Site Overlay

কৌন্তেয়

দেবযানী ভট্টাচার্য

– মাইনষের এত দুঃখ ক্যানে বাবাঠাউর?

সব ঝ্যান জম্মের শোধ ধুঁকতিছে দুখির পাথরডা ঘাড়ে পিঠে নে চলতি চলতি। কুকুরের জিভখান বেরোয় আসে দেখিছ তো জষ্ঠির তাতবেলা চড়লি, হ্যা হ্যা করি জুড়োতি চায় ভেতরডা, আমাগের সকলিরও একই পেরমাণে দোমের বাড়ন্ত হতি লেগিছে মনে লয়। শোকতাপের পারা বুকিতি এমন চেইপ্যে চড়তিছে ঝে কানাইয়ের মাপে হা করি শ্বাসবায়ু টেনি নিলিও ফেঁপড়েডা ফোলে না আগের লাখান। সেই জন্তন্নায় অস্থিরপানা লাগে, আবার ধরো গেন কতিও তো পারি নে, কার ঝাঁপি কে খোলে কও দিন এই ব্যালা, সকলেরই পাছায় বাবা পঞ্চাননের ছপটির বাড়ি পড়তিছে ― ছুটোয় মারতিছে চিতেয়ে না ওঠা অব্দি। তয় করা যায় কী! জ্বলে মরি আর কুত্তা বিলাই হইয়্যে খ্যাক খ্যাক করি সগুষ্ঠিরে, বান্ধবজনেরও ছাড় পার মেলে না।

– হ্যাঁ রে কুচো দার্শনিক, তোর এমন নামটা কে রেখেছিল বল দেখি কুন্তী?

– ক্যানে শুধোচ্ছ?

– নাহ, এমনিই মনে হল। এই নামটি তো বড় বেশি প্রচলিত নয়। বিশেষ করে তোদের…

– কী নয় বৈল্লয়্যে?

– প্রচলিত নয়। মানে বেশি লোকে রাখে না। এই আর কী।

– ও এই কথা। তা কুন্তী না রেইখ্যে পান্তি খুন্তি রাখলিও বা কত ঘড়া অসৈরণ হত বলো দিন। কপালের চামে তো সেই মুনিষ খাটাই টিপ ছাপ দে ইস্তির করি পাঠালে ভগমান।

খাড়াও বাবাঠাউর, মনে লয়, জানি। ঈশান মাঠে পালা হৈছিল, আমি মায়ের গভ্যর ভেতর ছিলেম শুনিছি সে সময়, তাতে এই আমার নামের পাট ছেল্য। বাপের সোন্দর লেগিছিল পমেটম মাখা সেই মেয়েডারে। দিছিল নিজিগির মেইয়ের নাম বানায়ে কুন্তী। ছাড় দিন। পরস্তাব তো এইই। তুমি আমারে ঐডির জবাব দাও। দুঃখ ক্যানে?

– “ঈর্ষ্যী ঘৃণী ত্বসন্তুষ্ট ক্রোধনো নিত্য শঙ্কিতঃ।

পরভাগ্যোপজীবী চ ষড়েতে দুঃখভাগিনঃ।।”

বুঝলি?

–হ্যাঁ হ্যাঁ। এইডে বুঝবনি! কিড়িং মিড়িং মানিই হল সে হেই ভারী অ্যাক্ বিষয়। দুখের লাখান দুখের কারণও বড় ভারী। আমাগের লব্জে তারে বলা কওয়া যাবেনানে মোট্যে। কিলিয়ার বুঝতি গেলি মরতি হবে।

– মরতে হবে কেন কুন্তী?

