রূপা চক্রবর্তী
আজকে বন্যা বিশেষ যত্ন নিয়ে তার প্রসাধন সম্পূর্ণ করেছে। চওড়া লাল পাড়ের ঘন সবুজ ধনেখালি তাঁতের শাড়ী, সঙ্গে উজ্জ্বল লাল ব্লাউজ, কপালে বড় লাল টিপ, এলো চুলে লাল থোকা ফুল। ঠিক যেন রক্তকরবীর নন্দিনী তার রঞ্জনের প্রতীক্ষায় আকুল হয়ে উঠেছে। আজকে সেই বহু প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা। অনুষ্ঠান শুরু হতে আরও ঘন্টা দুয়েক বাকি। তার মধ্যে তাকে কলেজে পৌঁছাতে হবে। বন্যার মানসিকতার সাথে সুর মিলিয়ে প্রকৃতিও বড় মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে মৃদুমন্দ হাওয়া যেন আগমনী রাগের অপূর্ব সমাহার। পরিষ্কার আকাশ পূর্বাভাস দিচ্ছে, যে ক্ষণিকের এই বৃষ্টি আজকের সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে কোন বিঘ্ন ঘটাবে না। বরং মেঘ-মল্লারের উপযোগী অনুগত সঙ্গতের ভূমিকাই পালন করবে। কলিংবেলের মিষ্টি বোল উঠতে বন্যা বুঝতে পারে ড্রাইভার তাকে নিতে এসেছে। বেরনোর আগে শেষ বারের মত ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ যেতে বন্যা কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। অন্যমস্কভাবে বেশ কয়েক বছর আগের কথা ক্ষণিকের জন্য মনে পড়ে যায়। তখন বন্যা এই কলেজের ছাত্রী ছিল। সেদিনও কলেজের একটা অনুষ্ঠানে সাগরের সাথে ‘শেষের কবিতা’ করবে বলে বন্যা এইভাবেই সাজগোজ করে উইংসের পাশে অপেক্ষা করছিল। খেয়াল করেনি কখন সাগর তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।হঠাৎ তার ধ্যানভঙ্গ করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সাগর বলেছিল – ‘রবীন্দ্র-সৃষ্ট সব নারী-চরিত্ররা তোমার এই সজল উজ্জ্বল মোহিনী রূপের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে বন্যা!’ আজকে বন্যা, নিজেই এই কলেজের অধ্যাপিকা। মাঝে প্রায় কুড়িটা বসন্ত পার হয়ে গেলেও আজও বন্যার অভিজাত সৌন্দর্য অমলিন। তার রুচিসম্মত মার্জিত সাজ, শারীরিক গঠন, বুদ্ধিদীপ্ত সপ্রতিভতা এবং সুশিক্ষিত মানসিকতা এই মধ্য-চল্লিশেও তাকে ত্রিশের চৌকাঠে আটকে রেখেছে। বন্যার স্বামী দৃপ্তমান একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। অফিসের কাজে মাস খানেকের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছে। অফিসের কাজ শেষে ডেনভারে ওর মাসির কাছে দুদিন থেকে ফিরবে। বন্যাকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু এতোদিন কলেজে ছুটি নিলে অসুবিধা হোত, বিশেষ করে আজকে কলেজের এই সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান, যার দায়িত্ব পুরোপুরি বন্যার উপর। কারণ সে কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা। দৃপ্তর মাসিকে বন্যা কাকীমা বলেই ডাকে, কারণ তার বিয়ের আগে এই কাকীমারা বন্যাদের পাশের বাড়ীতে থাকতেন এবং তাকে খুব স্নেহ করতেন। কাকীমার দুটি মিষ্টি ছেলেমেয়ে এবং বন্যার ভাই এই তিনজন ছিল বন্যার সুন্দর সময় কাটানোর সাথী। এখন তারা ডেনভারে থাকে। দৃপ্ত এবং বন্যার বিয়ে এই কাকীমার মধ্যস্থতায় হয়। ওরা দুজনেই কাকীমার খুব প্রিয়। তাই কাকীমা বারবার করে বন্যাকে যেতে বলেছিলেন; কিন্তু বন্যা এবার কিছুতেই সময় করতে পারল না। অগত্যা বিষণ্ণ মনে দৃপ্ত একাই আমেরিকা গিয়েছে। বন্যার ছেলে উৎস ভুবনেশ্বরের কে.আই.আই.