Site Overlay

শখের পাঁচালি

সুজয়া ধর

আমি একটু আধটু লিখতে পারি,বই পড়তেও খানিকটা পছন্দ করি, সময়ে অসময়ে বেড়াতেও ভালবাসি;প্রশ্নটা হলো আসলে কি ভালবাসি, উপরের সবগুলো না নির্দিষ্ট কোনো একটি, হয়তো কোনটাই নয়। এত কিছু ভাবতে ভাবতে মনে হলো আজব দুনিয়াতে আমরা বাস করি।‌কেন এ কথা বললাম এবার বিস্তারিত ভাবে বলি।  এক জীবনে একটা শখ, এ‌ আবার হয় না কি। আমার তা মনে হয় না।ছোট্ট বেলায়, যখন পরীক্ষায় অনুচ্ছেদে আসতো ‘আমার শখ’, তখন আমরা কমবেশি সবাই হয় বই পড়া, নাহয় বাগান করা লিখতাম। শখ এমন একটা জিনিস যা বয়সের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। অথবা আরো নতুন নতুন শখ যুক্ত হতে থাকে।কত মানুষের কত ধরনের শখ – কেউ গান গাইতে ভালোবাসে, কেউ বা শুধু ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতেই আরামবোধ করে,দেশলাইয়ের বাক্স জমানো, বিভিন্ন সময় বা দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করা, চিপসের প্যাকেট জমানো,পাখির পালক সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা, কত ধরনের ফুল শুকিয়ে রাখা, পেপার কাটিং করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার এক দাদু , তিনি গ্ৰামে ঘুরে ঘুরে মহিলা দের পুরনো সেলাই যোগার করতেন আর তাই দিয়ে পুজোর সময় নিজের বাড়িতে একটা ঘরে ওই সেলাই গুলো দিয়ে এক্সিবিশন করতেন, তাতে শিল্পী দের সবার নাম পরিচয় থাকতো,এটাই ওনার শখ বা নেশা। কেউ আবার মৃত্যু কে পরোয়া না করে হিমালয়ের কাছে ছুটে যাচ্ছেন।

 কিছুক্ষণের জন্য এবার একটু শৈশবে ফিরে যাই, শৈশবে বাবা মা আমাদের মানসিক বিকাশের জন্য পড়াশুনা বাদ দিয়ে নাচ গান, আবৃত্তি, আঁকা, খেলাধুলা শেখানোর চেষ্টা করতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই শিক্ষা গুলোর থেকেই কোনো একটি দুটি বিষয় ভালো লাগতে শুরু করে। হয়তো সেই খান থেকেই আমাদের শখ, ভালবাসা তৈরি হয়। কিন্তু আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ, বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারে একটু বড় হলে পড়াশুনা বাদ দিয়ে কিছুই ভাবতে শেখানো হয় না। জীবনের স্থিতিশীলতা বা নিরাপত্তার জন্য চাকরি অথবা ব্যবসার দিকে স্বাভাবিক ভাবেই ঝুঁকে যায়। মানুষের ই তো মন, ছোটবেলার শখ ভালবাসা ধরাবাঁধা প্রাত্যহিক জীবনে অনেকটা আনন্দ দেয়,  কাজের শক্তিও যোগায়। এমনকি এগুলো আমাদের জীবনে মোক্ষম প্রভাব বিস্তারও করে।আর নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে আর্থ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনে এই শখ ভালবাসা নেশাকে অনেকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।

