Site Overlay

উত্তরাধিকারের খোঁজে

অভিযান ভট্টাচার্য্য

সেদিন অফিস ঢুকতে প্রায় ১৫ মিনিট দেরী হয়ে গেল ৷ পৌঁছেই শুনি বস নাকি ডেকে পাঠিয়েছেন ৷ দেরী হবার জন্য বকুনি শুনবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই দুরু দুরু বুকে বসের  চেম্বারের দরজা ঠেলে মুখ বাড়ালাম।

“ডাকছিলেন স্যার!”

“ ওহ্! সমীরণ ? এসো ৷ সিট ডাউন !” কফির কাপটা টেবিলে রেখে বললেন বস ৷

বকুনির প্রাকমুহূর্তে সাধারণ ভাবে গলায় যে ঝাঁঝ থাকার কথা, বসের বানীতে সেটা খুব একটা নেই ৷ সাহস নিয়ে বসলাম বসের উল্টোদিকের চেয়ারে ৷

“ শোনো, তুমি এখন যথেষ্ট সিনিয়র হয়েছো ৷ ইফ আই অ্যাম নট রং, তোমার তো প্রায় দু বছরের ওপর হয়ে গেল ৷ বাই নাও ইউ মাস্ট বি ওয়েল ভার্সড্ উইথ অল দ্য অপারেশন্‌স্ ৷”

ঘাড় নাড়ব কি নাড়ব না , নাড়লেই বা কোনদিকে নাড়ব, এসব ভাবতে ভাবতেই বস কফিতে দু চুমুক দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন,

“ নতুন যে ব্যাচটাকে রিক্রুট করা হয়েছে, আজ তারা জয়েন করেছে ৷ সাধারণতঃ সায়নী ওদের ইনিশিয়াল ইনডাকশন ট্রেনিংটা করায় ৷ কিন্তু আজ সকালেই ওর একটা মিসহ্যাপ হয়েছে ৷ শি হ্যাস গন অন আর্জেন্ট লিভ ফর এ ফিউ ডেজ ৷ তাই ওর জায়গায় তুমিই ট্রেনিংটা করাবে ৷ ওরা বোধহয় সব এসে গেছে ৷ ওয়েটিং ইন দ্য কনফারেন্স রুম ৷ এই ফাইলে ট্রেনিং ম্যানুয়্যালস আছে৷ জাস্ট ১৫ মিনিট চোখ বুলিয়ে শুরু করে দাও ৷ ট্রেনিংটা সিরিয়াসলি শুরু না করলে, নতুন ছেলে মেয়েদের কাছে প্রথম দিনেই কোম্পানী সম্বন্ধে একটা  রং মেসেজ যেতে পারে ৷ নাউ গো এণ্ড স্টার্ট ৷”

এমনিতেই আমি নির্বিবাদী ৷ কলেজ জীবনে মুখচোরা গোবেচারা ছিলাম ৷ সেই জন্য মেয়েবন্ধুদের সামনেই ছেলেবন্ধুদের টোন-টিটকিরি শুনে জীবনেও প্রত্যুত্তর দিতে পারিনি ৷ বেশ বুঝতাম মেয়ে বন্ধুরাও মুখ টিপে মজা নিচ্ছে৷

যাইহোক, অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব নিয়ে ব্যাজার মুখে বেরিয়ে এলাম বসের ঘর থেকে ৷ ট্রেনিং দেব মানে তো আর নিজের পেন্ডিং কাজগুলো অন্য কেউ করে দেবে না ! আমাকেই অতিরিক্ত সময় অফিসে থেকে কাজ শেষ করতে হবে। তার ওপর ১৫ মিনিট কাগজপত্র দেখে কি তৈরী হওয়া যায় !

কোনো মতে কাগজপত্তর গুছিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকলাম ৷ নতুন ছেলে মেয়েরা সব বসে আছে ৷ আমার নবতম সহকর্মীর দল৷ ভাবলাম, প্রথম দিন মোটামুটি পরিচয় পর্ব দিয়েই চালাই | সেই রকমই শুরু করলাম, ‘রাউণ্ড অব্ ইন্ট্রোডাকশন’ ৷ পরিচয় পর্ব চলতে চলতে মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ পিছনের দরজা ঠেলে কে যেন নিক্কণসুরে বলে উঠল, “ মে আই কাম ইন স্যার !”

পিছন ঘুরে তাকাতেই পৃথিবী তার সমস্ত ঘোরাঘুরি বন্ধ রেখে সময়কেই যেন অর্থহীন করে দিল ! আচমকা স্তব্ধ এই পৃথিবীর বুক থেকে সব যেন ছিটকে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে ! ঘরের মধ্যের সমস্ত মানুষ, এই কনফারেন্স রুম, অফিস, বস – সব ! সব ! নিস্তব্ধ সেই স্থির পৃথিবীতে শুধু আছি আমি, আমার হৃদয়-ফুসফুসের যৌথ উত্থান-পতনের সিম্ফনী, আর সময়ের দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়া সে – মাধবীলতা মৈত্র – কত বছর পর অবিশ্বাস্যভাবে মুখোমুখি – আবার ! আয়ত চোখ দুটো একাদশীর চাঁদের মতন নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “ সরি ফর বিয়িং লেট স্যার ৷ ক্যান আই কাম ইন ?”

