Site Overlay

জীবনের আগমনী গান

যোজনগন্ধা

আয়াঙ্গার হসপিটালের কাফেটেরিয়ার দেওয়াল ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা ধ্বনি হলো। দুই হাতে নিজের মাথা রেখে বসে আছে কৌশানী। চব্বিশ ঘন্টা আগে ডক্টর আইয়ারের বলে যাওয়া কথাগুলো এখনো অনুরণিত হচ্ছে মস্তিষ্কের অভ‍্যন্তরে। “খুব বাজে ভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ম‍্যাডাম। হিউজ ব্লাড লস্ হয়েছে। দুই পায়ের, দুই হাতের এবং পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। সিটি স্ক্যান করে মাথার মধ্যে রক্তক্ষরণ দেখা যেতেই অপারেশন করে ব্লাড বের করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন আর কিছু বলা যাবে না। পেশেন্ট ভেন্টিলেশনে আছে। হি ইজ ইন কোমা। চব্বিশ ঘন্টা পর আবার আপনাকে পেশেন্টের কন্ডিশন জানাতে পারব।”

এখন শুধু একটাই কাজ।

অপেক্ষা!

সেই অপেক্ষাই দীর্ঘ সময় ধরে করে চলেছে কৌশানী।

একটু আগেই সিস্টার এসে বলে গেছে ডক্টর সান‍্যাল আসছে কৌশানীর সঙ্গে দেখা করতে। মনের মধ্যে ওঠা ঝড়কে নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে যাচ্ছে কৌশানীর পক্ষে। কি বার্তা নিয়ে আসছে ডক্টর কুবলয় সান‍্যাল! আশাপ্রদ নাকি ভীতিজনক!

হাতের মুঠোয় পরিচিত স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকায় কৌশানী। “মন শক্ত করতে হবে। ডোডোর ব্রেন ডেথ হয়েছে। মানে ওর ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কৃত্রিম পদ্ধতিতে ডোডোর শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, পালস্ প্রভৃতি চালু রাখা হয়েছে কিন্তু আমরা আমাদের ছেলেকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম কৌশানী। মাথায় ম‍্যাসিভ চোট পেয়েছিল। কিচ্ছু করতে পারলাম না।” 

এ পৃথিবীতে সন্তান শোকের চেয়ে বড়ো শোক আর হয় না! বাবা মায়ের মৃত্যু হলে অতীত হারিয়ে যায় কিন্তু সন্তানের মৃত্যু হলে ভবিষ্যতটাই হারিয়ে যায়! ডোডোর মৃত্যু কৌশানীকে এক অর্থহীন জীবনের সন্ধান দিল যেন! শোকবিহ্বল স্ত্রীকে বুকের ভেতর গাঢ় আলিঙ্গন করে ধীর স্বরে কুবলয় বলে, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কৌশানী। কিন্তু তোমার অনুমতি ছাড়া তা সম্ভব নয়। তুমি তো জানো মেডিকেল সায়েন্স এখন কত উন্নত! আমরা ডোডোর সাতটা অর্গান সাতজন নিডি পার্সনকে ডোনেট করে তাদের জীবন বাঁচাতে পারি। ডোডো নেই কিন্তু ওর অর্গান নিয়ে একজন মানুষ বেঁচে থাকবে। সেটা তো ডোডোরই বেঁচে থাকা হবে তাই না? বাবা হিসেবে তোমার কাছে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারি নি কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে, একজন ডাক্তার হিসেবে আর পাঁচটা ডোডোকে তো আমরা অনায়াসে বাঁচাতে পারি কৌশানী?” স্বামীর বুকে মাথা রেখে শান্ত স্বরে কৌশানী জবাব দিলো, “এখানে সবাই তোমাকে বলে ‘ম‍্যান অফ স্টিল’। তুমি জানো? যে কোনো ডিশিসন নিতে তোমার বুক কাঁপে না। সেটা পার্সোনাল লাইফ হোক বা প্রফেশনাল! ছেলে হারানোর যন্ত্রণাকে পুরোপুরি অনুভব করার আগেই তুমি নবজন্মের ইঙ্গিত ঘোষণা করে দিলে গো! পেপার রেডি করতে বলো। আমি সিগনেচার করে দেবো।” স্ত্রীর আশ্বাসবাণী বুকে নিয়ে নিজের চেম্বারে যেতে যেতে আয়াঙ্গার হসপিটালের অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট কো-অর্ডিনেটর ডক্টর কুবলয় সান‍্যাল ভাবতে থাকে সেইসব লিস্টেড মৃত্যুপথযাত্রীদের কথা যাদের জন্য বিশল‍্যকরণীর ব‍্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছেন!!

*************

মৃগাক্ষীর কেস্ হিস্ট্রি স্টাডি করতেই একটা মুখ ভেসে উঠল সৌপর্ণর মনের মণিকোঠায়।

নিশিগন্ধা!