– তুমি কখন আলে? না মরলি সগ্গ নরক কোনও একডায় যাবানে কী করি দাদাবাবু? সেখেনে গেলি তবে না ও কিড়িং ভাষা শিখবার পারব। ঐ চলে কি না। শিখতি হবে। তখন ষষ্ঠীপুকুরির জলের পারা বুঝি যাব।

– তা বাবার সঙ্গে তোর দর্শন আলোচনা শেষ কখন হবে রে কুন্তী, ছাগল তো স্যাকরাদের মাচা সাফ করছে দেখে এলাম। ওরে নিয়ে আয় এই বেলা। নইলে ক্ষিরি জেঠি দেখতে পেলে এমন তুরুক নৃত্য দর্শন করাবে, টের পাবি।

– ওরে ছাগল বোলো নি। ও আমার মেইয়্যে। মুংলি ওর নাম। মঙ্গলী থেইক্যে মুংলি হইছে। ভালবাসি তো। মা-ই কতি পার।

– হ্যাঁ রে খোকা, তোর বাবা বুঝি আবার ওই পাগলিটার সঙ্গে বকরবকর জুড়েছে! আজ হচ্ছে দুজনের!

– উস্কোয় দিতি ভাল ঠ্যায়! না দাদাবাবু?

– “মাতা যস্য গৃহে নাস্তি ভার্যা চাপ্রিয়বাদিনী।

অরণ্যং তেন গন্তব্যং যথারণ্যং তথা গৃহম্।।”

এই হল হাল আমার রে কুন্তী!

– হুঁ। এইডে খুবই বুঝতি পার্তিছি। ঘরে যাও বাবাঠাউর, বাঁচতি হবে। বাড়োয় মারবে নে আজ তোমারে। আমি চলি।

– হা হা হা

………………

– ওই মুংলি, করিস কী এহেনে? খাইসে! যে ছাগল সেই ছাগলই থাকলি মেইয়্যেডা আমার, এট্টু মানুষ হতি পারলি না নে। চল দিনি, পলায়ে চল। ধরতি পারলি সত্যিই চাম ছাড়ায়ে নেবে নে জেঠি। এরম লকলকে কুমড়ো শাকের বংশ শেষ করতি লেগিছিস তুই, দেখলি অক্ত মাথায় কার না ওঠে ক দিনি। এও বুঝি রে পেটেরডার জন্যি খাই জ্বালা বেশি তোর এখন। কিন্তু তা বলি এই কাজডা তোমার মানতি পার্তিছি নে, সে তুমি ঝাই বল বেটি।

– কে রে, কে বকবক করে ওখানে? ছাইগাদায় ওধারে কার গলা রে?

– সব্বনাশ!

– কুন্তী না? ছাগলটাও রয়েছে দেখছি। ওখানে কী করিস তোরা?…ওরে আমার কুমড়ো গাছ রে! মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব আজ আমি ঐ ছাগলের! দাঁড়া বলছি…

– মুংলি ছোট!

………………….

– খেতে এস। আর কত বেলা অবধি পুঁথি মুখে বসে থাকবে? মানুষ রিটায়ার করলে বাড়িঘর সারায়, ছেলেপুলের বিয়ে দেয়, বউ নিয়ে বেড়াতে যায়, আর তুমি কী করলে, না গাঁয়ের বাড়িতে থাকব বলে লোটা কম্বল গুটিয়ে চলে এলে এই পাগলা গ্রামে। কেউ কখনও ভাবতে পারে এক গ্রামের নাম পাগলা হতে পারে! ছেলেও হয়েছে তেমনি, মাটির ঝাড়ের ধারায় জন্ম খ্যাপা। মেডিকেল কলেজের চাকরিটা ছুঁড়ে ফেলে গাঁয়ের হেলথ সেন্টারের ডাক্তারবাবু হয়ে বসল। আমি মানুষটার তারপর আর না এসে আর উপায় কী! জ্বালা যত আমার ককী না! কী দেখে যে বাবা আমাকে তোমার সঙ্গে জুতে দিয়েছিলেন ভেবে পাই না। পেটের ছেলেটাও শান্তি দিল না। মাঝে মাঝে মনে হয় যেদিকে দুই চোখ যায় চলে যাই…

