Site Overlay

পটচিত্রকথা

হাসান শরিফ

আগেই বলে রাখি পটচিত্র বিষয়ে আমার কোন পাণ্ডিত্য নেই। শুধু পটচিত্র কেন, পৃথিবীর বেশিরভাগ বিষয়েই আমি বিশেষরূপে অজ্ঞ। তাই বরং গ্রামে ঘোরার গল্প করি। কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয় এই গ্রাম। সুজয়া আর আমি মাত্র তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়েই পৌঁছে গেলাম পিংলাতে। অবশ্য গ্রামটির নাম আসলে "নয়া"। গ্রামটির নামকরণের পিছনের গল্পটি একদিন জানতে হবে। 

মজার ব্যাপার হল এই গ্রামের সবাই ছবি আঁকেন। এবং আমার মত এলেবেলে আঁকেন না, বেশ ভালো আঁকেন - যাকে সত্যিই শিল্পকলা বলা যায়। 

গ্রামে প্রথমেই যার বাড়িতে হাজির হলাম তাঁর পোশাকি নাম স্বর্ণ চিত্রকর। 'পোশাকি' নাম এই কারণে বললাম যে তাঁর জন্মগত নাম অন্য (সেটি আর প্রকাশ করছিনা),  তবে পৃথিবীতে তাঁর পরিচয় স্বর্ণ চিত্রকর নামেই। তাঁর সাথে দুটি কথা বলেই আমার 'খালা আজ কি রেঁধেসো' গোছের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কারণ ভদ্রমহিলা একেবারেই মাটির মানুষ, বহুদিনের চেনা এমন মনে হচ্ছিল। আমার এখনও বিশ্বাস বংশলতিকা ধরে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে ঠিক বেরোবে উনি আমার কোন লতায়-পাতায় আত্মীয় হন।

তাঁর সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। পটচিত্র বস্তুটা কি উনি বোঝালেন। ব্যাপারটা জটিল কিছু নয়, আর্ট পেপারে ছবি আঁকা হয়। সেই কাগজের পিছনে একটা বাহারি রঙ্গিন কাপড় আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়। ব্যাস টেকনিকাল গল্প শেষ। পটের উপর ছবি আঁকা হল, সুতরাং পটচিত্র একে বলাই যেতে পারে। আমি এরকম আঁকলে সেটা অবশ্য পটচিত্র হবেনা, 'বাজে চিত্র' হবে। কারণ আসল ম্যাজিক তো ছবিটিতে। অবশ্য ছবির রঙের মধ্যেও বিশেষত্ব আছে। বাজারে পাওয়া রং পটচিত্রে এঁরা ব্যাবহার করেন না। নিজেরাই বানান। লক্ষণ ফলের বীজ ঘষে, তাতে বেলের আঠা  মিশিয়ে তৈরি হয় লাল রং। সিমের পাতা থেকে সবুজ, গাঁদা ফুল থেকে কমলা, অপরাজিতা থেকে নীল। ওখানে থাকলে আমার বউ লাফিয়ে উঠত, "সব অরগানিক রং!" অরগানিক জিনিষের প্রতি ওর একটা দুর্বলতা আছেই।
আমার নেই, কিন্তু রংগুলি ছবিটিতে যে অপূর্ব লাগে, এটা তো দিব্বি দেখতেই পাচ্ছি। আর ছবিতে ফর্ম ও সূক্ষ্মতার কাজ যে অনবদ্য সেটা বলতে আর্ট কলেজের ডিগ্রিরও প্রয়োজন পড়ছেনা।

তবে ছবি এঁকে কিন্তু গল্প শেষ হল না মোটেই। এরপর এঁরা এই ছবি নিয়ে গান বাঁধেন, অথবা উলটোটাই হয়ত সত্যি। আগে গান বাঁধেন, তার পর সেই অনুযায়ী ছবি আঁকেন। দু' লাইনের গান না। বেশ মহাকাব্যিক ভঙ্গিতে গান চলে অনেকক্ষণ ধরে। প্রায় দশ-বারোটা পটচিত্র আঁকা হয়, সেগুলো একটার নিচে আরেকটা জোড়া দেওয়া হয়। আর রাজা-মহারাজাদের দীর্ঘ চিঠির মত, একটি রোলে গোটাতে গোটাতে গানের কথার সাথে ছবি মিলিয়ে দেখাতে থাকেন এঁরা। অর্থাৎ, ছবিগুলি perform করেও দেখান।

