Site Overlay

গল্পে যেমন হয়

দেবযানী ভট্টাচার্য

– এটা সন তারিখ মানলে ঠিক ইদানিংয়ের গল্প নয়। আবার এও তো ঠিক যে ঠিকঠাক জিমন্যাস্ট হলে গল্পরা টুক করে দিনক্ষণের বেড়া ডিঙোতে ওস্তাদ খিলাড়ি। এই যেমন ধরুন না কেন জাফরাগঞ্জের কুখ্যাত দেউড়িতে খরখরে আলোর মাঝেও ফটকটা পেরোতে সামান্য আবছায়া ঘেরে। হঠাৎ শিরশির করে ওঠে ঘাড়ের কাছটা। কাঁধটা খামচে ধরে কেউ, চাপা অথচ হিসহিসে গলা উচ্চারণ করে “মোহাম্মদী বেগ, কাম খতম ইয়া…”। আবার শাম্বতীর্থের নাটমন্দিরে একটা চাঁদ-গলা রাত দর্শকের মন থেকে নিমেষে মুছে দিতে পারে দেশ-কালের বোধ। এক ঝটকায় দাঁড় করাতে পারে অর্কদেবের প্রস্তর অবয়বের সামনে। অনন্য বিভঙ্গে ক্ষণিকস্থিতা কোনও ভাগমতীর উল্টো দিকে। থামের আড়ালে হয়তো ছায়া পড়ে কুতুব কুলির সাজোয়ান বেটার।

–গল্পবাজদের রাশ আলগা করেছ কি বেলাগাম বকরবকর চালু হয়ে যাবে। কাজের কথা বেমালুম টঙে। বলবে তো ধুলোমাটিলেপা কালোকোলো কিস্সা, তাতে অনর্থক রাজা উজির মারা কেন বাপু! ফেরো ফেরো, শিগগিরই।

–হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বলি। সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু কলোনির মোড়ের মুখটায় ঢুকতে বামের দিকে তখন ছিল পরপর তিনটে দোকান। টিনের চাল। বাখারির দেওয়াল। চায়ের, চপের এবং বইয়ের দোকান। চায়ের দোকানে প্রজাপতি এস্, চপের দোকানে মুড়ি কাঁচালঙ্কা আর বইয়ের দোকানে সুলেখার কালি কলম পাওয়া যেত। আরেকটু এগোলে ডাইনে ময়রার দোকানের দাওয়ায় একখানি রসের কড়াই ভোর হতে সন্ধে রাত অবধি দেখা যেত। উনুনে বসানো। জ্বাল দিতেন জালাপেট এগিয়ে এবং এলিয়ে বসা এক বিপুলবদন। মুণ্ডু কালোজাম, ডায়াফ্রামের উপরটা জ্যাম্বো পান্তুয়া আর তার নীচে অগাধ জালা। তেলচিটে ধুতির গিট্টুটা বারবার খুলে যেত তাঁর, তৈলাক্ত ভুঁড়ির চাপে। একবার কাঠ গুঁজতেন উনুনের গর্তে আরেকবার গিঁট গুঁজতেন নাভির নীচে। ঐ পথে আসতে যেতে পথিকের চোখ এড়াত না এই জ্বালুয়ার পর্যায়ক্রমে গোঁজাগুলি এবং ঠিক ওঁর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে মাঝে মধ্যেই ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়ানো এক ভদ্রমহিলা। রবীন্দ্র বাবু অমিট্রায়ের মুখে চমৎকার একখানি খেদোক্তি বসিয়েছিলেন– “হাটের লোকের পায়ে চলা রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরতে ভরসা পায় না বলেই আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর”। উক্তি চরিত্রের মেনেও খেদ স্বয়ং ঔপন্যাসিকের এরম ভাবতে মন্দ লাগে না। তা এই ভদ্রমহিলাকে দেখলে বাবুমশায়ের আক্ষেপ দু আনা কমতই কমত, শেতলার কিরে। ফ্যাশনের মুখোশ বর্জন করে উনি স্টাইলের মুখশ্রীতেই সম্পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন আর কী। সে খোলতাই হয়েছিল বেড়ে। কমা অথচ চকমকে সিন্থেটিক শাড়ী সুনীতি দেবীর কায়দায় জড়ানো। কুঁচিগুলোয় চোখ পড়লেই ভক্তেরা লুটিয়ে পথে করিছে প্রণাম পঙক্তি মনে পড়তে বাধ্য কিন্তু ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরুটিকে চোখে পড়েনি কখনও। গোড়ালির দিকটায় আবার ফলসের ঝুরো সুতো নারকেলের শলার ঝাঁটাকে বেদম হারিয়ে লম্বমান। ঘেরের বেড়টা মাদ্রাসার ছাত্রদের পায়জামার ঝুলকে আত্মস্থ করেছে। আঁচলের প্রথমদিকটা এক কাঁধের উপর ঘুচিমুচি জড়ো করে শেষটা আরেক কাঁধের উপর আলগোছে ফেলা। আমাকে দেখো ব্লাউজ সমিতির “আমরা একলা কাফি – ঘুচাও এ মোহ আবরণ” আন্দোলনের ঘোর সমর্থক এরম দুরন্ত আঁচল নিপুণভাবে সামলানোদের মধ্যে এক মধুবালা দুই সুপ্রিয়া দেবী আর এই আমাদের লেবুসুন্দরী হলেন তৃতীয়া। হেঁচকি ওঠালে বদলাবে না, ওঁর নাম ওটাই, ভোটের কার্ডেও। মনে হয় গোটা লেবু দু আধলা করে পেছন দিকটা সামনে দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল উপরওয়ালা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সময়, চোখের গর্তে। চাঁদার বাইরের পিঠের আকারের ফিনফিনে ভুরুকে আরও তুলে সর্বদা ঠেলে বেরিয়ে এই পড়ল এই পড়ল ভাব। তাতেই হয়ত বাপ মায়ে অমনপারা নাম রেখেছিল। দেখার বর্ণনা ঘণ্টা খানেক চলল, গুণের বিবরণ পেশ করি এইবারে। লাবু পিসি, এখন থেকে ঐ নামেই ডাকব, পেশায় ঘটকী। ধ্যাৎ, ওরম তাকাবেন না। মহিলা ঘটক বোঝেন? ও হল তাইই। এই মুহূর্ত ইস্তক বাহান্নটা ছেলে আর সাতাত্তরটা মেয়ের জোড়া খুঁজে দিয়েছে পিসি। মেয়ের রূপগুণ হোক কি ছেলের মাইনেচরিত্র, লাবুপিসি “সব ভালো”-র ঝুড়ি খুলে বসলেই মুগ্ধতা ঝুরি নামিয়ে আনে কর্তা গিন্নির মাথার ভেতরে। মোহগ্রস্থ হতে বাধ্য এমনি কথার মায়াজাল। তা জ্বালুয়ার সামনে নিয়মিত খাড়ানোর উপলক্ষ দুটো খোশগল্প, মূল উদ্দেশ্য ঐ, বিয়ে দেওয়া। মিঠাপাতি খয়ের আর চুনের রসে টুকটুকে ফোলা ফোলা ঠোঁট জোড়া আরও ফুলিয়ে পান্তুয়ার বামের অংশ ফালা ফালা করবার অভিসন্ধি নিয়েই লেগে পড়ে আছে আজ হপ্তা খানেক হল। কিন্তু অল্পের জন্য অকৃতকার্য হচ্ছে নিত্যদিন। দুই পক্ষের যাবতীয় সন্দেহের জীবাণু মারা ব্লিচিং পাউডার মার্কা বাক্যবাণ শেষমেশ দুয়ো খাওয়া মুরগি ঠোকরানো আটার গুঁড়োর মত ফালতু কথা হয়ে যাচ্ছে! প্রায় পেড়ে ফেলেছে পাত্রপাত্রীর গল্প শুনিয়ে সেই মুহূর্তে আজ হয়তো মালিক পত্নীর হন্তদন্ত রাগত আবির্ভাব কাল হয়তো সিঙাড়ার পুরে আরশোলা গ্যাঙের পদচারণা। মোট কথা বোলে তালে মিলছিল না কিছুতেই। তবে পিসিও ছোড়নেওয়ালি নেহি। লেগেই আছে সুযোগের প্রতীক্ষায় শিকারী বাজের মত নাক কুঁচকে।

–বাজপাখির নাক হয়? সে বস্তু আবার কোঁচকায়?

–ওহ, বললুম না? বলে ফেললুম। অত ধরতে আছে না কি গল্পে? বলতে বলতে ওরম ভাবে এট্টু বাড়াবাড়ি হয়েই যায়।

–আর পাত্র পাত্রী দুইয়ের কথা বললে যে? এদিকে তো একজন, দুইয়ের কারবার হবে কী করে?