– কিন্তু যেতে পারেন না মিসেস চট্টোপাধ্যায়, যাবেনটা কোথায়! এ গণ্ডগ্রামে উঠোন পেরোলেই তো আদাড় বাদাড়। দিনমানে ভোঁদড় খাটাস ঘুরে বেড়ায়। জুলজুল করে চেয়ে থাকে। বীরাঙ্গনা একটু ভড়কে যান আর কী। ওগো শুনছ আর খোকা রে এই দুজনের পালা ক্রমে প্যালা লাগে তখন। কিঞ্চিৎ সমস্যা বটে।

– ভাল হচ্ছে না খোকা! বাপের সঙ্গে পড়ে তুমিও আজকাল আমায় নিয়ে ঠাট্টা জুড়তে শিখেছ। মার খাবি কিন্তু। কোন খারাপ কথাটা আমি বলেছি বল তুই? গাঁয়ের নাম পাগলা। পুকুরের নাম ছাগলবান্ধা। এটা আদৌ পৃথিবীর কোনো অঞ্চল কি না সেই সন্দেহ হয় আমার।

– ছাগল নিয়ে কী বলছ তোমরা বড় বউ? মুংলির কথা কিছু? সেটার কপালে আজ দক্ষিণা নাচছে শুনলাম যেন তখন…

– কিছু হয়নি বাবা। মুংলি কুন্তী দৌড়ে ঊষা আব্রাহাম জুটি। পগার তো দূর খালবিলও পার বলতে পার এক নিমেষে। ক্ষিরি জেঠি চিল্লিয়ে যাচ্ছেন কেবল।

– বেশ বেশ। স্বস্তিদায়ক সংবাদ। মুংলি মার খেলে কুন্তী বড় কষ্ট পেত রে। বাপ মা মরা সদ্য তরুণীটি ওর বয়সী আর পাঁচটা মেয়েদের থেকে খানিক আলাদা। বেশ একটু অন্যরকম, জানিস খোকা। এই বয়সে কত সহজ করে কত গভীর দর্শনের কথা বলে অবলীলায়। এই তো সেদিন, কী বলছিল শুনবি?

“এ পিত্থিবির গভ্যের সবচে’ আদরী ফসল ঝে ধান্য, তার টান জীবির জিভ ত্যাগ দিলি ভাববা সে জীবির শরীল ত্যাগ দেবার সময় এ্যসি গ্যেছে। আরও জোরালো গোপন টান দেছে তারে অন্য ভুবন। তারে ঝাতি হবে নে এইবেলা। চক্কু মুদলিই দুই ভুরুর মদ্যি কেডা ঝ্যান ফুকারি ফুকারি ওঠে,

‘চল গো, নাও তৈয়ের, ঝা কিছু সত্যকার সঞ্চয়, ঝোলায় ভর আর এগোউ দেকি ঘাটের দিকি। কী কও? বলি যাবা? কারে কী বলি যাবা? এইডে করবা? ওইডে করবা? হা হা হা! অখন তো মণি তুমি মরবা! জিরোনের বেলাটুকুও আর নাই গো, বলা কওয়া থাকল আধসারা। লগিদে ঠ্যেল দে দেছে রে নাও, মাঝি সে নিঠুর নিয়তি পারা।’

জিভ আড় জুড়লো তো বোঝপা মরণও আড় ভাঙল।”

এসব কে ওকে শেখায় বল দেখি খোকা!

– জীবন। নাও, ভাতগুলো তো কড়কড়ে কলাই হয়ে গেল। বাপ ব্যাটায় মুখে দাও দেখি এইবারে। তোমাদের হলে সে ধিঙ্গিটিকে খুঁজতে বেরোতে হবে হ্যালার মাকে নিয়ে। দুইবেলার ভাতের কড়ার তো করে রেখেছ তার এখানে। মুখে সে দু গ্রাস না তুললে আমি বুড়িটা মাছ ভাত পেটে ঠুসি কী উপায়ে! মারের ভয়ে কোথায় লুকিয়ে বসে আছে কে জানে ছাগলিটাকে আঁকড়ে। সেটাও তো গাভীন। নিজেরা তো জুটিয়েই খালাস। জ্বালা যত আমার কী না!! দূর দূর!