আমাদের দেখানোর জন্য একটা বিরাট সুটকেস খাটের তলা থেকে বের করা হল। সেই সুটকেসের মধ্যে কি নেই! শ'দুয়েক পটচিত্র রোল করে রাখা আছে মনে হল। তার সাথে পেন্টিং করা কাঠের প্লেট, স্টিলের বাসনও বেরল। শুধু সুটকেস কেন, খাটের তলা, খাটের উপর, আলমারির ছাদে, আলমারির ভিতর, টেবিলের উপর, টেবিলের নিচে - ঘরময় এসবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ঘরদোর এদেরই দখলে। খালামা স্বামী, কন্যা, নাতনিদের নিয়ে টিকে আছেন কোন ভাবে!

স্বর্ণ চিত্রকর রাধাকৃষ্ণর প্রেমলীলার উপর একটি গান শোনালেন আমাদের। আমার তো ভীষণ ভালো লাগল। করোনা নিয়েও একটি গান বেঁধেছেন। খুব বিখ্যাত মাছের বিয়ের গান। অসংখ্য গান আছে। বেশিরভাগই খুব উপভোগ্য। তবে সবই আসাধারন হতে হবে কে বলেছে!

এই গ্রামে বংশানুক্রমে এই কাজই চলে আসছে সব কটি পরিবারে। দেশবিদেশ থেকে ডাক আসে তাঁদের। স্বর্ণ চিত্রকর তো গেছেনই, তার সাথে গ্রামের অন্য মানুষরাও ইউরোপ, আমেরিকায় দোভাষীর সাহায্য নিয়ে কর্মশালা করে এসেছেন, ছবি বিক্রি করে এসেছেন। খালামা বললেন যে কদিনের মধ্যেই প্রায় তিরিশজনের একটি দল যাবে উড়িষ্যাতে, সেখানে কোন একটি সরকারি মহলে দেয়াল পেন্টিং করার বরাত পেয়েছেন তাঁরা। 

কয়েকটি জিনিষ কিনবো বলে পছন্দ করে আমরা মনু চিত্রকরের বাড়ি গেলাম। ভদ্রলোককে দেখে আমার মনে হল ঠিক যেন প্রৌঢ় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আসতে আসতে কথা বলেন, মনে হল কথা বলতে খুব একটা পছন্দ করেন না। তার ঘরে ঢুকেও আমরা ছবি দেখলাম, এনার এক আলমারি ভরতি ছবি! কিছু কিছু ফ্রেম করিয়েও রেখেছেন। আমরাই একটু বিব্রত বোধ করছিলাম ছবি দেখতে চেয়ে। মনে হচ্ছিল, কিছুই তো নিতে পারবনা, এঁদের কষ্ট করানো কি ঠিক হচ্ছে! উনি বুঝতে পেরে বললেন, চিন্তা করবেন না, এটাই আমাদের কাজ। ছবি দেখানো। আপনাদের খারাপ লাগার কিছুই নেই।

দেখা হল বাহার চিত্রকরের সাথে। বিঁড়ি ফুঁকছেন আর ছবি আঁকছেন, মোটামুটি তিরিক্ষি মেজাজ। নাতি, নাতনিরা আর তাদের বন্ধুরা ধারে কাছে ঘুরঘুর করছে বটে, কিন্তু বুড়োর ভয়ে কাকপক্ষীর মতই ধারে কাছে ঘেঁষছে না। খুব মন দিয়ে ছবি আঁকছিলেন, কিন্তু আমাদের দেখেই বললেন - আসুন, দেখুন। আমাকে বিড়িও দিতে চাইলেন। শিল্পীর সাথে বসে বিড়ি ফোঁকার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি বটে, বিড়ি তো ছাড়িনি! কিন্তু শেষ অবধি সামলে নিলাম।