টি তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। পুজোর ছুটিতে তার কলকাতায় আসার কথা। আজকে বন্যার কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হয়ে আসছে বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং নাট্যব্যক্তিত্ব সুপুরুষ সাগর চৌধুরী। এক সময় সেও এই কলেজের ছাত্র ছিল। বন্যার বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব আধঘন্টা। গাড়িতে যেতে যেতে বন্যার মনে পড়ে যায় সাগরের সাথে বন্যার কতদিন কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। আজ সাগর জানেও না, যে অনুষ্ঠানে সে অতিথি হয়ে আসছে তার আয়োজক বন্যা। অথচ কলেজে পড়ার দিনগুলিতে তারা ছিল অবিচ্ছেদ্য। একসাথে রবীন্দ্র-ভাবনায় মথিত হয়ে তারা কত অনুষ্ঠান করেছে। আবৃত্তি, গান শ্রুতিনাট্যে তাদের মনন ছিল এক তারে বাঁধা। তাদের দুজনের করা ‘শেষের কবিতা’র সিডি ক্যাসেট অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিল। বলাবাহুল্য, অমিতের চরিত্র করেছিল সাগর এবং বন্যা করেছিল লাবণ্য। কেটির চরিত্র করেছিলো সোহিনী। সোহিনী সাগরকে খুব ভালবাসতো। কিন্তু বন্যা আর সাগরের মাঝে এমন কোন শূন্যস্থান ছিলো না , যা সোহিনী পূরণ করতে পারে। তাই সোহিনীর ভালবাসাটা অনুচ্চারিতই থেকে গিয়েছিল। সেইসময় বন্যা আর সাগরের বন্ধুত্ব আকাশ – বাতাস মুখরিত করে তুলেছিলো। যে কথাটা সবার মাঝে ভীষণভাবে ব্যক্ত ছিল , ওদের দু’জনের মাঝে সেই কথাটা অব্যক্তই থেকে গিয়েছিলো। হয়ত দুজনেই সেই কথাটা আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারণ করা বাহুল্য মনে করেছিল; দুজনেই যার যার পড়াশোনা এবং একসাথে সাংস্কৃতিক চর্চায় মগ্ন ছিল। কলেজে যখন তাদের বন্ধুত্ব ডালপালা মেলে বিকশিত হয়ে সুমিষ্ট ফলের দিকে এগোচ্ছে, এই রকম সময় একদিন বন্যাদের প্রতিবেশী কাকীমার বাড়িতে তার দিদির ছেলে দৃপ্ত এসে উপস্থিত হল। পড়াশোনায় তুখোড়, হ্যান্ডসাম, রৌরকেল্লায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া দৃপ্তর কথা বন্যা আগে অনেকবার কাকীমার কাছে শুনেছিলো কিন্তু তার জন্যে কোন অতিরিক্ত আগ্রহ অনুভব করেনি। সেবার দৃপ্ত এসে বন্যার সাথে আলাপ করে তার স্বচ্ছন্দ ব্যবহার দেখে এবং মাসী – মেসোর মুখে বন্যার স্তুতি শুনে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। এরপর থেকে কলেজের ছুটি পেলে এবং নানা ছুতোয় দৃপ্ত কলকাতায় চলে আসতে লাগল যখন- তখন। এই ব্যাপারে সে তার মাসী – মেসোরও প্রশ্রয় পাছিল। এরকমই একদিন বন্যা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে বুঝতে পারলো দৃপ্ত এসেছে তার মাসীর বাড়ি। কারণ তাদের দুটো বাড়ির ভৌগলিক এবং মানসিক নৈকট্য এতটাই ছিল যে এবাড়ির খবর অন্য বাড়িতে পৌঁছে যেতে বেশী সময় লাগত না। এছাড়া দৃপ্ত আসলেই টেপ-রেকর্ডারে কিশোরকুমারের অর্থবহ গান বাজিয়ে দিত, বেশ জোরে জোরে। সেদিন মেসো – মাসীর সামনেই সে বন্যাকে বলল, "আজকে কলকাতায় এসেই তোমার কলেজে গিয়েছিলাম, কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তোমার দেখা পেলাম না। শুনলাম মিটিং-এ আছো। তুমি কি কলেজে ক্লাস করো না? নাকি ভালো মেয়েদের ক্লাস করার প্রয়োজন হয় না?" ভীষণই অবাক হয়ে সরল মনে বন্যা বলল – "সামনেই আমাদের কলেজে একটা অনুষ্ঠান আছে। তাই সেই ব্যাপারে আলোচনার জন্যে প্রিন্সিপালের সাথে বসতে হয়েছিল। কিন্তু তুমি কেন আমাদের কলেজে গিয়েছিলে? কাউকে ভর্তি করার