Site Overlay

বাঙালির বাংলা অপ্রীতি

রূপা চক্রবর্তী

“ছোট খোকা বলে অ আ

শেখেনি সে কথা কওয়া।”

আমরা মানে বাঙালীরা রবি ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’ এর এই শব্দ বন্ধনীর মধ্যে দিয়ে প্রথম বাংলা ভাষার সাথে পরিচিত হতাম। ধীরে ধীরে আমাদের আত্ম অনুসন্ধান চলতো। এবং বাংলা ভাষার মণিমানিক্য আত্মস্থ করার চেষ্টা অটুট রেখে প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ হতাম। এই বিশ্বাস কে মনের মণিকোঠায় সযত্নে লালিত করতাম যে বাংলা ভাষা একদিন জগৎ সভায় শ্রেষ্ট আসন লবে। কিন্তু হায় আত্মঘাতী বাঙালি! পর ভাষার মোহে পড়ে মাতৃভাষার অবক্ষয় শুরু করলো। বর্তমানে তা প্রান্তসীমায় উপনীত।

‘হে বঙ্গ! ভান্ডারে তব বিবিধ রতন

তা সবে অবোধ আমি, অবহেলা করি

পরধন লোভে মত্ত লইনু শরণ

পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি

কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।’

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার জীবনের প্রান্তদেশে পৌঁছে এই উপলব্ধি করেছিলেন যে বাংলা ভাষার রত্নের ভান্ডারকে অবহেলা করে তিনি কত বড় ভুল করেছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবন দিয়ে তিনি সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্য করে গেছেন। পাশ্চাত্য স্বীকৃতির মোহে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করার মাশুল গুনে গেছেন শেষ জীবনের প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু হায়! বাঙালী জাতি, মধুসূদন দত্তের মৃত্যুর এতবছর পরেও তার জীবনের কড়ি দিয়ে কেনা বাংলার মাহাত্ম্য অনুভব করে সে গৌরবান্বিত হতে পারল না।

আমরা মানে বাঙালীরা চিরদিনই আত্ম সমালোচনা করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে ভালোবাসি। বাঙালীর যত দোষ সেগুলো সুপ্ত না রেখে প্রবলভাবে ব্যক্ত করে বিশ্ববাজারে  নিজের জাতি-কে হেয় প্রতিপন্ন করে যারপরনাই পুলকিত হই। তার জন্য বাংলার বাইরে যাওয়ার সুযোগ আমরা কেউই প্রায় হাতছাড়া করতে চাই না। আর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ তো আমাদের কাছে পরশপথর পাওয়ার ন্যয় প্রতিভাত হয়। আমরা খুব গর্বের সাথে বলতে ভালবাসি যে ‘এখানে থেকে কিসস্যু হবে না’। নিজের দেশে জাত্যাভিমান নিয়ে থাকার চেয়ে পরের দেশে পরবাসী হয়ে থাকাকে আমরা ঢের বেশী সম্মানের মনে করি। বিদেশে বসবাসকারী কোন আত্মীয় বন্ধুকে আঁকড়ে ধরাকে শ্রেয় জ্ঞান করি।

কলকাতার বাইরে বসবাসকারী বাঙালীরা প্রায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, ‘তোমাদের ওখানে তো চাকরীর বাজার নেই, শিল্প নেই, উন্নতি নেই …নেই,…নেই …নেই’। ‘তোমাদের’ বলার মধ্য দিয়ে তারা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় যে এই বাংলা কোন দিনই তাদের নিজের ছিল না। এতবছর বাংলায় থেকে বড় হলে, পড়াশনা করলে, বাংলার দান নিয়ে গেলে এখন যখন প্রতিদান দেওয়ার পালা তখন বেশী সুযোগ সুবিধা পাবে বলে, অন্য রাজ্যে বসে বাংলাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছ। অবশ্য এটা তো বাংলারই শিক্ষার দোষ, কারন তাকে সত্যিকারের বাঙালী করতে পারে নি। তাদের মত স্বার্থান্বেষী বাঙালী থাকলে তো বাংলা মায়ের এই আবস্থা হবেই। লক্ষ্য করার বিষয়, যে বাঙালীরা বাংলা ছেড়ে গেছে পরধন লোভে মত্ত হয়ে সেই প্রবাসীদের কাছে তখন বাংলা, বাঙালী, বাংলা ভাষা সবকিছু ‘তোমাদের’। তাহলে তাদের কাছে তখন ‘আমাদের’ কোন্ টা? তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে, নিজের দেশকে ছোট করে তারা যে পরের দেশে রয়েছে তারাও তাদেরকে ‘আমাদের’ ভাবে না।