– কী আর করবে বল বড় বউ। কপাল গতিকে এসে পড়েছ নির্বোধ বাপ ব্যাটার এই গোয়ালে, সগুষ্ঠীর জাবনা জোগান দেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর দেখি না।

“যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্রং তস্য করোতি কিং।

লোচনাভ্যাং বিহীনস্য দর্পণঃকিং করিষ্যতি।”

– ঠিক বলেছ, একদম ঠিক।

“কিং করিষ্যন্তি বক্তারঃ শ্রোতা যত্র ন বিদ্যতে।

নগ্নক্ষপণকে দেশে রজকঃ কিং করিষ্যতি।”

– ওহ! ব্রিলিয়ান্ট মা, সুপার্ব। বাবা, খবরদার ভুলো না, মা কিন্তু বেথুন পাশ আউট।

– খেয়ে উঠলি তোরা! হাতার বাড়ি না দিলে চলছেই না দেখি!

– হা হা হা!

……………….

– নেহ, এই ঠাঁয়ে বস দিনি। আর হুটোতি পারি নে বাপু তোমারে নে। বড় জ্বালা মোর তোরে নিইয়ে। এমন ছাগল তুই, বংশের নাম রাখবি মেইয়্যে হয়েও। পেটেরডা আবার ক্যামন আবোদা পাঁঠা হয় সেইডেই চিন্তের। তবে একবার মা হলি, বুঝবি মুংলি ক্যানো তোর লাগি এত মায়া আমার মনডায়। জগৎ ঝ্যান মায়ার সমুদ্দুর রে বেটি। সব ডুবে আছি আমরা, জড়ায়ে মরায়ে। মরণেও পাশ ছেঁড়ে না, ফের জন্ম, ফের মায়ায় ডুব, ফের জন্ম। শক্তিডা ভেইব্যে দ্যাখ বুইন একবার! সেদিন বাবাঠাউর বলতেছিল, শুনিছিস কি? শোন। অত ভাষা দে তো কতি পারবনানে, তুই রামছাগল বুঝবিও না, তাই নিজির মত করিই বলি। ঝে কয়ডা বাক্যিবন্ন মনে গেঁথে আছে, জুড়ি দেবানে। শোন এইবার।―

মায়ার সমসার, বুঝলা মণি?

টান তারিরো বড় কম তো নয়, জেবন শিকলি ছিঁড়তি সে বহু ঝটাপটিই চলে জীবির করোটি আর পঞ্জরের। কিন্তু তারেও পরাস্ত হতিই হয় একসময়। প্রাণবায়ু ডগায় বেঁধোয় তখন ভবিতব্য তার খঞ্জরের। তারপর মাসমেদের শরীল ঘেরে জ্বলন্ত কাঠ আর আগুনের ছপটি পড়ে বাসনার শরীলে।

জীবাত্মা আর কী করে বল দিন্ বেচারা,  আছাড়িপিছাড়ি খায় গতিপ্রাপ্ত আত্মজনের নিরালম্ব অস্তিত্বি। এই অ্যাতোটুক অ্যাতোটুক মিঠেকড়া কামনার সব ঘা খাওয়া টুকরোসকল কুচি কুচি ছিটকি পড়ে তেনাদের অশরীলে।…

বুঝলি কিছু? ছাগল! হি হি, আমিই ঝ্যান কত বুঝিছি! ছাগলের মা ধাড়ি ছাগল!

আচ্ছা মুংলি, যারে দে পেট করালি, তারে তোর মনে আছে? পড়ে মনে তারে যখন একলা ঘাস চিবুস ছাগলবান্ধার পাড়ে? জলিতি নিজির ছামাখানা দেখিস যখন, চোখে ভাসে তার ছামাখান? হলোই বা ক্ষণিক কালের, আশনাই তো বটে।…আমার মনে পড়ে জানিস, মেঘ জমলিই সেই গোকুলপাটের ম্যালায় বকুল মালা বেচতি আসা ছলডারে। আর মনে পড়ে যতন দাসের রসকলি…

‘‘চণ্ডিদাস কহে পীরিতি না কহে কথা

পীরিতি লাগিয়া পরাণ ত্যজিলে পীরিতি মেলয়ে তথা।”

মুংলি, ঐডে কী নড়ে ঝোপের পারে? কে আসে রে এই বাদাড়ে! নিঘিন্নে গন্ধডা পাচ্ছিস?! চোখটা ঝ্যান সাপের পারা লাগে। ক্যামন জিভ চাটার শব্দ উঠছে দ্যাখ! মুখটা তো ঠাহর পাই নে… ভাগ মুংলি ভাগ!

