Site Overlay

জ্ঞাতির গুঁতোয়, বাংলা লুটোয়!

স্বাধীন সরকার

শীতের ঝিমধরা দুপুরে ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলাম | সামনের আসনে জনা কয়েক তরুণ বঙ্গসন্তান বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ৷ কথোপকথনটা বাংলার মতন শোনালেও ঠিক যেন বাংলা না ৷ অনেকটা এই রকম:

১ম জন: দ্যাখ আমার মনে হয় তোর আর প্রিয়াঙ্কার ব্যাপারটা এবার তোদের বাড়ীতে বলে দেওয়া উচিত ৷  কেন কি, এইভাবে তো একদিন না একদিন ধরা পড়বিই ৷

২য় জন: যা বলেছিস!আরে ইয়ার, আমি তো শূকর মানালাম যে বাবা ওই টাইমে ঘরে ঢোকে নি ! দেখলে যে কি হতো! 

৩য় জনঃ আরে তাই তো তোকে বার বার বলছি, কিন্তু, তুই তো আমার কথায় ধ্যানই দিচ্ছিস না ৷ বাবাকে বলে একটা দিন দেখে প্রিয়াঙ্কার গলায় মালা ডেলে দে ৷

২য় জনঃ অতো সোজা না ভাই ৷ বাবাকে যদি বলি, আর যদি শুনে রেগেছে, তো এমন পিটবে না, যে পিঠের দাগ জিন্দেগীতে মিটবে না ৷

১ম জনঃ এত যদি ভয় পাচ্ছিস তো ভাঁড় মে যা ৷

২য় জনঃ হা হা ৷ আচ্ছা চল ৷ স্টেশন ঢুকছে নামতে হবে ৷

৩য় জনঃ ঠিক হ্যায় ৷ চলো ৷ বাকী কথা কাল হবে ৷

দ্বিতীয় জনের সাথে আমিও স্টেশনে নামলাম ৷ এটি আমারও গন্তব্য | স্টেশনের একটা চা-এর দোকান থেকে চা নিয়ে দুচুমুক দিতে থাকলাম মাথাটা হাল্কা করার জন্য ৷ একটু আগের সহযাত্রীদের কথোপকথন শোনার পর থেকে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অসোয়াস্তিজনক নানা চিন্তা মগজে গুলিয়ে উঠছিল ৷ সদ্য অতীত বিকট কথোপকথনটা নিয়ে মনের মধ্যে জাবর কাটতে লাগলাম ৷ 

হিন্দির “ শুক্র্ মানাও”, হয়ে গেছে “ শূকর মানা”! বক্তার মনেও আসেনি যে শূকর মানে বাংলায় একটি আবর্জনা ঘাঁটা পশুকে বোঝায় ! বক্তার মনে কোন যথাযথ বাংলা শব্দও যোগায় নি ৷ সে বলতে পারল না যে “ কপাল ভালো, যে বাবা আসেনি” ৷ সেই রকম “ কিঁউ কি” হয়ে গেছে “ কেন কি” ৷ বাংলায় যার কোন অর্থ হয় না ৷ হিন্দিতে ” মিটানা” মানে মুছে দেওয়া হয| কিন্তু বাংলায় আমরা কাজ “ মিটাই”, “ ঝগড়া মিটাই ” ৷ দাগ কি করে “মিটাই ” কে জানে! আবার “ এতো যদি ভয় পাচ্ছিস …” এই ধরণের বিজাতীয় বাক্য গঠন যেন সরাসরি হিন্দির “ আগর মগর” দিয়ে কথার আক্ষকরিক তর্জমা | বড়ই শ্রুতি কটু ৷ “ পড়িয়ে দেওয়া”  হয়ে গেছে “ডেলে দেওয়া” ৷  সব শেষে “গোল্লায় যাওয়া ” হয়ে গেছে “ ভাঁড় মে” যাওয়া , আর “ ঠিক আছে ” ঠিক না থেকে হয়েছে “ ঠিক হ্যায়”!