আছে?" চোখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে দৃপ্ত বলল- "বন্যা আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি – আমি নিশ্চয়ই তোমাদের কলেজে ভর্তি হতে যাব না।" কৌতূকমিশ্রিত স্বরে যোগ করল, "অবশ্য তুমি যদি বলো আমি তোমার ক্লাসে ভর্তি হয়েও যেতে পারি।" আরও বিস্মিত হয়ে বন্যা বলল, "তবে?" সাবলীল ভঙ্গিতে দৃপ্তর জবাব এল, "তোমার সাথে আমার কথা আছে। কালকে এগারোটার সময় আমার সাথে কফি খেতে যাবে। নাঃ, আমি কোনো ওজর আপত্তি শুনবো না। তোমাকে আসতেই হবে।" বন্যা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে দৃপ্ত বললো, "কেন? ডর লাগে?" দৃপ্তর সেই অকুতোভয় চোখের দিকে তাকিয়ে বন্যা কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না , তবে সত্যিই মনে মনে কেঁপে উঠলো। পরের দিন বন্যা মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করে, 'যাব না–যাব না' করেও প্রায় একঘন্টা দেরী করে বারোটা র সময় ‘কাফে ডে’-তে গিয়ে উপস্থিত হল। দেরী করার জন্য দৃপ্ত একটুও রাগ না করে , দৃঢ় প্রত্যয়ে বলল, "আমি জানতাম বন্যা, তুমি আসবে!" দুটো কফি অর্ডার করে দৃপ্ত একটা সুন্দর ছোট গোলাপী রঙের খাম বন্যার হাতে তুলে দিল। আস্তে আস্তে বলল, "আমি আজকে রৌরকেল্লা ফিরে যাছি। আমি চলে যাওয়ার পরে খামটা খুলবে।" কথা রেখেছিল বন্যা। দৃপ্ত রৌরকেল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে খামটা খুলেছিলো। মিষ্টি একটা ফুলের সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। একটা অজানা 'ভালো লাগায়' মন টা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। খামের মধ্যে ক’টা তাজা শুভ্র জুঁইফুলের সাথে হালকা গোলাপী কাগজে ছোট্ট একটা চিঠি। তার মধ্যে লেখা , "বন্যা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। সেখান থেকে আমার আর ফেরার কোনো পথ নেই। তুমি আমাকে আর যা খুশী বলো, শুধু ‘না’ বলো না।" দু’লাইনের চিঠিটাই বন্যা বারবার পড়ল । প্রতিবারই অদ্ভুত এক আবেশে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। ‘না’ বলতে পারেনি বন্যা। তার সর্বশক্তি জড়ো করেও ‘না’ বলতে পারেনি, এতটুকুও রাগ করতে পারেনি। অনুরাগের অনুরণন মনের সংগোপনে রেখে আবার কলেজের পড়া আর আবৃত্তির অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বন্যা ইকোনমিক্স নিয়ে পড়ে ।সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী, তাই পড়ার চাপ ও খুব বেশী। আর সাগর কেমিস্ট্রির। এর মধ্যেই একদিন রবীন্দ্রভবনের একটা অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করার জন্য সাগর আর বন্যার কাছে আমন্ত্রণ আসলো। ওরা এমন একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে খুব খুশী কিন্তু এর মধ্যে কলেজের পরীক্ষার দিন ঘোষণা হল। ওই দিনই সাগরের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই সাগর যেতে পারবে না বলে, বন্যাও ঠিক করল অনষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার আহবান সে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু সাগর তাকে বোঝাল, এমন একটা সম্মানজনক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়া বন্যার উচিত হবে না। তাছাড়া এতে উদ্যোক্তারা অপমানিতও হতে পারে। তাই অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বন্যাকে অনুষ্ঠানে আশগ্রহণ করতে রাজী করাল। সাগর সেদিন খুব যত্ন নিয়ে বন্যা কী কী কবিতা আবৃত্তি করবে তা ঠিক করে দিয়েছিল। তার আবৃত্তির অনুষ্ঠানের শিরোনামটাও ঠিক করে দিয়েছিল সাগর – ‘একা, কবিতার সঙ্গে বন্যা।’ নির্দিষ্ট দিনে সময়ের একটু আগেই উদ্যোক্তাদের সাথে বন্যা আনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল। গোধূলির আলোয় বন্যা পর্দা র আড়াল থেকে তার মঞ্চের প্রস্তুতি ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিতে গেল এবং বিস্মায়াবিষ্ট হয়ে দেখল অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনও কিছু সময় বাকী আছে তাই দর্শকাশনগুলো সব ফাঁকা, শুধু সামনের সারির একটা আসনে দৃপ্ত বসে আছে অননুকরণীয় রাজকীয় ভঙ্গিতে। দৃপ্ত রৌরকেল্লা থেকে কখন আসলো? বন্যা জানতেও পারেনি। একরাশ ভালোলাগায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বলাবাহুল্য, সেদিনের অনুষ্ঠানটা খুব ভাল হয়েছিল। সবাই এসে বন্যাকে অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছিল। আর দূরের থেকে দৃপ্ত নায়কোচিতভাবে মিটি–মিটি হাসি নিয়ে তাকে ঘিরে প্রশংসার বন্যা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল। অনুষ্ঠান শেষে বসন্তের রাতে ওরা দুজনে হেঁটে গল্প করতে করতে বাড়ী ফিরেছিলো। আর একে অপরের সাথে চিরদিনের জন্যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল। দৃপ্তর সাথে আলাপ হওয়ার কথা বন্যা সাগর-কে আগেই বলেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে বন্যার জীবনে দৃপ্তর আগমন এমন এক অনুভবে অনুরণিত করেছিল, যা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো সাগরের থেকে বহুদূরে দুঃসাহসিক জীবনের পথে, সেকথা সাগর –কে জানাতে তার সংকোচ বোধ হচ্ছিল। বন্যা সাগর-কে দৃপ্তর কথা বলার জন্যে কোন অবলম্বন খুঁজে পেল না। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেই কবিতা সবাই সাগর বন্যার কন্ঠে বহুবার শ্রুত হয়েছে বাধ্য হয়ে সেই ‘শেষের কবিতা'রই আশ্রয় নিল। বন্যা সাগর কে লিখলো, - ‘ওগো বন্ধু সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে, ফেলি তার জাল তুলে নিল দ্রুত রথে দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে তোমা হতে বহু দূরে – মনে হয় অজস্র মৃত্যু-রে পার করে আসিলাম আজি নব প্রভাতের শিখর চূড়ায়- রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়- আমার পুরানো নাম- ফিরিবার পথ নাহি, দূর হতে যদি দেখ চাহি- পারিবেনা চিনিতে আমায়- হে বন্ধু – বিদায়- ......... তবু সে তো স্বপ্ন নয় সবচেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয় সে আমার প্রেম- তারে আমি রাখিয়া এলেম অপরিবর্তন অর্ঘ তোমারি উদ্দেশ্যে পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে কালের যাত্রায়- হে বন্ধু – বিদায়।’ সাগর সবই বুঝেছিল। কোন ঈর্ষা-রাগ-- ক্ষোভ বিদ্বেষ দেখায়নি। তার আভিজাত্যে এতটুকু মলিনতা লাগতে দেয়নি। নিজেকে সামলাতে শুধু কিছুটা সময় নিয়েছিলো। দুদিন পরে ছিল বন্যার জন্মদিন। প্রতিবার বন্যার জন্মদিনে সাগর নিজের রচিত একটা কবিতা বন্যাকে উপহার দিতো, সেবার ও তার অন্যথা হলো না – সাগরের লেখা কবিতা উপহার হিসেবে পৌঁছাল বন্যার হাতে- ‘হে বন্যা, তুমি অনন্যা। আপন ঐশ্বর্যে আপনি ধন্যা। তীব্র আকস্মিক, বাধা বন্ধ ছিন্ন করে দিক- তোমারে চেনার অগ্নি দৃপ্ত শিখায় উঠুক উজ্জ্বলি দিব তাহে জীবন অঞ্জলী।’ সঙ্গে একটা ছোট্ট নোট। তাতে লেখা, "আজকে তোমাকে উপহার দিতে গিয়ে তোমার রবি ঠাকুরের সাহায্য নিলাম বন্যা। তুমি তো জানো ঐ ভদ্রলোক-কে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমাকে সম্পূর্ণ করার জন্যে উনি রইলেন ওনার সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে। কিন্তু তোমাকে কথা দিলাম বন্যা, তোমাকে ছাড়া আর কখনোও ‘শেষের কবিতা’ আবৃত্তি করবো না। আমার জন্যে ভেবে নিজের মনকে ছোট কোরো না। আমি ভালো থাকব। তুমি ভালো থেকো। দৃপ্ত-কে ভালো রেখো। জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা সহ... - ...সাগর" এরপরে কলেজে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাগর পুরোপুরি অভিনয়ের জগতে চলে আসে। তার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিলো। সেই ছাপ তার সেরিব্রাল অভিনয়কেও সমৃদ্ধ করেছিল । তার চিত্রাকর্ষক অভিনয়ের গুণে অচিরেই সিনেমা এবং নাট্যজগতে তার নাম দেশের প্রথম সারির অভিনেতাদের সাথে আলোচিত হতে লাগল। ইন্টেলেকচুয়াল অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত পরিচালকদের কাছে সে অপরিহার্য হয়ে উঠল। বন্যা দূরের থেকে সাগরের সাফল্যে খুশী হতো। এর মধ্যেই বন্যা খবর পেল সাগর সোহিনীকে বিয়ে করেছে। কিন্তু সেই বিয়ে একবছরও টিকলো না। কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেল। প্রফেশন্যাল জীবনে এত সফল মানুষটাই ব্যক্তিগত জীবনে একেবারে হেরে গেল। তারপর থেকে সে যেন আরও বেশী করে সৃষ্টিশীল কাজকর্মে নিজেকে নিবেদিত প্রাণ করে রাখল। বর্তমানে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের যুগে কেউ ই আত্মগোপন করে থাকতে পারে না; সেখানে সাগরের মত সেলিব্রিটির জীবনের সব কথাই পেজ থ্রি-র ইয়েলো জার্নালিজমের দৌলতে চর্চিত হতে থাকে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অহরহ কাটাছেঁড়া হয় ৷ সাগর চৌধুরীও তার থেকে ছাড় পেল না। বন্যা দূরের থেকে সব খবর ই পেল। ইতিমধ্যে দৃপ্ত পাশ করে বেড়িয়ে লোভনীয় চাকরী পাওয়ার পরে বন্যা আর দৃপ্ত বিয়ে করল। বন্যা আগেও অনুষ্ঠান কম করত ৷ উৎস হওয়ার পরে পাবলিক শো করা একেবারেই কমিয়ে দিল। সাগরের সাথেও আস্তে আস্তে সামাজিক যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেল। কলেজ সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে তার নিজের কলেজেই অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দিল। এতবছর পরে কলেজেরই সূবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে নাট্য এবং সিনেমা জগতের প্রাণপুরুষ অভিনেতা সাগর চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করে আনার জন্যে যখন ছাত্র–ছাত্রীরা তার কাছে আবদার করল, তখন সঙ্গত কারণেই বন্যা ‘না’ করতে পারল না। নাকি তার মনের সঙ্গোপনেও ছিল সাগরকে একবার কাছের থেকে দেখার বাসনা? আজ সেই বিশেষ দিন। সকাল থেকেই বন্যা একটু আনমনা রয়েছে। যেন কুড়ি-বছর পেছনে কিছু ছুঁতে চাইছে। আজ এত বছর পরে আবার তারা একসাথে কলেজ প্রাঙ্গণে। এতগুলি বছর পার করেও সাগরের জনপ্রিয়তায় কোন ভাঁটা পড়েনি। আপামর সিনেমাপ্রেমী তাকে বিশেষ সমীহের চোখে দেখে। উত্তরোত্তর পরিণত হয়ে সে প্রায় কিংবদন্তীর পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে ৷ সে যেন নিজের তৈরী করা একটা আলোক বৃত্তের মধ্যে যাপন করে নিজের আলোকে সবাইকে আলোকিত করে চলেছে। নির্দিষ্ট সময়ে পরিপূর্ণ অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠান শুরু হল। সংযোজিকার দায়িত্বে বন্যা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং কিছু নাচ গানের পরে এবার মূল অনুষ্ঠান। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সাগর চৌধুরীর মঞ্চে প্রবেশের জন্য। বন্যা নিজেকে সংযত করে সাগর চৌধুরীর আগমণ বার্তা ঘোষণা করে মঞ্চ থেকে নেমে এসে উইংসের পাশে একটা আড়াল খুঁজে নেয়, যেখান থেকে নিজেকে সাগরের থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেও প্রাণভরে সাগরকে দেখেতে এবং তার আবৃত্তি শুনতে পারবে। অবশেষে সেই বিরল প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। কলেজের কিছু কর্মকর্তা এবং অধ্যাপকের সঙ্গে মঞ্চে এসে প্রবেশ করে, লাল সিল্কের শার্ট আর ঘিয়ে রঙের ট্রাউজ়ার্স পরিহিত টুকটুকে ফর্সা, লম্বা ঋজু চেহারার নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের সেলিব্রিটি অভিনেতা সুদর্শন সাগর চৌধুরী। চোখে রিমলেস চশমা তার প্রাজ্ঞতাকে অন্য মাত্রা দান করেছে। হাতে দামী রিস্টওয়াচ। মাথায় কয়েকগুচ্ছ রূপালী চুলের ঝিলিক প্রায় ছ’ফুট লম্বা টান টান মেদ হীন চেহারার স্তিতধী স্মার্ট সাগরকে যেন আরও আভিজাত্য এনে দিয়েছে। বোঝা যায়, কলপ দিয়ে চুলের সেই রূপালী ঝিলিক কে আড়াল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা নেই। উচ্চমেধার সাগরের বুদ্ধির দীপ্তি তার চেহায়ায় ঠিকরে বেরোয়। একমুখ অনাবিল হাসি নিয়ে সপ্রতিভ সাগর যখন মঞ্চে হাতজোড় করে সবাই কে অভিবাদন করে, তখন সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। মঞ্চ উদ্ভাসিত করা সহাস্য উপস্থিতিতে আড়ম্বরের আতিশয্য নেই, কিন্তু বনেদিয়ানার আন্তরিকতা এবং কৌলিন্য আছে। বন্যা দূরের থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সাগরকে দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কিছু টুকরো টুকরো কথা, উত্তরীয়, পুষ্পস্তবক এবং উপহার সামগ্রী দিয়ে সাগর চৌধুরীকে বরণ করার পরে মঞ্চে একা সাগর। হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে গমগমে ব্যারিটোনে যখন ঘোষণা করলেন আজ তিনি তাঁর নিজের কলেজে ‘শেষের কবিতা’ পাঠ করে শোনাবেন, তখন বন্যা চমকে উঠল। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। তবে যে সাগর তাকে কথা দিয়েছিল, তাকে ছাড়া আর কোনো দিন সে ‘শেষের কবিতা’ আবৃত্তি করবে না। এতবছরে কোথাও তো সে আর শেষের কবিতা করেনি! বন্যা সাগরের সব খবরই রাখে। তার ওপর সাগর চৌধুরীর মত সেলেব্রিটির দৈনন্দিন সব কথাই পেজ থ্রি-তে খবর হয়। তার মানে এত বছর পরে সাগর তাকে দেওয়া কথা ভুলে গেছে? অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা। কুড়িটা বছর তো কম দিন নয়। এতদিন আগের প্রতিশ্রুতির কোন গুরুত্বই হয়তো তার কাছে নেই। হয়তো সাগর তাকেই ভুলে গেছে। অভিমানে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সাবলীল উদাত্ত কন্ঠে সাগর শুরু করল শেষের কবিতা। সমগ্র অডিটরিয়াম মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে আছে। পিন পড়ার আওয়াজ ও যেন শোনা যাবে – সাগর মগ্ন হয়ে আবৃত্তি করে চলে- ‘কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে, বসন্ত বাতাসে অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস, ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ , সেইক্ষণে খুঁজে দেখ, কিছু মোর পিছে রহিল সে, তোমার প্রাণের প্রান্তে, বিস্মৃত প্রদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি, হয়তো ধরিবে কভু নাম হারা স্বপ্নের মুরতি। তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সবচেয়ে সত্য মোর , সেই মত্যুঞ্জয়, সে আমার প্রেম। তারে আমি রাখিয়া এলেম অপরিবর্তন অর্ঘ তোমারি উদ্দেশে। পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে কালের যাত্রায় – হে বন্ধু ,বিদায়।' এই পর্যন্ত এসে হঠাৎ ছন্দপতন। আবৃত্তি করতে করতে সাগর চৌধুরী চুপ করে যায়। মনে হচ্ছে যেন ভুলে গেছে। বিহ্বল মুখে মঞ্চের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা যেন স্তব্ধতর হয়ে উঠেছে। একি অবাক কান্ড! সাগর চৌধুরী আবৃত্তি ভুলে গেছে? যার রোমে রোমে আবৃত্তি! যে প্রতিটি মুহূর্ত কবিতার সাথে যাপন করে, সেই আবৃত্তিকার সাগর চৌধুরীর কবিতা বিস্মৃতি? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বন্যা ভাবে এতবছর পরে ‘শেষের কবিতা’ করছে বলে হয়তো সাগরের সাময়িক বিস্মৃতি হয়েছে। কয়েকটা সেকেন্ড... তাকে কে যেন ভেতর থেকে ঠেলে তুলে দেয়। সে আর সময় নষ্ট করে না, সাগরের তাৎক্ষণিক বিমূঢ়তা কাটানোর জন্য সাবলীল পদচারণায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে। যেন সে অপরিহার্য ছিল। সাগরের আকস্মিক বিপর্যয় কাটাতে সুললিত কন্ঠে শুরু করে- ‘তোমার হয়নি কোন ক্ষতি। মর্তের মৃত্তিকা মোর , তাই দিয়ে অমৃতমুরতি যদি সৃষ্টি করে থাকো.. তাহারি আরতি হোক তব সন্ধ্যাবেলা- পুজার সে খেলা ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লাণস্পর্শ লেগে, তৃষার্ত আবেগ বেগে ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবেদ্যের থালে তোমার মানস ভোজে স্বযত্নে সাজালে যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়- তার সাথে দিবো না মিশায়ে যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে আজও তুমি নিজে হয়ত বা করিবে রচন মোর স্মৃতিটকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমারি বচন ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়- হে বন্ধু বিদায়। দু’জনের আবৃত্তির মেলবন্ধনে সারা হল হাততালিতে ফেটে পড়ে। এমনভাবে পুরো ব্যাপারটা দর্শকদের চোখের সামনে হয়, যেন সেটা একটা নাটকের অংশ। পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। সাগর তখন বন্যার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। প্রাথমিক বিমূঢ়তা কাটিয়ে একটু শান্ত হয়ে বন্যা অনুরাগ জড়ানো কন্ঠে আস্তে আস্তে সাগরকে বলে- "তুমি যে কথা দিয়েছিলে আর কখনোও শেষের কবিতা একা করবে না?" দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে সাগর উত্তর দেয়, "করিনি তো!" বিহ্বল বন্যা বলে, "তবে?" সাগর অর্থপূর্ণ হাসি নিয়ে বলে, "আমি তো বলেছিলাম তোমাকে ছাড়া কখনোও ‘শেষের কবিতা’ করবো না। তুমি সঙ্গে থাকলে আরোও অনেকবার করবো, বন্যা।" বিস্ময়াবিষ্ট বন্যা বলে, "তার মানে? তুমি জানতে, আমি এখানে আছি? আর ভুলে যাওয়াটা তোমার ছলনা? অভিনয়?" সাগর কৌতূক করে উত্তর দেয়, "একজন পদ্মভূষণ পাওয়া অভিনেতার কাছে এই অভিনয়টুকু করা কি সত্যই খুব কঠিন