Site Overlay

আগমনী

পূজা মৈত্র

ছুটির ঘন্টা পড়তেই লাফিয়ে উঠলো ক্লাসের সবাই। পুজোর ছুটি পড়ছে, আজকে থেকেই। সবাই আজকে ইউনিফর্ম ছাড়া এসেছিলো, রঙিন জামাকাপড়ে। সবারই পূজার নতুন জামা কেনা হয়ে গেছে। প্রবাহর হয়নি। ও একটা পুরনো জামাই পরে এসেছিলো তাই। ক্লাস সেভেন ওর। ওর ভাইয়ের ক্লাস ফাইভ। প্রমিত ওর নাম। ভাইয়েরও নতুন জামা কেনা হয়নি। বাবার কিনতে যাওয়ার সময় হয়নি – তাই। বাবা শহরের কলেজেই পড়ান, অধ্যাপক। সারাদিন কলেজ, সেমিনার, এন জি ওর কাজ, বাড়িটাকে ওদের দুইভাইকে – একা সামলানো, সময় কোথায় পাবে? 

প্রবাহ এসব বুঝলেও ভাই বোঝেনা। আজ স্কুলে ওরা ছাড়া সবাই নতুন জামা পরে যাবে যখন বুঝলো, তখন বাবার সামনেই প্রথমে চেঁচামেচি, জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি – পরে কান্নাকাটি করেছে। বাবা বলেছিলো গতকাল সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ফিরে নিয়ে যাবে ওদের দুজনকে। কিনে দেবে জামা। ফিরলোই রাত দশটায়। এনজিওর মিটিং ছিলো কাল। পুজোয় দুঃস্থ বাচ্চাদের জামাকাপড়, খেলনা দেওয়া নিয়ে। বাবা এনজিওর পদে আছে। সেক্রেটারি। সন্ধ্যায় যে সেই মিটিং-টা আছে ভুলেই গিয়েছিলো প্রবাহদের কথা দেওয়ার আগে। মিটিং-এ বসে বাড়ি ফেরার কথাও ভুলে গিয়েছিলো। কতজন বাচ্চাকে দেওয়া হবে, খরচ খরচা কত, কোথায় দেওয়া হবে – মস্ত হিসাব। প্রবাই ভাইয়ের কথাতেই সাড়ে আটটার দিকে বাবাকে একটা ফোন করেছিলো ওদের কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইন থেকে। বাবা ধরেনি।

বাবা ভাইয়ের এমন কান্না দেখে ভারী অপ্রস্তুত হয়েছিলো। কষ্ট হচ্ছিলো বাবার। প্রবাহ বাবার চশমার আড়াল থেকেও দেখতে পেয়েছিলো বাবার চোখেও জল চিকচিক করছে। প্রবাহ ভাইকে বুঝিয়ে বাবার সামনে থেকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো। বাবা এমন কাজপাগল, এমনই সব ভুলে যায় কাজের মধ্যে ঢুকলে। বারো বছর বয়সে এটুকু বুঝেছে প্রবাহ। তা বলে বাবা ইচ্ছা করে এমন করেছে তা নয়। বাবা ওদের জামা কিনে দিতে চায়নি, তা নয়। বাবা ওদের ভালোবাসেনা তা-ও নয়, কিন্তু এই কথাগুলো ভাইকে বোঝাতে পারে না। ঘরে নিয়ে গেলেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছিলো বোকাটা সারাক্ষণ। প্রবাহই বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর এক সেট প্রায় নতুন জামা বার করে ইস্ত্রি করে রেডি করে দিতে তারপর চুপ করেছে। জামাটা মাত্র একবার পরা হয়েছিলো, কোন একটা বিজ্ঞান মঞ্চের অনুষ্ঠানে। বাবার সাথে গিয়েছিলো ওরা দুই ভাই। ওদের বেড়াতে যাওয়া বলতে এগুলোই। বাবার সেমিনার, বাবার অনুষ্ঠান। প্রবাহর ভালোই লাগে সেসব। ভাই পছন্দ করে না, বিরক্ত হয়, উসখুশ করে ওখানেও। ফেরার পথেও সারা রাস্তা বাবাকে এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও বলে বিরক্ত করে। বাবা বিরক্ত হচ্ছে বুঝেই প্রবাহ ভাইকে থামাতে চায়। ওর কাছে ভাইকে ভোলানোর জন্য কিছু না কিছু থাকেই। কখনো লজেন্স, কখনো চকোলেট, কখনো কমিকসের বই দিয়ে থামিয়ে দেয়।

