Site Overlay

শুদ্ধশীলের বিশুদ্ধ প্রেম

যোজনগন্ধা

ষষ্ঠী।

‘ঐ সাদা শাড়ি পড়ার কোনো মানে হয়! কি এমন বয়স এখন যে ঐ বিধবা মার্কা শাড়ি পড়ে বেরতে হবে? পুজোর সময় লোকজন কত রকমের রঙিন কাপড়ে নিজেদের সাজিয়ে তোলে! অত যত্ন করে খুঁজে খুঁজে কিনে আনা কচিকলাপাতা রঙের শাড়িখানা ছিল তো! সেটা পড়া যেত না! সাদা একটা রঙ হলো! এ তো বৈধব‍্যের প্রতীক।” গজগজ করছে শুদ্ধশীল।

আয়নার সামনে বসে লাস্ট টাচ আপ দিতে দিতে আড় চোখে একবার শুদ্ধশীলের মুখখানা দেখে নিল শাকম্ভরী। নাহ! প্রফেসর হবার পর থেকেই বড্ড খুঁতখুঁতে আর খিটখিটে হয়ে গেছে শুদ্ধ। ছোট্ট একটা গলা খাঁকারি দিয়ে খুব মিষ্টি করে শাকম্ভরী বলে, “এখনকার ফ‍্যাশন হলো সাদা। সাবেকি বৈধব‍্যের সাজ এটা নয় রে উন্মাদ। সাদা শাড়ির সঙ্গে উজ্জ্বল ডিজাইনার ব্লাউজ, গাঢ় মেকআপ আর ঝলমলে মানানসই গয়না হলো আভিজাত্য, সাবেকিয়ানা আর আধুনিকতার মেলবন্ধন। তোর ঐ পদার্থবিজ্ঞান ভরা মাথায় আমার এসব অপদার্থ আইডিয়া ঢুকবে না শুদ্ধ।”

‘তোর সঙ্গে একসাথে চলা আমার পক্ষে জাস্ট ইম্পসিবল বুঝলি শাকপাতা? আজ থেকে আমাদের ব্রেক আপ।’ বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শুদ্ধশীল।

‘তাহলে আমাদের সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত আজকে শেষ হলো তো শুদ্ধ? মানে তুই ভেবে বলছিস তো কথাটা? না.. এর আগেও এই পাঁচ বছরের মধ্যে কয়েক ডজন বার তো এমন করে ব্রেক আপ করেছিলি আবার তিন দিন হতেই সব ভুলে যেতিস তাই জিগ‍্যেস করলাম আর কি!’ খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে শাকম্ভরী।

‘খুব ভেবে চিন্তেই বললাম। এটা ফাইনাল ব্রেক আপ। তোর সঙ্গে আমার মিল হবে না কোনদিনই। তুই যা। তোর ঐসব হনুমান, হনুমতী বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যা। আমি যাব না।’ রেগেমেগে ঘর থেকেই বেরিয়ে যায় শুদ্ধশীল। পারফিউম ছড়িয়ে ক্লাচটা হাতে নিয়ে আয়নায় শেষ একবার নিজেকে দেখে নিয়ে ঘর ছাড়ে শাকম্ভরীও।

সপ্তমী।

“কি ব‍্যাপার রে? সাত সকালে ফোন করছিস কেন? পুজোর ছুটিতে কোথায় একটু পড়ে পড়ে বেলা পর্যন্ত ঘুমাব তা না… এই তোকে ফোন করতে কে বলেছে? ব্রেক আপ করেও কেউ যে আবার এমন করে নিজের থেকে ফোন করে এটা তোকে না দেখলে জানতে পারতাম না শুদ্ধ। আচ্ছা তোর লজ্জা শরম বলে কিছু নেই?” ঘুম জড়ানো গলায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে শাকম্ভরী।

ওপাশ থেকে হড়বড় করে শুদ্ধশীলের জবাব আসে, “সারা সন্ধ্যায় ঘুরে এসেও রাতের দশটায় ঐ একটা দাঁড়কাকের সঙ্গে কি এতো হেসে হেসে কথা ছিল তোর?”

“এই.. এই.. শোন” উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসে শাকম্ভরী। “তুই যে শাঁকচুন্নীটাকে হাত ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প‍্যান্ডেলের কারুকার্য দেখাচ্ছিলি সেটা কে ছিল আমি কি জানতে চেয়েছি?”

