সুলক্ষণা সাহা চক্রবর্তী
![](https://i0.wp.com/95canvas.com/wp-content/uploads/2022/03/Untitled_Artwork-14.jpg?resize=768%2C1024&ssl=1)
বিচিত্র আমাদের জীবন।
রোজ ভালো-মন্দ মিশিয়ে না জানি কত অভিজ্ঞতা হয়, সব যে মনে থাকে তা নয়, মনে রাখা সম্ভব এমনও নয়, কিন্তু কিছু ঘটনা থেকে যায় আমৃত্যু!
কখনো সেসব ঘটনার রেশ আমাদের আঘাত করে, আহত করে, আবার এমনও কিছু ঘটনা থাকে, যা আমাদের বেঁচে থাকার রসদ যোগায়, জীবনকে আরো সুন্দর করে তোলে।
আমাদের প্রত্যেকের ঝুলিতেই এমন কিছু চকমকি পাথর আছে, যা মাঝেমধ্যে মনের ঝুলি থেকে তুললেই তার আলোকে ঝকমক করে উঠি আমরা!
তেমনই খুব ভালেলাগার একটা ঘটনার কথা আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে।
সম্প্রতি ক্রিকেটের জগতে এক নক্ষত্র পতন হল।
শেন ওয়ার্ন – শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় প্রতিভা, না ফেরার দেশে চলে গেলেন মাত্র ৫২ বছর বয়সে।
মানুষ তো অমর নয়, কোথাও…. কোনো একদিন সব মানুষকেই দাঁড়ি টানতে হয়।
তাই এত কম বয়সে কেন তিনি চলে গেলেন বা আরো কিছুদিন থাকলে ভালো হত, এসব আলোচনা না করে বরং এত কম জীবনে তিনি কত ভাবে উদ্দীপিত করলেন আমাদের, কোন ম্যাজিকে বারবার “বোল্ড” করে বাকরূদ্ধ করে দিলেন গোটা পৃথিবীকে, তার আলোচনা হোক, উৎসব হোক তাই নিয়েই।
তাই এত কম বয়সে কেন তিনি চলে গেলেন বা আরো কিছুদিন থাকলে ভালো হত, এসব আলোচনা না করে বরং এত কম জীবনে তিনি কত ভাবে উদ্দীপিত করলেন আমাদের, কোন ম্যাজিকে বারবার “বোল্ড” করে বাকরূদ্ধ করে দিলেন গোটা পৃথিবীকে, তার আলোচনা হোক, উৎসব হোক তাই নিয়েই।
ব্যক্তিগতভাবে আমার একবার সুযোগ হয়েছিল এই নক্ষত্রের মুখোমুখি হওয়ার, সেই অভিজ্ঞতা -সেই দিনটার কথাই বলব আজ।
…..হ্যাঁ,শেন ওয়ার্ন-এর সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল, কথাও হয়েছিল বেশ খানিক…. না না, স্বপ্নে নয়, সাক্ষাতে — একদম সরাসরি — তখন অবশ্য আমি নিতান্ত বালিকা।
১৯৯৬ সাল, সেবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শুরুটা হয়েছিল কলকাতায়, ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামে। আমি তখন তনুশ্রী শঙ্করের ডান্স-স্কুলে নাচ শিখি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটা পারফর্মেন্সের দায়িত্বে ছিল আমাদের স্কুল, মানে “আনন্দ শঙ্কর সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস”– সেই সূত্রেই আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা একমাস টানা রিহার্সাল করেছিলাম স্টেডিয়ামে। প্রতিদিন ভোর হতেই বাবা সঙ্গে করে দিয়ে আসত স্টেডিয়ামে, তারপর সারাদিন মাঠেই চলত রিহার্সাল। বিষয়টা খানিক কষ্টসাধ্য সন্দেহ নেই কিন্তু ওই বয়সের উন্মাদনা, উৎসাহ এতটাই যে কখন কিভাবে হাসি-মজা-কাজে সারাদিন কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না।
অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওই সময়, আজ লিখতে বসে সব কেমন মনে পড়ে যাচ্ছে।
যেমন, ব্রেকফাস্ট -এ আমাদের স্যান্ডউইচ দেওয়া হত, সেই প্রথম বুঝি চিজ, লেটুস সহযোগে ত্রিকোণ পাউরুটিকে স্যান্ডউইচ বলে। ( তার আগে বাড়িতে বাটার বা ডিম দিয়ে পাউরুটি খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু এ জিনিস সে জিনিস নয়!)