বাবা আগে চুপচাপ ছিলো, দিনে দিনে আরও চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। আগেও কাজ করতো, এখন যেন কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝেই না। প্রবাহ বারবার ভাইকে বলে বাবার সামনে বেশি না রাগ দেখাতে, বেশি না ভাঙচুর করতে, কান্নাকাটি তো নয়ই। বাবা এতে রেগে যায়। ওদের দুইভাইয়ের উপরে নয়, নিজের উপর। সবটা গুছিয়ে করার কথা ভাবে সবসময় বাবা। যেমনটা আগে হতো, মা থাকতে। চেষ্টাও করে সেরকমটা করার। অথচ পারে না, কাজে আটকে যায়, ভুলে যায়। তাতে ভাই রাগ দেখালে কি কাঁদলে বাবার কষ্ট হয়। নিজের উপরেই রাগ হয়। তারপর বাবা সারারাত ঘুমোয় না। নিজের ঘরে জেগে বসে থাকে, কাজের বাহানায়। প্রবাহ প্রায়ই দেখে এটা। বাবাকে ডাকতে চায়, ডাকতে পারে না। 

রিকশা করে ফিরতে ফিরতে ভাই বললো, “মা কবে আসবে রে, দাদা?” 

ওদের স্কুলের থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশ খানিকটাই। বেশির ভাগেরই বাড়ি থেকে কেউ না কেউ আনতে যায়। যাদের যায় না তাদের স্কুল গাড়ি আছে। অনেকে মিলে ভাড়া করে নেওয়া ম্যাক্সি ক্যাব। ভাই-ও চায় ক্যাবে যেতে। সবার সাথে মজা করতে করতে যাওয়াও হবে আবার তাড়াতাড়িও ফেরা হবে। ওদের স্কুল থেকে কলেজ রিকশায় যেতে অনেকক্ষণ লাগে। বাবা ওদের ক্যাবে দেবে না, জানে প্রবাহ। তাই ভাইকে জেদ করতে মানা করে। রিকশায় যেতে যেতে অনেক গল্প বলে ভাইকে, ভুলিয়ে রাখে। 

“মা? চলে আসবে,  পুজো তো এসে গেলো।”

“আজ চতুর্থী, কাল পঞ্চমী, আগেরবার পঞ্চমীতে এসেছিলো, না?” প্রবাহ অন্যদিকে তাকায়।

“না, ষষ্টী…”, “চল, এক কাজ করি।” ভাইয়ের কথায় তাকালো প্রবাহ, নিশ্চয় কোন অবাস্তব আর ছেলেমানুষির কথা বলবে ভাইটা।

“কী, শুনি?”

“বাবাকে বল – এবার আমরা মায়ের কাছে যাই? পুজোর ছুটিতে?”

প্রবাহ একটু ভাবে, “মায়ের স্কুল যেখানে সেটা কতদূর, জানিস?”

“জানি তো, বাবা মাকে ফোন করে দিক – আমরা কাল সকালে বেরোলে মায়ের কাছে কাল রাতেই চলে যাবো, মাকে আর কষ্ট করে ট্রেনে উঠে আসতে হবে না এতোটা, যাবি?”

“কে কে?”

“তুই আর আমি।” প্রমিত হাসি মুখে দাদার দিকে তাকায়।

প্রবাহ বলে, “আর বাবা?”

