Site Overlay

একটি চিরায়ত গানের জন্মকথা

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী

রবীন্দ্রসংগীতের জগতে অতীত দিনের মহিলা শিল্পীদের মধ্যে অমলা দাস, কনক দাস, শৈল দেবী, সুপ্রীতি ঘোষ, রাজেশ্বরী দত্ত প্রমুখদের গানের স্টাইল, পরিবেশন, রেকর্ড বা সিডিতে শোনার পর, পরবর্তী কালে রবি ঠাকুরের গান যে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক নব্য-অনন্য মহিমায় প্রকাশিত হল সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় নামে এক শিল্পীর ঋজু-সতেজ-দৃপ্ত-অননুকরণীয় কন্ঠস্বরের আবির্ভাবে, এ সত্য অস্বীকৃত হওয়ার নয়। অরুণকুমার বসুর কথায়, "তার পাশে  সতর্ক হয়ে শুধু দাঁড়ানোই যায়, হুমড়ি খেয়ে পড়া যায় না। চারপাশে এমনই একটা অভিজাত দীপ্তি, একটি দূরত্বের মহিমা"। পরবর্তীকালে, যখন তিনি সুচিত্রা মিত্র হন, তখনকার স্মৃতিচারণা অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে শ্রী বসুর কলমে, "রাজনৈতিক সভায় গণনাট্যের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল অপরিহার্য। যতদূর মনে পড়ছে ১৯৪৯-৫০ সালে কোনও এক অনুষ্ঠানে সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ এবং সলিল চৌধুরীর ‘সেই মেয়ে’।
 কৃষ্ণকলি গানটি সুচিত্রা মিত্রর কন্ঠে তখনই বোধহয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তিনি ঠিক যেমন করে উচ্চারণ করেন ‘কালো’ শব্দটি, প্রত্যেকবারই তাকে নতুন মনে হয়। যেন প্রতি উচ্চারণই অন্যটির চেয়ে পৃথক। যেন ঠিক রবীন্দ্রনাথ এমন করে বলতে চেয়েছিলেন। আজও, সেই সুচিত্রা মিত্র, স্বদেশে বিদেশে, যে কোনও রবীন্দ্রসংগীতের আসরে, শতকরা নিরানব্বই জন শ্রোতার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াতে পারেন না এই ‘কৃষ্ণকলি’ গানটি শোনানোর জন্যে" (‘গানের ফ্রেমে ঝাপসা কৈশোরের ছবি’, রবিতীর্থ সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ)।   

 তাঁর কন্ঠে ‘কৃষ্ণকলি’ গান চিরায়ত, অজেয়, অম্লান। তাঁর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার দশ বছর পার হয়ে গেলেও (৩/১/২০১১) শুধু একটি গানের পরিক্রমায় তাঁকে ভিন্নভাবে আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রতি, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনস্বরূপ এই নিবন্ধ। "তাঁর কন্ঠস্বরে এমন একটি পৌরুষ ও দার্ঢ্য আছে, যা শতকরা আশিজন মহিলা শিল্পীর পক্ষে অকল্পনীয়। অথচ তা এমন পৌরুষ নয় যা মনের মাধুর্যপরায়ণ গীতস্পৃহাকে অতৃপ্ত রাখে"( অরুণকুমার বসু)। মনে হয়, তাঁর কন্ঠের বৈশিষ্ট্য নিয়ে অতিরিক্ত কিছু বলা বাতুলতা হবে মাত্র। 

তাঁর সুরলোকে চলে যাওয়ার পর এই নিবন্ধকারের মতো অসংখ্য ছাত্রর মনে পড়বে তাঁর কাছে ‘রবিতীর্থ’ শিক্ষায়তনে ক্লাস করার মধুর-অমলিন স্মৃতি। ‘পূজা’ থেকে ‘প্রেম’ অতিক্রম করে ‘ঋতু’ বা ‘স্বদেশ’ পর্যায়ের গানে তাঁর অবাধ বিচরণের কথা একনিষ্ঠ শ্রোতা গভীরভাবে জানেন। একবার বসন্তের সান্ধ্য এক একক অনুষ্ঠানে তাঁর অনবদ্যভাবে সাজানো গানের ডালির মাঝেই কতবার যে শ্রোতাদের পক্ষ থেকে ‘কৃষ্ণকলি’ গাইবার জন্য বারংবার অনুরোধ আসছিল যে তিনি বাধ্য হয়েই বলেছিলেন, "আজ ওই গানটি না গাইলেই নয়?" কে শোনে কার কথা। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। তাঁর অনুষ্ঠানের স্মৃতি যাদের স্মৃতিপটে অমলিন আছে, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই জানেন সে সব কথা। 

গানটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যায় শান্তিদেব ঘোষ রচিত ‘রবীন্দ্রসংগীত’ গ্রন্থের ‘কাব্যগীতি’ নিবন্ধ থেকে। "১৯৩১ সালে বর্ষামঙ্গল উপলক্ষে ‘ক্ষণিকা’র ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটিতে সুর দিলেন কীর্তন ও নানা রাগিনী মিশিয়ে-বর্তমান লেখককে দিয়েই সেই পরীক্ষা চালালেন। গানের বাঁধা ছন্দকে ভেঙে আবৃত্তির ধরনটিকে বজায় রেখে আমাকে সর্বসমক্ষে প্রথম গাইতে হল। সেখানে প্রশ্নসুচক ‘কালো’? কথাটি তিনি অবিকল কথার সুরে রাখলেন, একটুও বদলালেন না। আবৃত্তির এরকম নতুন রূপ সকলের কাছেই ভালো লেগেছিল।" শান্তিদেবের কথায় জানা যায় গানটিতে ‘আমাদের দেশের প্রাচীন কথকতাপদ্ধতি,’ ভাব অনুযায়ী প্রত্যকটি কলিতে ‘এক একটি রাগিনীর ব্যবহার’ করা হয়েছে, যা ‘কালো’ শব্দটির নানা ধরনের উচ্চারণে ধরা পড়ে। ‘ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ’য়ে ‘সুরের দোলায় ঢেউয়ের দোলার ইঙ্গিত লক্ষণীয়’। 

সুচিত্রাদির কন্ঠে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘কৃষ্ণকলি’ গানটি যে কতবার শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। গান যখন শেখার স্তর অতিক্রম করে বোধি-মনন-অনুভূতির মিশেলে ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকল, তখন থেকেই অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি, প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রতিবার তিনি গানটি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। অরুণ  কুমার বসুর কথায়, "কোনও একটি গান একজন শিল্পীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে এমন দৃষ্টান্ত খুব কি পাওয়া যাবে?" "রেকর্ডে তাঁর গানটি প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত ১৯৬১ সালে", শ্রী বসু বলেছেন। আজও, এত বছর পরও, তাঁর সুরলোকে গমনের ১০ বছর পরও তাঁর কন্ঠে ধৃত ‘কৃষ্ণকলি’ শ্রোতাকে আবিষ্ট করে রাখে। 

"গীতিকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয় না সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের আরম্ভ" (‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। ‘কৃষ্ণকলি’ গানে কথারই আধিক্য। একটি বর্ণনা। ইংরেজিতে যাকে ballad  বলা হয়, যে দীর্ঘ গান বা কবিতা একটি গল্পের আদলে বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা প্রেম কাহিনী, আভিধানিক অর্থে তাই ballad। স্বাভবিকভাবেই মনে হয় ‘কৃষ্ণকলি’ও কি ব্যালাডধর্মী গান? গানটি ঢালাভাবে কোনও রিপিটেসন ব্যতিরেকে গাওয়ার নিয়ম। সুচিত্রাদি যেভাবে গাইতেন, তাতে তাঁর গুরু শান্তিদেব ঘোষের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু একটুকুও অতিশয়োক্তি হবে না যদি বলা যায়, তিনি তাঁর বোধের  ব্যাপ্তিতে ‘কৃষ্ণকলি’কে রসোত্তীর্ণ করেছেন। সেই কারণেই তাঁর কন্ঠে এই গান কালোত্তীর্ণ। পাঁচটি স্তবকে রচিত বিচিত্র পর্যায়ে গ্রন্থিত ‘কৃষ্ণকলি’ এমনই এক গ্রাম্য কিশোরী নাকি রমণী, যার সঙ্গে কবির দ্যাখা এক ঘন বর্ষায়  আঁধার নেমে আসা মাঠে। তার ঘোমটাবিহীন, ‘পিঠের 'পরে মুক্তবেণী’ লোটানো ছবি এক লহমায় আমাদের মানসপটে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুচিত্রা মিত্রর সুরের চলনে। ওদিকে মেঘের গুরুগুরু আওয়াজ, আর ‘শ্যামল দুটি গাই’য়ের ডাক শুনে ‘শ্যামা মেয়ে’ ‘কুটির হতে ত্রস্ত’ ছুটে আসে। ‘ত্রস্ত’ উচ্চারণ নিয়ে অনেক বাক বিতন্ডা শ্রুত হয়। কিন্তু, আর কেউ ‘ত্রস্ত’ভাবে ছুটে আসার ছবি স্পষ্ট করতে পারেন না সুচিত্রাদির মতো। যদিও অনুকরণ অনেকেই করেন।...তারপর সেই ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যাওয়ার স্বর্গীয় সুর। মনে হয়, সেই দুলুনিতে আমরাও দুলছি। ময়নাপাড়ার মাঠের সেই কালো হরিণ-চোখের ‘কৃষ্ণকলি’কে সুচিত্রা মিত্রই করেছেন কিংবদন্তী।                            **************

Facebook Comments