…………………

আধোঘুমে পুরোনো কালের পুকুর ঘাটের ভোর ছেয়ে যায় না দেখার সবটা জুড়ে। সোনালী ঘণ্টাসময় বা নীলাভ ঘণ্টাসময়ের কেতাবি হিসেবের বাইরে যে অপার্থিব মৃদুল আলোকপর্দা টাঙানো সময়, এ হল সেই প্রভাতক্ষণ। এসময় স্থলপদ্মের তরুণ ঝাড়ে রোদ ও ফুলের মধ্যে গোলাপি শাদার ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলে। শতমূলীর টুকটুকে ক্ষুদে ফল অচেনা সুগন্ধ ছড়ায়। নিজেদের শরীরে রাশিকৃত সজনে ফুল বিছিয়ে রাখে দুর্বাচর। গাছগুঁড়ির গায়ে দারচিনি ফাটল পথে ক্রমশ উপরে আরও উপরে উঠে চলে কুরকুট। মুখে দুধ শাদা ডিম।

বর্তমান আর ভবিষ্যৎ পথ চলে যত্নবান যৌথতায়।

একটুক্ষণ দেখতে শুরু করলেই মাথার ভেতরে তালপাতার বাতাস বয়। এক ঘটি অদ্যিকালের কুয়োর জল আর এক মুঠো শেতলার থানের মাটি ঘুলিয়ে যেন কপালে বুকে লেপে দেয় শাঁখাপলা লেগে থাকা হাত কোশ।

আরাম। বড় আরামে ঝিম ধরে।

কোষে কোষে পৌঁছে যায় আধচেনা বৈরুতি সুবাস। খানিক বন্য খানিক পোষ মানা শাকশাখালি। বেতের টুকরি আলগোছে পড়ে থাকে অগোছালো ফুলেদের সামলে। ক্ষীণস্পর্ধী বাতাসে আলতো জলঢেউয়ে ঢলা এ শালুক থেকে ও শালুকে লাফানি ডাকছানা থমকে চেয়ে দেখে পায়ে পায়ে গুঁড়ির দিকে এগোয় কুড়ানি। জাদুমুগ্ধ।

হট্টিটি ডাক ভেসে আসে।

ডিড ইয়্যু ডু ইট?

অতীত পথ আগলে দাঁড়ায়। তার হাতের খেরোর খাতা তাকিয়ে রয় কৈফিয়ত তলব চোখে।

চিচিং ফাঁক।

ভোর হারিয়ে যায় দিনের বিরাট হাঁয়ের গহ্বরে।

আর ফেরেনি কখনও।

শুভ্রা, আমিও আর ফিরব না রে। জানিস তো,

“পীরিতি করিয়ে ভাঙ্গয়ে যে

সাধন সঙ্গ পায়না সে।’’

– এই খোকা, কী বিড়বিড় করছিস? ওঠ দেখি, ওঠ, বেরোতে হবে তো। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না কুন্তীরে। একটু ওঠ বাবা। কোথায় হারাল মেয়েটা!

– হারিয়ে গেছে? কুন্তী? অর্থ কী এর? ও হারাবে কী করে মা, এ গাঁয়ের কোনও কানাচ তো ওর অচেনা নয়। কী যে বল তুমি!

– ঠিকই বলছি। তোরা খেয়ে উঠলি, শুতে গেলি। তারপর ওকে ডেকে ডেকে সারা আমি। সেই থেকে পথ চলতি এমন কোনও জায়গা নেই খোকা যেখানে খুঁজিনি আমরা। আমার মন কু গাইছে খোকা, আর দেরি করিস না। বেরিয়ে পড়। তোর বাবাও যাবেন।

– খোকা! সর্বনাশ হয়ে গেছে খোকা!