“বাবার তো কাজ সারা পুজোয়, শুনলি না কাল ফোনে বলছিলো? কত পুজো পরিক্রমাতে যাবে, কত বাচ্চাদের জামা দেবে – বাবা এখানেই ভালো থাকবে।”

প্রবাহ জানে সেটা। বাবার সারা পুজোয় সময়ই হবে না ওদের জন্য। কলেজের সামনের বারোয়ারিটায় ওদের দুইভাইয়ের পুজো কাটে। মা ষষ্টীতে আসে, মা পুজোর ভিড়ভাট্টা, সাজগোজ, ঘোরাবেড়ানো একদম পছন্দ করে না। বাড়িতেই থাকে সারা পুজো। লক্ষ্মীপুজো অবধি থাকে মা। তারপর চলে যায়। মায়ের প্রচুর প্রোগ্রাম পড়ে যায় তখন, গানের। মা দারুণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। কলকাতাতেও নানা মঞ্চে গান গায় মা। যে ক’দিন ওদের কোয়ার্টারে থাকে, মায়ের গুণগুণ চলতে থাকে কাজের ফাঁকে। প্রবাহর ভীষণ ভালো লাগে, পুজোমন্ডপে যেতেই ভালো লাগে না ওর। নেহাত ভাইকে সঙ্গ দিতে যেতে হয়, মা থাকলে সারাবাড়িটাই অন্যরকম লাগে। কোয়ার্টারটাই পুজো পুজো মনে হয়। 

“না, না ভাই। ওভাবে হয় নাকি। বাবা একা থাকবে, পুজোতে?”

“বাবারই তো ভালো, কিচ্ছু মনে রাখতে হবে না। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে না। কাজ করতে পারবে।”

“মা-ও তো চায় পুজোয় এখানে আসতে।” ছোট্ট করে বললো প্রবাহ। যদিও জানে কথাটা ঠিক না। মায়ের আসতে হয় – ওদের কথা ভেবে। ওদের উত্তরবাংলার মফঃস্বল আর মায়ের কলকাতা পেরিয়েও আরো দক্ষিণের স্কুলের ঠিকানার মধ্যে বহু মাইল দূরত্ব। প্রায় একদিন লাগে যেতে। তবুও মা-বাবা কেউই দূরত্বটা কমাতে চায় না। এভাবেই মনে হয় ভালো থাকে ওরা – একে অপরের থেকে দূরে। নাহলে ট্রান্সফার তো হয়। প্রবাহ খবরের কাগজে পড়ছিলো সেদিন। উৎসশ্রী না কি তার মাধ্যমে তো বাড়ির কাছের স্কুলেই চলে আসছে সবাই। মা কি তা চায় না? নাকি মায়ের বাড়িই এটা নয়। কলকাতার দাদুর বাড়িটাই মায়ের বাড়ি হয়তো এখনো, ওখানে গান আছে, মঞ্চ আছে, অনুষ্ঠান আছে, আলো আছে – মা খুশি তাতেই। প্রবাহ আর প্রমিত নেই। তাতেও খুশি। নাকি বাবার থেকে দূরে বলে খুশি? প্রবাহ ভাবে কিন্তু উত্তর পায় না।    

ভাই যে রাতে বাবার সামনেই মায়ের কাছে যাবো বলে জেদ ধরে বসবে ভাবেনি প্রবাহ। বাবা এনজিওর প্রোগ্রাম করে সবে ফিরছিলো। বেশ দূরেই একটা গ্রামে গিয়েছিলো বাবা আর এন জি ওর কাকুরা, বাচ্চাদের জামাকাপড় নিয়ে। ফিরে বাবা ব্যাগ রেখে জুতো খুলতে না খুলতেই ভাই বলেছিলো, “কাল মায়ের কাছে যাব, আমি আর দাদা। পুজোতে ওখানেই থাকবো। টিকিট করে দাও। মাকে বলে দাও।,”

বাবা আকাশ থেকে পড়েছিলো, “এখন? টিকিট হয় নাকি এতো তাড়াতাড়ি? তাছাড়া মা তো আসছেই, পরশু। পরশু ষষ্টী না?”