এরকম আরো কত!
আশা ভোঁসলেকে দেখেছিলাম, বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন কে দেখেছিলাম, শুধু দেখিনি, রীতিমতো অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম!
আর খুব মনে আছে আনন্দশঙ্করের (আমাদের আনন্দ’দার) কথা, তনু্শ্রীদিকে খুব ভয় পেতাম কিন্তু আনন্দ’দা যেন আপন দাদা-ই, এত সহজ প্রাণখোলা ভদ্রলোক খুব কম দেখেছি। আনন্দ’দা সামনে এলেই পরিবেশটা কেমন পাল্টে যেত, সবার চোখেই খুশির ঝলক!
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে মাঠে বিশ্বকাপ ‘লোগো’-র কোরিওগ্রাফড ফর্ম তৈরি করার জন্য তনুশ্রীদি কিছু স্টুডেন্টকে সিলেক্ট করেন, আমি তাতে সিলেক্টেড হই, তাই অনুষ্ঠানের দিন মানে ১১ ফেব্রুয়ারি মূল মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানেই দেখি সমস্ত ক্রিকেট দলের সদস্যদের। যদিও আমি তেমন ক্রিকেটপ্রেমী নই তাই সবাইকে খুব চিনতে পারিনি তখন, আর আশেপাশে এত রথী-মহারথীরা, তারকারা থাকলে বোধহয় মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, তবু ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আজহারউদ্দিনকে দেখেই ছুটে গেছিলাম অটোগ্রাফ নিতে, ওয়াসিম আক্রমকেও ছাড়িনি।
অস্ট্রেলিয়ান প্লেয়ারদের যেখানে রাখা হয়েছিল, তার খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা। মার্ক টেলর, শেন ওয়ার্ন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আমরা দু’তিনজন প্রচুর সাহস-টাহস নিয়ে সামনে গিয়ে বললাম “অটোগ্রাফ্ প্লীজ “…..
…..লিখতে গিয়ে আজ নিজেরই অবিশ্বাস্য লাগছে কিন্তু আমাদের দেখে তাঁরা শুধু যে অটোগ্রাফ দিলেন তাই নয় রীতিমতো গল্প জুড়লেন!
শেন ওয়ার্ন-এর উৎসাহই ছিল বেশি, মিনিট কয়েকের মধ্যে আমরা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গিয়ে টুকরো হাসি মজাও করেছিলাম। একদম বাড়িয়ে বলছি না…সত্যি বলতে এই বিশেষ গুণটির জন্যই “ওয়ার্ন”- কে এত ভালো লেগেছিল, এত পরিস্কার মনে আছে সবটা!
তবে সেলফি তুলতে পারিনি, সে যুগ তো সেলফির নয়, দু’একজনের কাছে ওই “হটশট” টাইপ ক্যামেরা ছিল, আমার তাও ছিলনা, তাই যেটুকু যা আছে ওই মনের ক্যামেরাতেই!
তাই কোনো প্রমাণও দিতে পারবনা। আমার ক্রিকেটপ্রেমী এক ভাইকে গোটা অটোগ্রাফ-এর খাতাটি দিয়ে তখন দারুণ হিরো হয়েছিলাম ফলে সেটিও আর দেখাতে পারবনা, থাকার মধ্যে আছে সেই বিশালাকার অদ্ভুতদর্শন পোশাকটা , যেটা পরে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি ( ওটা আমাদের দিয়ে দেওয়া হয়)। তাও মা’ যত্ন করে রেখে দিয়েছে তাই আছে । আমার জিম্মায় থাকলে ওটিও নির্ঘাত…..!
এই হল আমার আর শেন ওয়ার্ন-এর গল্প – আমার কাছে রূপকথা, সত্যিস্বপ্ন!
ভালো থেকো শেন ওয়ার্ন…..
আমার চোখে আজও তুমি সেই সাতাশ বছরের তরতাজা যুবক….
ওইরকম হাসিখুশি খুনসুটিতে ভরা থেকো….
অন্তত একজন “বেঙ্গলি গার্ল” কোনো একদিন ওখানে পৌঁছে তোমার সঙ্গে দেখা করবেই করবে…
ভালোবাসা রইল….
Facebook Comments