Site Overlay

প্রায়োরিটি

দেবব্রত দাশ

   “ভালোই হল, মা-বাবা দুজনেই একসঙ্গে আছেন এখন,” মাণ্ডভী যেন অকূল দরিয়ায় কূল পেল, “অনেকদিন ধরেই বলব বলব করছিলাম, আজ উপায় একটা বের করতেই হবে, নাহলে…”

   “কীসের উপায় বউমা ?”  কথা শেষ করতে না-দিয়ে জিজ্ঞেস করেন বনবীথি ।

“বলছি মা — আপনাদের একরত্তি নাতির দস্যিপনা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে-কথা ।”

“কেন…! কী করেছে বুবাই সোনা ?”

“নিত্যনতুন বায়না ! আজ তো আমি একেবারে জেরবার ! না মা, আমরা দুজনেই চাকরি করি…এখন নাহয় আমি ক’দিন ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে, এমন দৌরাত্ম্য যদি রোজ রোজ চলতে থাকে, তবে সামলাতে পারবেন না বাবা আপনি । আর মা— আপনার শরীরের যা হাল, তাতে তো…”

“আসল কথায় এসো বউমা,” অধৈর্য হয়ে বলেন আদিনাথ ।

“বুবাইয়ের আজকের বায়না অভিনব ! কী ?— না — ঠিক মতো ভাত-মাখা হচ্ছে না, তাই খাবে না !” 

“কীরকম চাইছে ?” চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেন আদিনাথ, “ও কি আরও শুকনো করে মেখে দিতে বলছে ?”

 “না বাবা, বলছে — ভাত খুব শক্ত, টিপে টিপে আরও নরম করে দাও ।”

 “ওই একই হল…স্রেফ বাহানা !” মুচকি হেসে মন্তব্য করেন আদিনাথ, “বাকিটা আমি বলে দিতে পারি বউমা ।”

 “মানে ?”

“মানেটা খুবই সহজ । আসলে, বুবাই আশ্রয় খুঁজছে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তো…সেজন্যেই এরকম বিদঘুটে সব বায়না । তুমি ভাবছ, আমার এমন ধারণার কারণ কী, তাই  তো ? আমি ভুক্তভোগী কিনা…” আদিনাথ গুছিয়ে শুরু করেন, “খুব ছোটো বয়সে আমি মাকে হারিয়ে যখন মানুষ হচ্ছিলাম আমাদের যৌথ পরিবারে স্নেহপরায়ণা এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ার তত্ত্বাবধানে, তখন প্রায়ই এই ধরনের সব বিটকেল বায়না করে জ্বালিয়ে খেতাম তাকে । চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলে…যেমন হয়েছে অনেকবার…ভাত শুকনো করে মেখে দেওয়া যখন কিছুতেই আর হয়ে উঠত না, তখন শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে অব্যাহতি পেত ওই মাসি…আমি মাসি ডাকতাম ওকে।”

  “শেষ অস্ত্র ! — সেটা আবার কী বাবা ?”

“মাঝবয়সি ওই মাসির ছিল হরেকরকম কাজের জন্যে নোড়ার আকারের শক্তপোক্ত ভারী কাঠের টুকরো, যার নাম ‘খেটে’। মাসি ‘খেটে’-টা হাতে তুলে নিয়ে বলত — আর যদি বায়না করিস খোকা, তবে এটা দিয়ে নিজের মাথায় বাড়ি মেরে এক্ষুনি মরে যাব আমি…ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে জোঁকের মুখে নুন । লক্ষ্মী ছেলের মতন হাঁ করে আমি ভাতের গেরাস নিয়ে নিতাম মুখের ভেতর । বড়ো হয়ে বুঝেছি, মাসি ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুন সেভাবে সঙ্গ দিতে পারত না আমায়, পারত না সদাব্যস্ত বাবাও । তাই একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় আমি ভুগতাম সারাক্ষণ ।”

   “আপনি কী করতে বলছেন তাহলে আমায় বাবা ?”

“যদি চাও — বুবাইয়ের সুস্থ মানসিক বিকাশ ঘটুক, তবে উদাসীন না-থেকে তোমরা মা-বাবা দুজনেই কিছুটা অন্তত সময় ওকে দাও…প্রায়োরিটি, সঠিক সময়ে সঠিক প্রায়োরিটি জীবনের প্রতিপদে প্রয়োজন । তুমি চাকরি বহাল রাখার জন্যে লিয়েন নিয়ে বাড়িতে থাকো কিছুদিন । বুবাইয়ের এই বয়সে তোমার সঙ্গ পাওয়াটা কিন্তু খুবই জরুরি — বুঝলে বউমা…আর আমরা দাদু-ঠাকুমা তো আছিই পরিপূরক হিসেবে ।”

 এক সপ্তাহও পার হল না, মাণ্ডভী তার শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে এসে হাজির, “না সম্ভব নয় । মা বাবা — আপনাদের দুজনকেই বলছি…”

  “কী সম্ভব নয়, সেটা তো বলো বউমা !”

“লিয়েন নেওয়া সম্ভব নয়, চাকরি ছাড়ার তো প্রশ্নই নেই ।”

 “তাহলে ? আদিনাথের ভ্রূ-যুগল কুঞ্চিত হয়ে ওঠে, “এরকম ভাবেই ছেলেটা…”

  “বুবাইয়ের জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা করেছি বাবা,” অপরাধী অপরাধী মুখ করে মাণ্ডভী বলে, “ও ক্রেশ-এ থাকবে কিছুটা সময় মানে যতক্ষণ না আমি অফিস থেকে ফিরব,ততক্ষণ।”

 “ক্রেশ !” আঁতকে ওঠেন দুজনেই — আদিনাথ এবং বনবীথি ।

  বুবাই মুখ চুন করে বসে মা’র কথা শুনছিল । বনবীথি সোফা থেকে উঠে গিয়ে বুবাইকে কোলে তুলে নিয়ে প্রায় নির্দেশের সুরে বললেন “তুমি অফিসে যাও, যেমন যাচ্ছ…এখন থেকে যত কষ্টই হোক না কেন বউমা, তোমার অনুপস্থিতিতে বুবাইয়ের দেখভালের দায়িত্ব নিলাম আমি । আমি ওকে সঙ্গ দেব মায়ের মতন ।

Facebook Comments