Ritwika Bhar (Pal)
অফিস থেকে বেরিয়েই বসুন্ধরা প্রতিদিনের অভ্যাস এর মত আকাশের দিকে তাকাল। নভেম্বর মাস ।দিন ছোট হয়ে গেছে। তাই সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। সারাদিনের ক্লান্তি যেন ঘিরে আসে তাকে। পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে সে ।সাড়ে পাঁচটার মেট্রো টা ধরতে পারলে ভালো হয় একটু বাজার করতে হবে বাড়ি ফেরার পথে।শঙ্খ আজ পাঁচ বছর কাজের সূত্রে বাইরে। বসুন্ধরা কাউকে কিছু বুঝতেই দেয় না তার অসুবিধার কথা ।চাকরি, বাচ্চা, বুড়ো শশুর শাশুড়ি সবই সে একা হাতে সামলায়। মাঝে মাঝে মানসিক ক্লান্তি আসে বটে তবে ওই যে life goes on..
বসুন্ধরা মেট্রোয় কার্ড পাঞ্চ করতে করতেই একটা ট্রেন বেরিয়ে গেল। ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে সে চেয়ারে গিয়ে বসলো ।আর চুপ করে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন কোথায় হারিয়ে গেল সে। প্ল্যাটফর্মের টিভির আওয়াজ অগ্রাহ্য করে তার মনের মধ্যে ভেসে উঠল অর্ণবের সাথে তার নানান কথোপকথন।
অর্ণব তার কৈশোরের ভালোলাগা। না বলা কথার অনুভূতি। ওকে খুঁজে পেয়েছিল ফেসবুকের সমুদ্রে। প্রথমে হাই-হ্যালো, তারপর বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।হাসিঠাট্টায় বসুন্ধরা এ কথা বলে ফেলে যে অর্ণব তার প্রথম। তারপর অবশ্যম্ভাবীভাবে ওদের প্রেমের সূচনা হয় এবং তারপর আরো অবশ্যম্ভাবীভাবে বিচ্ছেদ ! সময়ের সাথে সাথে মানুষ বড় হিসেবী হয়ে যায় যে !ভালোবাসাও তার থেকে ছাড় পায়না !!
এরকম কতো অফিস ফেরতা সন্ধ্যে ওরা একসাথে কাটিয়েছে। দুজনেই কোনো একটা common point এ দেখা করতো।তারপর কখনো দাঁড়িয়ে, কখনোও বা পথ চলতে চলতে গল্প করতো। কোনো কোনো দিন নিজেদের সংসারের গল্প আবার কোনোও দিন হয়তো অফিসের কোনো ঘটনা।অর্ণব ওর মেয়ের গল্প করতো।বসুন্ধরা শুনতো আর ভাবতো..অর্ণবের মেয়ে তো তার মেয়েও হতে পারতো ! অর্ণব তার চোখের ভাষা বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করে থাকতো।
কখনো কখনো বসুন্ধরার আকুলতায় অর্ণব বিরক্ত ও হতো। একদিন বললো যে সে কেন আগে তার জীবনে আসেনি ?? কেন আগে জানায়নি তার ভালোবাসার কথা ? কি করে বলতো বসুন্ধরা ? সে যে বরাবর মুখচোরা। আজ সময় তাকে এখানে টেনে এনেছে।আচ্ছা ভালোবাসা কি শ্বাশ্বত সত্য নয় ? তাহলে গ্রহণ করতে সমস্যা কোথায় ?
অর্ণব চিৎকার করে একদিন বলে দিলো যে তার পক্ষে আর এই সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় ! বাঃ রে ভালোবাসা ! যখন সবটা উপুড় করে দেওয়া হয়ে গেলো, ঠিক তখনি তা প্রত্যাখিত ! তাহলে যে অর্ণব তার সাংসারিক অশান্তির কথা বলতো ? তার স্ত্রীর সাথে সমস্যার কথা বলতো ? শান্তি পেতে চাইতো বসুন্ধরার সান্নিধ্যে ? সেসব নিছক মিথ্যে ?? কেবল সাহচর্য্য পাওয়ার জন্য অর্ণব বানিয়ে বলেছিলো ??
আর বসুন্ধরা ? সে তখন এতোটাই মগ্ন অর্ণবকে ভালোবাসতে যে সত্য মিথ্যা যাচাই করার কথা তার মাথাতেই আসেনি !! যেদিন যেদিন দেখা করতে যেতো, পরম স্নেহে নিজের হাতে কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে যেত …কেক, মাংস যা হোক… মেয়েদের এ এক অদ্ভূত স্বভাব ! ভালোবাসার মানুষকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ানোর বাসনা ! আর যখন তাতে চিড় ধরে ?
সেদিন অর্ণব বারবার বসুন্ধরাকে বাস্তব বোঝাচ্ছিল, বলছিল যে চাওয়া-পাওয়া কিছুই মিলছে না। সুতরাং এ সম্পর্কের অবসান জরুরি।বসুন্ধরার মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না। ভালোবাসাও তো বাস্তব ! স্বয়ং রবি ঠাকুর বলে গেছেন একথা। সে ছল ছল চোখে তাকিয়ে ছিল অর্নবের মুখের দিকে । একের পর এক মেট্রো হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছিল ।
আচ্ছা মানুষ চাওয়া-পাওয়া মিলিয়ে নিয়ে ভালোবাসে ? বসুন্ধরা অবাক হয়ে দেখছিলো অর্ণবকে। রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে ওর চোখ দুটো পড়বার চেষ্টা করছিল। বসুন্ধরা কোনদিনই কোন কিছু জোর করে আদায় করার চেষ্টা করেনি। তাই সেদিনও সে নিরুত্তর ছিল। আর ভালোবাসা যখন হার মানে হিসেবের জটিলতায়, সেখানে আর হাত পেতে লাভ কি ?
সেই দিনটাও একটা নভেম্বর মাসের সন্ধ্যে ছিল। ভাবতে ভাবতে বসুন্ধরা খেয়ালই করেনি কখন পুলিশ এসে তাকে জিজ্ঞাসা করছে সে কোথায় যাবে? কেনই বা সে এতক্ষণ বসে আছে ? কতক্ষন বসে আছে সে ??সম্বিৎ ফিরতেই সে ঘড়ি দেখল। ছটা বাজে !!এতক্ষণ সে অতীতের ডুবে ছিল ? সে পুলিশকে বুঝিয়ে উঠে দাঁড়ালো পরের ট্রেনটা ধরবে বলে।বাড়িতে একটা ফোন করে দিতে হবে, অহেতুক দেরি হয়ে গেল, তবে সত্যি কি অহেতুক?? স্মৃতি যে ছোবল মারবেই !
মেট্রো থেকে বেরিয়ে সে ফলের বাজারের দিকে এগোলো। শহরের কংক্রিটের জঙ্গল এর ফাঁকে এক টুকরো আকাশ দেখতে পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ।তবুও আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বসুন্ধরা দেখল এক কোণে জ্বল জ্বল করছে শুকতারা। সে আদতে তারা নয়।তবুও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বসুন্ধরাও আঘাত, দুঃখ,অপ্রাপ্তিতে জর্জরিত হলেও জীবন থেকে পালিয়ে তো যায়নি! সেও তো স্বমহিমায় উজ্জ্বল ! তাইতো বসুন্ধরাও সন্ধ্যাতারা…
Facebook Comments