Site Overlay

ব্যতির স্মৃতিচারণ

শ্রীতমা সেনগুপ্ত

“The real friendship is like fluorescence, it shines better when everything has darken.”
 Rabindranath Tagore

আজ বন্ধুত্ব নিয়ে যতই ভালো কথা বলি না কেন, আমরা কিন্তু সত্যিই বন্ধুত্বের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ।
নাহ্! কেউই আমরা আমাদের পরমপ্রিয় বন্ধু ব্যতিকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওর জীবনে পাশাপাশি পথ চলতে ব্যর্থ আমরা।

ব্যতিক্রম ঘটক (ব্যতি) আমাদের খুব প্রিয় ও কাছের বন্ধু। খুব ভালোমানুষ গোছের  সাধাসিধে একটা ছেলে, তার এভাবে স্মৃতিচারণ করে কিছু লিখতে বসা যেন একটা দুঃস্বপ্নের অতীত, চরম বেদনারও । তবুও পেন ,খাতা নিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে ভর্তি হলাম আর আমার কলমও চলতে থাকলো। আজ মনে হচ্ছে আর থামতে পারবো না পুরনো কথা পুরনো স্মৃতি উগরে দেওয়ার একটা নেশা যেন আমাকে পেয়ে বসেছে।

আজ  আমরা যতই আধুনিক হই না কেন , নিজেদের ক্ষত আর যন্ত্রণা, কষ্টের জায়গাগুলো লুকাতে কিন্তু আমরা  সেই ওল্ড স্কুল… পারিনা কিছু জায়গায়। আমরা হেরে যাই।

আমরা যারা এই জেনারেশনের বলা যায় 90’s এ যারা টিন-এজ অতিবাহিত করেছি তারা খুব লাকি ।একটা  technology-depended আর pre-technology-depended লাইফের সন্ধিক্ষণ নিয়ে কাটিয়েছি। তাই দুটো জগতকেই আত্মস্থ করে তার স্বাদ আস্বাদনও করেছি, সাথে তুলনাও করতে পেরেছি। ভার্চুয়াল আর রিয়েল দুটোই উপভোগ করলাম কিন্তু অনেক তো হলো ভার্চুয়াল জগত এবার একটু আমাদের রিয়েল ফ্রেন্ডশিপে ফিরে যাই। সেই ৯০ দশকে যখন ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে খুব সহজ-সরল বিশ্বাসযোগ্য বন্ধুত্ব তৈরি হতো। ব্যতির সাথেও ঠিক যেমন আমার হয়েছিল।

সালটা মনে হয় 1991, আমরা বাংলা ও ইংরেজি টিউশন পড়তে ভর্তি হলাম বারাসাত মহাত্মা গান্ধী স্কুলেরই প্রণম্য শিক্ষক শৈলেন বাবুর কাছে। আমার জীবনে প্রথম ব্যাচে পড়া শুরু ক্লাস সেভেন আমরা দুটো মাত্র স্টুডেন্ট আর স্যার। তাই বন্ধুত্ব তা যেন আরও গাঢ় হয়েছিল। নামের মধ্যেই ‘ব্যতিক্রমের’… ‘ব্যতিক্রমী সত্তা টা যেন লুকিয়ে ছিল। ওর এক্সট্রা অর্ডিনারি লেভেল এর ইংরেজিতে জ্ঞান, ওর বন্ধু হওয়ার  সুবাদে আমাকেও যেন সমৃদ্ধ করেছিল। শুধু নকল করতাম ব্যাতির হাতের লেখা আর ওর জ্ঞান আহরণের খিদেকে। অত বৌদ্ধিক জ্ঞান, মনন তখন আমার কিছুই ছিল না। আমি ভীষণ সাদামাটা সাধারণ একটা মেয়ে ছিলাম। বন্ধুত্বের ফাঁকে ফাঁকে খুনসুটির মাঝে মাঝে যেন সেগুলো আমি গ্রহণ করতে থাকলাম। অত উচ্চাঙ্গের চিন্তাভাবনা সত্যিই আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যেত।

