Site Overlay

শেখা, শেখানো, দেখা আর দেখানো

অসীম বসাক

কাউকে কিছু শেখানো যায় বলে আমার মনে হয় না।দেখানো যায়। অনুকরণ করা যায়। অনুসরণ করা যায়। অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।প্রেষনা, প্রেরনা, উৎসাহ, আনন্দ দেওয়া যায়।

তাহলে কি আমরা কেউ কিছুই শিখিনি? কিছুই শেখাই নি?

উত্তর: না।

কি সাঙ্ঘাতিক শব্দ, না?

শিক্ষা অন্তর্নিহিত। বীজের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি প্রাণীর শেখা ও শেখানোর গুন নিজস্ব।

বাবুই যুগ যুগ ধরে একইভাবে বাসা বোনে। মাছরাঙা একই ঢঙে মাছ ধরে। বেড়াল একই তালে ল্যাজ নাচায় আর সিংহ একই চাহনিতে গাম্ভীর্য প্রকাশ করে। বিবর্তন ও অভিযোজনের মধ্য দিয়ে খুউব ধীরে একটু একটু করে পরির্বতন ও উদবর্তন হতে থাকে।

কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। সবাই বলে সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ইহা কি সত্য?

সব দিক থেকে যথার্থ নয়। বরং সব দিক থেকে যদি ভেবে দেখি তাহলে বলতে হয় জোরগলায়: সবার উপরে উদ্ভিদই সত্য। উদ্ভিদ দান করে: প্রান, অক্সিজেন,জীবন, জল,সুশীতল সবুজ,অসংখ্য কীটপতঙ্গের আশ্রয়, আমাদের সকলের খাদ্য, আরও অনেক কিছু.....

মানুষ সারাজীবন গ্ৰহন করে।কি দেয় সে? অশিক্ষা,কুশিক্ষা, অশান্তি,হিংসা, লোভ,ঈর্ষা আর যুদ্ধ... রক্তস্রোত।

ভোগী মানুষের ত্যাগ কেবলমাত্র মল-মূত্র-কফ-থুথু আর কার্বন-ডাইঅক্সাইড।

সব মানুষই কেবল ভোগী নন। তারা ত্যাগীও।তারা অনুকরণীয় , আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা। এদের জীবনযাপন, চিন্তা আমাদের সম্পদ আমাদের কাছে শিক্ষা।

আবার শিক্ষার কথায় ফিরে এলাম। শিশু দেখে শেখে।তাই ব্ল্যাকবোর্ড, চক, ডাস্টার, ল্যাপটপ, মোবাইল, স্মার্টবোর্ড অপেক্ষা মাষ্টার মানুষের শরীর-কথা-চলন-বলনই শিশুর মনে বেশি অভিঘাত ফেলে।চারটি আঁক টেনে, পাঁচটি অঙ্ক কষে, দুটি ট্রানশ্লেশন লিখে আর আধখানা ল্যাব টুকে হয়তো ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কেরানি বা অন্য কিছু হওয়া যায়, কিছু করে কম্মে খাওয়া যায়, শিক্ষক হওয়া যায় না।

যিনি শেখেন,শিখতে চান তিনিই শিক্ষক।

১৯৮৬ থেকে একটানা ছাত্রদের সাথে প্রথাগত অধ্যয়ন, অধ্যাপনায় থাকার সুযোগ পেয়েছি।এই সমাজ আমাকে এই সুযোগ দিয়েছে।আমাকে সম্মান, স্বীকৃতি,অর্থ, নিরাপত্তা এই সমাজ দিয়েছে। কিন্তু আমি কি দিয়েছি? এখনও পর্যন্ত অনেক ছাত্র-ছাত্রী, মাষ্টার মশাই এবং দিদিমনির সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের থেকে অনেক কিছু শিখতে ,আত্তীকরন করতে চেষ্টা করেছি। এখনও করছি।করেও যাব আজীবন।

আমি সবসময়েই যুক্তির পথে, বিজ্ঞানের আলোয় দেখানো কুসংস্কারহীন পথে হাঁটতে চেয়েছি। এবং হাঁটছি।হয়তো আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা সেই পথ খোঁজে। কিন্তু সে পথ মসৃন ও গতানুগতিক নয়।তাহলে আমাদের কর্তব্য কি?

হাতে লাল-নীল-হলদে সূতো, তাবিজ-কবজ-মাদুলি,কাঠির টুকরো.... আঙ্গুলে পাথর ভরা আংটি আরও কত কি! ভাগ্য বদল বা অন্বেষণের ফাঁদ, ব্যবসা। চেষ্টা করেছি, বাধা দিয়েছি সরাসরি। বুঝিয়েছি।

অনেকেই অনুকরণ করেছে। অনেকেই মুখ বুজে  মেনেছে।মান্যতা দেয় নি।

আমি কিন্তু নিজে মেনেছি, মানছি, মানবোও আজীবন।মন, মুখ, আচরন এক হতে হবে।

আমি কাউকেই আঘাত, অপমান করতে চাই না।তবে মনের কথা খোলামেলা স্বরে ছাত্রদের মাঝে তথা জনমানসে মেলাতে, মেশাতে, ছড়াতে চাইছি।

আমি ভক্তি বা ভয়ে বা ধর্মীয় কারনে মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বার-তীর্থপ্রাঙ্গনে যাই নি।অগনিত মানুষের পায়ের ছাপে, বুকের দীর্ঘশ্বাসে, মনের কামনায় ভারী বাতাসের পরশ পেতে গিয়েছি।কেদার বদ্রী তুঙ্গনাথ মদমহেশ্বরের প্রকৃতি-পরিবেশ , মানুষের কাছে নিজেকে হাজির করেছি। হিমালয়ের নির্মল সৌন্দর্য,অসহায় পাহাড়ী মানুষের সরল সাদা জীবন, পবিত্র হাসি আমার জীবনকে ধন্য করেছে। ধর্ম নয় মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই, প্রকৃতিকে রক্ষা করার লড়াই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।টেকসহ উন্নয়নের নামে পরিবেশ লুন্ঠন চলছেই।খালি বক্তৃতা আর সেমিনার! কোথায় গেল শিক্ষা!

ধর্মের সর্বনাশা নেশায় আসক্ত অশিক্ষিত মানুষ। দিশাহীন মানুষ।ভয়-ভীতি, রীতিনীতি,ধর্ম-অধর্ম সর্বস্ব মানুষ।যুগ যুগ ধরে ধর্মের বাণী মানুষের মুখে মুখে।এ বুলি শেখানো হয়েছে।এ বুলি পড়ানো হয়েছে পরম সযতনে। মানুষের অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য ধর্মের ব্যবহার কুচক্রীরা বার বার করেছে।তবলিগি জমায়েত,কুম্ভস্নান, গঙ্গাসাগর, পুন্যস্নান - আসলে সবই সাধারণ মানুষকে ধর্মের আফিমে মাত করে অজ্ঞান রাখার খেলা।

খেলা, মেলা আর ভিক্ষা দিয়ে আর যাই হোক শিক্ষা হয় না।

Facebook Comments

1 thought on “শেখা, শেখানো, দেখা আর দেখানো

Comments are closed.