প্রতিটা শব্দ যেন বিলম্বিত প্রতিধ্বনিতে মগজে ধাক্কা মেরে হৃদয়ের বিবশতা কাটিয়ে স্তব্ধতা খান খান করে ফিরিয়ে আনল বাস্তবের ক্যাকাফোনী ৷ “ ইয়েস … প্লিজ্ !” সম্মোহিতের মতন বললাম ৷ মাধবীলতা দ্রুতপদে একটা ফাঁকা ডেস্কে গিয়ে বসল ৷ চিনতে পেরেছে আমায়? কলেজের দিনগুলো মনে আছে ওর ?  নাকি আমি ভুল করছি? এটেন্ডেন্স শিটে এবার ভালো করে চোখ বোলালাম ৷ ন’ নম্বরে ক্যাপিটাল লেটারে গোটাগোটা করে লেখা Ms. MADHABILATA MAITRA – না , আমি ভুল করি নি !

মাধবীলতার সাথে প্রথম দেখা কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশনের রিহার্সালে ৷ সবাই ওকে মাধু বলেই ডাকত ৷ আমি তখন সেকেন্ড ইয়ার ৷ গানের গলা মন্দ ছিল না ৷ মঞ্জরী ম্যাডামের পরিচালনায় একটা নৃত্য-গীতি আলেখ্য হবে ৷ পুরুষ কন্ঠের গানগুলো গাইবার জন্য আমার ডাক পড়ল ৷ কিন্তু সঠিক স্কেলে গাইবার মতন যুৎসই নারী-কন্ঠ পাওয়া যাচ্ছে না ৷ হঠাতই একদিন ম্যাডাম মাধবীলতাকে নিয়ে এলেন ওনার ঘরে ৷ ওখানেই হারমোনিয়াম সহযোগে গানের রিহার্সাল হত ৷ তন্বী-সান্নিধ্যের স্বভাবজাত অস্বস্তিতে আমি মাধুর সাথে ন্যূনতম দৃষ্টি ও বাক্য বিনিময় করেই রিহার্সালে কাজ চালাতাম ৷ কিন্তু বন্ধুমহলে সরগোল পড়ে গেল ৷ ক্লাশে একটা বড় অংশের ছেলেই বিশুর চ্যালা ৷ বিশু একটু মস্তান গোছের বখাটে ছেলে ৷ আমার সাথে মোটেও বনে না ৷ ওদের কেউ কেউ নিছক ইয়ার্কিতে , কেউ কেউ আবার বোধকরি চাপা ঈর্ষায় নানান আদিরসাত্মক টোন টিটিকিরি শুরু করল ৷ কে যেন ক্লাশে কাঁচা ছন্দের বাঙালে ছড়া ছাড়ল, “সমীরণ ক্যাবলায়, মাধুরে খাবলায় ৷” অথচ যাকে নিয়ে এতো কথা, সেই মাধুকে যে দেখতে কেমন, সেই বর্ণনাও আমি দিতে পারতাম না তখন ৷ ভালো করে ওর মুখটাই তো দেখিনি!

মঞ্জরী ম্যাডামের ঘরটা একটু কোণা চেপে ৷ কলেজের দোতলায় ৷ মূল করিডর দিয়ে যেতে আসতে নজর হয় না ৷ দিনের বেলাতেও ঘরে আলো না জ্বাললে বিশেষ দেখা যায় না ৷ পশ্চিম দিকের দেওয়ালে একটা জানলা আছে বটে, তবে সেটা খুব একটা খোলা হয় না ৷ রিহার্সাল পুরোদমে চলতে লাগল ৷ মাধু বেশ চটপটে ৷ দ্রুত স্বরলিপি কন্ঠস্থ করে নিতে পারে ৷ ওর কন্ঠে কি যেন একটা আছে! ও যখন গাইত, “যখন যাব চলে ওরা ফুটবে তোমার কোলে, / তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে / যেন আমায় স্মরণ করে …”, এক অদ্ভুত হারানোর বেদনা বুকের মর্মমূলে অনির্বচনীয় মৃদু  স্পর্শ রেখে যেত ৷

