলার সাথে দেখা হয়ে সেসব কথা মনে পড়ে গেলো…
তা ভায়া তোমাদের কোনো বাচ্ছা কাচ্ছা হয়েছে ?
— খেপেছেন দাদা! … শালা, নিজেদেরই খাওয়া হয়না.. তা আবার বাচ্চা!
— কেনো শ্বশুরবাড়ির কোনো সাহায্য ?
— শালা স্বশুরটা তো আমার টেনশনেই টেঁসে গেলো, শালাগুলো খুব সেয়ানা, কিছুই দেবেনা বলেছে I ফুলটুসিকে বলছে ফিরে যেতে, তবেই সব দেবেI
— তা ফুলটুসি কি ফিরে যাবে ?
— যাবে হয়ত ! শুনছি অফিসের HR ম্যানেজার ওর এখন লাভার!
আমি আর কথা বাড়ালাম না.. বেলা হয়ে আসলো অনেক.. আমি এবার বাড়ি ফিরবো। দত্তপুকুর থেকে বারাসাতI এনফিল্ড এ স্টার্ট দিলাম,লুকিং গ্লাসে পোটলার অনাহার ক্লিষ্ট মুখটা ভেসে উঠলো I
ধীরে ধীরে গতি নিলাম——–
পোটলার মুখটাও মিলিয়ে গেলো —–
Facebook Comments