তবে এই ধরনের বাংলা খুঁজে না পেয়ে হিন্দি হাতড়ানোর উদাহরণ ভুরি ভুরি – বাসে, পথে, বাংলা মেগাসিরিয়ালে, এফ এম চ্যানেলের উপস্থাপকের জগাখিচুড়িতে, হিন্দি বিজ্ঞাপনের এবং কেন্দ্র সরকারের বিজ্ঞাপ্তির জঘন্য বাংলা তর্জমায় – কোথায় না নেই ! হায়রে মধু কবি, তুমি বলেছিলে , “ হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন”! অথচ আজ হিন্দির ‘ওভারডোজে’ বাঙালীর ভাষাটাই গুলিয়ে গেল ৷ 

এমনিতে বাঙালীর মূদ্রাদোষ কথায় কথায় ইংরাজী ব্যবহার করা ৷ আমরা “ দুশ্চিন্তা কোরো না “ না বলে, বলি “ টেনশন কোরো না” ৷ “ বাঁ দিকে” না বলে বলি “ বাঁ সাইডে” ৷ কিন্তু, এসবেও বাংলা ভাষার স্বাভাবিক প্রকৃতি বোধ হয় খুব বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি ৷ সব থেকে বড় কথা, বক্তা এক্ষেত্রে চেতনে বা অবচেতনে জানেন যে তিনি একটা বিদেশী শব্দ দিয়ে বাংলার একটি শব্দকে প্রতিস্থাপিত করছেন ৷ কিন্তু হিন্দির ক্ষেত্রে সমস্যা হল, বক্তার সেই বোধটাই আদৌ হয়তো কাজ করছে না ৷ বক্তা তার ভাষাটা হারিয়ে বিজাতীয় বাক্যগঠন, শব্দচয়ণ করছেন সেটাকে তার নিজের ভাষা ভেবেই ৷ বহু ক্ষেত্রে হিন্দির যে শব্দটি বাংলায় বসানো হল, দেখা যাবে সেইটির একটি সম্পূর্ণ অন্য অর্থ হয় বাংলায় ৷ যেমন, হিন্দিতে “ ভাঁড়  মে যাও” -এর ভাঁড়ে আমরা দই মিষ্টি খাই ; যাই না; হিন্দিতে লোকে মনযোগ দেবার জন্য, গুরুত্ব দিয়ে শোনার জন্য “ ধ্যান দেয়” – আমরা ধ্যান করি সাধনার জন্য ৷

বিপদটা  বড় বেশী বোধ হয় এই কারণে যে, ভাষা বিজ্ঞানের দিক দিয়ে হিন্দি আসলে বাংলার জ্ঞাতি ভাই – একই আদি ভাষার অপভ্রংশ ৷ দুই ভাষার কিছু কিছু আপাত মিলের কারণে এবং প্রচারমাধ্যমের বিপুল শক্তিতে বলীয়ান হয়ে হিন্দি তাই অতি সহজেই বাংলা ভাষার মর্মস্থলে এক সাংঘাতিক দুষ্টক্ষতের মতন বাসা বেঁধেছে তীব্র মধুমেহতে ভোগা শরীরে  কর্কট রোগের মতো৷ সে এমনই সাংঘাতিক অবস্থা যে রুগী মধুমেহর তীব্রতায় যন্ত্রণা অনুভব করে না, কিন্তু দুষ্টক্ষত কুরে কুরে গোটা শরীরটা ধ্বংস করে ৷ হিন্দির প্রকোপে আমার বাংলা ভাষাও হয়তো নিঃশব্দ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে, কারণ বাংলা ভাষার শরীরটাই আজ বিপন্ন ৷ বাংলাকে কবন্ধ করে যেন হিন্দির মুখ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ৷ জুড়ছে বাঙালীরাই ৷ কারণ ওই যে, মধুমেহে আচ্ছন্ন …

আসলে,  জ্ঞাতি শত্রু বড় বিষম বস্তু ৷ভুরি ভুরি এরকম উদাহরণ আছে যেখানে কোন এক জ্ঞাতি, যাঁকে সারাক্ষণ ঘরের পাশেই পরম প্রত্যয়ে ঠাঁই দিয়ে রাজামশাই নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করেছিলেন, সেই তিনিই সটান এমন ঘটনা ঘটালেন যে কখনও গোটা রাজবংশই উজাড় হয়ে যায়, তো কখনও একটা পেল্লাই যুদ্ধ শুরু হয়ে মহাকাব্যিক রক্তারক্তি কাণ্ড হয় ৷ কখনওবা একটা জাতির ইতিহাসের গতিই পাল্টে যায়! পলাশী কিংবা পৃথ্বিরাজ, রামের বনবাস, রাবণের সর্বনাশ, দুর্যোধনের বুদ্ধিনাশ, প্রতাপাদিত্যের পরাভব – কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? আর শুধু রাজা-বাদশা, পুরাণ-ইতিহাসই বা কেন? আশপাশে   ঘাড় ঘুরোলেই তো দেখা যায় জ্ঞাতিতে জ্ঞাতিতে লাঠালাঠিতে ব্যবসা গুটিয়ে যাচ্ছে, সংসার ভাঙছে, এমনকি সময়ে অসময়ে প্রাণও চলে যাচ্ছে৷