–হে হে। পাত্র পাত্রী বললুম, ভড়কে গেলেন তো? রসুন। মা মরা মেয়ে তো বউ মরা এ লোকটার। ছেলে আছে দুইখান। নুলো ভাইও একটি। কিন্তু মেয়ে পার হলে ভিটেয় প্রদীপ দেবে কে? তাছাড়া জল বাতাসা পাখার বাতাস বাড়া ভাত পিঠে সেঁক এসবও তো একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। আবার সৎমা এলেই মাথায় কাঁটা হেঁটোয় কাঁটা হবে মেয়েটার। চুল কগাছ ছিঁড়েই নেবে হয়ত বাপের অলক্ষে। এগুনে বাপে মেয়ের এক লগনে হিল্লে হলে তার বাড়া ভাল নেই, তাই না? জুটেওছে জোড়া একখানা। পাত্রী পিসি এট্টুস খোঁড়া আর পাত্র ভাইপো সামান্য ল্যাংড়া। এছাড়া তো সমস্যা নাই। লাগিয়ে দেওয়া যাক। এরম অত্যন্ত সাধু উদ্যোগের ভাবনাখানাই ভেবেছিল লেবুপিসি। সেইমত চেষ্টায় ছিল। দিনকয়েক হুটকো ঝামেলায় অসফল হওয়ার পরে তক্কে তক্কে থেকে একদিন হাজির হল বিকেল পড়ল পড়ল এরম ঝোঁকে। এসময় আসা যাওয়া কম থাকে মালিক পক্ষের। ভারী রাত অবধি দোকান খোলা থাকে বলে মালিক বাবুর দিবানিদ্রাটি চলে বিকেল পার করে। চা জল খেয়ে সন্ধে গড়িয়ে ঢোকেন তিনি দোকানে। অতএব ময়দান ফাঁকা। কী দেখা গেল? সহকর্মী অ্যাবসেন্ট হওয়ায় রসের নাগড়ি সে সাঁঝে কচুরির কারিগর। ময়ামচুর লেচিগুলো বেলার তালে তালে মধ্য–মেদের আন্দোলন সে যেন এক সিন্ধুহিন্দোল জাগছে। লাবুপিসি দাঁড়াল। তরঙ্গ কিন্তু থামল না, থিরথির জাগছে। রোমাঞ্চ কী!

–বলি ও লঙ্কাবাবু, কবে যাবেন?

কালোজামের থুতনি ধুপ করে পড়ে গেল। পান্তুয়ার ঠেকনায়।

–কাজটা কি ঠিক হবে লাবু? লোকে ডায়ে বাঁয়ে বলবে যে।

–নয় নয় করেও এবেলা ওবেলা দশটা পাত পড়ে আপনার হেঁশেলের দাওয়ায়, ঠিক বলছি? তা সেইসব বোলনেওয়ালারা আপনার যজ্ঞির হাঁড়ি ঠেলবে তো দুইবেলা? পাতকো তলা ঝাঁটাবে? ঘর নিকোবে? না তো? সুতরাং নিকালো ওসব চিন্তা মন সে আর চলুন আমার সঙ্গে কাল। ফার্স্ট হাফে হাফ ছুটি আর সেকেন্ড হাফে ফুল ছুটি চেয়ে নিন। বারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়তে পারলে আড়াইটের মধ্যে পৌঁছে যাব বেগমপুর।

–বলছ? কিন্তু পুরো বেলা না খাটলে তো মালিক দুপুরের খোরাকিতে ঢ‍্যাঁরা বসিয়ে দেবে, পেটচুক্তি হোটেল এ চত্ত্বরে নেই…আমার খাওয়া একটু বেশি কি না…

–এই কথা! আমার ঘর তো এই দোকানের পেছনেই বলা চলে, চেনেন তো। সোজা চলে যাবেন। কাজ যাই করুন না কেন, জাতে তো বামুন। দু মুঠো অন্নসেবা সেখানে করে নেবেন, পুণ্য হবে আমার। আর ওজর তুলবেন না বাপু। বেগমপুরের চক্কোত্তি মশায় বড্ড তাগাদা দিচ্ছেন।