“আমি জানি হয়। তৎকালে। তুমি মা’কে ফোন করো এখনই।” প্রবাহ ভাইয়ে থামাতে চেয়েছিলো। বাবা রেগে যাচ্ছে, বুঝতে পেরেছিলো ও। বাবা রেগে গেলেও সামলে নেয় বেশির ভাগ দিনই। ভাই জেদ করলেও বকে না, মারে না। কিন্তু বছরে এক দু’দিন ভীষণ রেগে যায় বাবা। তখন হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়েই মারে। ভাইকে মারতে গেলে ভাই পালিয়ে যায়। ছুটে বেড়ায় সারা কোয়ার্টার। বাবা ভাইয়ের পিছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে যায়। প্রবাহকে হাতের কাছে পায় তারপর, ওকেই ধরে। ভাইয়ের সমস্ত রাগ ওর উপরেই তোলে বাবা। ভুলে যায় কাকে বকছে, কে জেদ করছিলো, কাকে মারতে হবে।    

আজকেও তাই হলো।

“মা ব্যস্ত, প্রোগ্রাম আছে। আর কাল তো ট্রেনে উঠছেই।” বাবার বলাও সারা ভাইয়ের ডাইনিং টেবিল থেকে গ্লাস ছুঁড়ে ফেলাও সারা।

“ভাই এমন জেদ করিস না, মা আসছে তো, কালই ট্রেনে উঠবে।” প্রবাহ বলতে বলতেই দেখল বাবা ভাইকে মারতে গেছে আর ভাই যথারীতি ছুটে পালিয়েছে। প্রবাহ জানে থামাতে হবে ভাইকে। ও নিজেও ছুটলো তাই। ভাই ধরা দেবার নয় যথারীতি সারা ঘর ছুটে বাবাকে হাঁফিয়ে দিলো। বাবা ওদের পড়ার টেবিল থেকে কাঠের স্কেলটা তুলে নিয়েছিলো ততক্ষণে। ভাইকে না পেয়ে প্রবাইকেই ধরলো বাবা। প্রবাহ কিছু বলার আগেই বাবা ওকে আচ্ছা করে পেটালো। প্রবাহ পালাবার চেষ্টা করলো না। ওর লাগছিলো ভীষণ। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও চুপ করে মার খেয়ে নিলো। বাবার রাগটা কমবে এতে, কষ্টটাও। ভাই জেদ করে খুব কষ্ট দিয়েছে বাবাকে। এমনিতেই মা চলে গেছে বলে বাবার খুব কষ্ট হয়। প্রবাহ বোঝে সেটা। নিজে আর বাবাকে কষ্ট দিতে চায় না তাই।

“মা আসছে পরশু, তাও জেদ, না? বলছি বারবার ট্রেনের টিকিট হবে না, তাও এতো জেদ।” বাবা মারতে মারতে বলছিলো। প্রবাহ জানে বাবা ঠিক, ভাই-ই অন্যায় জেদ করেছে। স্কেলটা খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে বাবা বললো, “মা আসুক, বলবো তোরা কী করেছিস এই ক’দিন।” প্রবাহর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে বললো বাবা। এতক্ষণ প্রবাহ একফোঁটাও কাঁদেনি, এবার কেঁদে ফেললো। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই, বেশ জোরে। বাবা থমকে গেলো, একটুক্ষণ চুপ করে থাকলো। যেন বাবার মনে পড়ে গেছে, জেদটা প্রমিত করেছিলো, প্রবাহ না।

“ঠিক আছে, কাঁদিস না, চোখ মোছ, মা চলে আসবে তো ষষ্টীতে।” বাবা চশমা খুলে চোখ মুছলো। প্রবাহ বাবাকে আঁকড়ে ধরলো হঠাৎ করে, বাবা চমকে গেলো। ওর মাথায় হাত বোলালো, “খুব মেরেছি? আমারই ভুল। তোরা এমন জেদ করিস! যেটা আমার হাতে নেই সেটা তোদের কীভাবে দিই বলতো?”

