Site Overlay

সুহৃদ স্বজন

বাসুদেব মন্ডল

মানুষ সময়কে স্মৃতিতে ধারণ করতে পারে না, স্মৃতিতে ধরা থাকে কিছু ঘটনা, ঘটনার সাথে যুক্ত মানুষ, ঘটনার পটভূমি প্রভৃতি। অর্ধ শতাব্দীরও অধিক কাল  আগের কিছু ঘটনা প্রবাহ এবং ঘটনাবলীর প্রধান মানুষটির কথা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মনের আকাশে বার বার ফিরে ফিরে আসে।

 তখন অল্প দিন হল পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছি। কোন কাজ নেই; এদিক সেদিক ঘুরছি পরিচিত মানুষদের কাছে। তাছাড়া কিছু আইনি পরামর্শ এবং সহায়তার প্রয়োজন ছিল। একদিন পুরোনো বন্ধু পরিতোষের বিরাটির বাড়িতে গেলাম যদি সে এই ব্যাপারে কো সাহায্য করতে পারে। পরিতোষ কোন একটা ব্যাংকে তখন কাজ করছিল। ওর শ্বশুর বাড়ি ছিল বসিরহাট। একদিন আমাকে নিয়ে চলল সেখানে, পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন ওর পরিচিত এক ভদ্রলোক ওখানে বাস করতেন। ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে জানা গেল তিনি কাজের জন্য তাঁদের সাহেবের বাড়ি গিয়েছেন। আমার এই স্মৃতি- শ্রদ্ধাঞ্জলি ওই ‘সাহেব’ অর্থাৎ পুলিশ কর্তা রমেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী মহাশয়কে নিয়ে। 

    তখন তিনি ছিলেন একজন DIB Officer. তারঁ সাথে কোন পরিচয়তো দূরের কথা, তাঁর নামও কখনও শুনিনি। ওঁর বাড়িতে সেদিন গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ বাবু অর্থাত পরিতোষের পরিচিত সেই ভদ্রলোকের খোঁজে। আমরা বাইরের দরজার কাছে যখন পৌঁছেছি, দেখতে পেলাম একতলার টানা বারান্দার মাঝামাঝি জায়গায় চারজন ব্যক্তি শতরিঞ্চির উপরে বসে কাগজ পত্রের কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মধ্য বয়সী ব্যক্তি। দেখেই বুঝলাম ইনি খুব ব্যক্তিত্বশালী, ইনিই নিশ্চয়ই সেই ‘সাহেব’।

    বিশ্বনাথ বাবু বেরিয়ে এলেন পরিতোষের ডাকে।সব শুনে আমাকে বললেন, ‘ আসুন আমার সাথে সাহেবের কাছে, উনি খুবই ভালো মানুষ, দেখবেন আপনার সমস্যা মিটে গেছে।’ তখন ধারনা করতে পারিনি যে আমাকে সহায়তা করতে তিনি এত কিছু করবেন। যখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তিনি আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে বললেন,’ বলুন কেন আমার কাছে এসেছেন।’ আমি ইতস্তত করছিলাম সবার সামনে কথা গুলো বলতে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে কোন সমস্যা নেই। আমি অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে আমার কথা বললাম। আমাকে বসতে বললেন। ছোট ছেলেকে ডেকে সবার জন্য চা আনতে বললেন। আর যা বললেন তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ছেলেকে বললেন ‘ তোমার মাকে গিয়ে বলবে তোমার এই কাকু দুপুরে আমাদের সংগে খাবেন।’ ইতিমধ্যে পরিতোষ চলে গেছে তার শ্বশুর বাড়ি। এই আকস্মিক আতিথেয়তায় আমি বিব্রত বোধ করছিলাম, কিন্ত সে নিমন্ত্রণ অস্বীকারও করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পরে ওঁর সহকর্মীরা চলে গেলেন। আমাকে নিয়ে ভিতরে গেলেন, ওঁর স্ত্রীকে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তখন অস্থায়ীভাবে মধ্যমগ্রাম গ্রামে এক শুভাকাঙ্খীর বাড়িতে থাকছিলাম। সকালে বেরোনোর আগে স্নান করে নিয়েছিলাম। দাদা (এখন থেকে আমি ওঁকে এই লেখায় দাদা বলে উল্লেখ করব) একটা ধোলাই করা ধুতি বের করে দিয়েছেন।