থমথমে গলায় উত্তর আসে, “ঐভাবে কাউকে ভালো করে না জেনে শাঁকচুন্নী বলাটা ব‍্যাড ম‍্যানার্স ভরী। ওর নাম টিয়া। ওর একটা ভালো নাম আছে কিন্তু এখন মনে পড়ছে না। সম্পর্কে আমার বোন হয়। বেড়াতে এসেছে বলেই আমি ওকে..” ওপাশের তাড়নায় কথায় ছেদ পড়ে।

“ইসসস! বোন হয়! তা কিরকম বোন হয় শুনি? ঐ মায়ের বোনের পিসিশাশুড়ির ননদের ভাগ্নের মেয়ে টাইপ বোন? ইল্লি আর কি! তোর তিন কূলে কোনো বোন বলে পদার্থ নেই আমি জানি শুদ্ধ। আর শোন দাঁড়কাক কাকে বললি? তুই চিনিস না হিমানীশদাকে? আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের চূর্ণীর দাদাকে? আর এতো কথা আমি এখন তোর সঙ্গে বলছি কেন? আমাদের তো গতকাল ব্রেক আপ হয়ে গেছে না?”

ফোনেই শুদ্ধশীলের দীর্ঘঃশ্বাস ভেসে আসে। “ভেবেছিলাম ব্রেক আপ হলেও দুজনের মধ্যে একটু ডিগনিটি থাকুক। তোর যাতে ক্ষতি না হয়, কোনো ভুল যেন না করিস তাই উপযাচক হয়েই ফোন করে ফেললাম। তুই ফোনটা না ধরলেই তো পারতিস! এতো যখন ব্রেক আপ নিয়ে টনটনে জ্ঞান তখন ফোনটা আমি করেছি জেনেও ধরলি কেন শুনি?”

“বেশ করেছি ফোন ধরেছি।” অযথা গলায় জোর আনে শাকম্ভরী। “এই পাঁচ বছরে আপাদমস্তক আমাকে দেখে, আমাকে চিনে তোর একবিন্দুও চলে যাওয়ার কথা মনে হয় নি? যত মনে হওয়া সব কালকেই হলো? এই সুবুদ্ধিটা কে দিল? ঐ টিয়া না শকুন ঐটা? ফোন রাখ। পুজোর দিনে মাথা গরম করাস না।” ফোন কেটে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল শাকম্ভরী। 

অষ্টমী।

“সবেমাত্র লুচির থালা নিয়ে বসলাম! এতক্ষণ না খেয়ে থেকে অঞ্জলী দিয়ে এলাম। এখনই তোর ফোন করতে হলো? তুই কি ফোনেই খাবারের গন্ধ পাস নাকি হ‍্যাংলা?” শাকম্ভরীর কথা শেষ হতেই হো হো করে হাসির শব্দ ভেসে এলো। “আরে লুচির সঙ্গে আলুর দমের টেস্ট যা হয়েছে না! সুজির হালুয়াটাও কাকিমা জব্বর বানিয়েছে আজকে। খেয়ে দেখিস। আমি তো আসতাম না কিন্তু কাকিমাই ফোন করে জলখাবারের নেমন্তন্ন করল। তবুও বললাম তোর সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক শেষ, তো নিজেই বলল ‘খাবারের সঙ্গে কারুর কখনও বিচ্ছেদ হতে নেই’ তাই চলেই এলাম। ও হ‍্যাঁ, শোন, তোকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল। একেবারে মন্ডপের প্রতিমা আর তুই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিলি। মামনি যেমন তোকে চিবুক ধরে আদর করল আমারও খুব তোকে বুকে টেনে নিয়ে ঐভাবে চিবুক ধরে ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে…” “এই এই এই! থামবি তুই!” শুদ্ধশীলকে তাড়া দিয়ে ওঠে শাকম্ভরী। “ব্রেক আপ করেও এতো দুর্বল করে দিচ্ছিস কেন রে? মা যেই খেতে ডাকল চলে এলি! আমাকে লুকিয়ে খেয়েও নিলি? কি নোলা রে!! আর শোন তোকে যে বলেছিলাম অষ্টমীর সকালে পাঞ্জাবীটা পড়তে পড়লি না কেন রে? আমি এতো খুঁজে খুঁজে কষ্ট করে এতো সুন্দর জিনিসটা কিনলাম যে! তোর পড়তে ইচ্ছে করল না? নাকি ঐ কাক না শকুন কে যেন সে বারণ করেছে তোকে ঐ পাঞ্জাবীটা পড়তে?” আবারও হাসির শব্দ। সঙ্গে শুদ্ধশীলের ভরাট স্বর, “আমি একবার ব্রেক আপ বলেছি রে শাকপাতা কিন্তু তুই তো রোজ একবার করে শোনাচ্ছিস! এর মানে কি বল তো? যাক গে ছাড়। আমায় তুই ফলো করলি কেন বল? যখন সম্পর্কই নেই তখন এতো মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখার কি দরকার ছিল তোর? আচ্ছা শোন তোর ঐ বান্ধবী চূর্ণীর সঙ্গে আমার একটু আলাপ করিয়ে দিবি? তোর সঙ্গে তো আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই কাজেই ওর সঙ্গে কথা বললেও তোর আর আপত্তি নেই। বল?” রাগে গরগর করে ওঠে শাকম্ভরী, “ঐ বেড়ালমুখীটাকে খুব মনে ধরেছে? ইউ চিট!” হালকা হাসির সঙ্গে কথা ভেসে আসে, “আরে ভরী, চিটরাই আজকের বাজারে সুপার ডুপার হিট জানিস তো? আর ওভাবে চূর্ণীকে বেড়ালমুখী বলিস না, বল বিড়ালাক্ষী মানে ক‍্যাটস্ আই! কি গভীর চোখ দুটো দেখেছিস?” এবার ভীষণ তেড়ে উঠে শাকম্ভরী বলল, “তুই দূর হয়ে যা।” ফোন কেটে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। লুচিগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। বাইক স্টার্ট দিয়ে মনটা ভারী হয়ে যায় শুদ্ধশীলের। 