প্রবাহ বাবার দিকে তাকালো, “আমি তো জেদ করিনি, বাবা,” ভাইয়ের জন্য মার বহুদিন মুখ বুজে খেয়েছে প্রবাহ। আজ যেন সত্যিটা বলতে মন চাইলো, বাবা লজ্জিত হলো খুব, “ওহ, তাই না? আমিই তাহলে ভুল করে তোকে প্রমিত ভেবে –”

প্রবাহ বাবার বুকে মাথা রাখলো, “ঠিক আছে, বাবা।”

“আমারই ভুল, আমিই ভুলে যাই সব, কিচ্ছু গুছিয়ে রাখতে পারি না। দেখ না তোদের মা তার জন্য আসেই না, আসতে চায় না, আমার জন্যই…”

প্রবাহ মাথা নাড়লো, “তুমি খুব ভালো, বাবা। সবচেয়ে ভালো।”

“তোদের কোন কথা রাখতে পারি না যে, কাল জামাটাও কিনে দিতে ভুলে গেলাম, তোর মা এজন্যই বলেছে – কিচ্ছু হবার নয় আমার দ্বারা।”

প্রবাহ বাবাকে বলে, “তুমি একটু বসো, বাবা।”

বাবা খাটে বসলো, প্রবাহ বসলো পাশে।

“চোখ মোছ,” বাবা চোখ মুছলো, “জল খাবে, আনবো?”

বাবা অবাক চোখে তাকালো প্রবাহর দিকে, “এত মার খেলি তাও রাগ হচ্ছে না বাবার উপর?”

“ও তো আমি খাই-ই বাবা, তুমি ভাইকে মারতে গিয়ে ভুল করে মারো। ভাইটা তো মার খায় না, বলো?”

বাবা কষ্টের মধ্যেও হাসলো একটু, “ভাইকে এতো ভালোবাসিস?”

প্রবাহ চোখ মুছলো, “তুমি মা’কে বলবে না তো বাবা আমি জেদ করেছি?”

বাবা মাথা নাড়লো, “না রে, বলবো না।”

“মা’তো এমনিতেই আমাকেই বকবে বলো? ভাইয়ের রেজাল্ট ভালো হয়, র‍্যাঙ্ক করে, আর আমি এভারেজ,”

বাবা অদ্ভুতভাবে হাসলো। প্রবাহ মানে বুঝলো না হাসিটার। বাবা ওকে ঝুঁকে এসে আদর করে দিলো বহুদিন পর।

“কাল যাবি, আমার সাথে?”

প্রবাহ অবাক হলো, “জামা কিনতে?”

“জামা মা নিয়ে আসবে বলেছে, আমরা জামা দিতে যাবো, অ-নেক দূরে, তুই আর আমি। যাবি?”

“এনজিওর কাকুদের সাথে?”

বাবা হেসে ফেললো, “নাহ, শুধু আমি আর আমার যে ছেলেটা একদম আমার মতো হয়েছে, সে। গাড়িতে যাব, আমি চালাবো।”

প্রবাহ খুশি হয়েছিলো। বাবা ওকে বাবার সবচেয়ে পছন্দের কাজে নিয়ে যেতে চাইছে। একা ওকেই।

“ভাই?”

“বোর হবে যে! উসখুশ করবে।”

“আমি বুঝিয়ে রাখবো। স্কুল ছুটি তো, একা থাকবে কি করে?”

বাবা আরো আদর করলো প্রবাহকে। “বেশ, আমার কাজগুলো তোকে শিখিয়ে দিতে চাই। সময় হয়ে এসেছে। শিখবি তো?”