–বেশ। যাব।

………………………………

লেবুসুন্দরীর বাড়িটা একটা গভীর দীঘি লাগোয়া। গাছপালা, হ্যাঁ তাও আছে। আম কাঁঠাল বেল নারকেল আর কাঠ টগর এক এক পিস। বেশ মধ্যম মানের বনেদী ঘরদোর। বৈঠকখানা অন্দরমহল সদরদরজা খিড়কির দোর পাঁচিল সব আছে। খোলসা করে দেওয়া ভাল, সব ছিল। এখন কেবল ইটের কাঠামোর কঙ্কাল জ্যান্তভাবের ধুকপুকটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে মাত্র। ধরিত্রী পিঠ নাড়া দেবে কি ঝুরঝুরিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়বে। বাসিন্দারাও ধুঁকছে। অবশ্য বাসিন্দা বলতে ওই লেবু, ওর ক্ষেপি বোন ঝুমি ওরফে ঝুমকোলতা আর বুড়ি মা তরলা। সারা রাত একপ্রকার জেগেই কাটায় লাবুপিসি। রাত যত বাড়ে মায়ের গাঁটে ব্যথা আর বোনের বকবকানি চাগাড় দেয়। ঝাঁঝানি দিতে দিতেই দুটোকে সামলায়। সামলাতে সামলাতে একসময় ভোর চুঁইয়ে নামে ছাদের ফুটো থেকে আর পিসি বিড়বিড় করতে করতে নামে এককালের বাগান বর্তমানের আগানে। নিত্য পুজোর জবাটা টগরটা জুটোতে হয় বৈকি। ওই একটা জায়গাই তো আছে তার বিশ্বসংসারে উথলে ওঠা বিষ ওগরানোর। ঠাকুরঘর। আজও ফুল তুলছিল আপন মনে হঠাৎ খেয়াল পড়ল গতকাল লঙ্কাদাকে হুট বলতে বলে এসেছে দুপুরে খেতে। কী আছে ভাঁড়ারে তা তো জানা নেই। তড়িঘড়ি পায়ে ছুটল রান্নাঘরের দিকে। শিকল খুলে ঢুকতে যাবে, দেখে মা কুটনো নিয়ে বসেছে।

–এত সকালে তুমি হেঁশেলে যে?

–শেষ রাতে তোর চোখ লেগে এসেছিল। অজান্তেই। তখন ঘোরে বলছিলি শুনেছি আজ গোপাল ময়রার ম্যানেজার লঙ্কেশ্বরকে খেতে বলেছিস। তোর তো ছোটবেলা থেকেই ঘুমের ঘোরে দিনভরের সবকিছু বকা স্বভাব তাই ভাবলাম কী জানি যদি সত্যি হয়। যাহোক দুটো গুছিয়ে রাখি।

–ওহ, বলে ফেলেছি, তাই না? তোমার কাছে কিছু লোকানো কি কখনও যাবে না মা!

–নাহ, যাবে না। এই দ্যাখ তো এদিকে। লাউ আছে আর গোটা কতক উচ্ছে। ফুলকপিও আছে এক খণ্ড। বেগুন দুটো আছে। কী পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে পাতে দিবি বল?

–মা, আমরা সাড়ে বারটা নাগাদ বেগমপুর রওনা দেব। আমি এবাড়ির অতিথ কুটুম নই তাই হাঁড়ির হাল জানা নেই এমন তো নয়। লোকটা ফস্কে যাবে দুপুরের খাওয়ার ছুতোয় তাই ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেছি। যা আছে ওই দিয়েই বেড়ে দেব ভাত। এক কাজ করো। ডুমো ডুমো করে খানিকটা লাউ কুটে রাখো। উচ্ছে কুচিয়ে নাও। শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তিতের ডাল রেঁধে ফেলি। বাকি লাউটা কুচিয়ে ফেললে জিরে ফোড়নে ছেঁচকি নেমে যাবে আধ কড়া। বেগুনটা পোড়া করে ফেলি আর রইল ফুলকপি ওটা পাঁচ টাকার বেসন এনে চুবিয়ে বড়া ভাজা করে দেব অখন। হবে না?