বন্ধুমহলের উৎপাত বেড়েই চলছে ৷ প্রায়ই আমার তাল কেটে যায় ৷ রিহার্সাল চলাকালীন যাদের কস্মিনকালেও মঞ্জরী ম্যাডামের ঘরমুখো হবার কথা নয়, দেখতাম সেইসব সংস্কৃতি-সম্পর্করহিত-সহপাঠীর দুএকজন মাঝে মাঝেই ঘরের সামনে এসে ঘোরাঘুরি করে ৷ মঞ্জরী ম্যাডামের সাথে চোখাচোখি হলে ভাবখানা দেখায় যেন পথ ভুলে চলে এসেছে ৷ পত্রপাঠ বিদায় নেয় ৷ অন্যথায় ম্যাডামকে আড়াল করে দরজার কোণ থেকে দাঁত বের করে হাসে, চোখে চোখে মাধুর দিকে ইঙ্গিত করে আমার উদ্দেশ্যে আদিরসাত্মক অঙ্গভঙ্গী করে| অত্যুৎসাহী কয়েকজন ক্লাসরুমে আমাকে আর মাধুকে নিয়ে নানা রসাল গল্প ছড়াল৷ দুই একবার প্রতিবাদের চেষ্টা করে ফল হয়নি৷ সেদিন মৃদুস্বরে ক্লাসে প্রতিবাদ করলাম, “ধুস৷ এসব উল্টোপাল্টা কেন বলিস? আমি কোনোদিন ওর মুখের দিকেও তাকিয়ে কথা বলিনা ৷” “ মুখ দেখবে কখন গুরু? তুমি তো সেয়ানা মাল ৷ তুমি তো শুধু বু… খ্যাক খ্যাক খ্যাক৷” বিচ্ছিরি ইঙ্গিত করে বখাটে বিশু হাসতে লাগল৷ বুঝলাম আমার প্রতিবাদের স্বভাবসিদ্ধ মৃদুতায় ওদের উৎসাহের পালে আরও হাওয়া লাগে৷ জানিনা মাধুদের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাশে সেকেন্ড ইয়ারের এসব কুকথা পৌঁছায় কি না৷ মাধুর সামনে ক্রমশঃই ভিতরে ভিতরে যেন কুঁকড়ে যাই৷

এর কদিন পরে, একদিন মঞ্জরী ম্যাডামের ঘরে একা বসে আছি ৷ কেউ আসে নি তখনও ৷ তবলার ছেলেটা আজ আসবে না৷ মঞ্জরী ম্যাডাম প্রিন্সিপ্যালের ঘরে কি একটা মিটিং-এ ব্যস্ত৷ মাধুও এসে পৌঁছয় নি৷ একদিকে ভাল৷ একা ঘরে মাধুর সাথে থাকতে আমি মোটেও স্বচ্ছন্দ নই৷ বাইরে প্রচন্ড মেঘ করেছে৷ ঘন ঘন  বিদ্যুতের শব্দ হচ্ছে৷ হাওয়ার ঝাপটা মাঝে মাঝে বন্ধ জানলার ওপর পড়ছে৷ হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে গুন গুন করে গাইতে লাগলাম, “বিজলী দীপশিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া / দু হাতে ঢেকো আঁখি, যদি গো জলে ভরে, /  বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে  …৷”  হঠাৎ খেয়াল হল, মাধু আমার পাশের চেয়ারে বসে টেবিলে হাতের ওপর গাল পেতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ কি জানি কখন এসে এভাবে গান শুনছে৷ আর ঠিক তখনই লোডশেডিং৷ ঘর জোড়া অন্ধকার৷ মৃদু শিখার মতন অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাধুর চোখ দুটো৷ কিছু না বলেই নিজের চেয়ার ঠেলে দরজার দিকে প্রায় পালাতে গেলাম৷ পাঞ্জাবীর হাতায় তীব্র টান পড়ল৷ “এভাবে কোথায় যাচ্ছ সমুদা !” হাতটা টেনে চাপা স্বরে বলল মাধু৷ আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম৷ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ উত্তেজিত ভাবে চাপা স্বরে বললাম, “ প্লিজ!  আমি যাই৷ কে কখন দেখবে৷ আজে বাজে কথা বলবে৷”

 “কোথাও যেও না৷ যে যা বলে বলুক | আমার তো তোমার ওপর বিশ্বাস আছে৷ সেটার দাম নেই ! যেও না সমুদা| অন্ধকারে একা থাকতে বড় ভয় করে!”

ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড দমকা বাতাসে এতদিনের বন্ধ জানলাটা দুহাট হয়ে খুলে গেল৷ ঘর জোড়া বৃষ্টির ছাট৷ আকাশ জোড়া তপ্তসোনার মতন বিদ্যুতের ঝলকানি একফালি কনে দেখা আলো হয়ে জানলা বেয়ে পড়ল মাধবীলতার বিবশমুখে ৷ কি অপরূপ! এই প্রথম দেখলাম ৷ পরমুহূর্তে চোখ চেপে বন্ধ করে ফেললাম| ঝলকানির অব্যবহিত পরে বজ্রপাতের শব্দে বড় ভয় করে৷ সেদিন অবশ্য শব্দ হয় নি৷

এই ঘটনার পর আমি যেন আরও গুটিয়ে গেলাম৷ উল্টো দিকে মাধু আরও সাবলীল৷ দরকারে অদরকারে নিঃসঙ্কোচে আমাকে ডেকে কথা বলত৷ আমি অধিকাংশ সময়েই অল্প কথায় কাজ সারতাম৷ রিহার্সালের বাইরে মাধুর সাথে প্রয়োজনও ছিলনা বিশেষ৷ কিন্তু ওকে দেখলেই বুকের কোথা থেকে কি যে এক সর্বব্যাপী তরঙ্গ বয়ে যেত …!