“তুমি তো ব্রিলিয়ান্ট, বাবা…”

বাবা প্রবাহকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, “তুই-ও”।

প্রবাহ জানে বাবা ভুল বলছে। প্রবাহ ব্রিলিয়ান্ট না, বাবার মতো, মায়ের মতো, ভাইয়ের মতো। হতেও চায় না, কিন্তু ওকে ব্রিলিয়ান্ট ভেবে বাবা আনন্দ পেলে, ও থামাবে কেন?   

রাতে প্রমিত দাদার কোল ঘেঁষে এসেছিলো। ওদের আলাদা ঘর। বাবার আলাদা। মা এলে মা আর প্রমিত এই ঘরে শোয়। প্রবাহ বাবার কাছে।

“দাদা- ঘুমোলি?”

“না রে, বল্‌”

“সরি, আমি জেদ করলাম আর তুই মার খেলি”,

প্রবাহ হাসলো, “ও কিছু না, এমন তো হয়ই, তুই ঘুমো”,

“দাদা – কাল বাবার সাথে যেতে হবে?”

“যাবি না? জামা দিতে যাবে বাবা। আমাদের ছোট হয়ে যাওয়া পুরনো জামাগুলো সব গোছালাম তো বাবা আর আমি, দেখলি না?”

প্রমিত দাদার গলা জড়িয়ে ধরলো। এটা কোন আবদার, প্রবাহ জানে, “বলছি কি – আমি সুধন্যদের বাড়ি থাকি? তুই আর বাবা যা?”

“সুধন্যদের বাড়ি? পাবজি নিশ্চয়? বাবা বকবে জানলে।”

“জানবে না। সব্বার মোবাইল আছে, আমাদেরই নেই। মা আসুক, বায়না করবো মোবাইল কিনে দেওয়ার জন্য”,

প্রবাহ চুপ করে থাকলো। মায়ের কাছে ভাই বায়না করলেই জিনিস পেয়ে যাবে, ও বায়না করতেই জানে না। মায়ের কাছে একটা বায়না করার কতো শখ ওর, গান শিখতে চায় ও। মায়ের মতো। সবাইকে লুকিয়ে গুণগুণ করে গান গায় প্রবাহ। খারাপ গায় না, ওর মন বলে, “বেশ, বলিস।”

“মা দেবে, বল্‌?”

প্রবাহ ভাইয়ের মাথায় হাত বোলালো, “মা তোকে সব দেয়,”

“তুই-ও চাইবি, দেবে। তুই তো চাসই না কিছু মায়ের থেকে”,

প্রবাহ কিছু বললো না। পরশু মা আসবে বলে খুব আনন্দ ভাইয়ের। প্রবাহরও আনন্দ কম নয়। কিন্তু মা এলে বাবা আরো কষ্ট পায়। মা কয়েকটাদিন থাকে মাত্র, তাতেই ওদের দুইভাইয়ের এত খুশি, এত আনন্দ দেখে বাবার মনে হয় নিজের না পারাগুলো মনে পড়ে যায়। মা এলে মায়ের কাছে একটা জিনিস চাইবে ভাবে প্রবাহ। মা এখানে চলে আসুক, সবসময়। তাহলে বাবার আর এত কষ্ট থাকবে না। ভাইয়েরও না। প্রবাহ জানে মা এলেও ও যে এভারেজ সেটা মায়ের খারাপ লাগবে। মা রেগে যাবে। ওকে বকবেও সারাক্ষণ। ছুটিতে এই ক’দিন এসেও প্রবাহর রেজাল্টে মায়ের অখুশি ভাব সারা বাড়িতে ছড়িয়ে থাকে।

মা বাবাকে বলে, “প্রতিবারই এমন রেজাল্ট!”

“বড়জনের?”