–একটা কথা বললে চেঁচিয়ে উঠবি না তো লাবু? এমনিতে কী সব স্থানে অস্থানে ঘুরে চরে বেড়াস দিনভর, একা একা বিড়বিড় করিস, পাগলের মত উল্মোঝুল্মো হয়ে ফিরিস। গা কাপড়ের খেয়াল রাখিস না। লোকে আড়ালে আগে বেহায়া বলত এখন ঝুমির সঙ্গে সঙ্গে তোকেও পাগলী বলে, সব শুনি আমি। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ এত গোছানি হয়ে উঠিস যে চমকে যাই। বড় আক্ষেপ হয় তোকে একটা সংসার দিতে পারলাম না। নিজের একটা সংসার হলে হয়তো তুই এমন করে বেড়াতিস না…

–আবার শুরু করলে যমের কেত্তন! ধ্যাত্তেরি। এইজন্য আমি বাড়ি থাকি না। শোনো মা, আমি এভাবেই থাকব এভাবেই ঘুরব। যা ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে চলব। একবেলা ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই যাদের তাদের কথা আমি জুতোয় ডলি বুঝতে পেরেছ? আর কী জান মা, আগেও বলেছি আজও বলছি। লোকজন যখন চোখ দিয়ে আমায় খায় না মা, এই আমায় আমায়, আলাভালা আমিটাকে,― বুকের ভাঁজকে নাভির খাঁজকে ঠোঁটের খুনি লালকে পায়ের গোছার ঢালকে ― কিন্তু ছুঁতে পারে না, মুচড়ে মুচড়ে মারে নিজেদের সব চোরা সাধের দাঁড়াগুলো, আমার বেশ লাগে বুঝলে? বুঝতে পারলে তুমি? বেশ লাগে আমার। ফুর্তি হয়। ঐ ঐ বমি ঠেলে ওঠে না পেট ফাঁপলে গলা দিয়ে, ওরম বুক পেট ফেঁপে ওঠা ভয়ঙ্কর ফুর্তি ঠেলে ওঠে আমার গলা বেয়ে। বুঝেছ তুমি??? বুঝতে পেরেছ?

ধ্যার! যা পার করো, আমি কিছুর মধ্যে নেই।

–কী হল তোর হঠাৎ করে? কেন এমন হিসহিস করছিস? এভাবে দুলছিস কেন? লক্ষ্মী মেয়ে আমার। ঠাণ্ডা হ মা ঠাণ্ডা হ। আমি আর বলব না। সত্যি বলছি আর বলব না। দ্যাখ বোনটা হাঁড়িকাঠে বাঁধা পাঁঠার মত কাঁপছে তোর ভয়ে। শান্ত হ। আর একটা বামুন মানুষকে খেতে বলেছিস, ভুলে যাস না।

–হ্যাঁ, থাম দেখি। সব জানি। পিন্ডি গেলা বামুন ওরা। বংশে কালিও আছে। সমস্ত গিলে ফেলেছি কারণ চার হাত এক করতে পারলে ভাল রকম উঠে আসবে আমার হাতেও। চক্কোত্তি মশায়ের গলায় জোড়া কাঁটা বিঁধে আছে না। ছেলে বোনের গতি হলে উনিও তৃতীয় পক্ষ আনবেন কানাঘুষো চলছে। তিন সেট বিয়ে যদি লাগিয়ে দেওয়া যায় দু তরফে একুনে অনেক মালকড়ি মা, অনেক মালকড়ি। ভয় পাস না বুনি। আমি ঠিক আছি। একদম ঠিক আছি। টাকা এলে তোকে নিয়ে বেড়াতেও যাব। দেখিস।

–যাক বাবা, মেয়ের মাথা স্থির হয়েছে। হ্যাঁ, যা শুনলাম, সে উপার্জন দু পয়সা বেশি হলে ভাল। চালটা ছাইয়ে নেওয়া যাবে এই চত্তিরে। অবশ্য যদির কথা তো…

–ভেবো না, এ সুযোগ আমি নদীতে কিছুতেই ভাসতে দেব না। আচ্ছা মা, প্রথম পাতে কী দেবে? তা তো ভাবা হল না।

–তাই তো, আর কিছু তো নেই…এক কাজ করি লাবু? লাউয়ের খোসা ভাজা করে দিই? কালজিরে দিয়ে? আর যদি কৌটো হাতড়ে দুটো কুমড়োর বড়ি পাই তো মন্দ হবে না।

–বড়ি? বড়ি কোথায় পেলে? কিনেছিলে? শখ বটে তোমার! নিত্যদিন গেলো তো কল্মী আর কচু, ওতে বড়ি লাগে বুঝি?