অনুষ্ঠানের দিন এসে গেল৷ কলেজের বাজেট কম| ছোটো স্টেজ৷ একটা ভোকাল মাইকেই দুজনকে গাইতে হবে৷ বাধ্য হয়েই গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়াতে হল৷ দর্শকের সারিতে, স্টেজের উইংসের আনাচে কানাচে দু-একটা ক্লাসের পরিচিত বিচ্ছুকে দেখলাম দাঁত বের করে, চোখ নাচিয়ে আমার দিকে অঙ্গভঙ্গি করছে। হারমোনিয়াম আমাকেই বাজাতে হবে। রিডে হাত চালাতে গিয়ে মাধুর গায়ে বার বার হাত লাগছে ৷ মাধুর যেন তাতে কোনো বিকার নেই ৷ তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছে৷ তাতে অস্বস্তি আমার দ্বিগুন হচ্ছে৷ খালি বিচ্ছু বন্ধুগুলোর মুখ মনে পড়ছে৷ ভাবছি কাল না দ্বিগুণ  টোন টিটকিরি শুনতে হয়! এই সব সাত পাঁচ মাথায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাত মনে হতে লাগল, সুরতালের ওপর আমার বাঁধুনী ক্রমেই যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে৷ “আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি” -র একদম শেষদিকে সমের মাত্রা গেল গুলিয়ে! মুহূর্তের মধ্যে কি করে যে মাধু বুঝে ফেলে ওর সুরেলা কন্ঠে তাৎক্ষনিক একটা তান তুলে আমাকে সমের মুখে ফিরিয়ে দিল৷ ওই মূহূর্তের সুরের যুগলবন্দীতে যেন হলঘরে বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ হাততালিতে ফেটে পড়ল ঘর ৷ আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হলে মঞ্জুরী ম্যাডাম আর প্রিন্সিপ্যাল মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন ৷ চারিদিকে ভূয়সী প্রশংসা৷

আমরা দুজনেই অনুষ্ঠান শেষে কলেজের মেন গেটের দিকে এগোতে থাকলাম৷ একটু ফাঁকা জায়গায় এসে আড়ষ্ট গলায় বললাম, “ মাধু!” মাধবীলতা যেন চমকে তাকাল৷ ওকে এই প্রথম আমি ডাকলাম ! বললাম, “তোমায় যে কি বলে ধন্যবাদ দেব! তুমি ওভাবে মেক আপ না দিলে তীরে এসে তরী …” ওর হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে দিল মাধু৷ খিলখিলিয়ে বলে উঠল, “আর থ্যাঙ্কস দিতে হবে না৷ এই যে এতদিন পর প্রথম নাম ধরে ডাকলে, এতেই আমি ‘ ধন্য’; আর ‘বাদ’ দিও না প্লিজ!”

ওর কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম৷ হাঁটা শুরু হল আবার৷ হাটতে হাঁটতে বললাম, “ কালপুরুষ পড়েছ ? সমরেশ মজুমদারের৷”

মাধু ঘাড় নেড়ে বলল, “ না! কিন্তু হঠাৎ ওই বইটার নাম বললে কেন?”

“ কালপুরুষের নায়িকার নাম জান? … মাধবীলতা!”

“সত্যি! ইশ্ | আমি তো ভাবতাম কি সেকেলে নাম আমারটা ৷ আমি নায়িকা ?!”

ওর কথা বলার ধরন দেখে হাসি চাপা দায় হয় আমার৷ ও বলে চলে, “তা কি রকম নায়িকা ? নাচ করে, গান করে, ফাইট করে, দারুন সুন্দরী …”

“ধ্যুৎ!” ছদ্ম ধমক দিয়ে ওকে থামালাম | “কালপুরুষের মাধবীলতাকে বোঝা তোমার কম্ম নয়৷” অন্যমনস্কের মতন বিড়বিড় করে বললাম,  “একটা আদর্শের আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের জন্য নিজের সমস্ত জীবনটাকে ছাই করে দেওয়া একটি সত্যিকারের নায়িকা!”

“ দাও ৷ পড়ব ৷” হাতে পেতে দিল মাধু ৷

“ তুমি পড়বে ? কিন্তু ওটাতো ‘উত্তরাধিকার’ -এর সিকুয়েল ৷ আলাদা করে কি পড়বে?”

“ উত্তরাধিকারে মাধবীলতা আছে ?”

“নাহ্”, হেসে বললাম আমি |

“তাহলে পরে পড়ব ৷ আগে তো মাধবীলতাকে চিনি, চিনলে উত্তরাধিকার এমনিই এসে যাবে ৷” মাধুর চোখ থেকে ঠোঁটের কোনে যেন একটা তীর্যক বিদ্যুৎ খেলে গেল , “ কি গো? আসবে না? মাধবীলতার চেনা কমপ্লিট হলেই উত্তরাধিকার চাই ৷ কথা রইল কিন্তু ৷”