ভদ্রলোক অনেক গল্প করলেন, কলকাতার কোন এক আর্ট কলেজে ওনাকে প্রায়ই যেতে হয়। সেখানে তাঁকে খুব সম্মান করে সবাই কথা বলেন, গর্ব করে বললেন আমাদের। রোদ আর মেঘের আলোছায়াতে ওনার অপূর্ব কয়েকটি ছবি তুলল সুজয়া।

একটা চমকপ্রদ কথা এই যে এই পটুয়াদের সকলেই মুসলিম। হিন্দু দেবদেবীর ছবি, পৌরাণিক কাহিনী নির্দ্বিধায় শুনিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা, বসত করছেন তাঁদের সাথে, আত্তীকরণ করে নিয়েছেন সবই। এগুলি সবই যে খুব সহজে সকলে মেনে নিয়েছে তাও নয়। মুসলিমদের মধ্যেই কেউ কেউ এগুলি পছন্দ করেননা। এমনকি গ্রামের কবরস্থানও এক সময় ব্রাত্য ছিল পটুয়াদের জন্য। এখন অবশ্য অনেকটাই বদলেছে মানুষ। অন্য গ্রামের মানুষদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কও হচ্ছে। তবে পটচিত্রের ঐতিহ্য বজায় রাখতে এঁরা গ্রামের মধ্যেই বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, অন্য গ্রাম থেকে কেউ এলে শেখাতে চেষ্টা করেন তাদের।

এমনই একজন হলেন রুনা চিত্রকর (আসল নাম দিলাম না)। এই গ্রামে বিয়ে হয়েছে তাঁর। এত সুন্দর কথা বলেন! বলেই ফেললেন স্বামী মাঝে মাঝে তাঁর ছবি নিজের নামে চালান, কারণ স্বামীর চেয়ে ছবিটা তিনিই ভালো আঁকেন তো! স্বামী পুরষ্কারও পেয়েছেন ছবি এঁকে!

ফিরে আসার একটু আগে দেখা হল একটি ফটোগ্রাফার দলের সঙ্গে। ঝকঝকে তরুণ-তরুণীর দল। সবাই গম্ভীর মুখে ছবি তুলতে ব্যস্ত। একটু এদিকে তাকান, একটু আলোর দিকে নিয়ে আসুন, এসব চলছে। ছবি কেনাকেটা কেউ করবেন বলে মনে হল না। অথচ ওটুকুর আশাতেই এই গ্রামের মানুষেরা শিল্পসাধনা করছেন, সবাইকে আমন্ত্রণ করে আনছেন বাড়ীর মধ্যে। গল্প করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে এই দলের ছবি থেকে আরও মানুষ নিশ্চয়ই জানবেন এঁদের সম্পর্কে, আরও বিক্রিবাটা বাড়বে। এটাই বা কম কি!

করোনার জন্য মাঝে এদের বাবসাপাতি নষ্ট হয়েছে বেশ। দেশে মেলা, বিদেশে কর্মশালা,exhibition সবই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু বন্ধ এখনো হয়নি এঁদের পরিশ্রম আর অনাবিল হাসি। 

মোট কথা "নয়া"তে গিয়ে নয়া অভিজ্ঞতা হল। জানলুম এখনো একটি জায়গা আছে যেখানে শিল্প, শিল্পী, বাণিজ্য, সৃজন, ঐতিহ্য, আধুনিকতা, হিন্দু, মুসলিম - এগুলির কোনটার সাথেই কোনটার বিরোধ নেই।

Facebook Comments

4 thoughts on “পটচিত্রকথা

  1. একটা সামান্য গ্রামের অসামান্য হয়ে ওঠার কাহিনী নিয়ে লেখা’পটচিত্রকথা’৷
    ওখানের ঐ মানুষগুলোর নিরলস সাধনা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির
    যে বর্ণনা এই লেখা থেকে পেলাম ,তা সত্যিই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে আরও নতুন করে জানতে , ধন্যবাদ হাসান

  2. পিংলার শিল্পকর্ম বাংলার গর্ব।কতো দারিদ্রেও কতো সারল্যে সৃষ্টিতে এরা মগ্ন।বিষয় নির্বাচন ভালো লাগলো👌

Comments are closed.