–বকিস না মেলা। গাছগুলো রুইয়ে দিই কি এমনি এমনি? সারাদিন চরকি কেটে বেড়াস। খবর রাখিস কোথায় কী ফলছে? বাগানের কুমড়ো। ঝুমি দিয়েছে বড়ি।

–কে দিয়েছে বললে? বুনি?!

–হ্যাঁ। ঝুমি। বিয়ে বিয়ে খেলা তো ওর বড্ড প্রিয়, নাচিয়ে দিলাম বড়ির বিয়ে দেওয়ার তালে। গুলে দিলাম। বুড়ো বুড়ির বিয়ে দিল, সেই আনন্দে বাকি বড়িগুলোও দিয়ে দিল।

–কী অবস্থা! ধন্য তুমি। তোমার মত যন্তরের পেটে জন্মেছি বলেই হয়তো দুনম্বরী মাল গছানোর ঘটকীগিরি চালাতে পারি। এরম উঞ্ছবৃত্তির পেশাতে টিকে গেলাম! নাও চলো। রেঁধে ফেলি।

……………………………..

লঙ্কেশ্বর এল এই সাড়ে এগারোটা নাগাদ। লাবুপিসি বলেছিল বটে হাফের হাফ করে আসতে কিন্তু সে গোটা দিনই ছুটি চেয়ে নিয়েছিল। বেশ করে তেল চাবড়ে চান করে― ট্রাঙ্কের পাট করা ধুতি হাওয়াই শার্ট পরে― সিঁতি কেটে চুল কগাছ আঁচড়ে― মসমসে জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে উঠেছিল বনগাঁ শিয়ালদা লোকালে। স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে অবশ্য শুকতলা অল্প ছিঁড়ে গেল একপাটির। বাড়ি তার বাগদার ওদিকে, এই জুতো কেনা বছর তিনেক আগে, চণ্ডীতলার মেলা থেকে। তাতে কী! নতুন তো। পরা না হলেই নতুন। এট্টু কম পরা হলেও, ওই নতুনই।  সে যাকগে, পিসির বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে যখন শেকলে ঘা দিল তখনও টুপটাপ তেলজল ঝরছে বাবরি বেয়ে। ঝুমি ছাড়া পেয়েছিল কোনও গতিকে। ছুটে এসে দ্বার খুলেই চিৎকার জুড়ল। বাবা এসেছে সুরো কাকী বাবা এসেছে। চায়ের জল বসাও। হুড়মুড়িয়ে এল লাবুপিসি। তরলা হেঁচড়ে নিয়ে গেল ঝুমিকে ভেতরদিকের কোনও অন্ধকারে।

–জানেনই তো। বাবা লাইনে কাটা পড়ল আর সেই থেকে…

–হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি বৈকি। আমরা একপ্রকার পড়শিই তো হই। সবই জানি। ও আমি কিছু মনে করিনি। বলছি আমরা বেরব কখন?

লাবুপিসি ঝুমির আকস্মিক অস্থিরতায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ। চেয়ে দেখল লঙ্কাদাদাটিকে। বেশ সেজেছে তো! বড্ড তাড়া-ও দেখছি। মুখ ঘুরিয়ে ফেলল কারণ ঠোঁট জোড়া বাড়ছিল দুইপাশে, মাথার বারণ সত্ত্বেও। অস্ফুটে মরণ উচ্চারণ করল কেবল। তারপর গলাটা খাঁকরে বলে উঠল

–এই তো, সাড়ে বারোটায়। চলুন খেয়ে নেবেন। আপনার খাওয়া হলেই রওনা দেব।

–হ্যাঁ, চলো চলো। দেখ দেখি তোমার হুজ্জোত হল খানিক এই রাঁধাবাড়াতে। আমি কিন্তু অল্প খাব। বলা যায় না খেতে খেতে যদি গাড়ি ফস্কে যায়।

–নাহ, চিন্তা করবেন না। আপনাকে হবু শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায় আমার। আর হ্যাঁ, খাবারের জোগাড় তেমন কিছুই নয়। একসময় এ বাড়িতে এরম কত পাত পড়ত… যাক গে, চলুন আপনাকে খাওয়ার জায়গায় নিয়ে যাই।

………………………………..