হাসতে হাসতে ঘার নেড়ে সম্মতি জানালাম ৷ হঠাত নজর হল, মেন গেটের পাশে বিশু আমাদের ক্লাশের ওরই মতন জন্য তিনেক বখাটে ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে ৷ দেখতে পেয়েই মাধু কোন কিছু না বলেই, মাথায় শাড়ীর আঁচলটা টেনে, মুখটা নামিয়ে  সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতপদে এগিয়ে বেরিয়ে গেল কলেজ গেট দিয়ে ৷ বিশু এগিয়ে এল আমার কাছে ৷ ওর তর্জনীটা দিয়ে আমার বুকের ওপর টোকা মারতে মারতে বলল, “ সোন৷ থার্ড ইয়ারের রনিদার মাধুকে ভালো লেগেছে৷ ছিপ ফেলে দিয়েছে৷ পার্টির দাদা৷ পেস্টিজ ইস্যু| বুয়েছিস? কোনো বেচাল নয়৷ ওখানে একদম হাত বাড়াবি না৷ মাধুর আসপাসে দেখলে কিন্তু কপালে দুক্ক আছে ভাই তোর। ঠিক আছে? মাছ খেলিয়ে রনিদার ছিপে তুলে দেবার দায়িত্ব আমাদের৷ তুমি ক্লাসের গুড বয়৷ লজেন চোসো|” বলেই বিচ্ছিরিভাবে হাসতে হাসাতে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে কলেজ বিল্ডিং -এর দিকে চলে গেল৷ আমি ভ্যাবলা হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম৷ এসব কি উটকো ঝামেলা রে বাবা! ঠিক যখন মনে হচ্ছে আমি মাধুর সমস্ত  সত্ত্বার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছি, তখনই এইসব! এরা ডেঞ্জারাস ছেলেপুলে৷ কি জানি কি করে দেয়! মাধুর না কোনো ক্ষতি করে! নাঃ, এসব থেকে দূরে থাকাই ভাল৷ যদি বাবাকে গিয়ে উল্টোপাল্টা বলে আসে! গাছে না উঠতেই মার খেয়ে পিছলে পড়ব৷

দেরী না করে হন হন করে কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম | কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে৷ রাস্তার ওপারে মাধু আর কয়েকজন বান্ধবীর সাথে ফুচকা খাচ্ছে৷ ঠিক দেখতে পেয়েছে আমাকে৷ চোখে একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি৷ বান্ধবীরা না থাকলে হয়তো কাছে ডেকে নিত৷ ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলাম বাড়ির পথে৷

এরপর থেকে বুঝতে পারতাম মাধু আমার সাথে কথা বলতে চাইছে ৷ বার, বার ! কিন্তু, কি যে এক বাধায় আমি পাশ কাটিয়ে যেতাম ! যতবার এড়িয়ে যেতাম ততবার হৃদয়ের কতগুলো কোষ যেন ছাই হতে থাকত ৷

সেদিন কলেজের সিঁড়িতে মুখোমুখি হয়ে এড়াতে পারিনি৷ বড়বড় চোখ তুলে বলল, “ দেবেনা সমুদা ? একটা বই ই তো চেয়েছি৷ তাতেই পালাচ্ছ?” আশ্বস্ত করলাম কাল ঠিক দেব৷ নিয়েও গেলাম পরের দিন – ‘কালবেলা’৷

মাধুর ক্লাসে কখন ছুটি হয়, মোটামুটি ধারনা ছিল৷ তাড়াতাড়ি ওদের ক্লাসরুমের কাছে গেলাম৷ ক্লাসরুম ফাঁকা! বোধ হয় অফ পিরিয়ড ছিল৷ কিন্তু না! একেবারে ফাঁকা তো নয়৷ কারা দুজন যেন জানলার কোন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে৷ ছেলেটার হাতের তালু দিয়ে দেওয়ালে শরীরের ভার রেখেছে৷ ছেলেটার দেহ আর দেওয়ালের মাঝে একটি মেয়ে৷ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কথা বলছে ছেলেটার সাথে৷ মাধু! ভাল করে খেয়াল করলাম ছেলেটাকে৷ রনিদা! এর কথাই বিশু বলেছিল৷ তাহলে কি মাধুকে মলেস্ট করছে? দুপা এগোতে মাধুর মুখটা স্পষ্ট হোলো৷ মাধুর চোখে মুখে তো আতঙ্কের কোনো চিহ্ন নেই৷ মনে হচ্ছে চোখে মুখে চাপা আনন্দের ছাপ৷ রনির দেহটাও শিথিল হচ্ছে যেন৷ মুহূর্তে তীব্র ঘৃণা গ্রাস করল আমার সমস্ত হৃদয়৷ গোটা বুকটা যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে! দ্রুত উল্টোদিক ঘুরে বেরিয়ে আসতে চাইলাম ক্লাসরুম থেকে৷ সজোরে হোঁচট খেলাম চৌকাঠে৷ পায়ে তীব্র বেদনা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই যত দ্রুত সম্ভব কলেজ গেটের দিকে এগোতে থাকলাম৷ এখানে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ বেশীদূর এগোনর আগেই পেছন থেকে ডাক শুনলাম, “সমুদা”! পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সামনে এসে পথ আগলাল মাধু৷ হাঁফাচ্ছে, চোখে মুখে তবু আনন্দ ৷

“এনেছ বইটা ?”