কাজ, বন্যা?" আর তোমার সব খবর রাখাটাও এমন কিছু শক্ত কাজ নয় । তাছাড়া, তোমার খবর রাখাটা আমি কাজ মনে করে করিনি – প্রাণের-মনের টানেই করেছি। ছদ্মকোপে বন্যা বলে, "তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ রাখনি কেন? আমি তো ভেবেছি, এত নাম, যশ পেয়ে তুমি আমাকে ভুলেই গেছ।" আহত কন্ঠে একরাশ অভিমান নিয়ে সাগর বলে, "তোমাকে ভুলে যাওয়াটাই তো সবচেয়ে কঠিন কাজ। এতবছর সাধনা করেও আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি, আর ভুলবো কেন? তুমি তো আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তাছাড়া তুমি কি আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছো বন্যা? তুমি আমাকে এতটা দীন ভাবলে কী করে যে, তোমার জীবনে দৃপ্ত এসেছে বলে আমি তোমাকে ভুল বুঝব? আমি এতটা সংকীর্ণমনা নই। আর ‘শেষের কবিতা’ আমি ভুলব কী করে? এই কবিতা তো আমার 'জীবনের কবিতা' হয়ে গেছে। আমার জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।" বন্যা চুপ করে থাকে। অনেক হাতড়েও কোন উত্তর খুঁজে পায়না। এরপরে সাগর একটা লাল ভেলভেটের বাঁধানো খাতা বন্যার হাতে তুলে দেয়। তার উপরে সোনালী রঙে লেখা ‘অন্তহীন’। মঞ্চে ওঠার সময় সে খাতাটা সঙ্গে নিয়ে উঠে ফুলদানী রাখা টেবিলে সযত্নে রেখেছিলো। বন্যাকে বলে,"এই কুড়ি বছরে তোমার প্রতিটি জন্মদিনের উপহার হিসেবে তোমার জন্যে একটি করে কবিতা এই খাতায় লেখা আছে। আজ তোমাকে দিয়ে আমি দায়মুক্ত হলাম বন্যা।" বন্যার মুখে তখন বিস্ময়, খুশী, রাগ, অভিমান... সব অভিব্যক্তিগুলো একসাথে খেলা করছে। দর্শক এতক্ষণ তাদের মৃদুস্বরে কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারছিল না কিন্তু দুজনের কন্ঠে ‘শেষের কবিতা’ শুনে তাদের হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। সাগর এবার তাদের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে আবৃত্তি করে- ‘তব অন্তর্ধানপটে হেরি তব রূপ চিরন্তন। অন্তরের অলক্ষ্যলোকে তোমার অন্তিম আগমন। লভিয়াছি চিরস্পর্শমণি আমার শূণ্যতা তুমি পূর্ণ করি গিয়েছো আপনি, জীবন আধার হল সেইক্ষণে পাইনু সন্ধান। সন্ধ্যার দেউল দ্বীপ , চিত্তের মন্দিরে তব দান। বিচ্ছেদের হোমবহ্নি হতে পূজামূর্তি ধরি প্রেম, দেখা দিল দুঃখের আলোতে।’ সাগরের কবিতা শুনে বন্যার মনের থেকে এত বছরের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে গেছে। আজ সে অনাবিল আনন্দে পরিপূর্ণা। বন্যা কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকার পক্ষ থেকে রাখা একগোছা লাল গোলাপ তাদের প্রধান অতিথি সাগর চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে- ‘তোমারে যা দিয়েছিনু, তার পেয়েছো নিঃশেষ অধিকার। হেথা মোর তিলে তিলে দান, করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান। হৃদয় অঞ্জলী হতে মম, ওগো তুমি নিরূপম, হে ঐশ্বর্যবান তোমাতে যা দিয়েছিনু তা তোমারি দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু বিদায়।’ সাগর স্মিত হাস্যে মাথা নত করে রাজকীয় ভঙ্গিতে অভিবাদন করে। আস্তে আস্তে মঞ্চের পর্দা নেমে আসে। বি: দ্র: রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর রচিত 'শেষের কবিতা' থেকে অনুপ্রাণিত, এবং কিংবদন্তী সেরিব্রাল অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছায়া অবলম্বনে।
Facebook Comments