“তা নয় তো কার? প্রমিতকে তো কিছু বলতে হয় না,”

“সে-ও তো পড়েই দেখি, পড়ে, রোজ স্কুলে যায়, টিউশান যায়।”

“আর তারপর এমন রেজাল্ট হয়? তুমি নিজে নিয়ে বসো কখনো?”

বাবা চুপ করে থাকে ।

“তোমার সেমিনার আর সমাজ সেবার থেকে সময় পেলে তো! ওকে নিয়ে যাবো কলকাতা – পরের ক্লাসেই। কাছে রেখে গাইডেন্স না দিলে হবে না,”

প্রবাহ চুপ করে শোনে সব। ও কলকাতাতে যেতে চায় না। ওর স্কুল, ওর শহর, ওর মাঠ, ওর নদী, ওর বন্ধুবান্ধব, সবার উপরে ওর, বাবা – কলকাতায় কিচ্ছু নেই যে, বাবা তাকায়, “তুমি নিয়ে গিয়ে সময় দিতে পারবে ওকে দেখার? তোমার স্কুল আর গানের প্রোগ্রামের ফাঁকে?”

তারপর ঝগড়া হয় ওকে নিয়ে, দুজনের মধ্যে। প্রবাহর একদম ভালো লাগে না এসব। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, মা মুখ ভার করে বসে থাকে। ভাই পুজো দেখতে বেরিয়ে যায় পাড়াতে। প্রবাহ যেতে চেয়েও যেতে পারে না। না পুজো মন্ডপে, না মায়ের কাছে। মা কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়, গানে ডুবে যায়। আবারো। প্রবাহ শুনতে থাকে। মায়ের উপর সব অভিমান সব রাগ নিমেষে ধুয়ে যায়। গানটা জাদুর মতো গায় ওর মা। যদি মা এখানে থেকে ওকে গান শেখাতো? কি ভালোই না হতো! কিন্তু কলকাতায় যাবে না ও। বাবাকে ছেড়ে। 

জামাগুলো দিয়ে ফেরার পথে বাবা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, “কেমন লাগলো আজ?” প্রবাহ অতদূর গ্রামে যায়নি কখনো। ওদের পুরনো জামাগুলো দেখে বাচ্চাগুলোর চোখে মুখে যে খুশি আর আনন্দের ঝিলিক দেখেছে ও – ভুলতে পারবে না কখনো।

“খুব ভালো লেগেছে বাবা, থ্যাংক ইউ – তুমি আমায় আনলে,”

“তোকে ছাড়া আর কাকে আনতাম! তোর ভাই কী বলে এড়ালো যেন?”

“থাক না বাবা, ও তো ছোট,”

“গেম খেলবে, তাই তো?”

“তোমাকে বললে তো তুমি রেগে যাবে, ওকে মারতে গেলে ও পালাবে, আমিই মারটা খাবো। বলে মরি আরকি?”

বাবা হেসে ফেলেছিলো, “তা ঠিক, হ্যাঁ রে, খুব খুশি তুই কাল থেকে না? মা আসছে বলে?”

প্রবাহ ঘাড় নাড়লো, “ষষ্টীর দিন তো মা আসেই, বাবা।”

বাবা ওর দিকে তাকালো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “ঠিক তো, ষষ্টীর দিন, মা তো আসেই। তোকে নিয়ে যেতে মা, এবার অ্যানুয়ালের পর, এবারের রেজাল্ট দেখে আরো রেগে গেছে।”

প্রবাহ চুপ করে থাকলো।

“কলকাতায় পড়াও ভালো হয়, মা ঠিকই বলেছে, আর তোর মা থাকতেও পারবে কাছে, নিজে পড়াতে পারবে।”

প্রবাহর চোখে জল চলে এসেছিলো। বাবা তাহলে ওকে কলকাতা যাওয়া নিয়ে রাজি করাতেই ওকে এনেছে এখানে,