ওর চোখে চোখ রাখলাম৷ সেদিন জানিনা আমার দৃষ্টিতে কি ছিল; ওর উজ্জ্বল মুখটা ধীরে ধীরে ধূসর হয়ে উঠল৷ আমি যন্ত্রের মতন বইটা এগিয়ে দিলাম৷ মাধু নিতে নিতে কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিল৷ আমি নিরবে ওকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম৷ পেছন থেকে শুনতে পেলাম রনিদার গলা, “ঠিক আছে মাধু ৷ ডোন্ট মাইন্ড| যে কোনো পবলেমে যে কোন হেল্প লাগলে বলবি৷”

পায়ের চোট নিয়ে বেশ কিছুদিন বাড়ীতে কাটালাম ৷ তারপর পরীক্ষা এসে গেল৷ সেদিনের পর মাধুর মুখোমুখি আর হওয়া হয় নি৷ মাধুর প্রতি কোনো রাগ, দ্বেষ মনে পুষে রাখিনি৷ ওর ওপর রাগ করতে গেলে যে অধিকার আদায় করতে হয়, তাতো আমি কোনোদিন করি নি! ইশ্! অসভ্য গুলোর ভয়ে গুটিয়ে না থেকে একটু আগে যদি …! ক্ষণিকের অভিমান, শূন্যতা আর আত্মগ্লানির রূপ নিয়ে মনের অনেকটা জুড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিল ৷

ট্রেনিং ভালোভাবেই উতরে গেল৷ মাধবীলতার সাথে দৃষ্টি বিনিময় যথাসম্ভব এড়িয়ে চললাম খুব সচেতন ভাবেই৷ মাধুর তরফে কোনো চাঞ্চল্য চোখে পড়ল না৷ প্রায় সারাক্ষনই মাথা নীচু করে নোট নিচ্ছিল ট্রেনিং-এর সময়৷ ট্রেনিং শেষে ওকে অন্য একটা ডিভিশনে কাজ দেওয়া হল ৷ ফলে কাজের প্রয়োজনে মুখো মুখি দেখা হওয়া বা বাক্যালাপের সুযোগও রইল না৷ এমনিতে ওদের ডিভিশনের একটা অংশ ওপরের তলায় বসে ৷ তাই মাধু যে সবদিন আমাদের ফ্লোরে থাকে, তাও নয়৷ তাছাড়া, মনে হয় না চিনতে পেরেছে৷ সামান্য কয়েক দিনেরই তো যোগাযোগ হয়েছিল সেই কবেকার কলেজ জীবনে৷ আমিও আগের মতন রোগা পাতলা নেই৷ শখ করে একটা ফ্রেঞ্চকাট রেখেছি৷ চিনতে না পারাই তো স্বাভাবিক! এক আধবার অফিস একটু ফাঁকা থাকলে যেচে ডাকতে ইচ্ছে হলেও সাহসে কুলোয় নি৷ যদি বাজে ভাবে কিছু রিঅ্যাক্ট করে! চারিদিকে সিসি ক্যামেরা৷ বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে একটা৷

এই ভাবেই চলে গেল বেশ কিছুদিন৷ এখন অফিস যেতে হঠাত করেই বেশ ভালো লাগে৷ লেট হওয়া তো দূর, অফিস টাইমের অনেকটা আগেই পৌছে যাই৷ শুধু দূর থেকে মাধুকে দেখলেই রনিদার ওই বিচ্ছিরি ভঙ্গীতে দাঁড়ানোটা মনে পড়ে৷ রাগ হয়৷ মাধুর মতো কোয়ালিটির মেয়ে কি করে যে ওই ধম্মের ষাঁড়টাকে … | পরমুহূর্তে বুকটা চিন চিন করে ওঠে৷ একবার কি পারতাম না ওকে জোর করে কাছে টেনে নিতে? অন্ততঃ একবার … দুনিয়া কি বলল তোয়াক্বা না করে … এমনকি, মাধু কি ভাববে তারও তোয়াক্বা না করে … একবার … !

সেদিন একটা কাজ শেষ করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গেল৷ অফিস সুনসান৷ শুধু সিকিউরিটি গার্ড হয়তো নীচে মেন গেটে বসে আছে৷ বস আজকের মধ্যেই শেষ করে স্টেটাসটা ওনাকে মেল করতে বলেছেন৷ বসকে ইমেল করে টয়লেটে কাজ সারতে গেলাম ৷ টয়লেটটা সিঁড়ির মুখে ৷ মূল অফিস ফ্লোর-এর থেকে একটু তফাতে৷ টয়লেট থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি সিটের দিকে এগোচ্ছি৷ এবার কম্পিউটারটা বন্ধ করে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে দ্রুত! হঠাত কে যেন ডেকে উঠল, “ সমুদা!”

বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল৷ এত রাতে কে আমার কলেজের নাম ধরে ডাকে?! যেন মাধুর কণ্ঠ৷ কাজ করতে করতে হ্যালুসিনেশ হল না কি? ডানদিকে সিঁড়িতে তাকিয়ে আরেকদফা চমকে উঠলাম ৷ সত্যিই মাধু! এতো রাত অব্দি অফিসে! কখন এসে যে ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছে বুঝতেও পারিনি৷ ওর এই এক স্বভাব! মনে পড়ে গেল মঞ্জুরী ম্যাডামের ঘরে বৃষ্টিধোয়া, লোডশেডিং-এ রিহার্সালের দিনটার কথা৷ সেদিনও আমি গান গাইতে গাইতে বুঝতেই পারি নি কখন ও আমার পাশে বেঞ্চে মাথা পেতে গান শুনছিল৷

আমার চমকে ওঠা প্রতিক্রিয়া দেখে মাধুও কিছুটা সচকিত হয়ে একটু অপ্রতিভ স্বরে বলল, “সরি, বিরক্ত করলাম৷  আমায় চিনতে পারনি ? আমি মা…”

ও শেষ করার আগেই আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, “ মাধু !” বহুযুগের ওপার থেকে যেন ডাকটা ভেস গেল আমার কন্ঠ বেয়ে ৷

“ ও, চিনতে পেরেছ তাহলে?” সিড়ির বাকী কয়েক ধাপ নেমে এসে একদম পাশে দাঁড়িয়ে বলল ৷

“ হ্যাঁ, সে তো প্রথম দিনেই …”

“ একদিনও কথা বলতে ইচ্ছে হল না ?!”

