Site Overlay

আলোয় আঁকা পাখিগুলি

অমৃতা পাল

Hobby অর্থাৎ শখ হলো এমন এক অভ্যাস যা মানুষকে মানসিক আনন্দ দেয় ,এক আত্মিক তৃপ্তি লাভ হয়।বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধরনের শখ থাকে গান শোনা,ছবি আঁকা, ঘুরতে যাওয়া, বাগান করা, ফটো তোলা,সাজগোজ করা ।

আমার শখের কথা যদি বলি তা হলো পাখির ছবি তোলা। তাদের behaviour observe করা আর তাদের সম্বন্ধে যতোটা সম্ভব জ্ঞান অর্জন করা।

      আজ থেকে প্রায় নয় দশ বছর আগে আমার শ্বশুর বাড়ি  রিষড়াতে থাকার সময় আমার পাখিদের প্রতি একটা আগ্রহ জন্মায়। রিষড়া গাছপালা সমৃদ্ধ একটি শহরতলি,আমাদের বাড়ির  আশে পাশেই পুকুর আর অনেক গাছপালার সমাহার। ফলে ভোর থেকে সন্ধে বিভিন্ন পাখির ডাকে মুখরিত থাকে।গরমকালে আমি ভোরে আর বিকেলের দিকে আর শীতকালে তো সারা দুপুর প্রায় ক্যামেরা নিয়ে ছাদে চলে যেতাম ,তখন আমার Fujifilm S200 exr ছিল,এটা dslr নয়,bridge camera,আর তা দিয়েই আমি যা যা পাখি দেখতাম ছবি তুলে রাখতাম।তখন সত্যি বলতে কি কাক,শালিখ,চড়ুই ছাড়া আর কোন পাখি সেভাবে চিনতাম না,ধীরে ধারে আমার পাখি চেনা শুরু হলো।আমাদের বাড়ির পাশে লাগোয়া একটা লাল চন্দনের গাছ আছে,সেই গাছে নানা ধরনের রং বেরংয়ের পাখি এসে বসতো বিশেষ করে শীতকালে রোদ পোহানোর খুব পছন্দের জায়গা ছিল গাছটার মগডাল।আমি যা ছবি তুলতাম তার সম্বন্ধে net এ search করে জানতাম,এভাবে অনেক পাখিদের জানতে শুরু করলাম,যেমন  Coppersmith barbet(বসন্তবৌরি),কেন এরকম নাম কারন এদের ডাকটা,এরা ডাকলে মনে হয় একজন তাম্রকার যেন অবিরাম তার হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে তামার উপর। কি interesting তাই না? Blue throated barbet(নীলগলা বসন্তবৌরি) Lineated barbet (সবুজ দাগী বসন্তবৌরি),Rufous treepie (হাঁড়িচাচা),Red vented bulbul(কালো বুলবুল),Whiskered bulbul(সিপাহী বুলবুল),Flamebacked woodpecker,এরকম আরো অনেক পাখিদের সাথে পরিচিত হলাম।সারা দুপুর ছাদে বসে থেকে আমি এদের behaviour observe করতাম।

একদিন দেখলাম একটা ছিট্ ঘুঘু (spotted dove) আরেকটি ঘুঘুকে একটা সুন্দর গাছের ডাল দেওয়ার চেষ্টা করছ,আমার বেশ অবাক লাগলো ব্যাপারটা,পরে পড়াশুনা করে জানলাম আসলে পুরুষ পাখিটি মেয়েটিকে উপহার দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে তাকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য এক কথায় প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে।

একে বলে courtship behaviour। মেয়েটি যদি উপহার গ্রহন করে তবে mating হবে।Coppersmith barbet এর courtship ও আমি দেখেছি সেখানে পুরুষ পাখিটি মেয়েটিকে ফল খাইয়ে impress করার চেষ্টা করছে। পরে লাটপাঞ্চারে Rufous necked hornbill-এর courtship behaviour দেখে আর ছবি তুলে এক অসাধারন অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম।আরেকদিন রিষড়াতে বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে আছি সকালবেলায় দেখলাম এক ঝুটি শালিখ(jungle mynah) কোথা থেকে মুখে করে কিছু গাঁদা ফুলের পাপড়ি আনছে আর নিজের নতুন তৈরি বাসার মধ্যে রাখছে ,এরকম বার কয়েক করতে দেখলাম আর মন দিয়ে পর্যবেক্ষন করার পর বুঝলাম শালিখটি তার সদ্যজাত বাচ্চাগুলোকে নরম বিছানায় রাখার জন্য ফুলের পাপড়ি ব্যবহার করছে কি অদ্ভুত সুন্দর তাই না?এভাবে দিনের পর দিন এদের সাথে থাকতে থাকতে ,এদের আচরণ লক্ষ্য করতে করতে এদের এই বিশাল সাম্রাজ্যের অনেক কিছু সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করলাম আর এদের প্রতি ভাললাগা আর কৌতুহল দুটোই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো।

         ধীরে ধীরে এদের আরো ভাল ছবি তোলার জন্য dslr camera r zoom lens দুটোই জোগাড় করে কলকাতার আশে পাশে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় যখন যেখানে বেড়াতে যাই নানা ধরনের পাখির ছবি তুলে আমার সংগ্রহশালার শ্রীবৃদ্ধি করার প্রয়াস করে চলেছি। দেশের বাইরে বিদেশেও যেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে পাখির ছবি তোলা থেকে বিরত হই নি।শীতকালে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে প্রবল শৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পেতে সুদূর  সাইবেরিয়া,ইউরোপের উত্তরাংশ,হিমালয়ের উত্তরাংশ থেকে কত যে পরিযায়ী  পাখি চলে আসে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে তাদের দেখা ও ছবি তোলাও এক আনন্দের ব্যাপার।হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলতে গিয়ে দেখেছি কত রংবেরংয়ের হাজার ধরণের পাখি,হিমালয়ের পাখির ছবি তোলা সত্যি খুব challenging,তবে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর যখন আকাঙ্খিত পাখিটিকে ক্যামেরা বন্দী করার সুযোগ হয় সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না,অপরিসীম এক তৃপ্তি মনকে আচ্ছাদিত করে।পাখির ছবি তুলতে গেলে লাগে অপরিসীম ধৈর্য্য,অনেকসময় এমন হয় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে হয়তো সেরকম ছবি ভাল হলো না ,পাখির দেখাই পাওয়া গেল না তখন মন হতাশ হয় কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না আবার নতুন উদ্যমে পরদিন অপেক্ষা করতে হয়।এভাবেই  বছরের পর বছর আমার এই বিশেষ শখটিকে প্রশ্রয় দিয়ে চরম আত্মতৃপ্তি লাভ করে চলেছি।তবে দুঃখের বিষয় হলো সবজায়গায় অপরিকল্পিত আগ্রাসী নগরায়নের ফলে পক্ষীকূল সমূহ বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।তাই পরিশেষে সকলের কাছে অনুরোধ প্রকৃতিকে ভালবাসুন,এই পশুপাখি,গাছপালা সকলকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই।নগরায়নের থেকে সবুজায়নই আমাদের সুস্হভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে।

Facebook Comments