মানুষের যেমন প্রাণ আছে, সেই মানুষ নিয়ে তৈরী একেকটা জাতিরও জীবন আছে, উত্থান-পতন, জয়-ক্ষয়-লয় আছে ৷ আর জাতির জীবনের কেন্দ্রে থাকে সেই জাতির মুখের ভাষা৷ তার বিমূর্ত শরীর আছে – প্রাণ আছে – জন্ম আছে – মৃত্যু আছে৷ ভাষা বিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলা সহ আজ ভারতের বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরে যত ভাষায় মানুষ কথা বলে, তারা সকলেই সহস্রাধিক কাল আগে থেকে সংস্কৃত এবং পালি ভাষার বিবিধ অপভ্রংশ থেকে বিবর্তিত হতে হতে আজকের রূপ লাভ করেছে ৷ বলতে গেলে এই ভাষাগুলি সকলেই সহোদর, কিন্তু নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে এবং ঐতিহ্যে ঋদ্ধ৷ অতত্রব এদের  ‘জ্ঞাতিভাষা’ বলার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই৷ এই জ্ঞাতিদের মধ্যে বয়সে বেশ নবীন হল হিন্দি ভাষা। যেটি মূলতঃ দেবনাগরী হরফে হিন্দুস্থানী ভাষা৷ এ হিন্দুস্থানী ছিল মূলতঃ মুঘল দরবারের  আশপাশের একটি বিস্তীর্ণ এলাকার আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যম৷ কিন্তু, স্বাধীনতার পর দিল্লিকেন্দ্রিক উত্তর ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর দাপটে বয়সে নবীন হিন্দি ভাষাকে শাসকের আলালের দুলাল বানিয়ে বহুভাষিক এই ভারতের অন্য ভাষাগুলির স্বীয় ঐতিহ্যের কার্যত অমর্যাদা করেই চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে ৷ এর পেছনে মদত দিচ্ছে উত্তর ও পশ্চিমের ব্যবসায়ী পুঁজিতে পুষ্ট অধিকাংশ বড় প্রচারমাধ্যম এবং মায়ের মুখের ভাষার প্রতি বাঙালীর অবহেলা | স্বাধীন ভারতে, বিশেষতঃ বাংলায়, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের একধরনের ছদ্ম অর্থনৈতিক উপনিবেশ ধীরে ধীরে যে ভাবে গড়ে উঠছে, তারই অবধারিত ফলশ্রুতি  হল এই ভাষা উপনিবেশ৷ 

এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাত খেয়াল হল, চা-এর কাপ  ফাঁকা হয়ে গেছে ৷ ডাস্টবিনে কাপ ফেলে দাম মিটিয়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটা দিলাম স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরার জন্য ৷ হঠাত দৃষ্টিপথে বিষম হোঁচট খেলাম ৷ দেখি প্রতিবন্ধী কামরার  প্লাটফর্মের নির্দিষ্ট অংশে  ভারত সরকারের রেল দপ্তর গোটা গোটা বাংলায় লিখে রেখেছেন “ দিবাং” ৷ আমি তো কোন ছাড়, আমার উর্দ্ধতন চতুর্দশ পুরুষ এই  শব্দ বাংলায় শুনেছেন কি না জানিনা ৷ মাথা চুলকে দেখি সরকার বাহাদুর “বিকলাঙ্গ্” -এর বদলে হিন্দিতে “ দিব্যাঙ্গ্” চালু করেছেন ৷ সরকার বাহাদুর এর উপযুক্ত কোন বাংলা প্রতিশব্দ খোঁজার প্রচেষ্টাকে বোধহয় নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করে চটজলদি বাঙালীকে “দিবাং” গিলিয়েছেন ৷ আমরাও নির্বিবাদে গিলছি – হয়তো বুঝে, হয়তো না বুঝে ৷ কোন ভ্রূক্ষেপ নেই – প্রতিবাদ নেই ৷

বাঙালী, তোমার মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা নিঃশব্দ মারা যাচ্ছে, বুঝতে পারছ? অন্ততঃ ভবিষ্যতের কাছে জবাবদিহি করতে পারো, এমন একটা সৎ চেষ্টা কর ৷ সময়ের স্রোতে তোমার সম্ভ্রম নিঃশেষ হয়ে চলেছে ৷

রুখে দাঁড়াও! 

Facebook Comments