“ আসলে ভাবলাম, মানে এতদিন পর … তুমি আবার কি ভাববে তাই …”

“ উফ ! একটুও বদলাও নি না ?” প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল, “ সারাটা জীবন খালি অন্যে কি ভাববে সেটাই নিজে ভেবে ভেবে ব্রেনটাতে জং ফেলে দিলে ৷”

বলতে বলতে ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেটে মোড়ানো জিনিষ বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ৷

“ কী!?” বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতে করতেই খুললাম প্যাকেটটা ৷ দেখি ‘ কালবেলা’! সেই কবে কলেজে মাধু নিয়েছিল ৷ আমি একগাল হেসে অবাক বিস্ময়ে মাধুর দিকে তাকালাম ৷

“প্লিজ এরকম ক্যাবলার মতন হেসো না৷ কোনো দিন যে বইটা তোমায় ফেরত দিতে পারব ভাবি নি৷ সেই যে সেদিন ওরকম বিচ্ছিরি ভাবে চলে গেলে, তারপর আর একদিন যোগাযোগও করলে না! কোনো ট্রেস পেলাম না তোমার৷ শুধু বইটার দিকে তাকালে তোমাকে মনে পড়ত৷ এইভাবে যে আবার দেখা হবে কে জানত!” মাধুর গলাটা ধরে আসছিল৷ হঠাৎ গলা পরিষ্কার করে বেশ ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল, “আমায় যদি তোমার অতোই অপছন্দ, তাহলে বইটা ঘটা করে দিতে আসারই বা কি দরকার ছিল?”

“এ বাবা, অপছন্দ কেন … কি সব বলছ মাধু? আমি কি কোনো দিন …” আমতা আমতা করে প্রতিবাদ করতে গেলাম ৷ কিন্তু, আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মাধু রীতিমত ধমকের সুরে বলে উঠল, “ এই শোনো তুমি না খুব বাজে অভিনেতা৷ তুমি যে আমায় প্রথম দিনই চিনতে পেরেছ সেটা বুঝতে আমার বাকী ছিল না৷ তুমি কী ভাবলে? একটা ফ্রেঞ্চকাট রেখে অমিতাভ বচ্চন হয়ে গেছ? আমি খালি দেখছিলাম তুমি কতদূর যেতে পার৷ সারাটা  কলেজ তো আমিই যেচে যেচে তোমায় … অফিসে এত দিন পর দেখা হবার পরও …” চোখটা ছল ছল করে উঠল মাধুর৷ কথাগুলো বলছে যেন খুব আপনার কোন মানুষ ৷ এই মাধুর জন্যই তো হৃদয়টা পুড়েছিল সেদিন ৷ পরক্ষনেই রনিদার সাথে ওকে সেই ক্লাসরুমে দেখার সেই সময়টা মনে পড়ল৷ মনে আবার চেপে বসল অভিমান|

ক্ষণিকের নিরবতা ভেঙে মাধু বলে উঠল, “ কলেজে না হয় বিশুদের দলটা ছিল৷ ভয় পেতে৷ এখানে কাকে ভয়? বিয়েও তো করনি, প্রেমও কর না৷ সেসব খোঁজ খবর আমার নেওয়া হয়ে গেছে৷ যাই হোক৷ কালবেলা ফেরত দিলাম৷ এবার ‘উত্তরাধিকার’ দাও৷” হাতটা পেতে দিল সামনে ৷

হেসে ফেললাম ৷ হয়তো একটু বিদ্রূপের ছোঁয়া ছিল ৷ বললাম, “রনিদা কিনে দেয় নি? এত বছরে উত্তরাধিকারের খোঁজ পেলে না?”

মাধু সোজাসুজি আমার চোখে চোখ রাখল। ছলছল চোখ গুলোতে যেন আগুন গলে নামছে৷ হিস হিস শব্দ করে বলল, “ তুমি না হয়ে অন্য কেউ হলে এই কথাটা বলার জন্য সপাটে একটা চড় মারতাম৷ এখানে রনিদা আসছে কোত্থেকে? হু ইজ রনিদা?”

ওর প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হয়েই বললাম, “ না মানে, আমি তো ভাবলাম ওই রনিদার সাথেই তোমার …”

“ উফ ! আবার সেই এক জিনিস ৷ নিজেই সবটা ভেবে নাও ৷ ভেবে নিয়ে মর ৷” চাপা গলায় উত্তেজিত ভাবে বলল মাধু, “ কি একটু দেখলে তাতেই সব বুঝে গেলে! ছুটে গেছিলাম তোমার কাছে শুধু কি বইটার জন্য?”