আমি আশ্চর্য হয়ে যাই যখন দেখি বাংলার বাইরে থাকা বাঙালী কলকাতায় থাকা আত্মীয় বন্ধুদের খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, ‘কলকাতার বাঙালীরা তো ভাল করে হিন্দিটা বলতে পারে না’। আমার জানতে ইচ্ছে করে কোনটা বেশী অসম্মানের? কলকাতার বাঙালীরা ভাল করে হিন্দি বলতে পারে না সেটা, নাকি বাঙালী হয়ে ভাল করে বাংলা বলতে পারে না , সেটা? বাংলা কোন মৌলিক ভাষা নয়, পুরানো বাংলার সঙ্গে মৈথিলি ভাষার সম্পর্ক আছে। 

আজকাল বাবা মাযেরা খুব গর্ব করে বলে, ‘আমার ছেলে (বা মেয়ে) বাংলাটা লিখতে পড়তে পারে না।’ মানলাম যুগের প্রয়োজনে তারা ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে পড়ে। কিন্তু তাই বলে বাংলা শিখবে না? স্কুলে তাদের প্রথম ভাষা ইংরাজী। দ্বিতীয় ঐচ্ছিক ভাষা যদি হিন্দি অথবা বাংলা থাকে তাহলে অধিকাংশ পিতামাতা তাদের ছেলে মেয়েদের দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি দিতে আগ্রহী। অর্থাৎ বাঙালী ছেলেমেয়েদের কাছে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবেও বাংলা স্থান পায় না। যেসব ইংরাজী মাধ্যম বিদ্যালয়ে তৃতীয় ভাষা থাকে সেখানে তৃতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা বিবেচিত হয় কারণ তখন বাংলা নিতে তারা বাধ্য। এর সাথে আবার অতিরিক্ত অনেক ভাষা যেমন – ফ্রেঞ্চ, লাতিন, জার্মানি শিখে রাখতে অনেকে আগ্রহী। তাই বলে ভাববেন না আমি মুক্তমনা বা উদারপন্থী নই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না। আমার বক্তব্য শুধু এইটুকুই – কোন কিছু শেখাই খারাপ না। যে যত শিখবে তত ভাল। অনেক ভাষা শিখে রাখা তো আরও ভাল। কিন্তু তার অর্থ কি সব ভাষা শিখতে হবে বাংলা ভাষাকে অগ্রাহ্য করে? অবহেলা করে? মাতৃভাষার প্রাপ্য সম্মানটুকু না দিয়ে?’ ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্স’ এর সংস্কৃতি ভাষার অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ও চারপাশে এই দ্বিচারিতা লক্ষ্য করেছেন। তার মতে কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থা খুব খারাপ। এখানে বাংলা ভুল বললে কেউ লজ্জিত হয় না। ইংরাজী ভুল বললে লজ্জার একশেষ। ইংল্যান্ড, আমেরিকার মাতৃভাষা ইংরাজী। কিন্তু সেখানেও কটা লোক আসল শেক্সপীয়ার পড়ে বুঝতে পারে? সাংস্কৃতিক বিগ্রহের আরাধনা এক জিনিস, ভাষা আর এক। কলকাতা শহর নিয়ে অমিত চৌধুরীর সাম্প্রতিক ‘ক্যালকাটাঃ টু ইয়ার্স ইন দ্য সিটি’ বইয়ে তার পর্যবেক্ষণ- ‘বাংলা আগে কসমোপলিটন ভাষা ছিল। এখন প্রান্তিক ভাষার জাত্যাভিমান।’ জাত্যাভিমান যে কত রকম। এই জন্যেই বাঙালীকে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে হয়। রামমোহন, রবীন্দ্র্নাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরের ভাষার এই হাল। রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সঞ্চালনার দায়িত্ব থাকার সুবাদে আমাকে একবার এক অভিভাবিকা এসে বলে, তার মেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে ইংরাজীতে বক্তব্য রেখে ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ কবিতার ইংরাজী অনুবাদ বলবে। কারণ সে বাংলায় পারদর্শী নয়। আমি ভাবি তাও ভাল- এরা বাংলাভাষাকে অগ্রাহ্য করলেও বছরে ওই একদিনের জন্য অন্ততঃ কবিগুরুকে অস্বীকার করেনি। সেটাই বা কম কিসে?