– কী হয়েছে বাবা? এরম কেন করছ? মা, বাবা তো পড়ে যাচ্ছে, ধর ধর।

– না না, আমি ঠিক আছি। ঠিক আছি আমি। অসিত এসেছে খোকা। মুংলির গলা কাটা দেহটা উত্তরের বাওড়ের পাশের জংলা জমিতে দেখে এসেছে সে। আরও দেখেছে। দূর থেকে। কুন্তী পড়ে আছে। বিবসনা।

– বাবা!

– তোর বাবাকে আমি সামলাতে পারব খোকা। এই নে শাড়ি। বেঁচে থাক মরে যাক, মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে আয়। এক্ষুণি যা। আমিও দেখতে চাই আদরের বাড়া ভাতের গ্রাস বঞ্চিত করে কোন শক্তির ক্ষমতা হয় তাকে আমার থেকে কেড়ে নেওয়ার!

……………….

–আঃ! আর পারি নে।… ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে গো।…জ্বলে যায় রে!… আমায় এইবার ছেড়ি দ্যাও ঠাউর মশায়…আর পাচ্ছি নে। মুংলি রে! এট্টু জল এট্টু জল…

– কুন্তী, কষ্ট হচ্ছে বোন, বড় কষ্ট হচ্ছে? এই তো, মুছিয়ে দিয়েছি রক্ত। পেঁচিয়ে দিয়েছি কাপড়। এইবার আমরা ঘরে যাব। মা দেবে তোকে জল। জল দেবে ভাত দেবে বাতাস দেবে। ওঠ দেখি মা, একটু চেষ্টা কর…

– দাদাবাবু, তুমি এসেছ! ভগবান! তুমি কেন এলে দাদাবাবু! তোমার পায়ে পড়ি আমার দিকে চেয়ো না। ছুঁয়ো না আমায়! আমি যে নষ্ট হয়ে গেছি গো! আগলা হয়ে পড়ে আছি। উফ! আর পারি নে ভগবান!

– তুই মায়ের জাত কুন্তী। মায়েরা কোনও দিন অপবিত্র হয় না রে পাগলী। কেন লজ্জা পাচ্ছিস তুই! উলঙ্গা বলে? পরণের কাপড় ছিনিয়ে নিয়েছে জানোয়ারটা! ওরে দিগ্বসনা যে স্বয়ং মহাকালী। কিসের লাজ তাঁর! এই যে শাড়িতে তোকে জড়িয়েছি, আমার মায়ের শাড়ি। দুনিয়ায় কিচ্ছুটি নেই যা এর সমান পবিত্র। এ শাড়িতে আজ তুইও আমার আরেক মা। সন্তানের কাছে মায়েদের লজ্জা কিসের! আমি তোকে বাড়ি নিয়ে যাব। আয় বোন। কোলে আয়।

– দাদাবাবু!

…………………

– বাবা ঠাউর, এইবার তুমি এট্টু জিরেন দ্যাও। চৌপর দিন আমারে আগলে বসি আছ। আমি ভাল আছি তো। বেঁচেই তো গেলাম তোমাগের দয়ায়, আমার মুংলিটা কেবল…

– নে, জল খা। ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। তোর গিন্নিমা মুংলির বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে গেছে।

– এই তো কুন্তী, বেশ কথা হচ্ছে তো বাবার সঙ্গে, আজ কিন্তু একটু হাঁটতে হবে, কেমন? বেশি নয়, এই উঠোনটা পেরিয়ে সামান্য পথ যাব, আবার ফিরে আসব।

– না! আমি বেরব না। কিছুতিই বের হব না। এ মুখ আমি কাউরে দ্যাখাব না। তোমরা আমায় মরতি দ্যাও গো দাদাবাবু। আমি মরি ঝাই।