“ মানে!”

“ রনিদা সেদিন আমাকে একা ঘরে প্রপোজ করেছিল৷ বিশুটাই সন্ধান দিয়েছিল ৷ এক নম্বরের চামচা |”

“ তারপর !” চাপা উত্তেজনায় শরীরের ভেতরে রক্ত তোলপাড় হচ্ছে আমার ৷

“ খুব বাজে ভাবে ফিজিক্যাল হবার চেষ্টায় ছিল৷ এমন সময় দরজার কাছে তোমাকে দেখতে পেলাম৷ তুমি মনে হয় তখনও আমায় দেখতে পাওনি৷ আমি জানতাম, তুমি যদি ওই অবস্থা দেখতে পাও, তাহলে তোমার বিপদ হবে৷ তুমি মনে কষ্টও পাবে৷ হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল ৷ রনিদাকে বললাম, আমি কারও সাথে সম্পর্কে জড়ালে তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে৷”

“ সে আবার কি কথা !”

“ সেটাই তো কথা৷ বললাম আমার একটা খুব বাজে জায়গায় ক্যান্সার ধরা পড়েছে৷ বেশীদিন বাঁচার আশা নেই৷ ” ডাগর ডাগর চোখ মেলে শেষের বোম শেলটা ছাড়ল মাধু ৷

আমি দেওয়ালে পিঠ ঠেসে চিত্রার্পিতের মতন বললাম, “এ বাবা ! তুমি এইসব কীত্তি করেছ! ধরা পড়লে …”

“ অতো সোজা না ৷ তবে যাই বলো ৷ রনিদা কিন্তু খুব সুইট ৷ ডাইরেক্ট বোন পাতিয়ে নিল ৷ বলল যে কোনো প্রয়োজনে ও দাদা হিসেবে হেল্প করবে৷”

দুজনেই হেসে উঠলাম ৷ কতজন্মের একটা পাথর যেন নেমে গেল। বললাম, “ ইস্, এতদিন পরে জানলাম!”

“ জানার চেষ্টা করেছ? বলব বলে তো সেদিন দৌড়ে এসেছিলাম৷ তুমি চলে গেলে৷ কালবেলার মাধবীলতার যৌবন চলে গেল ৷ আর এই মাধবীলতা উত্তরাধিকার খুঁজতে খুঁজতে দৌড়েই চলল৷ তার কথা শোনার লোকটাই তো কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল৷” বলতে বলতে মাধু মাথাটা গুঁজে দিল আমার বুকে ৷ ছোটোবেলায় বাড়ির চিলেকোঠাতে দেখেছিলাম, এভাবেই  কপোতী, কপোতের বুকে তার মুখটা গুঁজে দিত৷ শিরা ধমনী কাঁপিয়ে দুর্বার রক্তস্রোত বয়ে যেতে লাগল সমস্ত শরীরে৷ কিন্তু পরক্ষণেই ভয় ধরল ৷ যদি কেউ দেখে ফেলে! সিকিউরিটি গার্ড মাঝে মাঝে ওপরে এসে টহল দেয়৷ তাছাড়া সিসি ক্যামেরা আছে!

“ টয়লেটের এখানে ক্যামেরা নেই সমুদা, আর গার্ড কাকু ঘুমোচ্ছে!” আমার বুক থেকে মাথা না তুলেই বলে উঠল মাধু৷ কি করে যে বুঝে যায় সব! মনে পড়ে গেল ফাংশনের কথা ৷ সেদিনও আগেই বুঝে গেছিল, আমার তাল কাটবে ৷ নইলে অত দ্রুত ওরকম স্বর্গীয় আলাপ কেউ করতে পারে?

“ কাল উত্তরাধিকার টা এনে দেবে তো?” আমার বুকের ভেতর থেকে ভেসে এল  মাধুর আদুরে কন্ঠস্বর|

“ দেব৷” বলতে বলতে আলতো ভাবে হাত দিয়ে ঘিরলাম মাধুর সমস্ত পিঠ; ঠিক যেমনভাবে সেই ছোটোবেলার চিলেকোঠার কপোত তার ডানার আলিঙ্গনে ঢেকে দিত বুকে মুখ গোঁজা কপোতীকে !

Facebook Comments

1 thought on “উত্তরাধিকারের খোঁজে

  1. একটি অসাধারন প্রেমের ভালোলাগা গল্প ৷
    খুব ভালো লাগলো ৷
    আরও এইরকম ভালো ছোট গল্প উপহার পাব এই আশা রাখছি তোমার কাছে . |
    অনেক শুভেছা নিও ৷
    তুফানের জন্যে রইল অনেক ভালোবাসা |
    ওর আঁকার হাতটা বেশ পরিষ্কার হয়েছে ৷
    ওকে তুমি যেভাবে আগলে রেখে
    বাংলার কৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছ তাতে আমার বিশ্বাস ও ওর ঠাকুরদাদা , ঠাকুমা , মা এবং তোমার সম্মান রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ |
    ধন্যবাদ৷
    সঞ্জীব দেবনাথ
    বারাসাত

    SANJIB DEBNATH says:

Comments are closed.