বাংলা ভাষা জানা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে এত অপ্রস্তুত হয়ে থাকি যে কলকাতায় বসে বিহারী ফুচকাওয়ালার সঙ্গে বিহারী ভাষায় কথা বলে নিজের পারদর্শীতা দেখাই। চিনা বাজারে জুতো কিনতে গিয়ে সেই ভাষাও অল্পবিস্তর চেষ্টা করি। আফিসের দারোয়ানের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলি কারণ আমরা মনে করি সেটা খুবই কৃতিত্বের। আমাদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখে ওরা হাসে- তবুও আমরা শুধু বাংলায় কথা বলি না বা ওদের কে দিয়ে বাংলা বলানোর চেষ্টা করি না কারণ আমাদের নিজের ভাষা নিয়ে স্বাভিমান নেই।

হায়দ্রাবাদ গিয়ে একবার আমি এক অটোওয়ালাকে বলেছিলাম ‘চারমিনার যাবে’? সে দিব্যি সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে ছিলো। কিন্তু আমার সঙ্গী হা হা করে উঠেছিল, হিন্দিতে না বলে বাংলায় বলার জন্যে। সে বাংলা ভাষা বুঝবে না বলে। আরে বাবা! ও না বুঝলে সেটা তো ওর সমস্যা।

_ সর্ব ধর্মের সমন্বয় ঘটানো ভাল। সর্ব জাতির সমন্বয় ঘটানো ভালো, সর্ব ভাষার  সমন্বয় ঘাটানো ভালো। সেটাই যদি আমরা মানি তাহলে তো বাংলা ভাষাকেও সম্মানের সঙ্গে শেখানো ভালো। বাংলার লোক-লৌকিকতা-সংস্কতি সবার মধ্যে তুলে ধরা উচিৎ। সেটা তখনই করতে পারব যখন আমরা নিজের মাতৃভাষাকে ভালোবাসবো। মাতৃভাষায় কথা বলতে গর্ব বোধ করবো। আমি বাংলায় কথা বলছি মানেই আমি হিন্দি, ইংরাজী জানি না, তা কিন্তু নয়। তার অর্থ দাঁড়ায় আমি ভালো বাংলা জানি। বাংলা ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। সেটা কিন্তু কম সম্মানের, কম কৃতিত্বের নয়। তা না করে আমরা অবাঙালী সংস্কতির অন্ধ অনুকরণ করতে যাই। যার পরিণতি বাঙালী বিয়েতে আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে অবাঙালী মেহেন্দী অনুষ্ঠান।

_ কলকাতার বাইরের জনপ্রিয় তারকারা আবার সে কতোটা বেশী বাঙালী সেটা বোঝাতে কলকাতায় এসে বলে ‘আমি রসগোল্লা ভালোবাসি, তাই আমি বাঙালী।’ যদিও সেই বিখ্যাত সৌন্দর্য সচেতন চলচিত্র শিল্পীরা তাদের শারীরিক সৌন্দর্য অটুট রাখতে নাম মাত্রই দই, মিষ্টি চেখে দেখেন- বাঙালীকে খুশী করার জন্য। আর আমরা কলকাতাবাসী বাঙালীরা তাতেই যারপরনাই পুলকিত বোধ করি। আরে শুধু এই রসগোল্লা খেলেই বাঙালী হওয়া যায় না। বাঙালী হতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে হয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল, সুকুমার, সুকান্তকে পড়তে হয়। বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বুঝতে হয়। আমার তো মনে হ্য়, যারা বাংলা ভাষার বিবিধ রতন গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়েনি তারা বাঙালীই নয়। যারা রবি ঠাকুরের লেখা পড়েনি, তারা নিজেরাই জানে না নিজেদের অনুভূতির কত বড় ক্ষতি করেছে। নিজেদের কতটা অপরিপূর্ণ রেখেছে।

বর্তমানে বাংলার অনেক গল্প উপন্যাস নিয়ে হিন্দিতে সিনেমা হচ্ছে। যেমন-শরৎচন্দ্রের পরিনীতা, দেবদাস। শুনেছি অধুনা মুম্বাই-র বিখ্যাত চিত্র পরিচালক দিবাকর সেন, শরদীন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশ’ সিরিজের সব কটা গল্পের স্বত্ত কিনেছে চলচিত্রে রূপদানের জন্য। এর অনেক সমালোচনা হয়। যেমন- ‘পরিণীতা’ বা ‘দেবদাস’- চলচিত্রে উপন্যাসকে অবিকৃত না রাখার অভিযোগ উঠেছে। তবে আমার মনে হয় এর একটা আশাব্যাঞ্জক দিকও আছে। বর্তমান প্রজন্ম তো রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়ে না। উপন্যাস গুলোর নামই জানে না। তবুও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে চলচিত্র হওয়ার সুবাদে এরা বিখ্যাত গল্পগুলো জানছে। এটাই বা কম কিসে? কালজয়ী উপন্যাস গুলোর সারাংশটুকু অন্ততঃ দেখতে পাচ্ছে অন্য প্রদেশের বড় বড় পরিচালকের বিপুল বাজেটের চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যের মুন্সিয়ানায়। তাই দেবদাস সিনেমায় ‘চন্দ্রমুখী’ রূপী মাধুরী দিক্ষিতের সাথে ‘পারো’ রূপী ঐশ্বর্য রাই নৃত্য প্রদর্শন করল তো কি হয়েছে (শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলে কি করতেন জানি না) এটা তো বুঝেছে যে, বাংলার সাহিত্য ভান্ডারের আবেদন চিরকালীন, চিরন্তন। স্থান, কাল পাত্রের পরিধির মধ্যে এই সৃষ্টি সীমাবদ্ধ নয়। কথায় আছে ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ এই প্রবাদ প্ৰবচনগুলিও দূরদর্শী বাঙালীরাই বলে গেছেন। আজকাল চারিদিকে বিকৃত বানানের সমাহার দেখলে চমকে উঠতে হয়। ভাগ্যিস বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুদিন আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। 