“আমিও সময় দিতে পারি না। তোর ক্ষতি হচ্ছে এতে,” বাবা জানলার দিকে তাকিয়ে বললো।

বাবারও চোখ ঝাপসা, বুঝতে পারলো প্রবাহ। বাবা জানে বাবা যেটা বলবে প্রবাহ সেটাই করবে, কোন তর্ক ছাড়া, তাই এভাবে বলতে পারছে।”  

“আমি কলকাতা যাবোনা, বাবা,” প্রবাহ বললো।

বাবা চমকে তাকালো। প্রবাহর মুখে কখনো না শোনেনি বাবা,

“মায়ের যদি আমাকে পড়াতে হয়, এখানে এসে পড়াবে, ট্রান্সফার তো হচ্ছে, সবার হচ্ছে। মা’কে বলবো আমি।”

বাবা প্রবাহর মাথায় হাত রাখলো, “মায়ের কাজ যে – ওখানে?”

“তাহলে পড়াতে হবে না আমায়।”

“আমি বলি কি, মা এতো করে চাইছে যখন তোকে, যা, মায়েরও তো কষ্ট হয়, সারাদিন পরে ফিরে তোদের না পেয়ে।”

প্রবাহ চোখ মুছলো। “ভাইকে নিয়ে যাক, ভাই ভালো, মা ভাইকে অনেক বেশি ভালোবাসে, আমাকে কেন?” বলেই বুঝলো ঠিক বলেনি, বাবা কষ্ট পাবে এতে, “সরি, বাবা…”

“ঠিক আছে, যাবি না, বুঝেছি, তা বলে যেটা নয়, সেটা বলিস না, বাপিন।” বাবা ওর ডাকনাম ধরে ডাকলো।

প্রবাহ চমকে তাকালো, “কোনটা নয়? আমি যাবো না – টা? আমি তো যাবই না বাবা, তোমাকে ছেড়ে যাবো না আমি, তোমাকে সবাই ছেড়ে যায়, যেতে চায়, আমি যাব না গো।”

বাবা মাথা নাড়লো, “জানি তো, সবাই গেলেও তুই যাবি না।”

“তাহলে? নয় কোনটা?”

“এই যে বললি মা ভাইকে অনেক বেশি ভালোবাসে সেটা।”

প্রবাহ অবাক চোখে তাকালো।

“তোর মায়ের সাথে কথা বললে দশটা কথার নটা তোকে নিয়েই হয়।” মুচকি হাসলো বাবা, “মা আজ মনে করিয়ে দিয়েছে বাপিন পুজোর সময় পূজাবার্ষিকীগুলো পড়ে, এবার একটাও কেনা হয়নি।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

“মা বলে আমার কথা?”

“সবসময়, খুব চিন্তা করে তোকে নিয়ে।”

“তাহলে চলে আসে না কেন? সবসময়?”

“মা এলে বলবি, তুই-ই তো বলিস না।”

প্রবাহ খুশি হল খুব। “বলবো, বাবা?”

“বলবি, তোর গান শেখার ইচ্ছাটাও যেমন বলিসনি এতোদিন অথচ তোর মা বুঝে নিয়েছে।”

প্রবাহ ভীষণ অবাক হলো, “কী করে? আমি তো তোমাকেও বলিনি কখনো, বাবা?”

“তোরই মা যে, মনের কথা বুঝবে না?”

প্রবাহ চুপ করে গেলো। মা তাহলে স-ব জানে, স-ব বোঝে? আকাশের দিকে তাকালো প্রবাহ, নীল আকাশ; সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘে ভর্তি। মাঠের দিকে তাকালো, কাশফুল দুলছে, মা আসছে, যে মা সব্বার মনের কথা বোঝে, আসছে, মা-ও আসছে, আজ রাতের ট্রেনে। মা-ও কি ঐ মায়ের মতোই? নাহলে প্রবাহর সব মনের কথা বুঝলো কী করে? এতোদিন পুজো আসছে বলে আনন্দ হচ্ছিলো না প্রবাহর, এবার হচ্ছে, মা আসছে।           

Facebook Comments