– কেন জানতে পারি? ধর্ষিতা হয়েছিস বলে? এটা তোর অপরাধ বুঝি? স্বেচ্ছাউপগতা হয়েছিলি কি? সেও তো অন্যায় নয়। বরং সেটাই অন্যায় নয়। এটা অন্যায়। এটা ক্ষমাহীন অপরাধ কিন্তু তোর নয় কুন্তী, যে তোকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেল এ তার পাপ। তুই আমার কালিকার চরণের ত্রিপত্রের মত পবিত্র। নিষ্পাপ। তোকে স্পর্শ করবে এমন দুঃসাধ্য কোনও কলঙ্কের হবে না। আমি শশিশেখর চট্টোপাধ্যায়, ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ না করে জল স্পর্শ করি না, আমি বলছি মা, তুই আমার শক্তি অর্চনার সাক্ষাৎ পূত হোমাগ্নি। বড় বউ, তুমি ওকে ধরে একটু দাঁড়াও। টলতে দিয়ো না ওকে। সিধে খাড়া রাখবে। খোকা, তুই আয় দেখি আমার সঙ্গে। হারতে দেওয়া যাবে না কুন্তীকে। কিছুতেই না। আয় খোকা, আয়।

– এ বাবাঠাউরের কী রূপ মা?! রাশি রাশি আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে ঝ্যান শরীল দে। এত তাপ এত রাগ তেনার অন্তরে ছেল! কী হয়েছে মা, আমারে বল।

– হ্যাঁ, তোর জানা উচিত। তোকে জানতে হবে। কী জানিস কুন্তী, ক্ষমা চাওয়া তো দূর, সেই ইতর শয়তানটা বুক বাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামময়। প্রথমে তোর দাদাবাবুর দিকে আঙুল তুলেছিল তোকে ওই অবস্থায় ঘরে নিয়ে আসার জন্য। সেটা ধোপে টেকেনি, তারপর সপক্ষে জুটিয়েছে বেশ কিছু নরকের কীটকে। কুৎসিত যুক্তি খাড়া করেছে। ব্রহ্মণত্ব জাহির করে বলছে বাউড়ি ঘরের মেয়ে শুদ্ধা হয়েছে তার শারীর-সংস্পর্শে। তোর বাবাঠাউর সেসব শোনা থেকে এমন অগ্নি কুণ্ড হয়ে রয়েছে। কেবল বলে চলেছে, “ওকে সুস্থ করে তোলে খোকা। লড়াই হবে। জোর লড়াই। ন্যায় যুদ্ধ লড়ব আমরা”। তুই তাঁর অস্ত্র হবি কুন্তী। তুই যেন তাঁকে হারিয়ে দিস না মা। মানুষটা তাহলে জ্যান্তে পাথর হয়ে যাবে! আরও একটা সত্য বলি তোকে আজ। এই যে তোর দাদাবাবু শহর ছেড়ে চলে এসেছে কেন জানিস? তোরই মত এক মেয়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল লড়াইয়ে। অন্যায়কারী ছিল খোকার বান্ধবী শুভ্রার আপন দাদা। তাই শুভ্রা জিদ করেছিল খোকা যেন এই ঝামেলা থেকে সরে দাঁড়ায়। ওদের বিয়ে হত জানিস, সব কথা সারাও হয়েছিল, কিন্তু ছেলে গোঁ ধরে সব ছেড়ে চলে এল এখানে। মেয়েটি সুবিচার পেল কিন্তু খোকা আর শুভ্রার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।

ওই তোর বাবা ঠাউর আসছেন।..

– ধর, ধর এইটা।

– এইডে কী বাবা ঠাউর!

– রাম দা।

– এরে নে আমি কী করব?!