লঙ্কেশ্বর আর লেবুসুন্দরী বসে আছে বেগমপুর স্টেশনে। লাবুপিসি ভাবছে এখন তো যেতেই হবে একসঙ্গে কারণ এ লাইনে ট্রেন কর গোনা। শিয়ালদায় গাড়ি বদল হবে। সেখানে ইচ্ছে হলে এক গাড়ি, নইলে ভিন্ন যদিও সব ট্রেনই বারাসত হয়ে বনগাঁ যায়। গাড়ি আসবার বেশ দেরি এখনো। হঠাৎ তার মনে হল সে এমন ভাবছে কেন? এত ক্লান্ত লাগছে কেন তার? বিরক্তি জাগছে কেন অকারণে? তার তো প্রচণ্ড খুশি হওয়ার কথা ছিল। বিয়ে প্রায় পাকা, দু জোড়ারই, চক্কত্তির তৃতীয় পক্ষ খোঁজার বরাতও সেই পেয়েছে, এ তো প্রায় মহালক্ষ্মী বাম্পার থার্ড প্রাইজ লাগার সমান। সে কেন অখুশি? সে কি অসুখী হল এতে? কিন্তু কারণ কী?

এদিকে পাহাড় সমান উচ্ছ্বাস যদি বেঁধে ফেলতে হয় চায়ের কৌটোয়, যা সইতে হয় কৌটোখানির দেওয়াল ঢাকনাকে, লঙ্কেশ্বরের পাঁজরের আজ সেই হাল। আকুলিবিকুলি আনন্দের জোয়ার লেগেছে শরীরের কূলে কূলে। কিন্তু মাথা বলছে মেয়ের বিয়ে তো আছে তারও দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছে তাই বেশি নাচন অসৈরণ। কিন্তু খুশি কি চাপতে চাইলেই চাপা যায়! হিহিক্কার হাসির চেহারা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে বিনা কারণে।

–চা খাবে লেবু থুড়ি লাবু? লেবু চা? হে হে হে!

–না, আপনি খান।

–বলছি কী লাবু, আমরা আবার কবে আসব?

–কী করব?!

কী হচ্ছে তার! এ প্রশ্নে বিতৃষ্ণা জাগছে কেন মনে লোকটার উপরে? ঘেন্না জন্মানোর মত আদেখলামো তো করছেন না ভদ্রলোক। তার যদি বিয়ে ঠিক হত ধরা যাক ওই লঙ্কাদার সঙ্গেই, সেও কী এমনই করত না…ঝনঝন করে উঠল মাথাটা। এসব কী ভাবছে সে! ছি ছি! একবেলা ভাত বেড়ে খাওয়ানো এত বলা তো দূর ভাববার অধিকারও দেয় না! আর সেই খাওয়ানো তো তার নিজের স্বার্থেই ছিল। খদ্দেরের মাল আগলে রাখার স্বার্থ। কী করে ভাবতে পারল সে এমন নীচ কথা! এ কী হয়ে গেল তার ভেতরে! এত লোভ? এত নোলা? নিজের ভেতরটা দেখে ফেলে কেমন যেন হিংস্র হয়ে উঠল লেবুসুন্দরী। লজ্জায় ঘেন্নায় পিষে ফেলতে ইচ্ছে করল নিজেকেই। লঙ্কেশ্বরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো নয়ই ওর দিকে তাকানোর ক্ষমতাও নিঃশেষ তার। নিরুচ্চারে কেবল হে ঠাকুর চিৎকার বাজল বুকের ভেতর। হ্যাঁ, লাজহরণ মধুসূদনই আড়াল করলেন ওকে। তীক্ষ্ম হুইশেলে বাতাস চিঁরে সেই মুহূর্তে এসে পড়ল রেলগাড়ি। ছুটে লেডিজে উঠল লাবুপিসি।

–লঙ্কাদা, তখন শুধলে না, আমরা কবে যাব ওঁদের বাড়ি। যাব নিশ্চয়, তবে এখনই নয়। মানে তুমি যাবে, আমি নয়। বাকি কথার মধ্যে আমি আর থাকছি না, ও তো তোমরাই সেরে ফেলতে পারবে। আমরা সবাই বিয়েতে যাব। কেমন?

–হ্যাঁ হ্যাঁ, সে কী বলার অপেক্ষা রাখে লাবু! নিশ্চয় যাবে। তোমার ঘটকী বিদায়ও পাওনা যে। ওহ শোনো, আজ তোমাদের বাড়ি চমৎকার খেলাম বুঝলে। বহুদিন পরে যেন বড় আপনজনের রাঁধা অন্নব্যঞ্জন মুখে তুললাম। কী যে ভাল স্বাদ তোমার হাতের রান্নার। বর থাকলে দেখতে তোমায় মাথায় করে… ও কি, ছুটছ কেন? বারাসাত লোকালে যাবে? সেও তো কিছু দেরি এখনও। ও লাবু অমন ছুটলে পড়ে যাবে তো। কী হল কী মেয়েটার!