ব্যতিক্রমের একটা বিশেষত্ব ছিল যেটার প্রতি আমি ভীষণভাবে আকৃষ্ট ছিলাম। বলতে পারি রীতিমত “ক্রেজি” ছিলাম – ওর সেই turquoise blue ink এ cursive writing এ লেখা…. চোখের সামনে যেন আজও জীবন তো সে লেখাগুলো। আর আমার “ক্রেজিনেস” হল সেটা পেতেই হবে। আমাকে নিয়ে গেল ব্যতি ওদের ফেভারিট সেই তপাদার দোকানে। Chelpark এর  turquoise blue কালি কিনে তারপর শান্তি।

আরো একটা স্পেশাল ব্যাপার ছিল ওর মধ্যে – যত বেশি মনোযোগ দিয়ে লিখতো তত বেশি করে ত্যারছা করো জিভটা বেরিয়ে যেত। এই নিয়ে কিন্তু আমরা কম মজা আর খুনসুটি করিনি…

তখন টিভিতে ছিল পাগল করা কিছু গানের অনুষ্ঠান। ছিল রঙ্গলি, চিত্রহার, সুপারহিট মোকাবিলা। বাড়িতে কঠোর অনুশাসন, স্পেসিফিকেলি টিভি চালানোর ব্যাপারে, থাকা সত্ত্বেও ৯০ দশকের সব গানই আমরা জানতাম। মুখস্ত , ঠোঁটস্থ ছিল আর ক্রিটিসাইজ করতাম । দারুন রঙিন ছিল আমাদের কৈশোর জীবন। সহজ সরল সাদামাটা কিন্তু ততোধিক আনন্দের ,ফুর্তির। ৫- ৫ টা বছর আমরা একসাথে এক ব্যাচে পড়তাম। ক্লাস নাইনে এসে আমাদের ব্যাচ আরো বড় হল আরো বন্ধু হলো।

যে যার নিজের মতো এগিয়ে গেলাম, নিজেদের পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের পথে ।তখন কদাচিৎ রাস্তায় দেখা হত, ব্যাস ওইটুকুই। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ছিল না তাই যোগাযোগও ক্ষীন হতে থাকলো ক্রমশ.. অনেক ক্ষতবিক্ষত পথ পেরিয়ে যে যার নিজের সাংসারিক জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে ডুবে যেতে থাকলাম। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেল। তারপর হঠাৎই সোশাল প্লাটফর্ম, (thanks to the social partform…) Facebook Whatsapp জয়েন করলাম আর যেন পুরনো বন্ধুদের মেলা ,যাদের মুখ অবধি ভুলে গেছিলাম, আবার তাদের সাথে দেখা ,কুশল বিনিময়, আবেগের আদান প্রদান ,তার মধ্যে ব্যতিক্রমও ছিল একজন।

কিন্তু এত বন্ধু থাকা সত্ত্বেও কিছু তো করতে পারলাম নারে ব্যতি তোর জন্য! আমাদের হাত-পা বাঁধা যেন। নিজেদের ব্যস্ত সাংসারিক জীবনে জাঁতাকলে জড়িয়ে থেকে পারলাম না আমরা তোর পাশে থাকতে।

ব্যতি মাঝে মাঝেই বলতো, “শ্রী, অনেক কথা আছে রে ,একদিন বলব সব। চল একদিন কফি খেয়ে আসি দুজনে”…… আমিও সময় করে উঠতে পারলাম না, আর তুইও বলতে পারলি কই??

আমি এখনো তোর কথা শোনার জন্যই অপেক্ষায় রইলাম রে….

 তবে এখন যে অবিনশ্বর জগতে আছিস সেখানে নিশ্চয়ই পরম শান্তিতে সব কষ্টের ঊর্ধ্বে আছিস বন্ধু। তাই থাক …ভালো থাকিস।।

Facebook Comments