সৌপর্ণর আজীবনের ভালোবাসা! ডাক্তারি পাঠরত সৌপর্ণ বিরল ব্লাড গ্রুপের অধিকারিণী প্রেমিকার জন্য ট্রান্সপ্লান্ট উপযোগী কিডনির ব‍্যবস্থা করতে অক্ষম হয়েছিল। চোখের সামনে নিশিগন্ধাকে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে সৌপর্ণ। প্রতিজ্ঞা করেছে ডাক্তারির জীবনে কোনো মানুষকে মরে যেতে দেবে না অর্গানের অভাবে। নিজের মতো করে যথাসম্ভব চেষ্টা করবে।

মৃগাক্ষী আজ তিন বছর ধরে দুরারোগ্য হার্টের অসুখে ভুগছে। মাসের মধ্যে পনের দিন হসপিটালেই ভর্তি থাকে। অক্সিজেন মাস্ক না থাকলে জল থেকে তোলা মাছের মতো খাবি খায়। একটাই উপায় আছে মৃগাক্ষীকে বাঁচানোর। হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট। সৌপর্ণ জানে তার ম‍্যান-পাওয়ার আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার অপ্রতুল হলেও অপারেশনের বিপুল ব‍্যয়ভার বহন করা মৃগাক্ষীর স্বামী মিতদ্রুর পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ‍্য। সাতাশ/আঠাশ বছরের দুই তরুণ-তরুণীর আশ্চর্য জীবনীশক্তি, ভরপুর আত্মবিশ্বাস আর অপরিমেয় ভালোবাসাকে আন্তরিকভাবে সম্মান করে সৌপর্ণ। এতদিনের অভিজ্ঞতায় জানে যে কোন পুরনো অসুখে বিষাদ আসে। আর সেই বিষন্নতা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে পড়ে। কিন্তু মৃগাক্ষীর মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা দেয় নি শুধুমাত্র মিতদ্রুর জন্য। সিস্টার ললিতার কাছে সৌপর্ণ শুনেছে ভিজিটিং আওয়ারে স্বামী-স্ত্রী মুখোমুখি হলেই কি যেন এক অলৌকিক আলো জ্বলে ওঠে দুজনের চোখে মুখে। মিতদ্রু স্ত্রীর হাত নিজের হাতে নিয়ে মৃদু স্বরে অনাগত ভবিষ্যতের প্ল‍্যানিং করতে থাকে। সৌপর্ণ অনুভব করে মিতদ্রু আর মৃগাক্ষীর ভালোবাসা আলো-বাতাসের মতো, নুড়ি-পাথরের মতো, নদী-পাহাড়ের মতো সতত বহমান অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রথম যেদিন কোচিং সেন্টারে নিশিগন্ধাকে দেখে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল সৌপর্ণর মন আর শরীর জুড়ে, আজকের দিনেও প্রেমিকাকে স্মরণ করলে সেই একই অনুভূতি জাগ্রত হয় অজান্তেই! তার প্রেম পূর্ণতা পায় নি বলেই কিছুটা উপযাচক হয়েই এই দম্পতিকে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিতে যেন বদ্ধপরিকর ডক্টর সৌপর্ণ কর। দরকার একটা হার্ট আর একটা সহৃদয় পরিবারের!

“গ্রীন করিডোর মানে? হার্ট আসছে চেন্নাই থেকে? অপারেশনের কোনো খরচ লাগবে না? এবারের পুজোটা দেখার সুযোগ মৃগাক্ষী পাবে তো? অপারেশন থিয়েটারেই সবকিছু ————“

বিড়বিড় করতে থাকা মিতদ্রু চুপ করে যায় ডক্টর সৌপর্ণর স্পর্শে। “যে পেশেন্টের হার্ট প্রতিস্থাপন করা হবে মৃগাক্ষীর শরীরে তার ব্রেন ডেথ হয়েছে। তার বাবা নিজে একজন দক্ষ সার্জন। তিনি সস্ত্রীক হার্ট নিয়ে আসছেন এবং অপারেশন থিয়েটারে তিনি নিজেই থাকবেন আমার টিমের সঙ্গে। আপনাকে সবটা বুঝিয়ে বলি মিতদ্রু? হার্ট মানবদেহ থেকে বের করে নেওয়ার পর ট্রান্সপ্লান্ট উপযোগী থাকে মাত্র চার ঘন্টা। তারপর সেটিতে পচন ধরতে শুরু করে। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে গ্রীন করিডোর মুখ‍্য ভূমিকা পালন করে মিতদ্রু। এটা একটা স্পেশাল রাস্তা যেখান দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে নির্দিষ্ট সময়ে এক হসপিটাল থেকে আর এক হসপিটালে অর্গান পৌঁছে যায়। চেন্নাই আর কোলকাতায় ফ্লাইটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুটো গ্রীন করিডোর তৈরি হবে। নির্দিষ্ট সময়ে হার্ট প্রতিস্থাপন না হলে সমস্ত উদ্যোগ নষ্ট হয়ে যাবে মিতদ্রু। ডক্টর সান‍্যালের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অপারেশনের সমস্ত ব‍্যয়ভার আমরা দুজনে বহন করব। আপনার কুন্ঠিত হবার কোনো কারণ নেই। শুধু মৃগাক্ষীকে সাহস দিতে থাকুন। আপনাদের জীবনীশক্তি আমাদের জয়ের মূল চাবিকাঠি মিতদ্রু।” 

হাসপাতালের নুড়ি বিছানো পথে মৃগাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে ধীর গতিতে ট‍্যাক্সির দিকে এগিয়ে চলেছে কৌশানী। মিতদ্রুর পিঠে হাত দিয়ে পথ  চলেছেন কুবলয়ও। ডোডোর হৃৎপিণ্ড চারজনকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে। জীবন যুদ্ধে জয়ী মৃগাক্ষী অসুর রূপী মৃত্যুকে পরাজিত করে দেবীপক্ষের সূচনালগ্নে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে। মিতদ্রুর আর মৃগাক্ষীর লাভ স্টোরির হ‍্যাপি এন্ডিং করতে সৌপর্ণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। আজ সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পেরে ভীষণ ভারমুক্ত লাগছে। ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে সৌপর্ণর হৃদয় বিরামহীন ধুকপুক করছে। হৃদয়ে প্রেম থাকে কিনা জানা নেই কিন্তু হৃদয় আছে বলেই জীবন আছে।  

Facebook Comments