আমি অবশ্য কোনো পেশাতেই যুক্ত না, গৃহবধূ কিন্তু শখ নিয়ে জীবনের অনেকটা সময় আনন্দে কাটিয়ে দিচ্ছি। ছোটবেলায় খেলতে খুব ভালবাসতাম, আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক টা প্রবল বেড়ে যায়। কিন্তু কিছু বিশেষ কারনে খেলা আমি চালিয়ে যেতে পারিনি। শৈশবে আর ও দুএকটা বিষয়ে আমার বেশ ভালো লাগা ছিল ,এক ডাকটিকিট সংগ্ৰহ করা সেটা প্রধানতঃ আমার দাদার কারণে তৈরি হয়েছিল। দুই বিভিন্ন ধরনের পারফিউমের শিশি সংগ্ৰহ করে জমানো।একটু বড় হতেই দেশ বিদেশের বিভিন্ন সমুদ্র সৈকতে কুড়িয়ে পাওয়া শঙ্খ, ঝিনুক, কোরাল,মুক্ত এই উপাদান সংগ্রহ করতে শুরু করি। তবে কিশোর বয়সে এসে বুঝলাম ডাকটিকিট সংগ্ৰহ করা আমার ভালো লাগা বা শখ নয়, ওটা দাদাকে সাহায্য করার ইচ্ছে, শিশু মনের আরও একটা দিক। এই সময় থেকেই ছবি তোলার প্রতি একটা ভালবাসা জন্মায়। আমাদের বাড়িতে তখন ক্যামেরা ছিল না, কিন্তু বাবার পেশাগত কারণে কিছু ফটোগ্ৰাফার দের আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল। সেই থেকেই ফটোগ্রাফি প্রেম। জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার করে সংসার করতে এসে দেখছি শৈশব বা কৈশোরের শখ‌ গুলো অনেক পরিণতি লাভ করেছে। পারফিউমের শিশি আজও আমি সংগ্ৰহ করি কিন্তু শুধু জমানোর জন্য নয়, আমার ড্রেসিং টেবিলে সেই তিন বছর বয়সের অন্ডাল লোকাল থেকে কেনা বেলি,জুঁই রজনীগন্ধার সুগন্ধি র শিশি থেকে আমার দিদার ব্যবহৃত সুগন্ধি র শিশি  সাজানো। দেশ বিদেশের সমুদ্রতট থেকে সংগৃহীত শঙ্খ ঝিনুক কোরাল আমার বসার ঘরেই শোভা পায়।