নবমী।

“এতো রাতে ফোন করার কোনো দরকার ছিল না শাকপাতা। আমি একদম ঠিক আছি। ঐ চোয়ালের একটা ঘুষির ব‍্যথা ছাড়া আর কিছু নেই রে। খাবার, মেডিসিন সব ঠিকমতো হয়ে গেছে। জাস্ট দু পেগ খেয়েছি বিশ্বাস কর। তোর জলভরা চোখ দুটো আর খেতে দিল না। আমার জন্য না ভেবে এবার ঘুমাতে যা প্লিজ। বেপাড়ার ছেলে এসে আমাদের পাড়ার মেয়েদের টিজ্ করবে এ তো চুপ করে মেনে নেওয়া যায় না বল? বীরত্বের পোকা মগজে নড়ে উঠলো বলেই…” ওপাশ থেকে থমথমে গলার স্বর, “বীরপুরুষ আমার! বয়ে গেছে তোর জন্য ভাবতে। একাদশীর সন্ধ্যায় বাবার ডাক্তার বন্ধু সপরিবারে আসবে আমাদের বাড়িতে। ওনার ছেলেও ডাক্তার। বাপি আর মায়ের ষড়যন্ত্র চলছে আমাকে ঐ ডাক্তারের গলায় ঝোলানোর জন্য। বুঝলি?” হালকা হাসির সঙ্গে শুদ্ধশীল বলে, “বাব্বা!! এতদিনে শান্তি পেলাম। তুই আমার ঘাড় থেকে নেমে চলে যাবি। আমি তোর দুঃখে কাতর হয়ে বেদবাস হয়ে ঘুরব। ভ‍্যাঁ ভ‍্যাঁ করে কাঁদব। বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে ড্রিংক করব। তোর বকবকানি থেকে রেহাই পাব আর…” কথা শেষ না হতেই “এই বাঁদর ছেলে তুই জাঁহান্নমে যা আমার কি” বলে ফোন কেটে দেয় শাকম্ভরী। 

দশমী।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় পা দুটো বড্ড ভারী লাগছে শাকম্ভরীর। মা চলে গেছে বরণ করতে। ওকেও যেতে বলে গেছে। যাবে না যাবে না করেও তৈরি হয়েছে। দুর্গা মায়ের মুখটা এবছরের মতো শেষ একবার দেখতে মন চাইল। শেষ ধাপে এসে চমকে দেখে শুদ্ধশীল দাঁড়িয়ে আছে দু চোখে দুষ্টুমি আর এক গাল হাসি নিয়ে। জিন্সের উপর পাঞ্জাবীটায় দারুণ লাগছে দেখতে। ভালো লাগার মাহাত্ম্যে একটু যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল শাকম্ভরী। ঘন হয়ে এসে শুদ্ধশীল বলল, “শাড়িটা একদিনও পড়লি না দেখে ভাবলাম তোর পছন্দ হয় নি, ফেরত নিয়ে যাই। কিন্তু এখন দেখছি শাড়ির সঙ্গে মালকিনকেও নিয়ে যেতে হবে। তা ভালো। আজকের দিনে শিব এসেছে পার্বতীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আর শুদ্ধশীল এসেছে তার বিশুদ্ধ প্রেমের অভিমান ভাঙাতে।” পাঞ্জাবীর বুকের কাছে খামচে ধরে শাকম্ভরী বলে, “কিন্তু আমি তো চাই আমার অসুরটাকে বধ করতে” আরও কিছু বলার চেষ্টা করে শাকম্ভরী বুঝতে পারে তার ঠোঁট দুখানি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছে আরেক জোড়া ঠোঁটের সঙ্গে। মন্ডপ থেকে ভেসে আসা ঢাকের বোলের বিজয়ার সুরে ধ্বনিত হচ্ছে আগামীর বোধন।।

(সমাপ্ত) 

Facebook Comments