     দুপুরে পাশাপাশি বসে দুজনে খেলাম। কিছু কথা হল– ওদেশে কি করতাম, পড়ালেখা কতটা করেছি, রেজাল্ট কেমন ইত্যাদি। আমার জন্য আর এক চমক অপেক্ষা করছিল। আমি মধ্যমগ্রাম ফেরার জন্য মনে মনে ব্যস্ত হচ্ছিলাম। কিন্ত ওঁর কথা যেন ফুরোতে চায় না। উনি যখন আরও অনেক দিন পূর্বে ঢাকা থেকে একা এখানে এসেছিলেন তখন তাঁর সহায় কেউ ছিল না। কি ভাবে একা সংগ্রাম চালিয়ে ছিলেন, এবং কিভাবে তাঁর তখনকার অবস্থায় নিজেকে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হঠাৎই বললেন ‘ আপনি আমাদের সংগে থেকে যান যত দিন আপনার কোন একটা ব্যবস্থা না হয়।’ আমি কোথায় কার কাছে আছি সেটা ওনাকে জানালাম। বললাম আমার সেই শুভাকাঙ্খীর সাথে কথা বলে আমার সিদ্ধান্তের কথা ওঁকে জানাব। 

    আমি ওঁদের সংগে কম বেশি ছমাস ছিলাম। অল্প দিনের মধ্যেই আমি ওঁর ভাই হয়ে গেলাম, ওঁর স্ত্রী আমার আমার বৌদি হয়ে গেলেন, আমি ওঁদের তিন ছেলেমেয়ের কাকু হলাম। আশেপাশের পরিবার গুলোর সবাই আমাকে অযাচিত ভাবে আপন করে নিলেন। বাড়ির মালিক (দাদা সপরিবার তখন ভাড়া বাড়িতে ছিলেন।) শিবপদ বাবু এক তলায় আমাকে একটা ঘর ছেড়ে দিলেন যত দিন আমার প্রয়োজন। দাদা অবসর সময়ে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন; উপযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করতেন আমার ব্যাপারে। আমাকে IAS পরীক্ষার জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। যোগাযোগ করলেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিদের সাথে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাদুড়িয়ার অতুল মন্ডল মহাশয়, যিনি তখন ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কর্মরত ছিলেন। বই পত্র যোগাড় হল। তবে আমার নিরুৎসাহের জন্য শেষ পর্যন্ত সে পরীক্ষায় বসা হয়নি।

      তখন স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং কলেজ সার্ভিস কমিশন চালু হয়নি। পদ শূন্য হলে নিয়ম মাফিক বিজ্ঞাপন দেওয়া হত, ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হত। মাস কয়েক পরে আমি আড়বেলিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পরে বসিরহাট টাউন স্কুলে ইংরজি শিক্ষকের শূন্য পদে যোগ দিলাম। সেখানে দশ বছর কাজ করার পর আমি চলে আসি আমার শেষ কর্মস্থল বারাসত মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখন দাদা জীবিত ছিলেন না — এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর জীবনের অকাল অবসান ঘটে। দুর্ঘটনায় তিনি মারাত্মক আহত হয়েছিলেন এবং প্রায় এক সপ্তাহ পরে হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

     যখন ওঁর পরিবারের একজন হয়ে ছিলাম, তখনকার একটা স্মৃতি যা জীবন নামক এক অত্যাশ্চর্য সংগীতের leit motif-এর মত এখনও আমার কাছে বার বার ফিরে আসে, সেই কথা দিয়ে। প্রশ্নটা আমার মনে ছিলই। একদিন সুযোগ মত জিজ্ঞাসা করলাম যে আমার মত সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক যুবকের জন্য তিনি এত কিছু কেন করছেন? একটু থমকে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ওঁর এদেশে আসা, জীবন সংগ্রামের কথা বললেন। বললেন,’ আমি শুধু চাই তোমাকে যেন আমার মত কষ্ট করতে না হয়; আমার এই সামান্য সহায়তায় তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও এই মাত্র আমার প্রত্যাশা। তোমাকে প্রথমবার দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল আমিই যেন দ্বিতীয়বার ফিরে এসে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। এক অর্থে বলতে পার তোমার জন্য সামান্য যা করছি, সে আমার নিজের জন্য করা। তোমার কাছে আমার আর কোন প্রত্যাশা নেই। ‘

     দাদা বৌদি এ জগতে নেই। ওঁদের দুই ছেলে এবং এক মেয়ে আছে। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আমি ওদের কাকা হয়ে আছি। প্রতি বছর দাদা-বৌদির স্মরণ সভা হয়, মেধাবী ছেলে মেয়েদের পুরষ্কৃত করা, আর্থিক ভাবে দূর্বল ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বই এবং অন্যান্য শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা, দরিদ্র অসহায় বৃদ্ধ নারী পুরুষদের মধ্যে কাপড়, শীতবস্ত্র প্রভৃতি বিতরণ করা হয়। আমি প্রায় প্রতি বছর উপস্থিত থাকি সেই অনুষ্ঠানে; শ্রদ্ধা জ্ঞাপন আর স্মৃতি চারণ করি।

Facebook Comments