আমার সবথেকে প্রিয় শখ ভালবাসা নেশা বন্ধু ফটোগ্রাফি। আমার কাছে এর অর্থ আলো দিয়ে জীবনের ছবি আঁকা। একটা ফটো  হঠাৎ করে সেই সময় টা তে নিয়ে চলে যায়, আমরা আজকাল যাকে বলি time ride. আমার মন খারাপ, খুব আনন্দ সব কিছুরই বহিঃপ্রকাশ ছবি তোলা। প্রথম যখন ফটো তোলা শুরু করি সেই সময় বাড়ির লোকজনরা আমার মডেল ছিল বিশেষ করে বাবা। বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন,চা খাচ্ছেন, জুতো  পালিশ করছেন রোদে বসে,এই ছবি গুলো দিয়ে শুরু,আজও এলবামে রাখা আছে। তারপর একপ্রকার বাড়ির লোকেরা অতিষ্ট, তাদের ক্ষান্ত দিয়ে শুরু হল ফুল পাখি আকাশের  আর বেড়াতে গেলে সেখানকার ছবি তোলা।এটাই‌ দীর্ঘদিন দিন চলতে থাকে আর কি ক্যামেরা দিয়ে এই যাত্রা শুরু করেছিলাম জানেন?ইয়াশিকা হটশট, দাদাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল মামা, ওই ক্যামেরাই আমার বহুদিনের সাথী ছিল। ফটোগ্রাফি র দৃষ্টিভঙ্গি তে আমার ভালোলাগাটা খুব সীমিত ছিল, সেটা অনেক পরে বুঝতে পেরেছি। সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের তোলা ফুল পাখি প্রকৃতির ছবি দিতাম, ছবি দেওয়ার সুত্রে অনেক বন্ধু তৈরি হয়েছিল, তাদের তোলা ছবি দেখতাম।সবার ছবি দেখে চোখ আটকে যেত না, এরমধ্যে একজন মানুষের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বেনারসের ঘাটের তোলা কিছু ছবি দেখে মাথা ঘুরে গেল, তার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টার পর একদিন ভদ্রলোক নিজে থেকেই আলাপ করলেন এই সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মে। বলেছিলাম আপনার মতো ছবি তোলা শিখিয়ে দিন। প্রসঙ্গতঃ তখন আমি জেনে গিয়েছিলাম তিনি একজন স্বনামধন্য স্ট্রীট ফটোগ্ৰাফার। উনি  বলেছিলেন ফটোগ্রাফি বিশাল এক বিষয়, এক জীবনে সম্পূর্ণ আয়ত্তে আনার চেষ্টা খুব কষ্ট। সবার আগে প্রয়োজন ফটোগ্রাফির কোন ভাগটা তোমার মন কে টানে, তুমি কিসের ছবি তুলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করো। প্রাথমিক ভাবে আমার ক্ষেত্রে এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয় নি, কারন আমি ওনার মতো স্ট্রীটের ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। তাই  বলেছিলেন প্রতিদিন ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়,আর প্রচুর ছবি তোলো, আপনা আপনি চোখ তৈরি হয়ে যাবে, নিজে থেকেই বুঝে যাবে কোন ছবি টা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। আসলে ছবি তোলার সময় ফোকাস আর ক্যামেরা সোজা রাখাটা প্রাথমিক শিক্ষা, সেটা ছবি যত বেশি তোলা হয় তত হাত আর চোখের স্থিতি চলে আসে। আমার খুব দুঃখ ছিল যে আমার কোনো ভালো ক্যামেরা নেই। আমি তখন ইয়াশিকা হটশট ছেড়ে ক্যানন পাওয়ার শটে ছবি তুলি। ওনাকে বলতেই, বলেছিলেন ক্যামেরা একটা থাকলেই হবে আগে ছবি দিয়ে গল্প তৈরি করা শেখো,আজ বুঝি একটা ভালো ছবি নাম না জানা এঁদো গলির বা বস্তির মুমূর্ষু কাহিনির বা জয়সলমীরের বানজারা রমণীর নিস্তব্ধ চিত্র বাস্তব জীবনের ঘটনার কথা বলে। আজও ওনার বলা শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলেছি। তবে হ্যাঁ,প্রযুক্তিগত ভাবে নিজেকে উন্নত করা টা সময়ের সাথে সাথেই করে নিতে হবে। সেটার জন্য অনেক কোর্স চালু আছে নয়তো ইউটিউবে ভিডিও দেখেও শেখা যায়। আমি অবশ্য দ্বিতীয় পন্থাটিই অনুসরণ করেছি।এই ছবি তুলতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার সুত্র ধরে বেশ কিছু ভালো ফটোগ্ৰাফার  দেখেছি কিভাবে ছবি তোলেন, যেমন বিখ্যাত স্ট্রীট ফটোগ্ৰাফার নবীন বৎস্যা কে, উনি একটা ভালো ছবি তোলার জন্য দিল্লির ঠান্ডায় যমুনা ঘাটে নামতে দুবার ভাবেন না, বা নোংরা মাটির মধ্যে শুয়ে পড়তে।প্রবীণ সত্তরোর্ধ্ব ফটোগ্ৰাফার ভজোগোবিন্দ চৌধুরী ভালো ছবি তোলার নেশায় এখনও দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। এই ছবি তুলতে তুলতে এবং দেশ বিদেশের বহু ফটোগ্ৰাফারদের তোলা ছবি দেখতে গিয়ে, তাদের ব্লগ পড়ে  কতো ধরনের ফটোগ্রাফি হয় সেটাও জেনেছি। নেহাৎই মজার ছলে শেখা একটা ভাল লাগা আমার জীবন অনেক বদলে দিয়েছে আজ।এই ফটোগ্রাফির সুত্রে একবার ভোর বেলায় সমুদ্র সৈকতে জেলেদের ছবি তুলছিলাম, সেইখানে এক জেলে ভাই এর কাছে সদ্যোজাত শঙ্খের খোলা পেয়েছিলাম,যা প্রায় দুস্প্রাপ্য। নিজামুদ্দিন দরগাতে বসন্ত পঞ্চমী বা গড় মুক্তশ্বরের গাধার মেলায় যায় ছবি তুলতে যাই তখন বুঝতে পারি নতুন জায়গার সন্ধান করা এটাও আমার একটা নেশা, বয়সের পরিণতিতে নতুন আর একটা শখ জায়গা করে নিয়েছে মনে।অদ্ভুত হলেও আমার শখ গুলো একটা মালাতেই গাঁথা,একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে। 

আমাদের লম্বা এই যান্ত্রিক জীবনের একটা ছোট্ট অংশ হলো শখ। তাই হবি,শখ, কোন কিছুর প্রতি ভালোবাসা একটা শব্দের রূপান্তর মাত্র।সুন্দর শখগুলো মনে ধারন এবং লালন করাটাও একটা আর্ট। এর একটা নিজস্বতা আছে। প্রতিদিনের জীবনে চাপ মুক্ত হতেই আমরা শখের কাছে আশ্রয় নিই। তাই নিজের উপলব্ধি শখ নিয়ে স্বপ্ন দেখ , কিন্তু প্রত্যাশা রেখো না; অনেক সময় প্রত্যাশা মানুষের জীবনে চাপের সৃষ্টি করে। প্রত্যেকটা মানুষের শখ ছিল, আছে আর থাকবেও। ভবিষ্যত প্রজন্ম এই ভাবেই চলবে,হয়তো যুগের হাওয়াতে নতুন শখের সৃষ্টিও হবে। আসুন, আমরা সবাই শখ, ভাললাগা,ভালবাসা নিয়ে চাপমুক্ত পৃথিবী তৈরীর অন্তত চেষ্টা করি।।

Facebook Comments