আধুনিক হওয়ার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলার বিরোধ কোথায়? সুন্দরভাবে বাংলা বললে কি সপ্রতিভতার অন্তরায় হয়? মাতৃভাষাকে অপাংক্তেয় করে অন্যভাষার সাথে অভিসার সম্পূর্ণ হয় না। কারণ বাংলার সাথে বাঙালীর আত্মার সম্পর্ক। আসলে মানসিক বাধাটাই বাংলা-কে শেখার জানার অন্তরায় হয়ে উঠেছে। সেটা লঙ্ঘন করে ভালবেসে নিজের ভাষাকে আত্মস্থ করুন। বাঙালী বলে স্বাভিমান করুন। দেখবেন বাঙালী জাতি জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে।

‘বাংলাকে তো আমরা সচেতনভাবে হীন করতে করতে ব্যাঙ্গাত্মক বা বক্রোক্তি র পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছি। যেমন অতি নিকৃস্ট পানীয় ‘মদ’ বা ‘সুরা’-র নিম্নতম মান বোঝাতে আমরা বলি ‘বাংলা চোলাই’।

_ কি করে হারিয়ে গেল বাংলার প্রতি বাঙালীর আত্মিক যোগ? বিশ্বায়ানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্ম কেন ছুঁড়ে ফেলে দিল বাংলা বই? কেন আমরা বাংলায় যাপন করতে গর্ব অনুভব করি না? বোধ করি এর উত্তরও দিয়ে গেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যের পুরোধা বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার ‘বাংলা সাহিত্যের আদর’ প্রবন্ধে ইংরাজী শিক্ষিত বাঙালীবাবু ও তার ভার্যার সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের মাধ্যমে-

‘বাবু -: ছাই ভস্ম বাঙালীগুলি পড় কেন?

ভার্যা : ও কপাল! যে বইখানা অত ঘৃণা করছো , তোমার ইংরেজরাও অত করে না। ইংরেজরা তর্জমা করিয়া তা পড়িতেছে।

বাবু -: বাংলা বই ইংরাজী তে তর্জমা?! সিডিশাস তো নয়? কী বই?

ভার্যা :- বিষবৃক্ষ।

বাবু -: বিষ … এক কুড়ি?

ভার্যা-: আর এক রকমের বিষ, যা তোমার জ্বালায় আমি একদিন খাইবো।

বা্বু -: ও পয়জন? তারই গাছ?

ভার্যা-: গাছের ইংরাজী কি বল দেখি?

বাবু :- ট্রি! …ওহ! পয়জন ট্রি বলিয়া একখানা ইংরাজী বইয়ের কথা কাগজে   পড়িতেছিলাম বটে। সেখানা কি বাংলা বইয়ের তর্জমা?’”

…বাঙালী সেদিনও বাংলা পড়ত না। আজও পড়ে না। পাঠ অভ্যাস একই আছে। কিন্তু সময়ের সাথে চিত্র বদলে গেছে। তাই তারা বুঝতেও পারলনা বাংলা সাহিত্য না পড়ে কি অপার্থিব সুখানুভব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করল? কোন্ রস আস্বাদন থেকে তারা দূরে রইল? সাংস্কৃতিক জাত্যাভিমানটাই আমরা অনুশীলন করতে পারলাম না। আত্মঘাতী জাতির এমনটাই হওয়ার ছিল। বাঙালী জাতির বাংলা প্রীতির সবচেয়ে বড় অন্তরায়।আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি মহা সমারোহে আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবস পালন করি কিন্তু মাতৃভাষায় কথা বলতে কৌলিন্য বোধ করি না।

আমরা ভুলে যাই , যে ভাষায় আমরা ‘মা’ কে ডাকি তাই আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা কে অগ্রাহ্য করলে অচিরেই আমাদের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। সেটা একটা জাতির অস্তিত্ব বিনাশের সমতুল্য।

Facebook Comments