…………………………………

লেবুপিসি ছুটছে।

প্ল্যাটফর্ম-এ লুটোপুটি কুচি আকণ্ঠ থুতু কফ মাখছে।  কাঁধের উপর থেকে আঁচলের শেষভাগ নেমে লোকের জুতোর নোংরা মাখছে।

ফলসের সুতোগুলো হিলে অবিশ্রাম বাড়ি খাচ্ছে।

যেন অযৌবন করা পাপের শাস্তি দিচ্ছে নিজেরাই নিজেদেরকে। কেবল এতকাল অনির্বাণ জেগে থাকা নির্লজ্জ বুকজোড়া অদৃশ্য হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরছে বাতাস। হাঁপাচ্ছে। ভয়ানক ভয় পেয়েছে। সেঁধোতে চাইছে জ্যালজ্যালে আঁচলের আড়ালে। আবার আড়ালও করতে চাইছে তাদের সকলকে ঠাঁই দেওয়া মানুষটাকে। বুঝতে পারছে আজ লেবুসুন্দরী অন্তিম শাস্তিটা তাকে দেবে, নিজে নেবে। ঐ ট্রেন ঢুকছে…

আবারও তীব্র হুইশেল। এবারে সেটা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে দিল এক উন্মত্ত ভাবনার জাল। লেবুসুন্দরী থমকে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল যেন অদেখা দুটি দৃঢ় হাতের ঝাঁকুনি খেয়ে। প্রশ্ন করল নিজেকে। কী করতে চলেছে সে? কেন ছুটছে? কেন শাস্তি নেবে সে? কেন মরবে? এই সমস্তটার মধ্যে তার অপরাধ কোথায়? কী অপরাধ করেছে সে? সুখে বাঁচার লোভ পাপ?

না।

অভাগীর বুকে বসে শেষ উত্তর দিলেন সেই লাজহরণ তাপহরণ।

…………………………….

ভোর ফুটেছে অল্প। কাল রাতে মায়ের কাছে শুয়েছিল লাবুপিসি। বোনের পাশেও। ঘুম ভাঙল বুনিরই গানে। দুয়োরে বসে বসে কী যেন একটা সুর লাগাচ্ছে সে আবছা আবছা।

উঠে বসল লেবুসুন্দরী। আলোআঁধারে ফাটল ধরা আয়নাটায় নিজের চেহারাটা ঝাপসা লাগছে। অন্য সময় হলে হয়ত আঁচলে মুছত কাঁচটা। আজ মুখ ফিরিয়ে নিল।

–এই বুনি, তুই তো নিজের তালে কীসব গুনগুন করিস। আজ আমায় একটা গান শোনাবি?

ঝুমকোলতা দুলে উঠল।

“আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে এই প্রভাতখানি।

আকাশেতে সোনার আলোয় ছড়িয়ে গেল তাহার বাণী।

ওরে মন, খুলে দে মন, যা আছে তোর খুলে দে–

অন্তরে যা ডুবে আছে  আলোক-পানে তুলে দে।

আনন্দে সব বাধা টুটে  সবার সাথে ওঠ্‌ রে ফুটে–

চোখের ‘পরে আলস-ভরে রাখিস নে আর আঁচল টানি॥”

……………………

–কী হল? থম খেয়ে বসলেন যে? চেনা লাগছে, তাই না? খুব চেনা চেনা চরিত্র? আপনার আমার গায়ে ঘষাঘষি পরিচিতি যেন, নয়? বলেছিলাম না, সেদিনের গল্প ঝপাং করে এদিনে লাফ দিতে পারে। থাবা বাগিয়ে ঘাড়ে চড়তে পারে। তারপর? পেড়ে ফেলে।

খুব সাবধান।

Facebook Comments

1 thought on “গল্পে যেমন হয়

  1. তোমার লেখা আগেই আমাকে মুগদ্ধতায় পেয়েছিলো, তাই যাই পড়ি সব ভালো লাগে । তুমি দিদি লিখে যাও

    আরিফ হোসেন says:

Comments are closed.