– একটু আগে বলছিলি না, মরবি? মরতে তো হবে কুন্তী, কিন্তু তোকে না। তুই মারবি এইবার। তোকে যে লাঞ্ছিত করল, তোর মুংলিকে যে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে মারল, তাকে শেষ করবি। তোর মত প্রতিটি ধর্ষিতা মেয়ের হয়ে শাস্তি দিবি ঘৃণ্য মনুষ্যেতর জীবগুলোকে। মনে রাখিস কুন্তী, মুংলি মরেছে, কিন্তু মায়ের কর্তব্য করেই মরেছে। অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সয়েও সন্তানের জন্ম দিয়ে গিয়েছে। এবারে তোর কর্তব্য তুই করবি।

ওঠ। ওই শোন, বাইরে ওঁরা এসে গিয়েছেন। তোর পক্ষে লড়বেন ওঁরা। পাপের বিনাশ করতেই হবে মা। রক্তবীজের ঝাড় নির্বংশ করতেই হবে তোকে। তোদের মত আহত বাঘিনীরাই পারবে। তুই মুংলিকে আদর করতিস, কেবল জগৎ জোড়া মায়ার ভুবন বলতিস মনে পড়ে? প্রতিটি মেয়ের মধ্যে মহামায়া আছেন। আবার প্রতিটি মেয়ের মধ্যে কালিকারও অধিষ্ঠান। তাঁকে জাগা। সমস্ত দুঃখ কষ্ট ক্ষোভ যন্ত্রণা একত্র করে অগ্নিময় প্রতিবাদ রাখ। জাগ মা! ―

“করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম্।

কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্।। সদ্যশ্চিন্নশিরঃখড়্গবামাধোর্ধ্বকরাম্বুজাম্। অভয়ং বরদং চৈব দক্ষিণোর্ধ্বাধঃপাণিকাম্।।

মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্। কর্ণাবসক্তমুণ্ডালীগলদ্রুধিরচর্চিতাম্।। কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকম্।

ঘোরদ্রংষ্টাং করালাস্যাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।। শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীম্। সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্তধারাবিস্ফুরিতাননাম্।।

ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশানালয়বাসিনীম্। বালার্কমণ্ডলাকারলোচনত্রিতয়ান্বিতাম্।। 

দন্তুরাং দক্ষিণব্যাপিমুক্তালম্বিকচোচ্চয়াম্। শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাম্। শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দিক্ষু সমান্বিতাম্।

মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্।। সুখপ্রসন্নবদনং স্মেরাননসরোরুহম্।

এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং ধৰ্মকামার্থ সমৃদ্ধিদাম্ ।।”

– আয়, নেমে আয় আঁধার উঠোনে। আলো জ্বালতে হবে কুন্তী। আর অন্যায় সহ্য করা নয়, আর ব্যবহৃত হওয়া নয়। সমাজকে উল্টে চোখ রাঙাতে হবে।…এই তো, এই তো সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিস বোন। এই তো শক্ত হাতে ধরেছিস খাঁড়া। আমরা তোর সৈনিক। আসল লড়াই কিন্তু তোরই।

– কী দেখছিস মা আকাশে?

– ফুলকি ওড়ে কেবল বাবাঠাউর, অজস্র ফুলকি।

মনে লয় ঝ্যান তোমার ভাষার সেই আহত বঞ্চিত নিপীড়িত ‘আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুভূক নিরাশ্রয়’-রা ক্যামন আলোর পারা হইয়্যে গেছে বাবা ঠাউর! দেখো রাশি রাশি আলোর পাপড়ি।

– ঠিক বলছিস মা রে। একদম ঠিক বলছিস। চরাচর ব্যেপে নিরুচ্চার তরঙ্গ উঠছে। তোর ভাষায় বলে চলেছে তাঁরা ইথার উপচে :

“আমরা আছি গো, সব্বাই আছি, তোমাগের মধ্যিই আমরা বাঁচি। লড়াই ছেড়নি বুইন। লজ্জা আমাগের নয়। লজ্জা ওদের। ওদের। ওদের।”

লড়াই আমরা জিতব কুন্তী।

তারপর…মা হবি তুই।

আর কানীন নয়, ভবিষ্য–গর্ভজ এবার সদর্পে শক্তিমদমত্ত বীর্যপ্রথিতকারীর চোখে আঙুল দিয়ে বলবে, তোমাকে অস্বীকার করি আমি লোলুপ শয়তান। আমি স্রেফ কৌন্তেয়।

গর্বভরে কৌন্তেয়!!!

Facebook Comments